মিসেস মারকাডো চকিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন :
আচ্ছা নার্স, তোমার কি মনে হয় না, ওঁর চেহারাটা রীতিমত রোমান্টিক ধাঁচের। এমন মেয়ের জীবনে অনেক কিছু ঘটতে পারে।
কেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওঁর জীবনে তেমন কোন ঘটনা ঘটেছে নাকি?
ওঁর প্রথম স্বামী যুদ্ধে যখন নিহত হন এখন ওঁর বয়স মাত্র কুড়ি। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক, এবং বড় রোমান্টিক, তাই না?
হ্যাঁ, এক হিসাবে রাজহংসী এবং রাজহংসও বলা যেতে পারে।
কি উদ্ভুত উপমা? মিসেস মারকাডো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু তখন ছাদের উপর থেকে বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার জেঁকে বসতে যাচ্ছে। আমি বললাম, এবার আমাদের নিচে নেমে যাওয়া উচিৎ। মিসেস মারকাডো আমার কথায় সায় দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি ল্যাবরেটরি দেখতে চাই কিনা! আমার স্বামী এখন সেখানে আছেন আলাপ হয়ে যাবে।
ল্যাবোরেটরিতে আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু বড় ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। মিসেস মারকাডো ল্যাবোরেটরি ঘুরিয়ে দেখালেন আমাকে, কিছু দামী যন্ত্রপাতি, আমার গহনাপত্র, মোম লাগানো হাড়ের কয়েকটা টুকরো।
কিন্তু জোসেফ কোথায় যেতে পারে? মিসেস মারকাডো স্বগোতক্তি করলেন।
ড্রয়িং অফিসেও নেই। সেখানে ক্যারি তার কাজে ব্যস্ত ছিল। আমরা সেখানে ঢুকতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সে আমাদের দিকে। তার সেই অদ্ভুত ধরনের চাহনি আমাকে বিস্ময়ের আবর্তে ফেলে দিল যেন। এই লোকটি তার নিজস্ব ক্ষমতার একেবারে শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। খুব শিগগীর একটা কিছু ঘটবে নিশ্চয়ই। আমার মনে হয় অন্য
কেউ নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমনি একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করে থাকবে।
চলে আসার সময় আমি আর একবার ফিরে তাকালাম তার দিকে। তখন সে তার কাগজের উপর ঝুঁকে কি যেন নিরীক্ষণ করছিল, শক্ত করে চেপে ধরে রাখা ঠোঁট, না বলা কথার মধ্যে যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে। হয়ত এ রকমই তার অভিব্যক্তি। কিন্তু সে যাই হোক, আমার ধারণা এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে, সে যেন কোন এক বয়স্ক নাইট, যুদ্ধে যাচ্ছে এবং সে জেনে গেছে তার মৃত্যু অনিবার্য।
তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে আমার আর একবার মনে হল, সত্যি মানুষকে আকর্ষণ করার কি অদ্ভুত ক্ষমতাই না আছে তার মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত বসবার ঘরে মিঃ মারকাড়োকে পাওয়া গেল। তিনি তখন নতুন কোন গবেষণার কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলেন মিসেস লিডনারের সঙ্গে। মিসেস লিডনার একটা সাধারণ কাঠের চেয়ারের উপর বসেছিলেন। আর একবার আমি অবাক হলাম তার সেই পোশাক ও অদ্ভুত হাল্কা শরীরটা দেখে। দূর থেকে তাকে তখন ঠিক পরীর মতো দেখাচ্ছিল, রূপকথার দেশের রাজকন্যা আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে, রক্তে-মাংসে গড়া দেহের থেকেও বেশি সুন্দরী তিনি।
মিসেস মারকাডো হৈ-হৈ করে ছুটে গেলেন, ওহো জোসেফ তুমি এখানে। আমরা ভেবেছিলাম, তোমাকে ল্যাবোরেটরিতে দেখতে পাব।
লাফিয়ে ওঠেন জোসেফ, স্ত্রীর দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে তোতলাতে তোতলাতে বলতে থাকেন, আমাকে এখন যেতেই হবে। আমি এখন মাঝখানে– কথাটা তিনি সমাপ্ত করলেন না, তবে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
মিসেস লিডনার তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অলসভাবে বললেন, অন্য কোন এক সময় তুমি তোমার কথা শেষ করো, শুনতে আমি খুব আগ্রহী। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন। ওঁর হাসিটা কেমন কৃত্রিম বলে মনে হল।
মিনিট দু’এক পরে মিসেস লিডনার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ওই বুকশেকে কয়েকটা নির্বাচিত বই রেখেছি, ওগুলোর মধ্যে একটা বই পছন্দ করে নিয়ে এসে বসে পড়।
বুকশেলফের দিকে আমাকে যেতে দেখে মিসেস মারকাডো একবার আমার দিকে। তাকিয়েই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চকিতে তিনি আমার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন, সেই মুহূর্তটুকু সময়ের মধ্যে মিসেস মারকাডোর মুখটা দেখতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। রাগে থম থম্ করছে মুখ, চোখে হিংস্র চাহনি। মিসেস কেলসির কথা মনে পড়ল, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে তিনি আমাকে মোটামুটি এ ধরণের একটা আভাস অবশ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন আমি তার কথায় আমল দিইনি। এখন যে দিই তা নয়। মিসেস লিডনারকে আমি পছন্দ করে থাকি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও মনে হল, তাদের বক্তব্য কি একেবারে উড়িয়ে দেবার, এতটুকু সত্যের অবকাশ কি নেই তার পিছনে?
তবে মিসেস লিডনারের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু কুরূপা মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডোকে সে কথা বোঝানো যায় না, সব সময় তাঁরা যেন অগ্নিশর্মা, মিসেস লিডনারের কথা কিছু বললেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
বেচারা মারকাডো। আমার মনে হয় না, মিসেস লিডনার এ নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন মনে করেন, কিন্তু মিসেস মারকাডো সত্যি সত্যি মনে করেন, মিসেস লিডনারের তার স্বামীকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়, হাজার হোক তিনি পরস্ত্রী মারকাডোর কাছে।
আমার মনে হল, মিসেস লিডনারকে একটু সাবধান করে দিলে কেমন হয়। ওঁর দিকে তাকালাম, উনি তখন ওঁর হাতের সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। আমার আরো মনে হল, ওঁকে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ, মানুষ হিংসার বশে যে কোন জঘন্য নিষ্ঠুর কাজ করে বসতে পারে। অতএব ওঁর এখন এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয়, যাতে করে ওঁর শত্রুরা তার সুযোগ নিতে পারে।