আমার শেষ টেলিগ্রামের জবাবে উত্তরটা আমি পেয়ে গেলাম আজই, একটু আগে। টিউনিস থেকে আমার খবরদাতা জানিয়েছেন ফরাসী পুলিশের সূত্রে ব্যাপারটা এখন খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে, ফাদার ল্যাভিগনি একজন অতি চতুর দাগী চোর–যার কাজ হল মিউজিয়াম থেকে দামী দামী অলঙ্কার আত্মসাৎ করা। তার আসল পরিচয় হল রাউল সেনিয়ার এবং তার দোসর হল প্রথম শ্রেণির স্বর্ণকার আলি ইউসুফ। রাউলের কাজ হল মিউজিয়ামের আসল অলঙ্কারগুলোর ছাঁচ সংগ্রহ করা এবং সেই ছাঁচের আদলে নকল অলঙ্কার তৈরি করা হল আলির কাজ। এইভাবেই ফাদার ল্যাভিগনি যেসব মিউজিয়ামে যান, নকল পরিচয় দিয়ে আসল অলঙ্কার চুরি করার ফঁদ পাতেন।
আজ সকাল পর্যন্ত এই নিয়ে আটটি সম্ভাবনার কথা আমার মনে উদয় হয়েছে, কিন্তু ঠিক জানি না, আসল খুনী কে হতে পারে?
তবে খুন একটা বদ অভ্যাস, খুনী সে নারী কিম্বা পুরুষই হোক না কেন একবার খুন করলে বার বার সে খুন করবেই এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার খুন করে খুনী আমার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেছে বলে আমার মনে হয়। আমার অনুমান সত্য হলে খুনীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠতে বাধ্য।
আমার আশঙ্কা ছিল প্রধানতঃ নার্স লিথেরানের জন্য। তার অত্যাধিক কৌতূহলের জন্য প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার আশঙ্কা ফললো মিস জনসনের মৃত্যু দিয়ে। তবে মিস জনসন যে আত্মহত্যা করতে পারেন না–এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
প্রথমতঃ দেখা যাক, রবিবার সন্ধ্যায় মিস জনসনকে কাঁদতে দেখেন নার্স লিথেরান। সেই সন্ধ্যাতেই নার্স লিথেরান তাকে তার ঘরে একটি চিঠি পোড়াতে দেখেন, সেই চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে বেনামা চিঠিগুলোর হাতের লেখার অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলেন নার্স লিথেরান।
দ্বিতীয় তথ্য হল, মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় ছাদের উপরে মিস জনসনকে খুব চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পান নার্স। জানতে চাইলে মিস জনসন বলেন তিনি নাকি এমন একটা জিনিস দেখেছেন যা প্রকাশ হয়ে পড়লে নতুন তথ্য-আবিষ্কার হাতে পারে। আমি যা দেখেছি, অন্য কেউ দেখেনি তবে একোরে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে পারব না।
এবং তৃতীয় তথ্য, মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে তার শেষ কথা হল–ওই জানাল, ওই জানালা।
এইগুলো হল আমাদের সূত্র এবং আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তা হল- ..
সেই সব চিঠিগুলোর প্রকৃত অর্থ কী? ছাদের উপর থেকে সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন কি দেখেছিলেন? ওই জানালা, ওই জানালা বলতে তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
প্রথমেই দেখা যাক আমাদের দ্বিতীয় সমস্যার কথা। ছাদের উপর থেকে তিনি কি দেখেছিলেন, কাকে দেখেছিলেন। ফাদার ল্যাভিগনিকে কোর্টইয়ার্ড অতিক্রম করে আসতে তিনি দেখেন। তবে কি তিনি তাঁকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন? তবে কি তিনি তার ছদ্মবেশের আড়ালে আসল রূপটা চিনে ফেলেছিলেন? মিসেস লিডনার হয়তো তাকে চিনে ফেলেছিলেন বলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় তার মুখ বন্ধ করার জন্য।-এবং মিস জনসন সেই গোপন সত্যটা জেনে ফেলেছিলেন বলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এ কেসের একটা সঠিক সমাধান পেতে হলে সব কিছু আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে যা এখনও পর্যন্ত অনুল্লেখিত থেকে গেছে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন ছাদের উপর থেকে কি দেখে অমন চিন্তিত হয়ে ওঠেন? তাঁর কাছ থেকে যে তথ্যটা নার্স লিথেরান সংগ্রহ করতে পারেননি, আজ সকালে ছাদে গিয়ে আমি সেই অজানা তথ্যটা সংগ্রহ করেছি অনেক কষ্টে, নিজের মনকে বিশ্লেষণ করে। ছাদে দাঁড়িয়ে সেই তিনটি বিষয় আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল–সেই চিঠিগুলো, সেই ছাদ এবং সেই জানালা। আর ঠিক তখনই আমি দেখতে পাই-মিস-জনসন যা দেখেছিলেন, যা এখন আমি আপনাদের ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছি ।
.
২৮.
যবনিকা
ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন পোয়ারো। আমাদের প্রত্যেকের চোখ এখন নিবদ্ধ তার উপরে। আমরা সবাই তখন এক অদ্ভুত মানবিকতার শিকার হতে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবার মনে তখন কেবল একটাই চিন্তা, একটা সত্য উদ্যাটন হতে যাচ্ছে, সব না হলেও কিছু কিছু অন্তত–
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আগেই বলেছি অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সময় তিনজন লোকের এ্যালিরি ছিল। তার মধ্যে দুজনের এ্যালিবি অযোগ্য বলে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন দেখছি আমি ভুল করেছি। তৃতীয় জনের এ্যালিবিও গ্রহণযোগ্য নয়। আচ্ছা ডঃ লিডনার কি কখনও খুন করতে পারেন? কিন্তু এখন আমি বিস্মিত যে, সেদিন তিনি তার স্ত্রীকে খুন করেন।
তাহলে ডঃ লিড়নারই কী খুনী? একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল সেখানে তখন। ডঃ লিডনারের মুখে কোন কথা নেই। যাইহোক, ডেভিড এয়োটকে একটু অস্থির দেখাচ্ছিল এবং সেই প্রথম মুখ খুলল–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে আগেই বলেছি বেলা পৌনে তিনটের আগে ছাদ ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও নিচে নেমে আসেননি তিনি। আমি মিথ্যে বলছি না। অতএব তার পক্ষে ছাদ থেকে তার স্ত্রীকে হত্যা করা কি করে সম্ভব?
পোয়ারো মাথা নাড়লেন ধীরে ধীরে।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি বৈকি! আমিও বলছি–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে নেমে আসেননি সেদিন সেই সময়। কিন্তু আমি যা দেখেছি যা মিস জনসন দেখেছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়, তার থেকে ধারণা করে নেওয়া যায় যে–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে না নেমেই তার স্ত্রীকে খুন করতে পারেন।