সে কথা আমিও ভাবছিলাম বৈকি। তাই নীরবে মাথা নাড়লাম।
মিস রেলি মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে হঠাৎ ফেটে পড়লেন : জানি না এ বছর ওদের মধ্যে কি হয়েছে। একটা ব্যাপারে সবাই একমত। প্রত্যেকের মধ্যে একটা ঢাক ঢাক ভাব, চাপা গুঞ্জন। জনসন এমনি বিষণ্ণ যে, তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বার হয় না। ডেভিড ভুলেও কথা বলে না, পাছে অজান্তে তার পেট থেকে অজানা কোন তথ্য বুঝি বা বেরিয়ে যায়। অবশ্য বিল ঠিক উল্টো, কিন্তু তার অনর্গল বকবকানিতে সবাই বিরক্তবোধ না করে পারে না। ক্যারি এমন অদ্ভুত চোখে তাকায়, দেখলে মনে হয় অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝি সে কারোর মনের গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে। আর তারা পরস্পরের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে যেন, যেন–ওঃ আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বুঝি না; তবে এটুকু বলতে পারি, সন্দেহের অবকাশ থেকে কেউ বোধহয় মুক্ত নয়।
বিচিত্র, বড় বিচিত্র সব ঘটনা। তার চেয়েও বিচিত্র বোধহয় মানুষের মন। ভাবলাম, দুজন দুই প্রান্তের মানুষ যাদের মধ্যে কোন মিল নেই, অথচ সেই দুজন মানুষ মিস রেলি এবং মেজর পেনিম্যান কিন্তু একটা ব্যাপারে একই মতামত পোষণ করছে, অন্তত তাদের আলোচনা আমার মনের মধ্যে যথেষ্ট দাগ ফেলতে পেরেছে। আমাকে এক অজানা ভাবনায় ফেলে দিতে পেরেছে।
ঠিক সেই সময় মিঃ কোলম্যান হৈ-চৈ করতে করতে ফিরে এল। হৈ-চৈ বললাম বটে, বা এও হতে পারে, তার কথাবার্তার ভাবভঙ্গীই হয়তো এইরকম।
হ্যালো, বলল সে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাজার সরকার বলতে নিশ্চয়ই আমি। শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন ওঁকে?
শহর দেখার উৎসাহ খুব একটা নেই ওর, মিস রেলি শুকনো গলায় জবাবটা দিল। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ছবির প্রদর্শনী কিংবা প্রাচীন নিদর্শন দেখবার ঝোঁক তোমারও তো নেই বিল, আছে নাকি তোমার? আমি ভাবতেই পারি না, কি করে তুমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হলে?
তার জন্য আমাকে দোষ দিও না, দোষ যদি দিতে হয় তাহলে আমার অভিভাবককে দিও। শিক্ষিত তিনি, কলেজের ফেলো তিনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাষা ভাষা চোখ বুলিয়ে নেয় বইয়ের উপর, এমনি লোক তিনি।
তুমি মূর্খ, তাই তোমার পেশাগত কাজে তেমন মন নেই, শীলা তাকে স্পষ্ট কথা শুনিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না।
কিন্তু এ আমার মুর্খামী নয় শীলা, আসলে কি জানো, এই চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার কোন বিশেষ পেশার প্রতি লক্ষ্য আছে কিনা। আমি না বলে দিই, তাই তিনি নিজের খেয়াল-খুশি মতো এখানে পাঠিয়ে দেন আমাকে। যাইহোক, টাকা রোজগারের ধান্দায় আমি এখানে এসেছি। আমার ইচ্ছে মোটর-দৌড় কপ্রতিযোগিতায় যোগদান করা। ব্যস, এই পর্যন্ত।
অবাস্তব তোমার ধ্যানধারণা, মিস রেলিকে ক্রুদ্ধ বলে মনে হল।
তুমি ভুল করছ। হে আল্লা বলে যে কোন লোকের সঙ্গে এখানে মিশে গিয়ে আমি চিৎকার করতে পারি তাদের গলার স্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে। স্কুল জীবন থেকে অপরের হাতের লেখা নকল করার দিকে আমার দারুণ ঝোঁক ছিল। এখন আমি একজন ফার্স্টক্লাস জালিয়াত। যদি কোনদিন বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমাকে তোমার সামনে দিয়ে রোলস্ রয়েস হাঁকিয়ে চলে যেতে দেখো, তাহলে ধরে নিও আমি একজন ক্রিমিনাল।
ভুলে যেও না, অনেক আগেই এখান থেকে তোমার রওনা হয়ে যাবার কথা ছিল। সে জায়গায় তুমি এখনো এখানে সেই থেকে বকবক করে যাচ্ছো।
আমার অতিথি সেবাপরায়ণ, তাই না নার্স?
আমি নির্লিপ্ত ভাবে বলি, মনে হয়, এবার আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ মিঃ কোলম্যান।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ নার্স।
মিস রেলির সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এবং একটু পরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট রূপ আছে শীলার, মিঃ কোলম্যান বললেন, তবে সব সময় ও আমার কাজ কিংবা কথার খুঁত ধরে, হয়তো ও আমাকে সরিয়ে দেবার মতলব আঁটছে।
শহরের বাইরে ছোটে আমাদের ছুটন্ত গাড়িটা। পথের দুধারে সবুজ শস্যখেত। প্রায় আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একটা বিরাট বাঁধের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিঃ কোলম্যান বলেন, আরো একটু এগুলেই আমাদের তেল ইয়ারিমাহ।
দূরে কালো কালো চেহারার মানুষগুলোকে এখান থেকে ছোট ছোট পিঁপড়ের দল বলে মনে হচ্ছিল। আমার চোখে চোখ পড়তে তারা ছুটতে শুরু করল।
অভিযান পরিচালনা করার বাড়িটা ছিল নদী থেকে খানিকটা দূরে। মাঝখানে একটা কোটইয়ার্ড। সেই কোর্টইয়ার্ডের চারপাশে সারি সারি ঘর। প্রথমদিকে দক্ষিণ দিকের ঘরগুলো নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের অভিযানের তৎপরতা, পরে পূব দিকের কয়েকটা অপ্রয়োজনীয় ঘরগুলোর দখল নেওয়া হয়।
প্রত্যেক ঘরের দরজাগুলো কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে। আর জানালাগুলো বেশির ভাগ বহির্মুখখা। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা সিঁড়ি উপর দিকে উঠে গেছে। বিল্ডিং-এর আর তিনটে দিকের থেকে এ দিকটা একটু বেশি বড়।
পূর্বদিকে একটা খোলা বারান্দা। বারান্দা পার হলেই দরজা। মিঃ কোলম্যান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন এবং আমাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন। আমরা যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম সেখানে বহু লোক একটা চায়ের টেবিল ঘিরে আড্ডা দিচ্ছিল জমিয়ে।
টেবিলটার মাঝখানে বসে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল। এক পলকে সেই আমার প্রথম দেখা লুসি লিডনারকে।
১০. শনিবারের অপরাহ্ন
১০. শনিবারের অপরাহ্ন