হালকা ফক্সট্রট নাচের সমবেত বাজনার আওয়াজে ঘরের মধ্যে বসন্ত বাতাস বয়ে গেল বুঝি। ম্যাগাজিন ফেলে রেখে রিচার্ড কাপের সবটুকু কফি গলাধঃকরণ করে উঠে দাঁড়াল। লুসিয়াকে একবার দেখে নিল। বিড়ালের মতো পা ফেলে লুসিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা নামিয়ে নিয়ে এল স্ত্রীর কানের পাশে।
-লুসিয়া, অনেক ভেবেছি জান, রিচার্ডের ফিসফিসানি গলা–তোমার কথাই ঠিক, এখানে, এই পরিবেশে পড়ে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই পালানোর একটা উপায় বের করতে হবে। তবে তোমাকে এখানে ফেলে রেখে যাব না, জেনো।
-সত্যি, পালাবে? লুসিয়ার কণ্ঠে কান্নার সুর, রিচার্ড, সত্যিই আমরা এবাড়ি ছেড়ে পালাব? কিন্তু চোখের জল মুছে লুসিয়া বলল, কিন্তু টাকা কোথা থেকে পাবে? তুমিই বলেছিলে পালিয়ে যেতে হলে অনেক টাকা দরকার, কে দেবে?
ভেব না, লুসিয়া। টাকা জোগাড় করার অনেক রাস্তা খোলা আছে।
–বুঝলাম না? লুসিয়া এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে।
–কি বলতে চাইছ, স্পষ্ট করে বল।
-বলতে চাইছি যে, তোমাকে কেন্দ্র করেই আমার প্রেম ভালবাসা, আমার চিন্তা ভাবনা। যে পুরুষ, তার বউকে এতটাই ভালবাসে যে, যে কোন কাজ হাসতে হাসতে করতে পারে।
-ওসব ছেলে ভুলানো কথা তুলে রাখ। লুসিয়া বলে চলল–বরং আমার ধারণা, আমাকে তুমি এখনও বিশ্বাস করতে পার না, টাকা দিয়ে আমার ভালবাসা কিনতে চাও।
লুসিয়া কথা শেষ করতে পারল না, কান্নায় ভেঙে পড়ল। এমন সময় স্টাডির দরজার পাল্লা খুলে গেল। এডওয়ার্ড সোজা বেরিয়ে এসে কফি টেবিলের সামনে জলে গেল। গরম কফিতে কাপগুলো পূর্ণ। একটা কাপ তুলে নিল।
ইতিমধ্যে লুসিয়া রিচার্ডের কাছ থেকে সরে এসেছে, সে এখন গদিতে উপবিষ্ট। রিচার্ড নিজের জায়গাতে নেই। সে চলে এসছে ঘরের এক কোণে রাখা ফায়ার প্লেসের কাছাকাছি। ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে, তার দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ।
রেকর্ডে তখনও ফক্সট্রটের বাজনা বাজছে, বারবারা উত্তেজিত, নৃত্য করার জন্য মন ছটফট করছে। কিন্তু সঙ্গী কোথায়? সে চারপাশে তাকাল, এসে দাঁড়াল ঘরের ঠিক মাঝখানে ওই তো রিচার্ড। ওকে ডাকবে? না বাবা, কাজ নেই। যেমন গোমড়া মুখে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। তাহলে?
কফি টেবিলের কাছে রেনরকে দেখে বারবারা খুশি হল। হাঁক দিল–মি.রেনর, এমন বাজনার সঙ্গে একটু না নাচলে কি ভাল লাগে? আসুন, আমরা নাচি।
-অবশ্যই, অবশ্যই। রেনরের ঠোঁটে হাসির রেখা, ফক্সট্রটের বাজনা শুনে ও ঘরে বসে থাকতে পারল না, তাই তো…….. ম্যাডাম, একটু অপেক্ষা করুন, প্লিজ, স্যার ক্লডকে কফিটা দিয়ে এখুনি আসছি।
মি. রেনের, এডওয়ার্ডের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লুসিয়া–ওটা রেখে দিন, স্যার ক্লডের কাপ ওটা নয়, ওরটা এখানে আছে। লুসিয়া কথা শেষ করে অন্য একটি কফির কাপ রেনরের হাতে তুলে দিয়ে আগেরটা ফিরিয়ে নিল।
যান, মি. রেনর, এটা স্যার ক্লডকে দিয়ে আসুন। রেনরের হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়া ফকির কাপটা ট্রে-তে রেখে দিল, আপন মনে হেসে উঠল। ফিরে এল আগের জায়গায়, সোফার এক ধারে।
লুসিয়াকে আড়াল করে রেনর নিজের পকেট থেকে ওষুধের শিশি বের করে কয়েকটা বড়ি কফির সাথে মিশিয়ে দিল। এগিয়ে গেল স্টাডির দিকে।
বারবারার মনে তখন খুশির জোয়ার। সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল–মি. রেনর, আমাকে যদি নাচের সঙ্গী করতে চান, চটপট আসুন। আমার আবার দেরি সহ্য হয় না। ডঃ কারোলিকে তাহলে দলে টেনে নেব। উনি আবার লুসিয়ার সঙ্গে নাচবেন বলে উদগ্রীব, বুঝতে পারছি।
-আহা বেচারি, রিচার্ড বলতে বলতে এগিয়ে এল, এত ডাকাডাকি করছে, একটু ওর সঙ্গে নাচো রেনর, শেষ অব্দি সবাইকেই নাচতে হয়। কাজটা আমায় দাও, বাবাকে দিয়ে আসছি।
কথা শেষ করে রিচার্ড রেনরের হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে নিল কফির কাপ। স্টাডির দরজার দিকে পা বাড়াল, থমকে দাঁড়াল, সকলকে পর্যবেক্ষণ করল, তারপর লাগোয়া দরজার পাল্লা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হল।
বাজনার তালে তালে হাতে হাত রেখে বারবারা আর রেনর নাচতে শুরু করল। একপিঠের বাজনা শেষ। বারবারা উল্টোপিঠে ঘুরিয়ে দিল। আবার শুরু হল ফক্সট্রট নাচ।
লুসিয়ার শুকনো মুখ ডঃ কারোলিকে খুশি করল। তিনি চারপাশে তাকালেন, পরক্ষণে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি। তিনি পায়ে পায়ে চলে এলেন। সোফার ধারে, লুসিয়ার গা ঘেঁষে।
-লুসিয়া, মিস ক্যারোলিন অ্যামরিকে অশেষ ধন্যবাদ। ডঃ কারোলির চাপা গলা–উনি ছিলেন বলেই এই উইকএন্ডে তোমার কাছাকাছি আসার সুযোগ হল আমার। তাই কিনা বল।
-হ্যাঁ, মহিলার দয়ার শরীর, এমনটি আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি, লুসিয়ার কথাবলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, ডঃ কারোলির এই কাছে আসা, সে সহ্য করতে পারছে না।
আশ্চর্য তোমাদের এই বাড়ি, খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখতে হয়। লুসিয়ার মনোভাব আন্দাজ করে ডাক্তার সোফার অন্য পাশে এসে দাঁড়ালেন–বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে সেকেলে শিল্প রীতির ছাপ ঝরে পড়ে। তুমি জানো না, ভিক্টোরিয়ান যুগের শিল্প ও ভাস্কর্য সম্পর্কে সামান্য হলেও জ্ঞান আছে, পড়াশোনা করেছি। সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘুরে ঘুরে নিখুঁত ভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি আমায় সাহায্য করবে তো?
–আমি? এ বাড়িতে সদ্য এসেছি, কিছুই জানি না। পিসিমা, এ বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র জানেন।