হ্যাঁ, আমি তা বিশ্বাস করি। আসলে ডঃ রেলিই ওকে নষ্ট করেছেন, শীলার কোন দোষ নেই।
আমার তাতে কোন দ্বিধা নেই। কারণ দুদিন আমি হাতে হাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।
প্রথমতঃ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে ল্যাবোরেটরি থেকে কিছু রাসায়নিক তরল পদার্থ আনতে যাই। মিঃ মারকাডো তখন আরাম কেদারায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েছিলেন, চোখ-মুখ দেখে মনে হয়েছিল, তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমি তাকে বিব্রত করতে চাইনি। তাই নিঃশব্দে আমি আমার কাজ হাসিল করে চলে আসি।
সেইদিনই সন্ধ্যায় আমাকে অবাক করে দিয়ে মিসেস মারকাডো কৈফিয়ত চাইলেন আমার কাছ থেকে।
তুমি কি ল্যাবোরেটরি থেকে অ্যাসিডের বোতলটা নিয়ে এসেছো?
হ্যাঁ, আমি বললাম, নিয়েছি বৈকি।
কেন, তুমি তো বেশ ভাল করেই জানবে, ওই অ্যাসিডের একটা ছোট্ট বোতল সব সময় মজুত থাকে অ্যান্টিকরুমে। বেশ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বললেন তিনি।
তাই নাকি? আমি তো জানতাম না।
জানতে না বললেই হবে। তুমি ঠিকই জানতে। মুখ ঝামটা দিয়ে মিসেস মারকাডো অভিযোগ করেন, আসলে তুমি গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসেছিলে। আমি জানি হসপিটাল নার্সদের স্বভাবই এই রকম।
অবাক চোখে আমি তার দিকে তাকালাম।
মিসেস মারকাডো, আপনি কি যে বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বললাম, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, কারোর উপর গোপনে নজর রাখার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, এখনও নেই।
হ্যাঁ ছিল এবং এখনও আছে। তুমি কি মনে করো, আমি কিছুই জানি না? এখানে তোমার আসার উদ্দেশ্যটা যে কি, ভেবেছো তা আমি কিছুই জানি না!
বলেন কি ভদ্রমহিলা! আমি স্তব্ধ; হতবাক! সত্যি, মিনিট দুই-তিন নীরবে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, ভদ্রমহিলা ড্রিঙ্ক করেননি তো? কোন কথা আর না বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিন্তু আমি ভাবলাম, এভাবে চুপচাপ চলে আসাটা কেমন বেমানান।
কোনদিকে না তাকিয়ে আমি তখন দ্রুত পা চালিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে নজরে পড়ল, ফাদার ল্যাভিগনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং সঙ্গে আর একজন। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমি উপলব্ধি করলাম, আমার সেই দ্বিতীয় আবিষ্কার হল মিসেস লিডনার, আমার মনে পড়ল ইনিই বোধহয় সেদিন জানালায় উঁকি মারছিলেন।
আপনাদের আমি ঠিক দেখতে পাইনি, ক্ষমা চাইতে গেলে ফাদার ল্যাভিগনি হাসলেন। তারপর মিসেস লিডনার-কে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলেন।
শোন, আমি খুবই লজ্জিত। তিনি বললেন, আমি একজন ওরিয়েন্টাল ভাষার ছাত্র, কিন্তু এইসব ভাষায় শিক্ষারত ছাত্ররা কেউই আমাকে বুঝতে চায় না। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, আরবি ভাষা শিখছিলাম, কিন্তু খুব বেশি সফল হইনি। তবে লিডনার বলে আমার আরবি ভাষা নাকি খুবই খাঁটি।
সেই রাতটা আমাদের দারুণ আতঙ্কের রাত।
তখন প্রায় রাত দুটো হবে। আমার ঘুম খুব পাতলা, সব নার্সদের যা হয়ে থাকে। ঘুম থেকে জেগে উঠে সবে বিছানায় উঠে বসেছি, সেই সময় আমার ঘরের দরজা খুলে গেল।
নার্স! নার্স!
মিসেস লিডনারের আর্ত চিৎকার বাতাসে ভেসে আসে। দেশলাই জ্বেলে মোমবাতি জ্বালালাম।
দরজার ওপারে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস লিডনার। ভয়ার্ত চোখ, কাঁপা ঠোঁট। পরনে নীল ড্রেসিং গাউনটা থরথর করে কাঁপছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন নীল আকাশে হঠাৎ বিদ্যুতের চমক।
আমার পাশের ঘরে হয়তো কেউ ঢুকেছে–তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে আমি শুনেছি।
কথাটা শোনা মাত্র আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তার কাছে ছুটে গেলাম। এই তো আমি আপনার কাছে এসে গেছি ম্যাডাম, আপনার আর ভয় কিসের? আমি তাকে আস্বস্ত করতে বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরিককে ডাকো, ফিসফিসিয়ে বললেন তিনি।
মাথা নেড়ে আমি তাড়াতাড়ি ছুটে যাই ডঃ লিডনারের দরজায় টোকা মারার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি এসে হাজির হলেন আমাদের মধ্যে। মিসেস লিডনার তখন আমার বিছানায় বসেছিলেন। তার বুকের ওঠা নামা ক্রমশঃ দ্রুত হচ্ছিল।
আমি তাকে– মিসেস লিডনার বলতে থাকেন, আমি তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে শুনেছি।
মনে হয় অ্যান্টিক-রুমে কেউ ঢুকেছে, ডঃ লিডনার চিৎকার করে উঠলেন। বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ, হা হঠাই আমার মনে খটকা লাগল, মিসেস লিডনারের ভয়টা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, কিন্তু ডঃ লিডনারের চিন্তা-ভাবনা তখন তার সংগ্রহশালার জন্য।
অ্যান্টিক-রুম! মিসেস লিডনার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাইতো! সত্যি আমি কি বোকা বলো তো?
মিসেস লিডনার এবার বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন।
তারপর আমরা অ্যান্টিকরুমে গেলাম ডঃ লিডনার এবং ফাদার ল্যাভিগনির সন্ধানে। ফাদার ল্যাভিগনিও নাকি শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, সেই সঙ্গে অ্যান্টিকরুম থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু পায়ে চটি, গলাতে গিয়ে এবং টর্চ খুঁজতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে এসে তেমন কোন বিসদৃশ্য তার চোখে পড়েনি, কোন অচেনা লোককে দেখতে পাননি সেখানে। তাছাড়া ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল, যেমন সাধারণত থেকে থাকে।
একটু পরে ডঃ লিডনার এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনিও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যখন কোন কিছু চুরি যায়নি কিংবা ক্ষতি কিছু হয়নি,অতএব সেখানে বাইরের কারোর প্রবেশ ঘটতে পারে না।