কথায় কথায় তিনি আমাকে জানালেন, আমার এখানে আসাটা নাকি বিস্ময়কর ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত তিনি তো বলেই ফেললেন, আচ্ছা মিসেস লিডনার সত্যি কি তাহলে অসুস্থ?
না, ঠিক অসুস্থ নন। বেশ সতর্কতার সঙ্গে কথাটা বলতে হল।
অদ্ভুত মহিলা উনি। তিনি বললেন, তাছাড়া আমার মনে হয়, উনি বিপজ্জনকও বটে।
এ কথার অর্থ কী? পাল্টা প্রশ্ন করলাম, বিপজ্জনক? কি রকম বিপজ্জনক?
চিন্তিত ভাবে তিনি মাথা নাড়লেন।
বড় বেশি নির্দয় তিনি। একটু থেমে তিনি তার নিজের কথার সমর্থনে আবার বললেন, হ্যাঁ, অত্যন্ত নিষ্ঠুর তিনি।
আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার মুখে চোখে অবরুদ্ধ বিরক্তির ঝঝ ফুটিয়ে বললাম, এ আপনার অন্যায় অভিযোগ। ওঁর সম্বন্ধে এ আপনার অবান্তর কথাবার্তা।
মাথা নাড়লেন তিনি।
মেয়েদের আমি যতটা জানি তার থেকে বেশি তুমি জানো না।
মজার ব্যাপার, আমি ভাবলাম, একজন সন্ন্যাসীর মুখ থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনব, আমি ভাবতেও পারিনি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও ভাবলাম, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক তথ্য জেনে থাকবেন। কিন্তু একজন সন্ন্যাসী হয়ে তিনি যে এইসব ঘরোয়া কথায় কান দেবেন, সেটাও কেমন অবিশ্বাস্য লাগে আমার কাছে।
হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা, ফাদার ল্যাভিগনি গভীরভাবে চিন্তা করে বললেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে আমি এ কথাও বলতে পারি, তার মনটা পাথরের মতো কঠিন হলেও একটা ব্যাপার তিনি কিন্তু দারুণ ভীত। এখন জানতে হবে, তার সেই ভয়ের কারণটা কী?
হ্যাঁ, আমরা সবাই উদগ্রীব সেই কারণটা জানবার জন্য। আমার ধারণা, তাঁর স্বামী ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তির সেই কারণটার কথা জানার কথা নয়।
ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে। আমার ধারণা– হঠাৎ তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন, বোধহয় ডঃ লিডনার নিজেও সে কথা জানেন না। কোন একটা ব্যাপারে তিনিও বেশ চিন্তিত।
তার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে?
হয়তো সেজন্য হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। কি সেই কেমন করে আমি বোঝাব এ যে ভীষণ অস্বস্তিবোধ—
হ্যাঁ, সে কথা অবশ্য ঠিক। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ, একটা অস্বস্তিবোধের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছি আমরা সবাই।
তারপর আর কোন কথা বলা গেল না, কারণ মিঃ লিডনারকে সেই দিকেই আসতে দেখলাম। তখন সবে মাত্র একটা শিশুর কবর আবিষ্কার হয়েছিল, তিনি আমাকে দেখালেন শিশুর সেই কবরটা। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। ছোট ছোট হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো।
কিছুক্ষণ পরে ডঃ লিডনার জানালেন, তিনি বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন চা-পিপাসা নিবারণের জন্য।
মিসেস লিডনারকে আজ একটু ভালো দেখাচ্ছিল, সেই ক্লান্ত, রোগাটে ভাবটা আর নেই। বলতে গেলে চা একরকম তৈরিই ছিল। চায়ের আসরে ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে আজকের আবিষ্কারের বিবরণ দিলেন সংক্ষেপে, তারপর তিনি তার কাজে ফিরে গেলেন।
তারপর মিসেস লিডনার আমাকে সেই চোরাকুঠুরীতে নিয়ে গেলেন সংগৃহীত জিনিসগুলো দেখানোর জন্য। অধিকাংশই জিনিসই ভগ্নঅবস্থায় পড়েছিল এখানে।
আচ্ছা, এই ভাঙ্গা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রেখে লাভ কি বলুন? এর কি মূল্যই বা আছে?
হাসলেন মিসেস লিডনার। এরিককে তুমি তো চেনো না। এই সব ভাঙ্গা মাটির বাসনপত্র ওঁর কাছে অনেক মূল্যবান। প্রায় সাত হাজার বছর আগেকার পুরানো সব। যা কিছু পুরাতন, ওঁর কাছে বরণীয় সব। একটু থেমে তিনি বলেন, এসো, এবার তোমাকে একটা বিস্ময়কর জিনিস দেখাই। দেখে তুমি চমকে উঠবে নিশ্চয়ই।
শেল্ফের উপর থেকে একটি বাক্স নামালেন তিনি। তারপর সেই বাক্সের ডালাটা খুলতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি।
সোনার ছোরা, নীল পাথর ঘটি ও হাতল।
এ যে দেখছি সোনার ছোরা?
হাসলেন তিনি, হ্যাঁ, সবাই সোনা পছন্দ করে, কেবল আমার স্বামী ছাড়া।
কিন্তু ডঃ লিডনারের পছন্দ না করার কারণটাই বা কি থাকতে পারে মিসেস লিডনার?
প্রথমত সোনা জিনিসটা খুবই মূল্যবান। তাছাড়া শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তার বিনিময়ে কিছু মূল্য দিতে হয়।
কি আশ্চর্য, এর জন্য তাদের টাকা দিতে হবে কেন?
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। এর ফলে চুরির অভ্যাসটা ওরা ত্যাগ করতে পারে। ধরো, ওরা যদি ওই সোনার ছোরাটা চুরি করতো, তাহলে প্রত্মতাত্ত্বিক মূল্য বলতে কিছু থাকত না ওদের, সেক্ষেত্রে তারা এটাকে গলিয়ে ফেলতে পারত অনায়াসে। তাই আমি ওদের কিছু সৎ হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।
এর পর তিনি আর একটি ট্রে শেল্ফ থেকে নামিয়ে আনলেন। এবং সত্যি সত্যি অত্যন্ত সুন্দর একটি সোনার কাপ তিনি আমাকে দেখালেন। আমি আবার বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
হ্যাঁ, এটা সত্যি খুব চমৎকার জিনিস। তাই না? এ সবই পাওয়া গেছে রাজকুমারের কবরখানা থেকে। রাজপরিবারের অন্য আরো কবর আমরা আবিষ্কার করেছি বটে, তবে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ লুণ্ঠিত।
মিসেস লিডনারের চোখে ভ্রুকুটি। চোখের কাছে তুলে ধরা সেই সোনার কাপটা। নখ দিয়ে আঁচড় কাটেন উনি কাপটার উপরে।
কি আশ্চর্য! এই কাপটার উপরে মোমের ফোঁটা পড়ল কী করে? তাহলে মোমবাতি হাতে নিশ্চয়ই কেউ এখানে এসেছিল? মিসেস লিডনারের চোখে কালোছায়া।
বেলা বারোটায় মধ্যাহ্নভোজে আবার আমরা সবাই এক সঙ্গে মিলিত হলাম। তারপর ডঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো কিছু মাটির পাত্র পরিষ্কার করতে বসলেন। পরিষ্কার করার মাধ্যম হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। পরিষ্কারের পর সুন্দর কিশমি রঙের একটা পাত্র পাওয়া গেল, অপর একটি পাত্রের গা থেকে মাটি পরিষ্কারের পর ফুটে উঠল একটি ষাঁড়ের এক জোড়া শিং। সত্যি এ যেন যাদুমন্ত্রের বলে মাটির পাত্রগুলোর উপরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিত্র ফুটে উঠছে এক এক করে।