আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। তবে যত বেশি ভয় পাবার কথা ঠিক ততটা আমাকে পেতে দেয়নি এরিক। ও আমাকে তার একান্ত নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে দেয় তখন। দ্বিতীয় চিঠির ভাষা আগেরই অনুরূপ,আমি ভুলে যাইনি। পরিকল্পনা করছি। মরতে তোমাকে হবেই। কেন তুমি আমার কথার অবাধ্য হলে?
আপনার স্বামী এসব কথা জানেন?
মিসেস লিডনার একটু সময় চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, আমাকে যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এ কথা তিনি জানেন। দ্বিতীয় চিঠিটা আসতে আমি তাঁকে দুটো চিঠিই দেখাই। সমস্ত ব্যাপারটা তিনি একটি জালিয়াতি বলে মনে করলেন। আমার প্রথম স্বামী জীবিত, এই খবরটা প্রচার করে কেউ হয়তো আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায় বলে তার ধারণা হল।
দ্বিতীয় চিঠিটা পাবার কিছুদিন পরে একটুর জন্য বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যুর হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান তারা। ঘটনাটা এই রকম; ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ তাদের এ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে গ্যাসের সুইচটা খুলে দিয়ে থাকবে। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক সময় মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং গ্যাসের গন্ধ তাঁর নাকে লাগে। তখন তিনি নার্ভাস হয়ে পড়েন। তিনি তার স্বামীকে সব খুলে বলেন। এও বলেন, কিভাবে তিন বছর ধরে তিনি অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি তাঁর স্বামীকে বলেন, পত্ৰলেখক পাগল হোক, আর যাই হোক, সত্যি সত্যি সে এবার তাকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। কেন জানি না সেই প্রথম তার মনে হল, পত্রলেখক ফ্রেডরিক ছাড়া অন্য আর কেউ হতে পারে না। এর আগেও তিনি তার মধ্যে এমনি একটা নিষ্ঠুর ভাব লক্ষ্য করেছিলেন।
মনে হয়, মিসেস লিডনার আবার মুখ খুললেন, এরিক আমার থেকে একটু কম সতর্ক বলে মনে হল। পুলিশকে খবর দিয়ে সে তার কর্তব্য পালন করতে চাইল। স্বভাবতই আমি তার কথায় তেমন আমল দিলাম না। অবশেষে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এলাম আমরা, আমি তার সঙ্গে এখানে এসে বসবাস করব। আর গ্রীষ্মবকাশে আমেরিকায় ফিরে না গিয়ে লণ্ডন কিম্বা পারিসে গিয়ে থাকাটাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পরিকল্পনা মতো তাদের সব কাজ ঠিক ঠিক চলতে থাকে এবং তারপর সপ্তাহ তিনেক আগে আর একটা চিঠি পান মিসেস লিডনার। খামের উপর ইরাকের স্ট্যাম্প মারা ছিল। সেই তৃতীয় চিঠিটাও তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন
তুমি ভেবেছ, তুমি রেহাই পেয়ে যাবে। কিন্তু তোমার ভুল ধারণা। অন্যের হয়ে আমার কাছে তুমি বেঁচে থাকতে পারো না কিছুতেই। এ কথা আমি তোমাকে সব সময় বলে আসছি। তোমার মৃত্যু আসন্ন।
আর সপ্তাহ খানেক আগে এই চিঠিটা। এখানে এই টেবিলের উপর পড়েছিল। এমন কি ওটা ডাক ঘরেও যায়নি।
ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠিটা আসেনি? কেমন কৌতূহল হল। তার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিলাম। তিন অক্ষরের লেখা চিঠি নয়, যেন একটা চিরকুট, কিন্তু ভয়ঙ্কর তার অর্থ, একটা অশুভ ইঙ্গিত।
আমি এসে গেছি।
মিসেস লিডনার অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
বুঝলে, যে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে! সে লোক ফ্রেডরিক হতে পারে, আবার ইউলিয়ামও হতে পারে। তবে সে যেই হোক না কেন, সে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে।
কথা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর কঁপছিল। আমি তার কব্জিটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
এখন আমরা আপনার অনেক কাছে এসে গেছি। ভয় কি? এখন থেকে আমরা আপনার উপর নজর রাখব। আপনার কাছে স্যাম্ভল্যাটলি (মূৰ্ছাপ্রবণতায় ব্যবহৃত অ্যামনিয়াম কার্বনেট প্রস্তুত ঔষধ) আছে?
মিসেস লিডনার চোখের ইশারায় দেওয়াল-আলমারির দিকে তাকালেন। আমি তাকে ভাল রকম একটা ডোজ দিলাম।
একটু পরে তিনি সহজভাবে বললেন, হ্যাঁ, এখন আমি একটু সুস্থ বোধ করছি। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার বর্তমান অবস্থার কথা। আমি যখন জানালার সামনে লোকটাকে দেখি, আমি ভাবলাম, সে আসছে–এমন কি তুমি যখন এখানে এলে তখনও আমার সন্দেহ ছিল, তুমি বোধহয়–
একজন সাধারণ হসপিটাল নার্স, এই তো?
না, না ও কথা আমি ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, বুঝি সেই লোকটার সঙ্গে তোমার আঁতাত আছে।
আপনার চিন্তাধারা বিজ্ঞচিত নয়।
হ্যাঁ, হয়তো, বা তাই। কিন্তু আমার জ্ঞানের পরিধি যেন সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু যদি মনে করেন তো জিজ্ঞাসা করি, আপনার প্রথম স্বামীকে, আপনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।
জোর দিয়ে বলতে পারি না, ধীরে ধীরে তিনি বলেন, পনের বছর আগের কথা, হয়তো তার মুখ আমি চিনতেই পারব না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি কেঁপে উঠলেন।
কেবল একদিন রাত্রে দেখে ছিলাম, তবে সেটা মৃত লোকের মুখ। জানলায় টোকা মারার শব্দ হতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখি, সেই মৃত লোকের মুখ। ভয়ে আমি আঁতকে উঠি। আমার চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে আসে। কিন্তু তারা বলে, কেউ কোথাও নেই।
মিসেস মারকাডোর গল্প মনে পড়ে গেল।
আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম, আপনি তখন স্বপ্ন দেখছিলেন?
না, স্বপ্ন নয়, সত্যি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারি না। কারণ এ ধরনের ঘটনা রাতের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। যাইহোক, কোন রুগীর বিরোধিতা আমি করি না। মিসেস লিডনারকে যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করতে গিয়ে আমি বললাম, এ পাড়ায় যে কোন আগন্তুকই আসুক না কেন, আমি নিশ্চিত, সে এখানকার সবার পরিচিত না হয়ে থাকতে পারে না।