বিল কোলম্যান, ডেভিড এমোট; এদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তাদের কথার মধ্যেও সেই অজানা রহস্যের একটি প্রচ্ছন্ন আভাস, আমি অনুভব করেছি। কিন্তু তাদের কথায় রহস্যের কোন সূত্র আমি খুঁজে পাইনি এখনও পর্যন্ত।
বরং মিস জনসনের আলোচনার উপর আলোকপাত করলে বোধহয় ভাল হয়। তাকে আমার খুব পছন্দ। ও একজন দক্ষ, বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমতী মহিলা। ডঃ লিডনারকে গুরুর মত শ্রদ্ধা করে।
এই উপলক্ষে ডঃ লিডনারের জীবনের কাহিনী আমাকে শোনায় মিস জনসন, একেবারে তার ছেলেবেলা থেকে। মিস জনসন জানে কোথায় কোথায় তিনি খনন কার্য চালিয়েছিলেন এবং সেই সব খনন কার্যের ফলাফলও ওর বেশ ভাল জানা আছে। মিস জনসন তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা শুনেছে। ও আমাকে বলেছে, ডঃ লিডনারের মতো অমন জ্ঞানী-গুণি প্রত্নতত্ত্ববিদ খুব কমই চোখে পড়ে থাকে।
সত্যি উনি এতই সরল প্রকৃতির মানুষ যে, আমি ওঁর মধ্যে কখনো অহঙ্কার দেখতে পাইনি, আত্মগর্বে উৎফুল্ল হতে দেখেনি ওঁকে। কেবল মহান ব্যক্তিরাই এমন সহজ সরল হতে পারে।
সে কথা ঠিক, আমি বললাম, মহান ব্যক্তিরা নিজেদের ঢাক নিজে পেটায় না। কিংবা এ ওর পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া কথা কখনও বলে না।
শুধু কি তাই? ওঁর মতো অমন মিশুকে তোক বোধহয় হয় না। হাল্কা মন নিয়ে তিনি কথা বলতেন আমার এবং রিচার্ড ক্যারির সঙ্গে। ওঁর সংস্পর্শে এসে আমরা সবাই খুব সুখী। রিচার্ড ক্যারি ওঁর সঙ্গে প্যালেস্টাইন থেকে কাজ করছে, তা প্রায় দশ বছরের বন্ধুত্ব ওঁর সঙ্গে। আর ওঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সাত বছরের।
সুপুরুষ চেহারা মিঃ ক্যারির, আমি বললাম, কিন্তু বড় সে শান্ত, স্বল্পভাষী, তোমার তা মনে হয় না?
ওরকম হবার কথা নয় তার, আগেও এরকম ছিল না সে, মিস জনসন তাড়াতাড়ি বলে, এই কেবল সেদিন কথাটা অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ ও চুপ করে গেল।
কেবল সেদিন মানে? আমি ওর কথার পুনরাবৃত্তি করে জিজ্ঞাসা করলাম।
ও হ্যাঁ– মিস জনসন তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, আজকাল কত ভাল ভাল জিনিস কেমন সহজে বদলে যাচ্ছে এই আর কি।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। মিস জনসন নিজের থেকেই তার কথার জের যে টানবে, আমি তা জানতাম এবং হলও তাই।
আমি একজন রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের লোক। এক এক সময় আমি ভাবি, প্রত্মতত্ত্ববিদের স্ত্রীরা সত্যি যদি আগ্রহান্বিত না হয়, তাদের উচিত নয় স্বামীদের সঙ্গে এ ধরনের অভিযানে আসা। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর মনোমালিণ্যের কারণ ঘটতে পারে।
মিসেস মারকাডো– আমি জানতে চাইলাম।
ওঃ উনি! মিস জনসন অতি সাবধানে মিসেস মারকাডোর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি এখন আমার মিসেস লিডনারের কথা ছাড়া অন্য কারোর, কথা মনে পড়ে না। আকর্ষণীয় মহিলা। ওঁকে যে কেউ একটিবার দেখলেই বুঝতে পারবে, ডঃ লিডনার কেন ওঁর প্রেমে পড়েছিলেন?
তবে শেষ পর্যন্ত মিসেস লিডনারই এই অবিশ্বাস্যপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য যে দায়ী মিসেস কেলসির সঙ্গে মিস জনসন একমত হল এ ব্যাপারে।
তারপর একটু ভয়ে ভয়ে মিস জনসন বলে, আমি নিশ্চয়ই তার প্রশংসা করব। চমৎকার মহিলা উনি।
সেই পুরনো খেলা, কেন জানি না আমার মনে হল, মেয়েরাই বোধহয় মেয়েদের পরম শত্রু। কোন মেয়ের বাড়বাড়ন্ত হলে অন্য মেয়েদের হিংসা হয়, কারণে অকারণে তারা তখন তার খুঁত খোঁজে কি করে তাকে অপদস্থ করা যায়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিস জনসন খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ও ওর প্রধানের স্ত্রীকে পছন্দ করে না (এবং সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক), এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তাহলে ধরে নিতে পারি, মিসেস লিডনারকে দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন মিসেস মারকাডো।
আর একজন যিনি মিসেস লিডনারকে পছন্দ করেন না, তিনি হলেন শীলা রেলি। একবার কি দুবার আমি তাকে দেখেছি। তাতেই আমার মনে হয়েছে সেই শান্ত নীরব আমেরিকান যুবক এমাটের উপর শীলার দুর্বলতা আছে। এমাট অন্য কারোর সঙ্গে খুব বেশি কথা না বললেও শীলার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যায়। মনে হয় এমাটও বোধ হয় শীলার প্রতি অনুরক্ত।
একদিন মধ্যাহ্বতভাজের সময় মিসেস লিডনার ওদের রাগ-অনুরাগ পর্বের উপর মন্তব্য করেন।
রেলির মেয়েটি এখনও ডেভিডের মন জয় করতে ব্যস্ত। একটু হেসে তিনি আবার বলতে থাকেন, বেচারা ডেভিড।
মিঃ এমাট উত্তর দিলেন না। কিন্তু তার মুখটা কেমন টান-টান হয়ে গেল। থরথর করে তার লাল মুখটা কাঁপতে থাকে। চোখ তুলে তাকালেন মিসেস লিডনারের দিকে। মিঃ এমাটের মুখে চোখে এক অস্বাভাবিক কৌতূহল। মিসেস লিডনারের চোখে সোজা-সুজি দৃষ্টি রেখে তিনি যেন তার কাছে চালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
মিসেস লিডনারের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি।
আমার মনে হল, ফাদার ল্যাভিগনি ফিসফিস্ করে কি যেন বলতে যান, কিন্তু আমি যখন বললাম, ক্ষমা করবেন, তিনি নিজের থেকেই কি ভেবে মাথা নাড়লেন এবং মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেন।
সেদিনই অপরাহ্নে মিঃ কোলম্যান আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, সত্যি করে বলতে কি মিসেস লিডনারকে গোড়ার দিকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে এখন আমি তাকে ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছি। তার মত দয়ালু মহিলার সঙ্গে এর আগে কখনো মিলিত হয়েছি বলে আমার মনে হয় না। শীলা রেলির সম্বন্ধে তিনি হয়তো তার ভালর জন্যই একটু কড়া সমালোচনা করে থাকবেন, কিন্তু শীলা তার ভদ্রতার সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়ে যেভাবে তার সঙ্গে দুতিনবার রূঢ় ব্যবহার করে, তার সঙ্গে কোন তুলনা হয় না। তখন মনে হয়েছিল ভদ্রতা বলে ও বোধহয় কিছু জানে না।