মিসেস লিডনার বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং একবার তার দিকে ফিরে তাকালেন, কিন্তু তাতে কোন ফল হল না।
আমাদের আলাপের একেবারে শেষ পর্বে মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো এসে উপস্থিত হলেন সেখানে।
মিঃ লিডনার তার স্বভাব সুলভ সুন্দর ভঙ্গিমায় আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। চিন্তিত মুখে তিনি দ্রুত তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, পরক্ষণেই লক্ষ্য করলাম, তার মুখের উপর থেকে সেই ভাবনার ছায়াটা উধাও হয়ে গিয়ে, একটা তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল সেখানে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসলেন মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো মিসেস লিডনারের শূন্য আসনটা দখল করলেন।
দীর্ঘদেহী মিঃ মারকাভোর মুখটা অজানা আতঙ্ক এবং বিষণ্ণতায় ভরা, স্ত্রীর থেকে তার বয়স অনেক বেশি, অবিন্যস্ত দাড়ি। মনে হয় কোন কারণে নিজের শরীরের উপর তেমন যত্ন তার নেই। তার আগমনে আমি একটু খুশি হলাম, কারণ তিনি সেখানে প্রবেশ করা মাত্র তার স্ত্রী আমার দিকে তাকান বন্ধ করে দিল, এবং তার স্বামীর দিকে নজর দিল। তাকে ভীষণ অধৈর্য এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তার এই ভাবগতিক কেমন খাপছাড়া লাগল আমার কাছে। মিঃ মারকাভোর মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম, যেন স্বপ্নের ঘোরে চা খাওয়া শেষ করলেন নিঃশব্দে, কোন কথা নেই। অন্য কিছু খাওয়ার দিকে তেমন ইচ্ছা নেই। প্লেটের কেক প্লেটেই থেকে গেল।
এখনো একটা আসন ফাঁকা ছিল সেখানে। আর সেই সময় দরজা ঠেলে একটা লোক প্রবেশ করল।
আগন্তুক রিচার্ড ক্যারি। তার মত সুপুরুষ অনেকদিন চোখে পড়েনি। একই সঙ্গে কাউকে যদি একবার সুপুরুষ বলা যায়, এবং পরমুহূর্তে যদি বলা হয় যে, অন্য কোন মৃত সুপুরুষ ব্যক্তির মাথাটা কেটে তার দেহের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, স্বভাবতই কথার মধ্যে একটা বিসদৃশ্য ভাব থেকে যায়, তবু কথাটা সত্যি। এতটুকু বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলা নয়। তার বাদামি মুখে জ্বলজ্বলে নীল চোখ দুটো বড় অদ্ভুত, বড় বেমানান, এরকম বিসদৃশ এর আগে আমি কখনো দেখিনি বোধহয়। লম্বায় ছ’ফুট, বয়স মনে হয় চল্লিশের নিচেই হবে।
নার্স, ইনি হলেন আমাদের প্রত্মতত্ত্ববিদ মিঃ ক্যারি, ডঃ লিডনার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আনন্দের অতিশয্যে অস্পষ্ট গলায় ইংরাজিতে কি যেন বললো ফিসফিসিয়ে, বোঝা গেল না। তারপর তিনি গিয়ে বসলেন মিসেস মারকাভোর পাশে।
তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, তাঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে আগন্তুক, তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখলে মনেই হয় না যে তারা পরস্পরের পূর্ব পরিচিত, কেউ কেউ আবার একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচিত বেশ কয়েক বছরের।
.
০৬.
প্রথম সন্ধ্যা
চায়ের আসরের পর আমাকে ঘর দেখাবার জন্য নিয়ে গেলেন। মনে হয় এখানে ঘরগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া দরকার। বোঝবার কোন অসুবিধা নেই, অতি সহজ সরল প্ল্যান।
বিরাট উন্মুক্ত বারান্দা, বারান্দার দু’দিকেই দরজা, মূল দুটি ঘরের প্রবেশ পথ। ডানদিকে ডাইনিংরুম যেখানে একটু আগে আমরা চা খেয়ে এলাম। অপর দিকে ঠিক সেই রকমই আর একটি ঘর, (এটা আমি শয়ন কক্ষ বলে মনে করি) বসবার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেটা। যেখানে কিছু ড্রইং-এর কাজ হয়ে থাকে।
বসবার ঘরের মধ্যে লাগোয়া আর একটা ঘর আমার চোখে পড়ল। খননকার্য চালাবার সময় মাটির নিচে থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য জিনিসগুলোর প্রদর্শনী ক্ষেত্র বলা যেতে পারে এই ঘরটা। দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া সেলফ, পায়রার খোপের মত ছোট ছোট খোপগুলোয় জিনিসগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই চোরাকুঠুরি থেকে সরাসরি বেরুবার কোন দরজা নেই।
সেই চোরাকুঠুরির পাশের ঘরটা মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষ। কোর্টইয়ার্ডে যাবার দরজা আছে সেই ঘরের। মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষটা ছিল এক কোণায়। তার পাশের ঘরটা ডঃ লিডনারের, তবে দুটি ঘরের যোগাযোগের সেতু বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ কোন দরজার বালাই ছিল না। বাড়ির পূর্বদিকের এই ঘরটাই ছিল প্রথম। তারপরের ঘরটা আমার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আমার ঠিক পরবর্তী ঘরটা মিস জনসনের। তার পরের দুটি ঘর যথাক্রমে মিঃ অ্যান্ড মিসেস মারকাভোর। তারপর দুটি বাথরুম।
প্রতিটি শয়নকক্ষ প্রায় একই রকম, একটি জানালা এবং কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র দরজা। দক্ষিণে ড্রইং অফিস, ল্যাবরেটারি এবং ফটো তোলার ঘর।
অপরদিকের ঘরগুলোর ব্যবস্থাও ঠিক একই রকমের, কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র রাস্তা। ড্রইংরুম সংলগ্ন অফিসঘর। মিসেস লিডনারের অনুরূপ ঘরটা ফাদার ল্যাভিগনির, তাকে সব থেকে বড় ঘরটা দেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ছাদে যাবার সিঁড়ি। পশ্চিমদিকে শুরুতে রান্নাঘর কোয়ার্টার এবং পর পর চারটি ছোট আকারের শয়নকক্ষের বাসিন্দারা হল চারজন যুবক, ক্যারি, ইমোট, রেইটার এবং কোলম্যানের।
উত্তর-পশ্চিম কর্নারে ডার্করুম, মধ্যে ফটো তোলার ঘর। তার পাশেই ল্যাবরেটরি। তারপরেই একমাত্র প্রবেশ পথ, বিরাট খিলানের নিচে দরজা। সেই দরজাপথ দিয়ে আমরা প্রবেশ করেছিলাম। বাইরে স্থানীয় ভৃত্যদের থাকবার কোয়ার্টার, সৈনিকদের জন্য প্রতীক্ষালয়, ঘোড়াদের আস্তাবল।
বিল্ডিংয়ের একটা পূর্ণ বিবরণ আমি এখানে দিলাম, এই কারণে যে, পরে তার পুনরাবৃত্তি করতে যেন না হয়।