ক্লু খোঁজার জন্য চকিতে ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম, কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু চোখে পড়ল না। জানালাগুলো সব বন্ধ এবং ছিটকিনি লাগানো। খুনের চিহ্ন লুকিয়ে রাখার মতো জায়গাও তেমন চোখে পড়ল না। মনে হয় খুনী অনেক আগে নির্বিবাদে তার কাজ হাসিল করে কেটে পড়েছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ডঃ লিডনার তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। ডেভিড এমোট তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। তার চোখে অনেক প্রশ্ন।
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম এক এক করে। গলা থেকে কিছুতেই স্বর বেরুতে চাইছিল না, তবু কোন রকমে নিচু গলায় বললাম সমস্ত ঘটনা, সংক্ষেপে।
ডেভিডের উপর আমার বরাবর আস্থা ছিল। শান্ত প্রকৃতির মানুষ। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, তিনি আমার খবরটা উপলব্ধি করে নীল চোখে বড় বড় করে তাকালেন। কম কথার মানুষ তিনি, তার ওই চোখের চাহনিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, ঘটনাটা সাধারণ নয়, তার জটিলতা ভয়ানক রূপ নিতে বাধ্য।
একটু সময় চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশে একবার আমাদের খবর দেওয়া উচিত। যেকোন মুহূর্তে বিল ফিরে আসতে পারে। এখন লিডনারকে নিয়ে কি করব, সেটাই এখন বিরাট সমস্যা আমাদের কাছে যেন।
ওঁকে ওঁর ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসুন আমায় একটু সাহায্য করুন।
মাথা নাড়ল সে।
মনে হয় দরজায় সর্বপ্রথম একটা তালা লাগান দরকার। ডেভিড বলে। তারপর তিনি দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা আমার হাতে দিয়ে বলেন, চাবিটা তোমার কাছে থাকাই ভাল। যখন-তখন
দুজনে ধরাধরি করে তার ঘরে তাকে বহন করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমরা। তারপর ব্রান্ডির খোঁজে বেরিয়ে গেলেন মিঃ এমোট। একটু পরে মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। মিস জনসনকে কেমন চিন্তিত এবং তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিল, তবে তাকে বেশ শান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। তার উপর ডঃ লিডনারকে ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম কোর্টইয়ার্ডে দ্রুত পায়ে।
ঠিক সেই সময় ধনুকাকৃতি খিলান পথ দিয়ে স্টেশন ওয়াগনটা কোর্ট ইয়ার্ডে এসে প্রবেশ করল। বিলকে হাসি মুখে নামতে দেখে আমরা সবাই বিচলিত এ সময়।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, খুশিতে উপচে পড়ে সে আবার বলে ওঠে, হাইওয়ের কোন ডাকাতির নামগন্ধ নেই আর–
কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ সে চুপ করে গেল। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে, কি ব্যাপার? আপনারা সব চুপ কেন, কথা বলছেন না কেন? আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, আপনাদের প্রিয় পোষা পাখিটাকে দুষ্টু বেড়ালটা মেরে ফেলেছে।
মিসেস লিডনার মৃত, মিঃ এমাট সংক্ষেপে বললেন, তাকে খুন করা হয়েছে।
কি বললে? বিলের ফর্সা মুখটা হঠাৎ অবিশ্বাস্য ভাবে বদলে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে, মিসেস লিডনার মৃত!
মৃত? কান্না-জড়ানো কণ্ঠস্বর। পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখি মিসেস মারকাডো দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি কি বলতে চাও মিসেস লিডনার নিহত?
হ্যাঁ, আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, খুন হয়েছেন তিনি।
না! আর্ত চিৎকার। ওঃ না! এ আমি বিশ্বাস করি না। সম্ভবতঃ তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যা? নিজের মাথায় কেউ অমন মারাত্মক ভাবে আঘাত করে আত্মহত্যা করতে পারে? আমি শুকনো গলায় বলি, তিনি খুন হয়েছেন মিসেস মারকাডো।
হঠাৎ শব্দ করে একটা কাঠের প্যাকিংবাক্সের উপর তিনি বসে পড়লেন। উঃ, এ যে ভয়ঙ্কর, বীভৎস–
ভয়ঙ্কর, বীভৎস এ ঘটনা, একথা এখন আর অজানা নয় আমাদের কাছে। এ সব কথা ওঁর মুখ থেকে শুনতে আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না। আমার আশঙ্কা ভদ্রমহিলা বোধহয় লিডনারের প্রতি হিংসার মনোভাব প্রদর্শনের জন্য এখন অনুতপ্ত, বিবেকের দংশনে ক্ষত-বিক্ষত।
মিনিট পনেরো পরে একরকম এক নিঃশ্বাসে তিনি জিজ্ঞেস করে ফেললেন, তা এখন তোমরা কী করতে যাচ্ছো!
ওঁর কথার উত্তর আমরা কেউ দিলাম না। চুপ করে যে যার কাজে লেগে পড়লাম তারপর।
মিঃ এমোট শান্তভাবে তার কাজ বুঝে নিলেন।
শোন বিল, তুমি বরং আবার হাসানিয়েয় ফিরে যাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানকার নিয়ম কানুন আমি ঠিক জানি না। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এখানকার পুলিশের বড় কর্তা, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মনে হয় ঠিক হবে। তবে তার আগে ডঃ রেলিকে খবর দিতে হবে। তিনি জানেন, এরপর আমাদের কি করতে হবে। কি করা উচিত।
মিঃ কোলম্যান মাথা নাড়লেন। তার মাথায় তখন একরাশ প্রশ্ন গিজগিজ করছিল। তার মুখ দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে গেছে। নিঃশব্দে সে অপেক্ষামান স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসে। একটু পরেই গাড়ি চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় সে।
তারপর মিঃ এমোট কতকটা অনিশ্চিত ভাবে বলে, আমার মনে হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদটা এখন সেরে নিলে ভাল হয়। বলেই সে গলা চড়িয়ে হাঁক দেন, ইব্রাহিম!
হুজুর।
পরিচারক ইব্রাহিম ডাক শুনে ছুটে আসে। মিঃ এমাট তার সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলতে থাকেন! মিঃ এমাটের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় তার প্রশ্নগুলো খুব কঠিন এবং চোখা চোখা হচ্ছিল। ছেলেটার মুখ নাড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, সব কথাতেই সে না বলছিল, অস্বীকার করছিল।
অবশেষে মিঃ এমাট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলে, ইব্রাহিমের বক্তব্য হল, আজ অপরাহ্নে কোন আগন্তুক কিংবা অপরিচিত কোন লোক এখানে আসেনি, এবং যেই আসুক না কেন নিঃশব্দে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে তার কাজ হাসিল করে পালিয়েছে।