মিসেস লিডনার এক শুক্রবার তার জীবনের কাহিনী আমাকে শোনালেন। পরদিন শনিবার সকালে বাতাসে যে সুর ভেসে আসে, বুঝি তার কাহিনীর সঙ্গে কোথায় যেন একটা অমিল থেকে যায়। বিশেষ করে আমি লক্ষ্য করেছি, আমার উপর প্রভুত্ব করার একটা ঝোঁক আছে। আমি ওঁর সেবিকা হিসাবে এখানে কাজে এসেছি, সে কথা আমি অস্বীকার করছি। না, কিন্তু তাই বলে আমাকে ভুল বোঝানো হবে, বিশেষ, করে তার মানসিক রোগ উপশমের ভারটা যখন আমার উপরে ন্যস্ত, সেই দাবীতে আমি অন্তত ওঁর কাছ থেকে প্রকৃত সত্য ঘটনাটা আশা করতে পারি, পারি কি না? ঠিক আছে, তার জন্য আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র বিস্মিত নই। এ রকম ঘটনা বার বার আমার জীবনে ঘটছে এবং ঘটবে, এর মধ্যে অবাক হবার কী আছে? মেয়েরা সাধারণতঃ আবেগের মাথায় নিজেদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে থাকে। পরে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সত্য ঘটনাটা তখন বেমালুম চেপে যায়। এই হল মানুষের স্বভাব। আমরা সবাই স্বভাবের দাস, এ কথা অস্বীকার করা যায় না, তা না হলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়।
তারপর থেকে আমি খুব সতর্ক হলাম, মিসেস লিডনার যে কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলেন, সে নিয়ে তার কাছে ফিরে আর আমি উচ্চবাচ্য করলাম না ভুলেও। ওদিকে সকালেই মিঃ কোলম্যান হাসানিয়ের পথে যাত্রা করেছে। সঙ্গে চিঠিগুলো নিতে সে ভোলেনি। শ্রমিকদের বেতন দিবস আজ, ব্যাঙ্ক থেকে খুচরো মুদ্রা আনতে হবে তাকে। বিকেলের আগে ফিরতে পারছে না সে। আমার অনুমান শীলা রেলির সঙ্গে অপরাহ্নের ভোজ সারবে সে। সাড়ে তিনটার পর খোঁড়া খুঁড়ির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, কারণ একটু পরেই বেতন দেওয়া শুরু করা হবে।
ছোকরা আবদুল্লার কাজ হল মাটির পাত্রগুলো বোয়া মোছা করা। কোটইয়ার্ডের ঠিক মাঝখানে বসে সে তার কাজ করছিল এবং মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল চারিদিকে। মিঃ কোলম্যান ফিরে না আসা পর্যন্ত ডঃ লিডনার এবং মিঃ এমাট তাদের নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত রইলেন। আর মিঃ ক্যারি খনন কার্যের তদারকি করতে থাকলেন।
ওদিকে মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর আরামের যথাযথ ব্যবস্থা করে আমি আমার ঘরে ফিরে আসি। ঘুম আসছিল না, বই খুলে পড়তে বসলাম। তখন পৌনে একটা হবে, হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। নার্সিংহোমে মৃত্যু–রীতিমতো রোমাঞ্চকর কাহিনী। যদিও লেখকের লেখার ধরণ দেখে আমি মনে করি নার্সিংহোম পরিচালনার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা কম, এ ব্যাপারে তিনি আর একটু যত্ন নিলে বোধহয় ভালো হত। যাইহোক, এ ব্যাপারে লেখককে দু-একটা কথা লেখার কথা আমি ভাবছিলাম। অবশেষে বই বন্ধ করে (কাহিনীর বিবরণ মত ভোজ টেবিলের পরিচারিকাকে অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু একবারও তাকে আমার সন্দেহ হয়নি) ঘড়ির দিকে তাকালাম, তিনটে বেজে কুড়ি! সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম এবং গায়ে ইউনিফর্ম চাপিয়ে কোর্ট ইয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আবদুল্লা তখন তার কাজে ব্যস্ত এবং তার সেই বিষণ্ণ গানের সুরটা ঠোঁটে লেগেছিল। ডেভিড এমাট তার পাশে দাঁড়িয়ে ব্রুশ দিয়ে ধোয়া মাটির পাত্র গুলো আলাদা করে রাখছিলেন। আমার দৃষ্টিটা সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিতে হল কারণ ডঃ লিডনারকে ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখলাম তখন।
অপরাহ্নটা খুব একটা খারাপ নয়, ডঃ লিডনার উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ছাদটা পরিষ্কার করে এলাম। কদিন থেকে লুসিও অভিযোগ করছিল, ছাদে বেড়াবার জন্য এতটুকু জায়গা নেই। লুসি এবার খুশি হবে। এই খবরটা আমি এক্ষুনি তাকে দিতে যাচ্ছি।
মনে হয় মিনিট দেড়েকও হয় নি ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, সেটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি আবার ফিরে এলেন। তার দিকে এই মুহূর্তে তাকালে মনে হয় আমি যেন রাতের বিভীষিকা দেখছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘরে ঢোকার সময় তাকে বেশ হাসি-খুশি দেখেছিলাম। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন। ঠিক মাতাল অবস্থায়, পা টলছে, মুখে আতঙ্কের ছাপ।
নার্স–ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, বিচিত্র চাহনি, নার্স সঙ্গে সঙ্গে আমার কেন জানি না মনে হল, একটা কোন অঘটন ঘটেছে নিশ্চয়ই। ডঃ লিডনারের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর অন্তত যে কথাই বলে দিচ্ছে যেন। তাই আমি তাড়াতাড়ি তার কাছে ছুটে এলাম। আমার দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি, ভয়ঙ্কর বীভৎস সেই চাহনি। টান-টান ধূসর রঙের মুখ। তার অবস্থা দেখে মনে হল, যে কোন মুহূর্তে তার দেহটা অবশ হয়ে পড়ে যেতে পারে।
আমার স্ত্রী… কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার, আমার স্ত্রী ……… ওঃ হায় ঈশ্বর……
তার অসমাপ্ত কথাটা শোনবার জন্য আমার বুঝি আর তর সইছিল না। ডঃ লিডনারের পাশ কাটিয়ে তার স্ত্রীর শয়নকক্ষে ছুটে গেলাম। ঘরে ঢোকা মাত্র আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হল যেন।
বিছানার উপরে মিসেস লিডনারের দেহটা দলাপাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
আমি তার উপরে ঝুঁকে পড়লাম। তার দেহে প্রাণের কোন সাড়া নেই। স্পন্দনহীন দেহটা দেখে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না, তিনি মৃত। মৃত্যু ঘটেছে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে। মৃত্যুর কারণটা অনুমান করা খুবই সহজ ডানদিক ঘেঁষে মাথার উপর প্রচণ্ড আঘাত করার ফলেই তার মৃত্যুটা ঘটে থাকবে। মনে হয়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি একবার বিছানার উপর উঠে বসবার চেষ্টা করে থাকবেন, তারপর যেভাবে যে অবস্থায় ছিলেন ঠিক সেখানেই পড়ে থাকেন। বিশেষ কারণেই আমি তার মৃতদেহ স্পর্শ করলাম না।