মিঃ ক্যারি এবং মিঃ কোলম্যান মাটি খোঁড়ার কাজে চলে যায়। আর মিঃ রেইটার তার ফটো স্টুডিওয় গিয়ে ঢোকে।
তা তুমি এখন কী করবে লুসি? ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নিলে ভাল হয়।
আমি শুনেছি, দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে থাকো।
ঘণ্টাখানেকের জন্য নেবো। তারপর কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বাইরে ঘুরতে যাব।
ভালোই তো। নার্সও তোমার সঙ্গে যাবে। যাবে না তুমি?
নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
না, না, মিসেস লিডনার বাধা দিয়ে বললেন, একা যেতে ভাল লাগে আমার। তাছাড়া নার্স না ভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা সে আমার ডিউটিতে আছে।
না, তাতে কি হয়েছে। আমি নিজেই তো যেতে চাইছি ম্যাডাম।
না, আমি চাই, তুমি যেন যেতে না চাও। কোন যুক্তি তর্ক মানতে চাননা তিনি।
অবশ্য আমিও খুব বেশি জোর করলাম না। কিন্তু ঘুমোবার আগে আমার কেমন সন্দেহ হল, মিসেস লিডনার দারুণ নার্ভাস, একটুতেই ভয় পেয়ে যান, সঙ্গী না নিয়ে কি করে তিনি একা একা ঘুরে বেড়ানোর সাহস পান?
যাই হোক, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর চায়ের টেবিলে আবার তার মুখোমুখি হলাম। এখন তাকে অনেকটা নরম বলে মনে হল। নিজের থেকেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নদীর ধারে আমার বেড়ানোর ইচ্ছা আছে কি না! এই মিসেস লিডনার আজ দুপুরে আমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেছিলেন, ওঁর সঙ্গে আমি যেতে না চাইলে তিনি খুব খুশি হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি
তারপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে, অনেক ঘোলা জল পরিষ্কার হয়েছে। মিসেস লিডনারের মনেও হয়তো বা! তিনি বুঝতে পেরেছেন, আমি তার কথায় আঘাত পেলেও পেতে পারি। তাই তিনি জানতে চাইলেন, আমি তার কথায় রাগ করে বসে আছি কিনা।
কিন্তু আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, নার্সদের অমন ঠুককো সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না এবং আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।
অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু উধাও হয়ে গেল নদীর উপর থেকে। একটু পরেই একটা সুন্দর সন্ধ্যা নেমে এল সেখানে।
প্রথমে পথের দু ধারে বার্লির খেত তারপর কিছু ফল আর ফুলের বাগান পেরিয়ে অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম টাইগ্রিস নদীর ধারে। আমাদের ঠিক পাশেই তেল শ্রমিকরা তাদের অদ্ভুত করুণ সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছে।
এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অপূর্ব, তাই না? মিসেস লিডনার আমার দিকে তাকালেন।
আর জায়গাটা ভারি শান্তিপ্রিয়, প্রত্যুত্তরে বললাম, মনে হয় যে কোন জায়গা থেকে এ অনেক, অনেক দূরে।
হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সেই সঙ্গে নিজের একটা মন্তব্য জুড়ে দিলেন, এখানে অন্তত যে কেউ নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করতে পারে।
চকিতে তার দিকে আমি ফিরে তাকালাম। কিন্তু আমার মনে হল তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার থেকে নিজের সঙ্গে নিজের কথাই বেশি বলছেন যেন। তিনি বুঝতেও পারছেন না যে, তাঁর মনের কথাটা ফাস হয়ে পড়ছে।
এবার ঘরে ফেরার পালা। আমাদের পথ চলা আবার শুরু হল।
হঠাৎ মিসেস লিডনার এমন সজোরে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম।
কে ওখানে নার্স? কি করছে ওখানে?
অদুরে পথটা এক্সপিডিসন হাউসের গা ছুঁয়ে যেখান দিয়ে গেছে, ঠিক সেখানে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল, পরনে তার ইউরোপীয় পোশাক, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বুঝি পায়ের আঙুলের ডগার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং একটি জানলা পথে উঁকি মারার চেষ্টা করছিল।
আমাদের চোখে তার চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করল। ওদিকে আমি অনুভব করলাম, মিসেস লিডনার আমাকে ক্রমশ শক্ত করে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন।
নার্স, আমার কানে তার ফিসফিস্ শব্দ রিমঝিম বৃষ্টি পড়ার মত শোনায়, নার্স শুনছ?
সব ঠিক আছে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে, আমি তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম, আপনি ঘাবড়াবেন না।
লোকটা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ইরাক দেশের লোক সে। কাছ থেকে লোকটাকে দেখে মিসেস লিডনার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
যাইহোক, ইরাকের লোক বই তো আর কিছু নয় সে। মিসেস লিডনারের মুখের ওপর থেকে ভাবনার মেঘটা কেটে গেছে তখন।
এক্সপিডিসন হাউসের কাছ দিয়ে যেতে গিয়ে জানালাগুলো দেখলাম ভাল করে। লোহার গরাদ দেওয়াই শুধু নয়, জানালাগুলো খুবই উঁচুতে রাস্তা থেকে। জানালার ওপারে কিছু দেখতে যাওয়া বোকামো।
আমার মনে হয়, এটা একটা মামুলি কৌতূহল ছাড়া আর কিছু নয়, আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। মিসেস লিডনার মাথা নাড়লেন।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু এক লহমায় আমি ভেবেছিলাম– কি যেন বলতে গিয়ে চেপে গেলেন তিনি।
আমার কেমন সন্দেহ হল। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা আপনি তখন কী ভেবেছিলেন বলুন তো? আমার জানতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কী ভেবেছিলেন বলুন তো?
মুখে তিনি কিছু না বললেও আমি তখন একটা কথা বেশ স্পষ্ট ভাবে জেনে গেছি মিসেস লিডনার নিশ্চয়ই একজন কাউকে দারুণভাবে ভয় করে থাকেন।
.
০৮.
নৈশ বিপদ সংকেত
আমার এখানে আসার পর এক সপ্তাহে ঠিক কী কী ঘটেছে সেগুলো মনে করা একটু কষ্টসাধ্য। পিছনের দিকে ফিরে তাকালে অনেক ছোট-খাটো ভাল ভাল লক্ষণ আমি দেখতে পাই, তবে প্রথমদিকে আমি অন্ধ ছিলাম। যাইহোক, এ কাহিনীর সঠিক বিবরণ দিতে হলে মনে হয় সর্বাগ্রে আমার কৌতূহলগুলো মেটানো উচিত। বিশেষ করে যেসব কৌতূহল আমাকে ধাঁধায় ফেলেছে, অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে এবং আমায় বুঝতে শিখিয়েছে, এ কাহিনীর আড়ালে একটা কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।