ডঃ কারোলির সন্ধানী দৃষ্টি চরকির মতো ঘরময় ঘুরছে। এগিয়ে এসে মেঝের ওপর পড়ে থাকা ওষুধের টিউবটা দ্রুত তুলে নিলেন। বারবারার হাতে তুলে দিতে ঝুঁকে পড়তেই দেখতে পেলেন টিউবের গায়ে লেবেল সাঁটা নামটার দিকে সাংঘাতিক ব্যাপার! আঁতকে উঠলেন কারোলি–মরফিন! টেবিলের ওপর পড়ে থাকা আর একটা টিউব তুলে নিলেন, চক্ষু ছানাবড়া তার স্টিকনিন! মারাত্মক বিষাক্ত ওষুধ।
বারবারার সামনে টিনের বাক্সটা তখনও খোলা পড়ে আছে। ওটার ভেতরটা ঘেঁটে দেখতে দেখতে ডঃ কারোলি বারবারাকে লক্ষ্য করে বললেন–এসব মারণাত্মক বিষের টিউব আপনি পেলেন কোত্থেকে, মিস অ্যামরি?
–গত মহাযুদ্ধের ছাইপাশ, মশাই। বারবারার গলায় বিরক্তি ফুটে উঠল।
পিসি ক্যারোলিন এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছেন, কিন্তু তখনও ভয় রয়ে গেছে মনে। বললেন ডাক্তার, সত্যি করে বলুন তো, এগুলি মারাত্মক বিষ কিনা? পায়ে পায়ে বারবারা ও কারোলির সামনে এসে দাঁড়ালেন–আসলে বলছিলাম কি, এগুলো বছরের পর বছর ধরে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে, এর বিষক্ষমতা কি আগের মতোই আছে? তা হতে পারে না। এখন এগুলো মামুলি জিনিস হয়ে গেছে। পেটে গেলে প্রাণ সংশয়ের ভয় নেই, তাই না?
-না, ম্যাডাম, ভুল বললেন, ক্যারোলিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাক্তার বলতে থাকেন–ওগুলোর বিষক্রিয়া একটু কমে যায়নি। বারোজন কি তার বেশি তাগড়াই চেহারার মানুষের ইহলীলা সাঙ্গ করে দেবার ক্ষমতা রাখে।
টিনের বাক্স থেকে একটা টিউব তুলে ধরলেন, মনে করুন এটা, লেবেলে চোখ বুলিয়ে নিলেন চটপট–হা, স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড, ওয়ান মিক্সটিস্থ অফ এ গ্রেট। এর সাত আটটা বড়ি কোন সুস্থ মানুষের পেটে ঢুকে গেলে দেখতে হবে না। বিষের জ্বালায় হৃৎপিন্ড যন্ত্রণায় লাফালাফি করবে, অসহ্য যন্ত্রণা, একসময় সব থেমে যাবে–ব্যাস, কেল্লাফতে।
আর একটা টিউবের লেবেলের লেখা পড়ে, ডঃ কারোলি বললেন–এটা আট্রোপিন সালফে, যন্ত্রণা দিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মারে।
টেবিলের ওপর রাখা টিউবগুলো বাক্সের মধ্যে আগের জায়গায় বসিয়ে অন্য আর একটা টিউব তুলে নিলেন কারোলি–হিক্সোসিন হাইড্রোব্রোমাইড, ওয়ান হান্ড্রেড অফ এ গ্রেন। বড়িগুলো দেখতে খুবই ছোট, কিন্তু এর আদ্ধেকখানাতেই কম্ম সাবাড়। যার পেটে যাবে, সে ঘুমের জগতে পৌঁছে যাবে, জীবনে সে আর জেগে উঠবে না। তবে হ্যাঁ, কোনরকম মহাসুখে মরতে পারা যায়।
এক চিলতে কুটিল হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। তিনি ওষুধের টিউবটা লুসিয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন।
টিউবটা নেবার জন্য লুসিয়া হাত বাড়াল, কারোলির দিকে তাকাল, কেউ বুঝি তাকে সম্মোহন করছে, এমন ভঙ্গিতে চাপাসুরে বলল, ……গভীর ঘুমের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু, যে ঘুম জীবনে আর ভাঙবে না……, আর কোন শব্দ তার মুখ থেকে বেরোল না।
ডঃ কারোলি লুসিয়াকে টিউবটা না দিয়ে এগিয়ে এলেন ক্যারোলিন অ্যামরির দিকে।
এমন সময় লাইব্রেরি ঘরের দরজা ঠেলে রিচার্ড ঢুকল, পেছনে বাটলার, তার হাতে কফির জগ, ধোঁয়া উঠছে। আর আছে কয়েকটা কাপ-ডিশ।
ডঃ কারোলিকে দেখে রিচার্ড নিঃশব্দে গোমড়া মুখে ডেক্সের পাশে টুলে গিয়ে বসে পড়ল।
কফি টেবিলের মাঝখানে সব কিছু রেখে ট্রেডওয়েল নিজের কাজে চলে গেল। গরম কফি কাপে ঢালার জন্য লুসিয়া সোফা ছেড়ে এগিয়ে এল।
এই সময় বারবারা এসে দাঁড়াল তার পাশে। দুটো খালি কাপ কফিতে পূর্ণ করল। একটা কাপ রিচার্ডকে দিল, অন্যটি নিজের তফাতে সরিয়ে রাখল।
এদিকে ডঃ কারোলি নিজের কাজে ব্যস্ত। কালো টিনের বাক্সে সবকটি ওষুধের শিশি সাজিয়ে রাখলেন, ঠিক আগের মতো। তারপর ঢাকনা বন্ধ করে সেন্টার টেবিলে তুলে দিলেন।
–হরেকরকম বিষ, আর তাদের বিষক্রিয়ার গল্প শুনে আমার বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেছে, জানেন, ডাক্তার। ক্যারোলিন হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে, রক্ত জল হয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, বিষবিদ্যা সম্পর্কে আপনার এত জ্ঞান দেখে অবাক হয়েছি, আপনি একজন ইটালিয়ান হয়ে এত সব খবর কোথা থেকে পেলেন?
সামান্য হেসে ডঃ কারোলি বললেন–মাফ করবেন, ম্যাডাম। আপনার কথা আমি জানতে পারলাম না। বিষের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান ইটালিয়ানদের থেকে ইংরেজদের বেশি। তাছাড়া যে কোন বিষ মেয়েদের কাছে এক অস্ত্র, যে অস্ত্রের ব্যবহার পুরুষের কোনদিন জানা ছিল না। তাই বিষের ক্ষমতা সম্পর্কে মেয়েদেরই বেশি জ্ঞান থাকা অস্বাভাবিক নয়।
ডঃ কারোলি চুপ করলেন, কি যেন ভাবলেন। তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠলেন…….. আপনি কোন ধাঁচে কথাটা বললেন, তা আগে আমার বোঝা উচিত ছিল। সরি। ম্যাডাম বর্গিয়া, ইটালির ইতিহাস ফাঁকে মারাত্মক বিষ প্রয়োগকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে, কুখ্যাত ঘৃণিত এই মহিলা সহজ অথচ মারাত্মক অস্ত্রের সাহায্যে একের পর এক শত্রুদের বিনাশ ঘটাতেন। আপনি নিশ্চয়ই তার কথাই এতক্ষণ ভাবছিলেন। কি ঠিক বলেছি?
-হ্যাঁ, লুক্রেজিয়া বর্গিয়া, কারোলির কথার জের টেনে ক্যারোলিন বলতে থাকেন আপনার ধারণা সম্পূর্ণ নির্ভুল, ডাক্তার। মহিলা ছিলেন সুন্দরী, যেন শিল্পীর পটে আঁকা ছবি, যেমন আকর্ষণীয় চেহারা, তেমনই মুখশ্রী। হালকা হলুদ বর্ণ, ঘনকালো চুল, অথচ তার স্বভাব ছিল রক্তপিপাসু ডাইনির মতো, সেই বর্গিয়ার কথাই আমি তখন ভাবছিলাম, আমাদের লুসিয়ার সঙ্গে তার কোন ফারাক নেই।