-ক্যারোলিন ভেব না, যিনি এই বাড়িতে অতিথি হয়ে আছেন, যাঁর সাথে আমাদের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই, তাকেও আমি আমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত করেছি। ধারাল গলায় স্যার ক্লড বলতে থাকেন, আর বাড়ির দাস-দাসীদের কথা বলছ? ফর্মুলা সিন্দুকে রাখা থেকে শুরু করে তা উধাও হওয়া–এই সময়টুকুর মধ্যে ওরা কেউ স্টাডিতে ঢোকেনি, এমনকি ট্রেডওয়েলও নয়। তাই ওরা সন্দেহমুক্ত।
স্যার ক্লড একটু থামলেন, ঘরের চারদিকে তার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াল। তারপর আবার তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন আপনারা নিশ্চয়ই ঘটনাটার গুরুত্ব ও জটিলতা অনুধাবন করতে পারছেন, আশা করি নতুন করে বুঝিয়ে বলতে হবে না। যাই হোক, ফর্মুলা যে কেউ একজন হস্তগত করেছে এবং সেটা এখনও তার কাছেই আছে ওটা খাবার ঘরে পাওয়া যায়নি, কারণ ডিনার শেষ করে আমরা একে একে এঘরে চলে এলে ট্রেডওয়েল খুব ভালভাবে খুঁজেছে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ আপনাদের কারো সঙ্গেই জিনিসটা রয়েছে। তাই এখানেই সকলকে আটকে থাকতে হবে, যতক্ষণ না……..
স্যার ক্লড চুপ করলেন। ঘরে নেমে এল অখণ্ড নীরবতা। হঠাৎ নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেল ডঃ কারোলির কণ্ঠস্বরে–স্যার ক্লড, আপনি কি করতে চাইছেন বলুন তো? কেউ আমাদের খানাতল্লাশি করছে, আর আপনি তা চোখ চেয়ে উপভোগ করবেন, তাই তো? মুখ ফুটে সেটা বলে ফেলুন।
না, একথা আমি একবারও বলিনি, আর চাইও না। স্যার ক্লড কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন। বলতে শুরু করলেন দুমিনিট বাকি আছে ন’টা বাজতে। পাক্কা নটায় এরকুল পোয়ারো মার্কেট ক্লিভ স্টেশনে পৌঁছোবেন। ওঁকে আনতে গাড়ি যাবে, সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে। নটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বড়ির সব লাইট নিভে যাবে। এক মিনিট অন্ধকার। তারপর আবার সমস্ত বাড়ি আলোতে ভরে উঠবে। আমার হুকুমে বাটলার ট্রেডওয়েল এসব কাজ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো ততক্ষণে এসে পড়বেন। এই রহস্য অনুসন্ধানের দায়িত্ব আমি তাঁর হাতেই তুলে দেব।
স্যার ক্লড একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–এখনও সময় আছে, যে-ই ফর্মুলা হাতিয়ে নিয়ে থাকুক না কেন, অন্ধকারের মধ্যে কেউ কাকেও দেখতে পাবেন না, সকলের অগোচরে ফর্মুলাটা রেখে যান, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, এরকুল পোয়ারোকে বলব, যে কাজের জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম, তা সমাধান হয়ে গেছে, আপনি এখন আসুন আবার বলছি, ফর্মুলা ফেরত পাবার পরেই আমিও সব বলব।
কথা শেষ করে স্যার ক্লড টেবিলের ওপর ঘুসি বসালেন।
-বাবা, তোমার সিদ্ধান্ত শুনে আমরা অপমানিত বোধ করছি। উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে রিচার্ড বলল। ঘরের সকলের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। আবার বলল আমার মনে হয়, আমাদের প্রত্যেককে আগাগোড়া তল্লাশি করলেই ব্যাপারটা মিটে যায়, অন্ততঃ আমার সেই ধারণা।
-আমি আপনার মতকে সমর্থন করছি। আমিও চাই আমাদের সার্চ করা হোক। এডওয়ার্ড রেনর তার মত জানাল।
ডঃ কারোলির দিকে রিচার্ড পলকহীন কঠিন চোখ তাকিয়ে ছিল। ডঃ কারোলি বিব্রত বোধ করলেন। তার মনে কি আছে কে জানে, কিন্তু মুখে তিনিও রিচার্ডের সিদ্ধান্তকে মেনে নিলেন, জানালেন, খানাতল্লাশিতে তার কোন আপত্তি নেই।
–তোমরা যখন চাইছ, তখন আমি আর না’ বলব না। ক্যারোলিন বললেন।
–আর লুসিয়া? রিচার্ড তাকাল স্ত্রীর দিকে সেই দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে প্রচণ্ড ক্রোধ তুমি কি বল?
–আমি… আমি…… ভয় জড়ানো কণ্ঠে লুসিয়া বলল–তোমার কথায় আমার সায় নেই। তোমার বাবা যা চাইছেন, সেটাই বরং ভাল।
স্ত্রীর কথা শুনে রিচার্ড তাজ্জব বনে গেল। হতচকিত হয়ে নীরবে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
এতক্ষণ স্যার ক্লড, চুপচাপ ছেলের রঙ্গ দেখছিলেন। এবার বললেন–রিচার্ড, চুপ কেন? এবার কিছু বল।
রিচার্ডের বুক থেকে গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এল। সে ঘাড় ঘোরাল বারবারার চোখে চোখ পড়ল। বারবারা ঘাড় নাড়ল, অর্থাৎ তল্লাশিতে সেও রাজী আছে।
রিচার্ড অবশেষে বলল–বেশ, সকলে যখন খানাতল্লাশি চাইছে, আমি আর আপত্তি করি কেন? তোনার সিদ্ধান্তই মেনে নিলাম, বাবা।
স্যার ক্লড নড়ে চড়ে আরাম কেদারায় আয়েশ করে বসলেন–বিড়বিড়িয়ে বললেন–আজ কফিটা এত তেতো লাগল কেন, কে জানে! মুখ বিকৃত করলেন–গলা পর্যন্ত তে হয়ে আছে। তিনি হাই তুললেন, বুঝি ঘুম আসছে।
এদিকে ম্যান্টলপিসে রাখা পুরনো ঘড়িটা নিজের কাজ করে চলেছে–এক…… দুই….. তিন…….. চার…… পাঁচ……… সকলে হকচকিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল-নটা বাজে। ঘণ্টা বেজে চলেছে ছয়……. সাত………আট…… নয়………। নটার শেষ ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সব আলো নিভে গেল। ট্রেডওয়েল তার মনিবের আদেশে বেসমেন্টে-এ বাড়ির মেইন সুইচ টিপে বন্ধ করে দিল। ঝুপ করে নেমে এল নিঃসীম অন্ধকার। পুরো বাড়িটাই সীমাহীন আঁধারের অতলে নিমেষে ডুবে গেল।
দারুণ আতঙ্ক এসে গ্রাস করেছে ঘরের বাসিন্দাদের। মেয়েরা চিৎকার করতে শুরু করল।
ক্যারোলিন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,–আরে, এসব কি হচ্ছে। ছাই পাঁশ কিছু তো বুঝতে পারছি না।
-পিসিমা, কি করছ? চুপ কর। চাপা গলায় বারবারা ধমকে উঠল কিছু একটা হচ্ছে, ভালোভাবে শুনতে দাও, দোহাই।
এক-একটি মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। কালি ঢালা আঁধারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে চাপ চাপ নীরবতা। বসার ঘরকে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। এর মধ্যে ভেসে এল একটা ছোট্ট আওয়াজ–কেউ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কাগজের খসখসানি শোনা গেল। তারপর ধাতবের ঠুনঠান, কেউ বুঝি কিছু ছিঁড়ে ফেলছে, বোঝা গেল, টেবিল যা চেয়ার উলটে পড়ল, আওয়াজ হল–তারপরেই সব স্তব্ধ, নেমে এল নীরবতা।