তারপর আমি নিজেকে বললাম, আমি লিথেরান, তুমি বোকা, মিসেস লিডনার বাচ্চা মেয়ে নয়, ইতিমধ্যে তিনি চল্লিশ পেরিয়ে এসেছেন। আর জীবন সম্বন্ধে ওঁর অভিজ্ঞতা কম নয়।
কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হল, বোধহয় সে অভিজ্ঞতা ওঁর নেই। এক এক সময় তার চোখে আতঙ্ক ভাব দেখে অন্তত তাই মনে হয় আমার।
সত্যি, কি তার জীবন! মাত্র দু বছর আগে ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এবং মিসেস মারকাডোর কথা মতো প্রায় পনেরো বছর আগে তার প্রথম স্বামীর মৃত্যু হয়।
ড. লিডনার আমার ঘরে এলেন, এই রকমই আমি চাইছিলাম। করমর্দন করে বললেন, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে। প্রথম সাক্ষাতেই ও তোমাকে আপন করে নিয়েছে, তাতে আমি খুব খুশি। আমার মনে হয়, এখন থেকে সব ঠিক ঠিক চলবে।
বাচ্চা ছেলের মতো আগ্রহ দেখালেন মিঃ লিডনার।
আমারও তাই মনে হয়, মিসেস লিডনার আমাকে তার আপনজন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু ডঃ লিডনারের মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আমি হতে পারছি না। আমার কি রকম একটা ধারণা হল, মিসেস লিডনারের ব্যাপারে উনি আরো অনেক কিছু জানেন, যা উনি প্রকাশ করতে চাইছেন না।
হয়তো কিছু, হয়তো এমন কিছু, যার হদিশ আমি পাচ্ছি না, কিন্তু বাতাসে তার আভাস আমি অনুভব করছি। পশমের মত নরম সুন্দর বিছানা, তবু সেই নিবিড় ঘুম যাকে বলে, ঠিক সেই ভাবে চোখের পাতা দুটো এক করতে পারলাম না। এরই মাঝে বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে কয়েকবার।
মনে পড়ে ছেলেবেলায় কীটসের কবিতার দুর্বোধ্য কথাগুলোর অর্থ জানবার জন্যে যে ব্যাকুলতা আমার হয়েছিল, ঠিক সেই রকম কৌতূহল এখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থ খুঁজতে গিয়ে বারবার আমি ব্যর্থ হই, মনটা খারাপ হয়ে যায়। এটা একটা এমনি কবিতা, যা আমি সব সময় ঘৃণা করে থাকি। আমি মনে করি এবং আমি বিশ্বাস করি, সেটা আমি চাই কি চাই না আগে আমায় জানতে হবে। যাইহোক, অন্ধকারে ঘুম থেকে জেগে উঠতেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা একটা অপূর্ব দৃশ্য যা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।
ওঃ কি যাতনা নাইট তোমার, নিঃসঙ্গ একাকী এবং (কি সেটা?) বিষণ্ণ মুখ খুঁজে বেড়াও………? সেই প্রথম আমার মনের আয়নায় সেই নাইটের মুখখানি প্রতিফলিত হতে দেখি, আর সেই মুখ মিঃ ক্যারির টান-টান, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, ঠিক এরকম মুখ আমি ছেলেবেলায় যুদ্ধের সময় বেচারা যুবকদের মধ্যে দেখে ছিলাম, যুদ্ধাতঙ্ক। তার জন্য আমার দুঃখ হল, একটু পরেই আমার চোখে ঘুম নেমে এল। স্বপ্নে আমি আবার দেখলাম, বেলি ডেন সান্ড মারসি যেন মিসেস লিডনার, অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করে একদিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন, হাতে এমব্রয়ডারি করা একগুচ্ছ ফুল এবং তারপর ঘোড়াটা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু ভয়ে আমার দেহের কাঁপুনি তখনও থামেনি।
.
০৭.
জানলায় মানুষের মুখ
আমার মনে হয় শুরুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার, এ কাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় কোন ঘটনা জড়িত নয়। স্বীকার করতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই, প্রত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান নেই, আর জানবার ইচ্ছাও তেমন নেই। মিঃ ক্যারি আমাকে বলতে শুরু করেছেন, আমার মধ্যে প্রত্মতাত্ত্বিকের মেজাজ নাকি দেখতে পায় না সে, সত্যি কথা বলতে কি তার ধারণা একেবারে মিথ্যা নয়।
আমার পৌঁছানোর পর দিনই ক্যারি জানতে চাইলেন, তার পরিকল্পিত পা্যলেস আমার দেখার ইচ্ছা আছে কিনা। কয়েক যুগ আগের ঘটনাকে আজ সে কি করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে সে কথা আমার অজানা, স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমার। স্বভাবতই সেই কাল্পনিক দৃশ্যটা দেখার কৌতূহল হওয়া আমার স্বাভাবিক। তাই আমি তাঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম, সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমি নিজেই খুব উৎসাহিত বোধ করছিলাম। প্রায় তিন হাজার বছর আগের পুরনো প্যালেস, তখনকার দিনের প্যালেস কি রকম হতে পারে, সেটা দেখাই আমার একমাত্র কৌতূহল। তুতানখামেনের ছবিতে সে দৃশ্য আমি দেখেছিলাম, সেটা চাক্ষুস দেখার সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। কিন্তু আমাকে দারুণভাবে হতাশ হতে হল। বিশ্বাস করা যায়, সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু না? দু’ফুট উঁচু মাটির দেওয়াল, প্যালেসের ধ্বংসাবশেষ বলতে এই পর্যন্ত। তবু বেশ উৎসাহ নিয়ে মিঃ ক্যারি আমাকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বোঝাতে থাকে, ওটা একটা বিরাট আদালত, ওখানে কতকগুলো চেম্বার, দোতলা ঘর, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমার তখন কেবল একটাই চিন্তা, ও কি করে জানল এত সব? খুব মার্জিত ভাবেই প্রশ্নটা রাখলাম তার কাছে। ওরা যে যাই বলুক, আমি কিন্তু খুব নিরাশ হয়েছি ওদের কাজকর্ম দেখে। সমস্ত খননকার্য আমার কাছে মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু বলে মনে হয়নি। কোথায় সেই মার্বেল পাথরের সৌধ, সোনার কারুকার্য কিংবা, সুদৃশ্য কিছু দর্শনীয় বস্তু? ক্রীলউডে আমার কাকীমার বাড়িতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখানে কোথায় সেই অ্যাসিরিও বাসীদের জীবন-ধারার প্রামাণ্যচিত্র, যাদেরকে রাজা বলে আখ্যা দেওয়া হতো?
অবশিষ্ট মাটির ঢিবিগুলো আমাকে দেখানোর ভার সে তুলে দিল ফাদার ল্যাভিগনির হাতে। ফাদার লাভিগনি একজন বিদেশী, তার ওপর তিনি একজন সন্ন্যাসী এবং গম্ভীর প্রকৃতির লোক বলে তাঁর সম্বন্ধে আমার একটু জড়তা ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে মিশতে গিয়ে আমার মনে হল, তিনি অতিশয় সদাশয় ব্যক্তি, যদিও তিনি আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট।