সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকালাম।
সেই জানালা, পোয়ারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন–সেই জানালা! মিস জনসনের মতো আমিও এই কথাটা উপলব্ধি করি। মিসেস লিডনারের ঘরের জানালাটা ছিল কোটইয়ার্ডের ঠিক বিপরীত দিকে। ডঃ লিডনারের বড় এ্যালিবি হল–তিনি তখন ছাদের উপর নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এবং সেই ভারী হস্তচালিত পাথরের যাঁতাটা তার হাতের কাছেই সংগ্রহ করা ছিল। সত্যি কত সহজেই না ছাদের উপর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে একটা হত্যাকাণ্ড সবার অলক্ষে ঘটানো যায়! ওঃ কি অপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য!
পোয়ারো বলতে থাকেন।
ডঃ লিডনার ছাদে ব্যস্ত তার পটারির কাজে। মিঃ এমোট, মনে আছে তিনি আপনাকে মিনিট দশেক ছাদে আটক করে রাখেন কথার ছলে। ইতিমধ্যে আপনার সহকারী সেই বাচ্চা বয়টি কোটইয়ার্ডের বাইরে চলে যায়। নিচে ফিরে এসে আপনি তার খোঁজে চিৎকার শুরু করে দেন। সেই সুযোগে ডঃ লিডনার তৎপর হয়ে ওঠেন তার পরিকল্পিত কাজের চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্য। পকেট থেকে আঠালো মুখোসটা বার করেন, যে মুখোস দিয়ে এর আগে তিনি তার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ভয় দেখিয়েছিলেন। ছাদের প্যারাপেট থেকে ডঃ লিডনার তার দেহটা ঝুলিয়ে দেন, তার হাতের মুখোসটা মিসেস লিডনারের ঘরের জানালায় আঘাত করতে থাকেন ক্রমাগত। মনে রাখবেন–সেই জানালাটা ছিল কান্ট্রিসাইডের ঠিক বিপরীত দিকে।
ওদিকে তখন মিসেস লিডনার আধোঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। তখন ভরা দুপুর। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি চিন্তা করেন। প্রকাশ্য দিবালোকে তার জানালায় টোকা মারার মতো দুঃসাহস কে দেখায়? বিছানা থেকে নেমে তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ান। কৌতুহল মেটাতে জানালা খোলেন তিনি অন্য মেয়েদের মত। তারপর খলা জানালা পথে মুখ বাড়িয়ে উপর দিকে তাকাতে যান। ওদিকে প্যারাপেটের উপর অপেক্ষা করছিলেন ডঃ লিডনার তার হাতের সেই ভারী পাথরের যাতাটা নিয়ে। মুহূর্তে আর বিলম্ব না করে সেই মুহূর্তে তিনি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তার স্ত্রীর মাথা লক্ষ্য করে
একটা ক্ষীণ আর্তচিৎকার (মিস জনসন যে শব্দটা শুনতে পান) করার পর মিসেস লিডনারের রক্তাক্ত দেহটা জানালার নিচে লুটিয়ে পড়ে।
তিনি যদি তার স্ত্রীকে অত ভালবেসেই থাকবেন, কেন তবে তাকে হত্যা করতে যাকেন? অধৈর্য হয়ে ডঃ রেলি প্রশ্ন করেন-এ খুনের মোটিভ কী? লিডনার আপনি বলতে পারেন? বলে দিন মঁসিয়ে পোয়ারোকে পাগলের প্রলাপ বকছেন তিনি।
ডঃ লিডনার না পারলেন কথা বলতে, না পারলেন একটু নড়ে চড়ে বসতে।
তার হয়ে পোয়ারোই জবাব দিলেন–আমি আপনাদের বলেছি অপরাধটা একটা অভ্যাস। মিসেস লিডনারের প্রথম স্বামীও তো খুব ভালবাসতেন, তবে কেন তিনি তাঁকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতেন? কারণ তিনি তাকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। ফ্রেডরিক বনসারের প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বিতীয়বার আমি আবার মিসেস লিডনারের আগের জীবনে ফিরে যাচ্ছি। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন–ডঃ লিডনারের তাঁর বিয়ে হওয়ার আগের মুহূর্তে কিম্বা ঠিক পরমুহূর্তে সেই ধরনের কোন বেনামা চিঠি আসেনি তাঁর কাছে। কেন? এই প্রশ্নের মধ্যেই আমি ডঃ লিডনারের পরিচয় উপলব্ধি করতে পেরেছি সত্যি কি সহজ উপলব্ধি আমার–ডঃ লিডনারের আসল পরিচয় হল ফ্রেডরিক বনসার। যৌবনে এই ফ্রেডরিক লুসিকে পাগলের মত ভালোবাসতেন। সেই স্ত্রী তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পিতার সাহায্যে তাঁর প্রাণদন্ডের ব্যবস্থা করেন। পরে তিনি জেল-হাজত থেকে পালিয়ে যেতে গিয়ে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হন। সৌভাগ্য যে, প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তার সহযাত্রী সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক লিডনার তার চোখের সামনে সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন। ফ্রেডরিকের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় তখন। এরিক লিডনারের পরিচয় নেন তিনি এবং নিহত এরিক লিডনারকে তার পোষাক এবং পরিচয় ভূষিত করে সরে পড়েন ঘটনাস্থল থেকে। পরবর্তীকালে এরিক লিডনারের মৃতদেহ ফ্রেডরিক বনসারের বলে সমাধিত করা হয়।
তারপরের ঘটনা তো অতি সহজ এবং সরল। নতুন করে এরিক লিডনারের পরিচয় দিয়ে লুসির মন জয় করেন তিনি। ছদ্মবেশের আড়ালে লুসি তাকে চিনতে পারলেন না। বেচারি! ডঃ লিডনার সুযোগ খোঁজেন কিভাবে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। মাঝে কতকগুলো বেনামা চিঠি পাঠিয়ে তিনি তার এ্যালিবি তৈরি করে রাখেন, ফ্রেডরিক বনসার তখনও জীবিত। শেষ দিকে মিসেস লিডনার বোধহয় তার পরিচয়টা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। যার ফলে তিনি শেষ দিকে রিচার্ড ক্যারির দিকে ঝোঁকেন। এই সুযোগটাই চাইছিলেন ডঃ লিডনার। এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করেন সেদিন অপরাহ্ন বেলায় সবার অলক্ষ্যে হলেও মিস জনসনের চোখে তিনি ধরা পড়ে যান। তাই তাঁকেও চলে যেতে হল। আমি আবার বলছি–খুন একটা বড় অভ্যাস ডঃ লিডনারের, তাই তিনি রেহাই দিলেন না মিস জনসনকেও! কি–আমি ঠিক বলিনি ডঃ লিডনার?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন ডঃ লিডনার। অবশেষে তিনি ভেঙ্গে পড়লেন–হ্যাঁ আমি তাকেও খুন করেছি। বেচারি জনসন। আমি দুঃখিত–এ আমার অজ্ঞতার পরিচয়, এ আমার নিষ্ঠুরতার পরিচয়। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনিও একজন দক্ষ প্রত্নতত্ত্ববিদ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের অতীতকে আবিষ্কার করলেন এক নতুন রঙে, এক নতুন ঢঙে। আমার ঘুমন্তু সত্ত্বাকে আপনি জাগিয়ে তুললেন, লুসির ব্যবহারে পৃথিবীর সমস্ত নারীর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাই খুন আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। মিস জনসন সেই বদ অভ্যাসের শেষতম শিকার!