স্যার ক্লড সরাসরি এবার তাকালেন পারিবারিক অতিথি ডঃ কারোলির দিকে যে তালার সাহায্যে এ ঘরের দরজা জানলা এঁটে দেওয়া হয়েছে, তা আমিই বিশেষভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তৈরি করেছি, এ সংসারের সকলেই তা জ্ঞাত। কিন্তু তালা খোলার ব্যাপারে কারো কোন ধারণা নেই। এখনও নটা বাজেনি। দশ মিনিট বাকি আছে। অপেক্ষা কর, কলে আটকে পড়া ইঁদুর ধরার লোক এল বলে।
তার মানে? আমি তো এসব কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, রিচার্ডের কথায় অধৈর্যের আভাস লোকটা কে?
–একজন গোয়েন্দা। স্যার ক্লড কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন।
.
০৫.
–গোয়েন্দা! নাম কি? রিচার্ড এবার সত্যিই খেপে গেছে, এখানে তার কাজ কি?
–গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো বেলজিয়াম পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের বড়কর্তা ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। গম্ভীর গলায় স্যার ক্লড অ্যামরি বলে চললেন, লন্ডনে বাস, বেসরকারি গোয়েন্দা হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি আছে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সকলের কাছে খুব পরিচিত নাম। কিছুদিন আগে এক সমস্যায় পড়েছিলাম, তখন থেকেই পরিচয়ের সূত্রপাত্র। খানিক বাদেই ভদ্রলোক এখানে এসে পা রাখবেন।
শ্বশুরের মুখের কথা শুনে লুসিয়া আর্তনাদ করে উঠল। রিচার্ড বুঝি বোবা হয়ে গেছে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল স্ত্রীর দিকে।
একেই বলে কপাল, শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা। ক্যারোলিনের গলায় আক্ষেপের সুর। বারবারাও চাপা গলায় একইরকম আক্ষেপ প্রকাশ করল। আর ডঃ কারোলি? তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন, অপলক চোখে স্যার ক্লডকে দেখছেন।
এডওয়ার্ড রেনর মুখ খুলল–স্যার ক্লড, সত্যি বলছি, আপনার জুড়ি মেলা ভার।
–কথাগুলো তোমাদের আগাম জানিয়ে রাখা উচিত মনে করে বললাম, কঠিন কণ্ঠে স্যার ক্লড বললেন। কফির শূন্য কাপ ছোট টেবিলে রেখে আর্মচেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন–কফিটা বড্ড তেতো লাগছিল, বিস্বাদ, কেন কে জানে!
তিনি তাকালেন বোনের দিকে এ পরিবারের খুঁটিনাটি দেখার দায়িত্ব তার হাতে। ক্যারোলিন একথা শুনে বিরক্ত হলেন, ক্ষোভ জমল মনে, চোখে মুখে তার প্রকাশ ঘটে গেল।
কিন্তু ওই গোয়েন্দাকে কেন এখানে ডাকা হয়েছে, রিচার্ড গম্ভীর গলায় বলল, এ প্রশ্ন আমাদের সকলের।
–নিশ্চয়ই, জানবে বৈকি! স্যার ক্লডের ঠোঁটে কুটিল হাসির রেখা।
-হ্যাঁ, বলছি, শোনো সকলে। আমাদের প্রত্যেকের জানা আছে, বর্তমানে আমি পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সম্প্রতি ওই পারমাণবিক বোমা তৈরির ফর্মুলাও আবিষ্কার করেছি। এ হল মারাত্মক ক্ষমতাশালী বিধ্বংসী বোমা, যা তোমাদের ধারণার বাইরে।
***
স্যার ক্লড থামলেন, ডঃ কারোলিকে নিরীক্ষণ করলেন। আবার বলতে শুরু করলেন, হ্যাঁ, কাজের কথায় ফিরে আসি। অ্যামারাইট’–আমার ফর্মুলায় তৈরি বোমার নাম। কয়েক মুহূর্তের বিরতি এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যেসব পারমাণবিক বোমা বের করেছে, তার দশগুণ শক্তি ধরে আমার ফর্মুলায় তৈরি অ্যামারাইট–লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ধ্বংস করে সব ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।
–ওফ, কি নৃশংস কাণ্ড! লুসিয়া শিউরে উঠল।
–তবুও বাস্তবকে মানতেই হবে, বাছা আমার। স্যার ক্লডের ঠোঁটে হাসি, সত্যের অন্তরালে থাকে সীমাহীন কৌতূহল, অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্খা।
কিন্তু এসব আমাদের বলে তোমার লাভ কি? রিচার্ড কৈফিয়তের সুরে বলল।
কারণ আছে, তাই বলছি। চাপা গম্ভীর গলায় স্যার ক্লড বলতে থাকেন, আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার পরিবারের কেউ ওই অ্যামারাইট-এর মহামূল্যবান ফর্মুলা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করে চলেছে। তাই আমি গোয়েন্দা পোয়ারোর শরণাপন্ন হয়েছি। ঠিক করেছিলাম, উইক এন্ডেই অর্থাৎ আগামীকাল এখানে আসার আমন্ত্রণ জানাব। পরে ভেবে দেখলাম, তাহলে বড় দেরি হয়ে যাবে, তাই আজই তাকে চলে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। উনি দু-দিন এখানে থাকবেন। সোমবার সকালে ফিরে যাবেন লন্ডনে, আমি আমার বোমা তৈরির ফর্মুলা ওনার হাতে তুলে দেব। উনি তা পৌঁছে দেবেন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কোনো দুদে অফিসারের কাছে।
স্যার ক্লড থামলেন, সকলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, তাদের মনের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন। ফের বলতে শুরু করলেন–মহামূল্যবান ফর্মুলাটি লেখা ছিল মামুলি একটা কাগজে। এটা সুরক্ষিত করার জন্য খামে ভরে সিন্দুকে তুলে দিলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, আজই সন্ধ্যের পরে ডিনারের আগে সেই বড় খামটা উধাও হয়েছে, সিন্দুকে নেই। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি নিশ্চিত, এই ঘরে, এই মুহূর্তে যারা আমার সামনে রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ একজন কান্ডটা ঘটিয়েছে।
স্যার ক্লডের মুখ থেকে ছিটকে ছুটে আসা শেষ শব্দগুলো শুনে সকলে চমকে উঠল, চোখ হল চড়কগাছ। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল তারা দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে সন্দেহের কালো ছায়া।
-ফর্মুলা চুরি হয়ে গেছে? ক্যারোলিন বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন।
বন্ধ সিন্দুক থেকে ফর্মুলা উধাও? রিচার্ডও অবাক। চেঁচিয়ে বলল–এ তো অসম্ভব!
সকলেই যখন বিস্ময়াহত, তখন একজনের মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা গেল। তিনি হলেন ডঃ কারোলি। তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ, বোঝা গেল তার মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার ঝড় শুরু হয়েছে।