লাঞ্চের পর ডঃ রেলি হাসপাতালে চলে গেলেন। তার দেখাদেখি মিঃ কোলম্যান শহরের পথে চলল কিছু কেনাকেটা করার জন্য। মিস রেলি জানতে চাইল, শহর ঘুরে দেখতে আমি যাব কিনা, নাকি বাড়িতে বিশ্রাম নেব। সে আরো বলল, মিঃ কোলম্যান তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসবেন।
দেখবার কিছু আছে এখানে?
কতকগুলো ছবির প্রদর্শনী আছে, মিস রেলি সঙ্গে সঙ্গে বলল, তবে আমার মনে হয় না সেগুলো তোমার পছন্দ হবে। কারণ অত্যন্ত নোংরা সেগুলো।
ওর কথাটা কাটার মতো বিধল আমার কানে। ওর এ কথা বলার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না। এ ব্যাপারে ও আমার পছন্দ অপছন্দের কথা জানল কী করে। অন্তত আমি তো ওকে বলিনি।
একেবারে শেষে ও আমাকে ক্লাবে নিয়ে গেল। সামনেই নদী, জলের ক ক শব্দ ভেসে আসছিল হাওয়ায়। ইংরাজি পত্র পত্রিকা চোখে পড়ল সেখানে।
বাড়ি ফিরে এসে মিঃ কোলম্যানকে দেখতে পেলাম না। তাই কি করি! ফিরে দুজনে আবার গল্প করতে বসলাম। তবে কথাবার্তা খুব একটা সহজভাবে এগুলো না। শীলা জানতে চাইল, এখনো পর্যন্ত মিসেস লিডনারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কি না।
‘না’, প্রত্যুত্তরে বললাম, তার স্বামীর সঙ্গে কেবল দেখা হয়েছে।
ও, তাই বুঝি, শীলা বলে, জানি না মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে কী তুমি ভাবছ?
ওর এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমি দিলাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবার নিজের থেকেই বলতে লাগল, ডঃ লিডনারকে আমি খুব পছন্দ করি। সবাই তাকে পছন্দ করে থাকে।
তার মানে তার স্ত্রীকে তুমি পছন্দ করো না। উত্তরে এই কথাটা আমার বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু এর পরেও আমি আগের মতোই নীরব রইলাম। এবার ও আকস্মিক ভাবে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস লিডনারের কী ব্যাপার বলো তো? ডঃ লিডনার কিছু বলেছেন তোমাকে?
আমি আমার রুগিনীকে এখন পর্যন্ত চোখে দেখিনি, না দেখার আগেই তার সম্বন্ধে খোশগল্পে মেতে উঠতে আমি রাজী নই। তাই কৌশলে তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, শুনেছি ভগ্ন-স্বাস্থ্য ওঁর। দেখাশোনা করার জন্য ওঁর লোক দরকার। হাসল শীলা, ওর সেই হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল।
ভাল, ভাল, তেমনি বিশ্রী হাসি হাসতে হাসতে ও বলল, নজন লোক তার দেখাশোনা করছে এখন, সেটাই কী যথেষ্ট নয়?
আমার মনে হয় তারা যে যার কাজে ব্যস্ত।
যে যার কাজে ব্যস্ত? অবশ্যই তাদের কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা হয় বৈকি। কিন্তু লুসি কী তাতে সন্তুষ্ট হয়?
জানি না, আমি নিজের মনেই বললাম, তুমি নিশ্চয়ই ওঁকে পছন্দ কর না। করলে এ কথা কখনো বলতে না।
এটা একটা কথা হল, মিস রেলি বলতে থাকে, আমি ভেবে পাই না, একজন পেশাদার নার্সের এমন কী প্রয়োজন হল তার? আমার তো মনে হয় অপেশাদার কাউকে রাখলে তার পক্ষে সেটা যথেষ্ট বলেই মনে হতো। মুখে থার্মোমিটার খুঁজে দেওয়া কিংবা পালস্ দেখার মতো রুগীনী তো আর নন তিনি।
আমার কি রকম কৌতূহল হল যেন। তাই ভাবলাম, শীলার যুক্তিটা মেনে নেওয়া বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তাহলে তুমি কি মনে কর অসুখ বলতে তার তেমন কিছু হয়নি? প্রশ্নটা শীলার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
হ্যাঁ, ঠিক তাই! ষাঁড়ের মতোই শক্ত সমর্থ হল মেয়েটা। প্রিয় লুসির চোখে ঘুম নেই। তার চোখের নিচে কালো বৃত্তের দাগ। হ্যাঁ সেখানে নীল পেন্সিলের দাগ টেনে দাও। এই অবস্থায় একটা কিছু আকর্ষণ করতে হলে সবাই তার সামনে দলবদ্ধ হতে হবে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলবার জন্য। তবে যদি ঘুম আসে।
এর থেকে বোঝা যায়, একটা কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে ওঁর মধ্যে। আমি জানি (যা অন্য কোন নার্সের জানা নেই) এমনি এক স্নায়বিক রোগগ্রস্থ রুগীদের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম, তাদের একটা খেয়াল ছিল। বড় অদ্ভুত সেই খেয়াল, পরিবারের সকলকে নাচিয়ে ছাড়তে সে।
মনে হয়, মিসেস লিডনার হয়তো এ ধরনের কোন এক রুগীনী হবেন। স্বভাবতই এক্ষেত্রে স্বামীরাই সর্ব প্রথম শিকার হয়ে থাকেন, প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমি দেখেছি এ ধরনের অসুখ সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বামীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহজ সরল বিশ্বাসী হয়ে থাকে। তবু এ সব সত্ত্বেও এতদিন আমি যা শুনে এসেছি, যা দেখে এসেছি, এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। সেই সব যুক্তি তর্ক যেন একেবারেই বেমানান মিসেস লিডনারের বেলায়। নিরাপদ ডঃ লিডনারের সেই কথাটা ভাবতে গিয়ে আমি যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
মজার ব্যাপার হল সেই কথাটা এখনো আমার মনের মধ্যে কেমন গেঁথে আছে। সেই প্রসঙ্গে ফিরে এসে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা মিসেস লিডনার স্নায়ুর চাপে ভুগছেন না তো? মানে একটু ঘাবড়ে যাওয়া
কিন্তু সেরকম হবার কারণই বা কী থাকতে পারে? সব সময় দশজন অনুচর তাঁর কাছে থাকে। তারা সব অনেক দিনের পুরনো প্রহরী, ভয় পাবার কি আছে! না, না তার ঘাবড়াবার কোন কারণ থাকতে পারে না।
কি ভেবে শীলা মিনিট দুই চুপ করে থাকল। তারপর আবার মুখ খুলল ও।
কী অদ্ভুত সব কথা বলছ তুমি?
কেন?
একদিন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জার্ভিস এবং আমি ঘোড়ায় চড়ে আসছি। সময় সকাল। প্রায় সবাই তখন খননকার্যে লিপ্ত। মিসেস লিডনার তখন চিঠি লিখতে ব্যস্ত। মনে হয় আমাদের দেখতে কিংবা পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। যে ছেলেটি তোমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসে, সেও তখন ছিল না সেখানে। আর আমরা সোজা বারান্দায় চলে এলাম। আপাত দৃষ্টিতে দেওয়ালে ফ্লাইট-লেফটেনান্ট জার্ভিসের ছাঁয়া পড়তেই সেদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন তিনি। পরে অবশ্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নিতে গিয়ে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন অচেনা আগন্তুক কেউ। কিন্তু তাই যদি বা হয়, আগন্তুক কাউকে দেখে ও ভাবে কেন তিনি আঁতকে উঠবেন। আগন্তুক তো আর বাঘ-ভাল্লুক কিছু নয় যে, ভয় পেতে হবে?