ওঃ, ওঁরা যে সন্দেহবাতিক লোক, একটু পরেই তুমি তা টের পাবে নার্স। একটু থেমে ঠোঁটের প্রান্ত রেখায় হাসির একটা সূক্ষ্ম রেখা টেনে তিনি আবার বললেন, তুমি এসেছ, তাতে আমরা সবাই খুব খুশি। আমাদের প্রিয় মিসেস লিডনারকে নিয়ে আমাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল, তাই না লুসি?
তোমার কী খুব দুশ্চিন্তা ছিল? মিসেস লিডনারের কথা শুনে মনে হল, মিসেস মারকাভোর কথায় তিনি খুব একটা স্বস্তিবোধ করলেন না। যাইহোক, আমার ব্যাপারে তোমাকে আর ভাবতে হবে না মেরি। এখন থেকে নার্স আমার যত্ন নেবে।
নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই! আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম।
মিসেস লিডনারের কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হল, খুব সহজে তিনি তার শত্রু সৃষ্টি করতে পারেন। তার কথাবার্তায় একটা রুক্ষ্ম, মেজাজের সুর ধ্বনিত হয়–(তবে এর জন্য আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না)।
ওদিকে মিসেস লিডনার ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে তার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। ভঃ লিডনার টের পাননি তার আগমনের কথা, তার পিঠে কোমল হাতের স্পর্শ পড়তেই তিনি ফিরে তাকালেন চকিতে। ডঃ লিডনার শান্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর পানে, সে চোখে অনেক জিজ্ঞাসা এবং অনেক অজানা কৌতূহল।
মিসেস লিডনার শান্তভাবে মাথা নাড়লেন, তার একটা হাত লিডনারের কাঁধে জড়ানো ছিল।
ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর প্রতি খুবই অনুরক্ত, তাই না? মিসেস মারকাডো প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন।
হ্যাঁ, প্রত্যুত্তরে বললাম, দেখতে বড় ভাল লাগে।
কথাটা বোধহয় মিসেস মারকাডোর মনঃপুত হল না। সন্দেহ এবং বিরক্তির ছায়া পড়েছিল তার মুখে চোখে।
ওঁর সম্বন্ধে তোমার সত্যিকারের কী ধারণা বলোত? গলার স্বরটা খাদে নামিয়ে এনে তিনি শুধোলেন।
ওহো, তেমন মারাত্মক কিছু নয়, ব্যাপারটাকে হাল্কা করার উদ্দেশ্যে বললাম, আমার ধারণা, সাময়িক ভাবে ওঁর স্বাস্থ্যটা বোধহয় একটু ভেঙে পড়ে থাকবে।
তখনও তার সন্দেহ বোধহয় ঘাচেনি। হঠাৎ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কী মানসিক রোগগ্রস্থ রুগীদের নার্স?
ওহো, না, না সে সব কিছু নয়, সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললাম, কিন্তু এ কথা আপনার কেন মনে হল বলুন তো?
এক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন, তুমি জান না কি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা উনি। কেন, ডঃ লিডনার তোমাকে কিছু বলেননি?
আমার কাজের ব্যাপারে খোশগল্প করতে আমার ইচ্ছা ছিল না। তাছাড়া আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ সব কেসে রুগীর আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে সত্য খবরটা আশা করা বৃথা। নিজের চোখে দেখা না পর্যন্ত কোন গুজবে কান দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলে অন্য কথা। কিন্তু সেরকম কাউকে এখানে দেখা যাচ্ছে না। ডঃ রেলি একজন চিকিৎসক হলেও পেশাদার চিকিৎসক হিসাবে তাকে এখানে ডাকা হয় না। তাছাড়া ডঃ লিডনারও আমাকে খোলাখুলি ভাবে কিছু বলেন নি এখনও পর্যন্ত। ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। যাইহোক, সব কিছু ভাল করে জানার পর আমি আমার কর্তব্য ঠিক করব। মনে হয় মিসেস মারকাডো কিছু বলতে চান। কিন্তু তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, মিসেস লিডনারের উপর অহেতুক আক্রোশ বা হিংসে আছে। যাইহোক আমার যা পেশা, তাছাড়া মানবতার খাতিরে তার কথা আমাকে শুনতেই হবে।
আমার যতদূর ধারণা, তাকে বললাম, সম্ভ্রান্ত মিসেস লিডনার এক এক সময় ঠিক স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছেন না। খুব শিগগীর তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।
স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন? আমি বলছি, তা আর সম্ভব নয়। ওঁর ভয়ে সব সময় আমরা তটস্থ, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। ওঁর ভয়ার্ত চিৎকারে আমরা ব্যতিব্যস্ত। একদিন রাত্রে ওঁর ঘরের জানলায় আঙুলের টোকা পড়তে শুনেছেন উনি। তারপর আর একদিন তিনি নাকি দেখেছেন তার জানালার সামনে একটা কাটা হাত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেই হাতটা ছাড়া দেহের আর কোন অংশ তিনি দেখতে পাননি। একটা হলুদ মুখ জানালায় প্রতিবিম্বিত হতেই দ্রুত ছুটে যান তিনি সেদিকে, কিন্তু জানালার ধারে গিয়ে দেখেন কেউ কোথাও নেই।
এ যেন একটা তাজ্জব ব্যাপার। তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এ ব্যাপারে আমাদের নাক না গলানোই উচিৎ নয় কি? তবু মাথা ঘামাতে হচ্ছে।
মনে হয় কেউ বোধহয় ওঁকে এভাবে ভয় দেখাতে চাইছে, প্রতারণা করতে চাইছে, আমি আমার ধারণার কথা বললাম।
ওহো না, এ সব ওঁর স্থল কল্পনা। এই তো মাত্র তিন দিন আগে নৈশভোজের সময়, এখান থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে একটা গ্রামে গুলির শব্দ হতেই মিসেস লিডনার লাফিয়ে ওঠেন এবং আঁতকে ওঠেন। আর ডঃ লিডনার? তিনি তখন এক হাস্যকর কান্ড ঘটালেন, দ্রুত স্ত্রীর কাছে ছুটে এসে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকেন, ও কিছু নয় প্রিয়তমা। আদৌ ও সব কিছু নয়। আমার মনে হয়, নার্স তুমি নিশ্চয়ই জানো, সব পুরুষরা এমন সব হিস্ট্রিয়াগ্রস্ত নারীদের এমনভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু এ অন্যায়, এটা একটা খারাপ নজির। প্রতারণাকে কখনই উৎসাহিত করা উচিৎ নয়।
আর সেগুলো যদি প্রতারণা না হয়?
এছাড়া আর কিই বা হতে পারে?
আমি উত্তর দিলাম না, কারণ আমি জানি না কি বলতে হবে। এ এক বড় অদ্ভুত ব্যাপার। গুলির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠা ও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই ভুতুড়ে মুখের গল্প এবং কাটা হাতের গল্প যেন অন্যরকম। ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন মেজাজের, যার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। এ ব্যাপারে আমার দুটো ধারণা হয়েছে। হয় এটা মিসেস লিডনারের বানানো গল্প (ছোট ছেলেরা যেভাবে বানিয়ে গল্প বলে, যা বাস্তবে ঘটেনি, সেই রকম তিনিও হয়তো সবার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করানোর জন্য গল্পটা নিজে বানিয়ে বলে থাকবেন), কিংবা এমন হতে পারে, আমার যা ধারণা, একটু আগে যে কথা আমি বলেছি, তাকে কেন্দ্র করে এটা একটা কারোর ইচ্ছাকৃত ঠাট্টা-তামাশাও হতে পারে। আমার শেষোক্ত ধারণাটা যদি সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে মিঃ কোলম্যানকে আমার কেমন সন্দেহ হয়। ছেলেটি অদ্ভুত ধরণের। এ ব্যাপারে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। তাই আমি ঠিক করলাম, তার উপর কড়া নজর আমি রাখব। নার্ভাস রুগীরা সামান্য একটু ঠাট্টা কিংবা তামাশার ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে।