রাতের প্রহরীর বক্তব্যও তাই। তার জবানবন্দীতে দেখা যায়, বাইরের কোন লোক তার দৃষ্টি এড়িয়ে অ্যান্টিক-রুমে ঢোকেনি। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবাই যখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল সেই সময়, তাহলে কি করে তারা এতো জোর দিয়ে বলতে পারে যে, বাইরের কোন লোকের প্রবেশ সেখানে ঘটেনি।
আবার এমনও হতে পারে, ফাদার ল্যাভিগনির পায়ের শব্দে মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙে যায় এবং তাতে তিনি অমন ভয় পান।
আবার কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনির কথাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ প্রথমত তিনি নিজের কানে তার ঘরের জানালার সামনে তৃতীয় ব্যক্তির পায়ের শব্দ শুনতে পান এবং দ্বিতীয়তঃ অ্যান্টিকরুম থেকে আলোর রেখা, সম্ভবতঃ টর্চের আলো দেখতে পান তিনি।
ওরা ছাড়া অন্য আর কেউ কিছু দেখেনি কিংবা শুনতে পায়নি।
যাইহোক, পরদিন মিসেস লিডনারের কাছ থেকে যে কাহিনী আমি শুনি তাতে এই ঘটনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেড়ে যায়।
.
০৯.
মিসেস লিডনারের কাহিনী
মধ্যাহ্নভোজ তখন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। রোজকার অভ্যাস মতো মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করলেন বিশ্রাম নেবার জন্য। যথেষ্ট সংখ্যক বালিশ এবং তার প্রিয় কতকগুলো বই বিছানায় রেখে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাব, মিসেস লিডনারের ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম।
যেও না নার্স, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।
আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম।
দরজাটা বন্ধ করে দাও।
বাধ্য মেয়ের মত আমি তার কথা রাখলাম।
দরজা বন্ধ। আড়চোখে একবার সেদিকে দেখে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আপন খেয়ালে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকলেন তিনি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমাকে কিছু বলবার আগে তিনি যেন নিজের মনটাকে সেই ভাবে তৈরি করে নিচ্ছেন। তাই আমি তাঁকে বাধা দিলাম না।
অবশেষে সেই ইতস্ততঃ ভাবটা কাটিয়ে উঠে আমার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি এবং হঠাৎ বললেন, বসো।
শান্ত ভাবে বসলাম। কথা বলার শুরুতেই তাকে একটু নার্ভাস বলে মনে হল আমার। এই সব দেখে শুনে তুমি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছ তাই না?
কথা না বলে কেবল মাথা নাড়লাম।
শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি মনস্থির করলাম, তোমাকে আমি খুলে বলব–সব কিছু। কাউকে না কাউকে আমার বলা একান্ত দরকার, তা না হলে আমি তো পাগল হয়ে যাব।
এই মুহূর্তে তার হাঁটা চলার মধ্যে একটা নিদারুন অস্থিরতার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তার সেই অস্থির পা দুটো হঠাৎ স্তব্ধ হল, তিনি তখন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
তুমি কি জান আমার কিসের ভয়?
কোন একটি লোককে।
হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো বললাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি নিজেই আবার বলেন, আমার আশঙ্কা আমি বোধ হয় খুন হয়ে যাচ্ছি।
সে সম্ভাবনা এখন আর নেই। তবু এ ব্যাপারে তাকে সান্ত্বনা দেবার কোন প্রয়োজন নেই।
ও, তাহলে এই ব্যাপার?
আমার কথার মধ্যে কি ছিল কে জানে, তারপর হঠাৎ তিনি হাসতে শুরু করলেন। হাসি, হাসি আর হাসি। এবং তারপর কান্না। অশ্রুর বাদল নামল তার দু চোখের কোল বেয়ে।
যে ভাবে তুমি বললে! হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি অনুযোগ করলেন, যেভাবে তুমি কথাটা বললে-
এখন, এখন আর ও নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, ঠাণ্ডা জল এনে তার কপালে ঢালোম তাকে শান্ত করার জন্য।
এখন আর অবুঝ হবেন না,, একরকম ধমক দিয়ে আমি তাকে বললাম, শান্ত ভাবে সব গুছিয়ে আমাকে বলুন আপনার জীবনে কি ঘটেছিল।
তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু, নার্স, তুমি আমাকে এমন বোঝাচ্ছ যেন আমি দু বছরের বাচ্চা মেয়ে। যাইহোক, আমি তোমাকে বলব, সব খুলে বলব।
এই তো ভাল মেয়ের মতো কথা হল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম।
তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, এবার শান্ত এবং সংযত তার কণ্ঠস্বর। কোন তাড়াহুড়া নেই, কোন আবেগ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। মিসেস লিডনার এখন অন্য মানুষ, অন্য মন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন।
কুড়ি বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় একজন প্রতিষ্ঠিত যুবকের সঙ্গে। তখন ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ হবে।
জানি, আমি বললাম, মিসেস মারকাডো আমাকে বলেছেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান।
কিন্তু, মিসেস লিডনার মাথা নেড়ে আপত্তি জানালেন।
কিন্তু বলে থেমে গেলেন কেন? আমার কেমন কৌতূহল হল।
উনি যা ভেবে থাকেন। শুধু উনি কেন বলছি, সবাই ওই একই কথা ভেবে থাকে আমার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। জানো নার্স, সেই বয়সে আমি তখন ভীষণ দেশপ্রেমিক উৎসাহী মেয়ে ছিলাম। আমি আমার আদর্শের একচুল বাইরে যেতাম না। বিয়ের কয়েক মাস পরে এক আকস্মিক ঘটনায় আমি জানতে পারি, আমার স্বামী জার্মানদের একজন বেতনভুক গুপ্তচর ছাড়া আর কিছু নয়। তখন আমার কাছে একটা খবর ছিল, আমার স্বামী একটা গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান জাহাজ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সফল হলে বেশ কয়েকশো লোকের সলিল সমাধি হওয়ায় সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমি জানি না সেই অবস্থায় পড়লে অন্য কোন স্ত্রী দেশপ্রেমিক হিসাবে কি করতে তখন। তবে আমি কি করেছিলাম সেদিন তাই তোমাকে বলছি। সরাসরি আমি বাবার কাছে গেলাম, তিনি তখন যুদ্ধ বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁকে আমি সব খুলে বললাম, কিছুই গোপন করলাম না। এমন কি স্বামী হিসাবেও কোন দুর্বলতা প্রকাশ করা নয়, তখন আমার মানসিকতা ঠিক এরকমই ছিল এই ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছিলাম। ফ্রেডরিক যুদ্ধে নিহত হয় পরবর্তীকালে, –কিন্তু আমার কাছে আরো একটা খবর ছিল, আমেরিকায় গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।