আর লুসিকে আমি ভালবেসেছিলাম এবং তাকে আমি খুনও করেছি। আপনি যদি লুসিকে বুঝে থাকেন, অহলে আমাকেও উপলব্ধি করতে পারবেন….না, আমার ধারণা আমার সম্বন্ধে আপনার চিন্তাধারা অন্য…..।
৫. তেল ইয়ারিমাহ
০৫. তেল ইয়ারিমাহ
স্বীকার করতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই যে, মিসেস লিডনারকে প্রথম দেখে আমার মনে যে ধারণা হয়েছে সেটা পুরোদস্তুর বিস্ময়কর যেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনার অতৃপ্ত কামনা-বাসনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন এখন। আমি ভেবেছিলাম, একটা বিশ্রী অবস্থায় ওঁকে দেখতে হবে। কিন্তু আমার সব ধারণা পাল্টাতে হল, আমি যা ভেবেছিলাম উনি তা নন। শুরুতেই বলে রাখি, সুন্দরী, রীতিমত সুন্দরী উনি। তবে ওঁর স্বামীর মতো জাতে উনি সুইডিস নন। স্বর্ণকেশী, স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশের মেয়েদের মতো রূপ ওঁর, সচরাচর এরকম দেখা যায় না। ওঁকে ঠিক যুবতী বলা যায় না। মাঝবয়সী, তিরিশ থেকে চল্লিশ বয়স হবে। ওঁর মুখটা ঈষৎ কৃশ, তবে চোখ দুটো অপূর্ব, ওরকম সুন্দর বেগুনি রঙের চোখ আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। বড় বড় চোখের নীচে সামান্য একটু কালো ছায়ার আস্তরণ। রোগাটে চেহারা। ওঁর চাহনির মধ্যে কি একটা যেন গোপন করবার অদম্য কৌতূহল লুকিয়েছিল।
আমার দিকে তিনি তার হাতটা প্রসারিত করে হাসলেন। মুক্তোর মতো সারিবদ্ধ দাঁতের হাসিটা বড় মিষ্টি বলে মনে হল। নিচু গলায় শান্ত ভাবে তিনি শুধোলেন, চা খাবে? নাকি একেবারে তোমার ঘরেতে গিয়ে উঠবে? তাঁর কথায় আমেরিকান সুর।
চা খাবার ইচ্ছাটা প্রকাশ করলাম আমি। টেবিলটাকে ঘিরে বসে থাকা অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বললেন,–ওঁরা হলেন মিস জনসন এবং মিঃ রেইটার, মিসেস মারকাডো, মিঃ টমোট, ফাদার ল্যাভিগনি। আমার স্বামী একটু পরেই এখানে এসে হাজির হচ্ছেন। তারপর ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিস জনসনের মাঝখানের আসনটা দেখিয়ে তিনি বললেন, তুমি ওই জায়গাটায় বস।
মিস জনসন বেশ আলাপী। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে নিলেন। আমারও বেশ ভাল লাগল তাঁকে। পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার কথার মধ্যে যথেষ্ট গভীরতা ছিল এবং মিষ্টি করে কথা বলার সময় একটা ব্যস্ততা লক্ষণীয়। টুইড কোর্ট এবং স্কার্টে তাকে কতকটা পুরুষের মতোই দেখাচ্ছিল। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে তিনি বললেন, ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা তিনি।
ওঁদের মধ্যে ফাদার ল্যাভিগনিকে একটু সতর্ক বলে মনে হল। রীতিমতো লম্বা তিনি, কালো দাড়ি, নাকে স্প্রিং লাগান চশমা। মিসেস কেলসি বলেছিলেন, এখানে একজন ফরাসী সন্ন্যাসী আছেন। এখন ফাদার ল্যাভিগনির পরনে সাদা উলের আলখাল্লা দেখে মনে হল, ইনিই তাহলে সেই ফরাসী সন্ন্যাসী। ওঁকে এখানে এই লোকালয়ে দেখে অবাক হয়ে যাই, কারণ ছেলেবেলা থেকে আমি জেনে এসেছি, সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণত লোকালয় ছেড়ে নির্জন মঠ বা আশ্রমে বাস করে থাকেন, মঠের বাইরে থাকেন না কখনও তারা।
মিসেস লিডনার বেশির ভাগ সময় ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনি বেশ স্পষ্ট ইংরেজি ভাষায় কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। লক্ষ্য করলাম, ওঁর মুখের ভাব-ভঙ্গী এবং চাহনির মধ্যে একটা চতুরতার ছাপ আছে। ওঁর মেপে মেপে কথার বলার মধ্যে একটা পরিশ্রমের ছাপও পাওয়া যায়।
আমার ঠিক বিপরীত দিকে অপর তিনজন বসেছিল। মিঃ রেইটার বেশ শক্ত সমর্থ যুবক, চোখে চশমা। তার কোঁকড়ানো চুল কাঁধের অনেক নিচে নেমে গেছে। এবং নীল গোলাকৃতি চোখ। প্রখর দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, সে যেন একটা নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু তাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আমার মনে হল, শূকরছানার মুখ ধারণ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষের অবয়ব। অপর দুটি যুবকের চুল ছোট করে ছাঁটা। একজনের মুখের দিকে তাকালে আমার কেন জানি না মনে পড়ে যায় একজন ভাড়ের কথা, তার দাঁতগুলো ভারী চমৎকার। হাসলে তাকে ভারী সুন্দর দেখায়। কম কথা বলে সে। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। রেইটারের মত সেও জাতে আমেরিকান। শেষ ব্যক্তি হল মিসেস মারকাভো। তার দিকে আমি ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না, কারণ যখনই আমি তাকে আড়চোখে দেখতে যাই, বুঝতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার ক্ষুধার্ত চোখ দিয়ে। যেভাবে সে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে মনে হবে যে, হাসপাতালের নার্স মাত্রই যেন এক একটি জানোয়ার; সভ্যতা ভদ্রতা বলে কিছু জানে না তারা।
মিসেস মারকাভোর বয়স খুব বেশি নয়, পঁচিশের কাছাকাছি হবে হয়তো। গায়ের রঙ কালো এবং চেহারা দেখে মনে হয়, বোধহয় এই মাত্র সে গর্ভপাত করিয়ে এসেছে। তবে এককালে সে যে সুন্দরী ছিল তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। গায়ের পুলওভারের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নখে নখ পালিশ লাগান। পাখির ঠোঁটের মত সরু ঠোঁটে চাপা উত্তেজনা। বড় বড় চোখ দুটো সজাগ সদা সর্বদা। মুখে সব সময় যেন একটা সন্দেহের ছাঁয়া লেগে আছে।
চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারি, ভাল স্বাদ আছে। একেবারে সস্তা দামের কিছু নয়। সঙ্গে জ্যাম-জেলি মাখন টোস্ট। মিঃ এমাট আমার খাবারের তদারকি করছিলেন।