উঃ কি ভয়ঙ্কর। আমি চমকে উঠলাম।
হ্যাঁ, তোমার মতো আমিও তখন দারুণ চমকে উঠেছিলাম। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর সত্যই বটে। সে ছিল অত্যন্ত দয়ালু, ভদ্র এবং সব সময় কিন্তু আমার মনে কোন সংশয় ছিল না, ফ্রেডরিকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমি একটুও ইতস্ততঃ করিনি। সম্ভবতঃ আমি ভুল করেছিলাম।
বলা মুশকিল, প্রত্যুত্তরে বললাম, জানি না আপনার মতো অবস্থায় পড়লে অন্যরা কি করতো।
তোমাকে যা বলছি বাইরের কেউ জানে না। লোকে জানে, আমার স্বামী ফ্রন্টে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। সৈনিকের বিধবা পত্নী হিসাবে অনেকে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন তখন।
কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর কি রকম ভারী হয়ে আসে, উপলব্ধির ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম।
বহু পুরুষ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার মনটা তখন দারুণ বিষিয়ে উঠেছিল। আমি তখন ভাবতেই পারি না, নতুন করে আবার আমি বিশ্বাস করতে পারব।
হ্যাঁ, আপনার তখনকার মনের অবস্থা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারি।
তারপর হঠাৎ আমি একটি যুবকের প্রেমে পড়ে যাই। আমার মনটা ভীষণ বিচলিত হয়ে ওঠে তার সান্নিধ্যে এসে। সেই সময় একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়। ছদ্মনামে লেখা একটা চিঠি পাই ডাকে–চিঠিটা ফ্রেডরিকের। হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি, আমি যদি আবার অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করি, তাহলে ও আমাকে খুন করবে।
ফ্রেডরিকের কাছ থেকে? তার মানে আপনার মৃত স্বামীর কাছ থেকে?
হ্যাঁ, আমার স্বামীর কাছ থেকে বৈকি! প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আমি পাগল হয়ে গেছি কিংবা স্বপ্ন হয়ে গেছি। অবশেষে আমি আমার বাবার কাছে যাই। তিনি তখন আমাকে সত্য ঘটনাটা খুলে বলেন। আমার স্বামী নাকি প্রকৃতপক্ষে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাননি। কয়েক সপ্তাহ পরে একটি ট্রেন ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন তিনি এবং তাতেই অন্যদের সঙ্গে তার মৃতদেহ ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পাওয়া যায়। যাইহোক, লোকটা যখন আর জীবিত নেই, তাই তিনি আমাকে তার মৃত্যুর খবরটা দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। একটু থেমে মিসেস লিডনার আবার বলতে থাকেন, কিন্তু সেই চিঠিটা একটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তবে কি আমার স্বামী বেঁচে আছেন?
মিসেস লিডনারের বাবা ব্যাপারটা খুব সাবধানে এড়িয়ে যান। তিনি খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দেন, ফ্রেডরিকের মৃতদেহ বলে যাকে কবর দেওয়া হয় সেটি প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিকেরই। তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন, ফ্রেডরিক মৃত এবং সেই চিঠিটা একটা বিদ্বেষপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
এ ঘটনা শুধু একবারই নয়, বারবার ঘটে। কারোর সঙ্গে আমার যদি খুব ঘনিষ্ঠতা থাকত, তাহলে সেই সব হুমকি দেওয়া চিঠিগুলোর অর্থ বুঝতে পারতাম।
আপনার স্বামীর হস্তাক্ষর আপনি চিনতে পারেন?
সেটা বলা মুশকিল, ধীরে ধীরে তিনি বললেন, তার কোন চিঠি আমার কাছে নেই। স্মৃতি শক্তি ছাড়া আমার তহবিলে আর কিছু নেই।
তবে কি এটা কোন অলৌকিক ঘটনা কিংবা সেরকম কিছু।
না, তা নয়। মিসেস লিডনার যা বললেন তা এই রকম, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত কতকগুলো সাংকেতিক ভাষায় মনের ভাব বিনিময় হতো, যেমন নিকনেম। কেউ যদি সেই সব ভাষাগুলো তাদের চিঠিতে ব্যবহার করতো তাহলে না হয় বিশ্বাস করা যেত।
হ্যাঁ, অনেক ভেবে-চিন্তে আমি বললাম, এক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত বলেই মনে হয়, চিঠিগুলো আপনার স্বামীর লেখা নয়। তবে কি সে অন্য কেউ হতে পারে?
হ্যাঁ, সেই সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফ্রেডরিকের এক ভাই ছিল, আমাদের বিয়ের সময় তার বয়স ছিল দশ কি বারো। ফ্রেডরিককে সে শ্রদ্ধা করতো এবং ফ্রেডরিক তাকে স্নেহ করতেন। উইলিয়াম তার নাম। তার পর সেই ছেলেটির যে কি হল, জানি না। ছেলেটি তার দাদাকে ভালবাসতো, তাই ফ্রেডরিকের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য মনে হয় সরাসরি সে আমাকে দায়ী বলে মনে করে। এমনিতেই আমার প্রতি তার হিংসা ছিল এবং ফ্রেডরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সে হয়তো আমাকে শাস্তি দেবার জন্য এই পরিকল্পনা করে থাকবে।
হ্যাঁ, এটা সম্ভব, আমি বললাম, শকের ব্যাপারে শিশুদের মনে দারুণ রেখাপাত করে থাকে।
জানি, আমিও জানি। হয়তো এই ছেলেটি প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায় তার জীবন উৎসর্গ করতে চায়।
তারপর? আমি ওঁকে তাড়া দিলাম, থামলেন কেন, বলে যান ম্যাডাম।
এরপর বেশি কিছু বলার নেই। তিন বছর আগে আমি এরিকের সঙ্গে মিলিত হই। তবে তাকে বিয়ে করার কথা আমার কখনোই মনে হয়নি তখন। এরিক একটু একটু করে তার ভালবাসা, মমতা দিয়ে আমার মনের মধ্যে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দেয়। আমাদের বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছিলাম সেই ধরনের হুমকি দেওয়া আর একটা চিঠির জন্য। কিন্তু কোন চিঠিই এলো না। তাই আমার তখন মনে হয়েছিল, পত্রলেখক যেই হোক না কেন, হয় সে মৃত এখন তা না হলে সে তার নিষ্ঠুর খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের বিয়ের দুদিন পরেই এই চিঠিটা আবার পেলাম।
ছোট এ্যাটাচি-কেসের ডালা খুলে একটা চিঠি বার করে আমার হাতে তুলে দিলেন তিনি। চিঠিটা ঈষৎ বিবর্ণ এবং মেয়েলী হাতের লেখা। চিঠির ভাষাটা এই রকম, তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ। তাই এখন তুমি আর রেহাই পেতে পারো না। একমাত্র ফ্রেডরিক কানারের স্ত্রী তুমি। অতএব মরতে তোমাকে হবেই!