চিনির বাটি নিয়ে ডঃ কারোলি এগিয়ে যেতে গিয়ে বাধা পেলেন, লক্ষ্য করলেন ক্যারোলিন প্রবলভাবে হাত নাড়ছেন, অর্থাৎ তিনি চিনি ছাড়া কফি খাবেন। অতএব চিনির বাটি যথাস্থানে তিনি রেখে দিলেন। কফির কাপ নামিয়ে রেখে রিচার্ড অ্যামারি ম্যাগাজিনের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
–ওফ! মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলেবেলার দিনগুলোর কথা। ঘুমের ঘোরে কি সাংঘাতিক হাড় হিম করা দুঃস্বপ্ন। ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। ক্যারোলিন শিউরে উঠে বলতে লাগলেন–মা-কাকিমা জেঠিমা। একসঙ্গে বসে আড্ডা দিত। গল্প করত আর বড় বড় মদের গ্লাসে চুমুক দিত। ওরা রসিয়ে রসিয়ে ওই ডাইনি বর্গিয়ার নৃশংস প্রেমকাহিনীর ঘটনা শোনাত–কোন রাজকুমারকে কোন বিষ খাইয়ে খতম করেছে, এইসব আর কি। এসব শুনে শুনে রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে আমাকে ওই রাক্ষুসী পেয়ে বসত–সুন্দরী রাক্ষসী ভুলিয়ে ভালিয়ে খানিকটা বিষ মদ আমার মুখে ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে বিষক্রিয়া, আমার গলা-বুক জ্বলছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছি, কি দুঃসহ সাংঘাতিক ব্যাপার, কিভাবে যে বোঝাই।
ক্যারোলিন এবার চুপ করলেন। বড় বড় নিশ্বাস নিলেন। লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললেন–লুসিয়া, আমি বাছা কারো মন রাখা কথা বলতে পারি না। তোমার সেই সুন্দর মুখখানার দিকে তাকালেই আমার ডাইনি বর্গিয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
-তাই নাকি! ডঃ কারোলি এগিয়ে এলেন লুসিয়ার সামনে শ্রীমতী লুক্রেজিয়া বর্গিয়া, একটু নীচু হলেন, বললেন–ক্ষতি না করে আমাদের মঙ্গল করুন।
এহেন রসিকতাপূর্ণ কথা লুসিয়ার মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না, বরং শুনতে পায়নি এমন ভাব দেখাল।
কারোলি লুসিয়ার কাছ থেকে সরে এলেন সেন্টার টেবিলের কাছে, শূন্য এঁটো কফি কাপ রাখলেন।
বারবারা এতক্ষণ চুপচাপ সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করছিল। ঘরময় বিরাজ করছে গুমোট হাওয়া, কেমন গম্ভীর-গম্ভীর ভাব, যা তার মোটেও পছন্দ নয়। পরিবেশ হালকা করার জন্য যে পুরনো গানের রেকর্ড বের করে গ্রামোফোনে লাগিয়ে ছিল। মুহূর্তের মধ্যে হালকা নাচের বাজনার আওয়াজ ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।
ক্যারোলিন প্রায় ছুটে এলেন কিরে বারবারা, রেকর্ডের অভাব নাকি? হাত বাড়িয়ে রেকর্ডটা থামনোর চেষ্টা করলেন–আহা, বলিহারি, যাই, অমন বাজনার সঙ্গে কেমন বিশ্রী কথা! এসব কোন ভদ্রঘরের মেয়েরা শোনে না। ভাল রেকর্ড বের কর। দাঁড়া, আমি দেখছি। একটা রেকর্ড বের করে আবার ক্যারোলিন বললেন–এই নে, জন ম্যাক করম্যাক, লাগিয়ে দে। এটাও ভাল, হ্যাঁন্ডেলের লাগো………
-তুমি কি গো পিসিমা! বারবারা নাক কুঁচকে বলতে লাগল, তোমার পছন্দ দেখে অবাক হয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত হ্যাঁন্ডেলের লাগো। যত্তসব পুরনো বস্তাপচা বাজনা। না না, তোমাকে দিয়ে হবে না বুঝতে পারছি। তুমি সরো! কোথায় গেলেন ডঃ কারোলি? হ্যাঁ, ওই তো। ডঃ কারোলি, এদিকে আসুন তো, আমাকে একটু সাহায্য করুন, ধ্রুপদী রেকর্ড খুঁজছি। দেখুন তো পান কিনা।
তিনজনে মিলে ভাল রেকর্ড পছন্দ করার কাজে লেগে পড়লেন। রিচার্ড অ্যামরি, একবার চোখ তুলে সেদিকে তাকালেন, পরক্ষণে ম্যাগাজিনের পাতায় মন দিল।
ঘরের সবাই যখন যে যার কাজে ব্যস্ত, লুসিয়া এই সময় আপনমনে পা টিপে টিপে এসে দাঁড়াল সেন্টার টেবিলের সামনে। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, এবার তার নজর আটকে গেল কালো টিনের বাক্সটার দিকে। আবার সে চারদিকটা সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করল, না, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। সে বাক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ওষুধের টিউব তুলে নিল। কি লেখা আছে লেবেলে?–হিস্কোসিন হাইড্রোব্রোমাইড এক্কেবারে মরণ বিষ। সে সন্তর্পণে টিউবটা উলটে দিল হাতের চেটোতে, প্রায় সবগুলো বড়ি তার মুঠোবন্দী তখন।
ঠিক এইসময় স্টাডির দরজার কপাট খুলে বাইরে উঁকি দিল একটা মুখ–এডওয়ার্ড রেনর, স্যার ক্লড অ্যামরির সচিব। লুসিয়া টের পেল না। সে অন্য হাতে টিউবটা বাক্সের মধ্যে রেখে পা টিপে টিপে চলে এল সেন্টার টেবিলের কাছে, এখানেই তখনও পড়ে আছে গরম কফি ভরতি জগ আর কাপ-ডিশ। রেনর কিন্তু লক্ষ্য রেখেছে, লুসিয়াকে।
কয়েক মুহূর্ত এইভাবে কেটে গেল। স্টাডির ঘর থেকে গৃহকর্তার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সচিবের বুঝতে দেরি হল না যে, তার স্যার কি চাইছেন? ঘরের ভেতর দিকে মুখ সরিয়ে বলল–হ্যাঁ, যাচ্ছি স্যার ক্লড, আপনার কফি নিয়ে এখুনি আসছি।
–আর মার্শালকে যে কফি পাঠানোর কথা ছিল……….
ততক্ষণে রেনর স্টাডির দোরগোড়া থেকে কিছুটা ভেতের ঢুকে পড়েছে।
আবার স্যার ক্লডের হাঁক ডাক শোনা গেল–বলি, সেগুলো কোথায় গেল…….?
–আজ বিকেলের ডাকে সে চিঠি পাঠানো হয়েছে, স্যার ক্লড। রেনর জবাব দিল।
–কিন্তু রেনর, আমি তোমাকে বললাম এক………. বসার ঘর থেকে ভেসে আসা বাজনা শুনে সচিব সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল–আরে, ওদিকে যাচ্ছ কোথায়? স্যার ক্লডের গম্ভীর গলা, হাজারটা কাজ পড়ে আছে। এস, চটপট হাত লাগাও।
–দুঃখিত, স্যার, ক্ষমা চাইছি–রেনর আর না এগিয়ে স্টাডির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
***
স্যার ক্লডের রাসভারী গলা–লুসিয়া চমকে উঠল, কিন্তু খানিক আগে যে এডওয়ার্ড রেনর তার ওপর নজর রাখছিল, তা ছিল তার অজানা। সে লক্ষ্মী মায়ের মতো রিচার্ডকে আড়াল করে সেন্টার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। সযত্নে নিয়ে আসা মারাত্মক বিষাক্ত বড়িগুলো এক কাপ কফির মধ্যে ফেলে দিল। চুপচাপ এসে বসল সোফার ওপর।