একটু আগে যা বললাম, মিসেস লিডনার নিজে আমাকে সঙ্গে করে সারা বিল্ডিংটা ঘুরিয়ে দেখালেন, অবশেষে আমার থাকবার ঘরে নিয়ে এলেন, উদ্দেশ্য এরপর যাতে করে আমি পূর্ণ বিশ্রামের অবকাশ পাই। ঘরটা দারুণ পরিপাটি করে সাজানো।
মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজের আগে এবং সকালে অবশ্যই ছেলেরা গরম জল দিয়ে যাবে। বাড়তি জলের প্রয়োজন হলে বাইরে বেরিয়ে এসে হাতের ইশারায় ছেলেদের ডাকতে হবে। তারা কাছে এলে বলবে, জিব মাই হার কথাটা মনে থাকবে তো?
মাথা নাড়লাম। নিচু গলায় দু-চারবার কথাটা আওড়ালাম।
ঠিক আছে। আরবরা সাধারণ ইংরাজি ভাষার এক বর্ণও বোঝে না।
ভাষাটা দেখছি এখানে একটা দারুণ সমস্যা।
তা যা বলেছ, মিসেস লিডনার বলেন, এখানে প্যালেস্টাইনে একটা চার্চ আছে, সেখানে উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা প্রার্থনা সংগীত বিভিন্ন ভাষায় লেখা আছে।
ঠিক আছে, আমি বললাম সেই লেখাগুলো আমি অবশ্যই লিখে রাখব, পরে আমার কাকীমাকে বলব, তিনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন।
আমি আশাকরি, এখানে তুমি সুখেই থাকবে, তারপর হঠাৎ মিসেস লিডনার তার বেগুনি রঙের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –সত্যি করে বল তো নার্স, আমার স্বামী ঠিক তোমাকে আমার সম্বন্ধে কি বলেছেন? আমার কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করো না।
আমি শুনেছি, আপনার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে মিসেস লিডনার, সহজ ভাবে কথাটা একরকম ছুঁড়ে দিলাম, আর সেই কারণে আপনার দেখাশোনা করবার জন্য এবং আপনার সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখবার জন্য আপনি আমাকে এখানে এনেছেন।
চিন্তিত ভাবে ধীরে ধীরে মাথাটা একটু কাত করে মিসেস লিডনার বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি আমার উপকারে আসবে বৈকি!
তাঁর কথাটা হেঁয়ালির মত শোনাল। কিন্তু এ নিয়ে আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না। বরং আরো একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, আশা করব, আপনি আমাকে আপনার বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করার সুযোগ দেবেন, আমাকে বেকার হয়ে বসে থাকতে দেবেন না।
হাসলেন তিনি। ধন্যবাদ নার্স।
তারপর তিনি আমার বিছানায় বসে হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলছি এই কারণে যে, তাঁর চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে গিয়ে সেই প্রথম আমার মনে হল মিসেস লিডনার একজন মহিলা। আর আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোন মহিলা অন্য কোন মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামিয়ে থাকে। কিন্তু তিনি যেন তাদের ব্যতিক্রম। আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানবার আগ্রহ তার খুব। কোথায় আমি ট্রেনিং নিয়েছি। এখানে আসার কী কারণ থাকতে পারে। আমাকে ডঃ রেলি সুপারিশ করলেন কী জন্য। এমন কি তিনি জানতে চাইলেন, আমেরিকায় আমি কখনো গেছি কি না এবং সেখানে আমার কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধু-বান্ধব আছে কিনা। তারপর তিনি এমন কয়েকটা প্রশ্ন করলেন যা ঠিক সেই সময় আমার কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু পরে দেখলাম যথেষ্ট অর্থবাহক বটে।
তারপর হঠাৎ তিনি কেমন বদলে গেলেন। হাসলেন, সূর্যস্নাত উচ্চ হাসি। তার মিষ্টি কণ্ঠস্বর আমার কানে যেন মধু বর্ষণ করল, আমাকে পেয়ে তিনি নাকি খুশি এবং তিনি নিশ্চিত আমি তার অনেক উপকারে আসতে পারি। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন, ছাদে গিয়ে আমি সূর্যাস্ত দেখতে চাই কিনা। আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং তখুনি আমরা দুজনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাগদাদ থেকে আসবার সময় নির্দিষ্ট কোন লোক তোমার নজরে পড়েছে?
উত্তরে আমি বললাম, তেমন কোন নির্দিষ্ট লোককে আমার মনে পড়ে নি, তবে রেস্টুরেন্ট-কারে দু’জন ফরাসীকে দেখেছিলাম। আর তিনজন লোককে পাইপ লাইনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুনেছিলাম।
তিনি মাথা নাড়লেন। তার মুখ-চোখের অবস্থা দেখে মনে হল, তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
মিসেস মারকাডো বসেছিলেন প্যারালোটের উপর এবং ডঃ লিডনার কতকগুলো টুকরো টুকরো পাথর এবং মাটির বাসনের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছিলেন নির্দিষ্ট মনে। মনে হয় সেই জিনিসগুলো অতি দুষ্প্রাপ্য। সত্যি কথা বলতে কি অমন অদ্ভুত ধরনের পাথর আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।
এই যে এখানে এসো’, মিসেস মারকাভোর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম তার দিকে, দৃশ্যটা সুন্দর না?
পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, অপূর্ব সেই দৃশ্য, অনস্বীকার্য। অদূরে টাইগ্রিস নদীর কলকল শব্দ। এই মুহূর্তে দূর থেকে হাসানিয়েকে যেন এক স্বপ্নময় দেশের সুন্দরী পরীর মত দেখাচ্ছিল। এই মুহূর্তে আমরাও যেন স্বপ্নের আবর্তে পড়ে একাকার হয়ে গেলাম।
চমৎকার, তাই না এরিক? মিসেস লিডনারের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি।
আবিস্ট চোখে তাকালেন ডঃ লিডনার, ফিসফিসিয়ে বললেন, চমৎকার, চমৎকার। কথা বলতে বলতেই তিনি সেই মাটির বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছিলেন।
মিসেস লিডনার হাসলেন, প্রত্মতত্ত্ববিদরা বড় বেরসিক, তারা তাদের পায়ের নিচের জিনিস ছাড়া অন্য কিছু দেখতে চায় না। তাদের মাথার উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটা সুন্দর আকাশ যে আছে, সেটা বোধহয় তাদের জানা নেই।
মিসেস মারকাডো মুচকি হাসলেন।