ডঃ রেলি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
.
২৭.
যাত্রা শুরু
বিসমিল্লাহি আর রহমান আর রহিম’–আরবি ভাষায় এই প্রবাদটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পোয়ারো বলেন, করুণাময়, দয়াময় আল্লার নামে এই প্রবাদটা যে-কোন যাত্রার শুরুতে ব্যবহার করা হয়। আমাদেরও যাত্রা শুরু হল। এ যাত্রা সুদূর অতীতে। এ যাত্রা সেই সব বিচিত্র জায়গায়, যেখানে মানুষের আত্মা ঘোরাফেরা করে থাকে আজও।
সত্যি কথা বলতে কি পোয়ারোর কথায় হঠাৎ আমার প্রাচ্যের সেই মোহিনী মায়ার’ কথা মনে পড়ে গেল। ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে সেই সব বিচিত্র দৃশ্য। মনে পড়ল সমরখন্দ এবং ইমপাহানের নাম, সওদাগর, হাঁটুমুড়ে বসে থাকা উটের দল, পিঠে কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে নুইয়ে পড়া শ্রমিকদের চলমান স্রোত, মেয়েদের মেহেন্দি রঙে কলপ দেওয়া মাথার চুল, টাট্টু ঘোড়ার চি-চি শব্দ।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘরের চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম এবং আমার মনে। একটা অদ্ভুত চিন্তার উদয় হল, মিঃ পোয়ারো যা যা বললেন সব কি সত্যি আমরা সবাই সেই নিরুদ্দেশ যাত্রার পথিক, সমবেত হয়েছি এখানে। কিন্তু আমাদের সবার চিন্তা এখন প্রবাহিত ভিন্ন ভিন্ন ধারায়।
এখানে প্রথম আসেন রেইটার এবং এমোট। তারপর বিল কোলম্যান, রিচার্ড ক্যারি এবং সব শেষে মিঃ মারকাভো। প্রথমে আমি তাদের যে চোখে দেখেছিলাম আজও ঠিক সেই চোখে দেখছি; সেই রঙ, সেই ঢঙ, বদলায়নি কিছুই।
কিন্তু তারা যেন কেউ স্বাভাবিক নন। কেমন ভয়ে ভয়ে মিঃ মারকাডো তার হাতের আঙুলগুলো মোচড়াচ্ছিলেন। স্বামীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন মিসেস মারকাডো। একটা অদ্ভুত কায়দায় ডঃ লিডনারকে কেমন সঙ্কুচিত বলে মনে হল। ওদিকে মিঃ কোলম্যান সরাসরি তাকিয়েছিলেন পোয়ারোর দিকে। তার মুখটা ঈষৎ খোলা, দৃষ্টি প্রসারিত। এই মুহূর্তে তাকে ঠিক সূর্যের মতো দেখাচ্ছিল। মিস রেলি জানালার দিকে তাকিয়ে কি যে ভাবছিলেন জানি না। তবে যে কারণেই হোক মিঃ ক্যারির মুখের ভাব দেখে আমার কেমন একটু করুণা হল। জানি না, পোয়ারো আমাদের সম্বন্ধে এখন কি ভাবছেন।
এ যেন এক বিচিত্র অনুভূতি।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর শান্ত সংযত, ভঙ্গিমা বুদ্ধিদীপ্ত, গভীর নদীর শান্ত ঢেউয়ের মত।
একেবারে গোড়া থেকে আমার মনে হয়েছে, এই কেসের গভীরে পৌঁছতে হলে বাইরে থেকে কোন ক্ল সন্ধানের প্রয়োজন নেই, সত্যিকারের ক্লু হল ভিতর থেকে অনুসন্ধান কাজ চালানো। এ কেসের ব্যাপারে আমি বলতে পারি–কারোর ব্যক্তিগত এবং গোপন হৃদয়ের সংঘাতই হল অমন নিষ্ঠুর পরিণতি। আমার ধারণা, এ কেসের সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করার মত রসদ যদিও আমার হাতে ছিল না গোড়ার পর্বে, তবু আমি বলতে পারি যে সম্ভাব্য সমাধানের পথ এখানেই নিহীত আছে।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
এখানে এসে এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সময় থেকে আমার অনুসন্ধানের যাত্রা শুরু। আমার ধারণা প্রতিটি ঘটনার একটা নির্দিষ্ট আকৃতি এবং রূপ আছে। এই ঘটনার ধরন দেখে মনে হয় মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমাধানের সূত্রটা লুকিয়ে আছে। তাই যতক্ষণ না জানতে পারছি, মিসেস লিডনার ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়–কেন তিনি খুন হলেন, আর কেই বা তাকে খুন করল? অতএব আমার অনুসন্ধানের প্রথম কাজ হল–মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হওয়া।
মনস্তত্বের দিক থেকে আর একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল–এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যদের মনের মধ্যে সব সময় একটা উদ্বেগ, উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে, মিসেস লিডনারের উপরে তাদের দুর্বলতার জন্যই বোধহয় এমনি আশঙ্কা। যাইহোক, পরে এক সময় আমি এর সঠিক মূল্যায়ন করব আপনাদের কাছে।
শুরুতেই বলে রাখি, মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের উপরে আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছি।
আমার ধারণা, মিসেস লিডনার একটু উগ্র প্রকৃতির হলেও তাঁর মধ্যে একটা শিশুসুলভ রুচিবোধ আছে। তার শয়নকক্ষে বইগুলো দেখে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে তার বুদ্ধি ছিল এবং তিনি ছিলেন অহঙ্কারী।
হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে যে পুরুষদের আকর্ষণ করার প্রবণতা ছিল তার প্রবল। তবে তাই বলে এই নয় যে, তার সেই প্রবণতার দরুণই এমনি এক দুর্ঘটনায় পতিত হন তিনি।
তাঁর সংগৃহীত বইগুলোর মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব ছিল। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় তার এই রুচিবোধ। উপন্যাসের মধ্যে, লিনডা কনডন এবং ক্রিউ ট্রেন বই দুটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নারী স্বাধীনতায় মিসেস লিডনারের সহানুভূতি এবং সমর্থন ছিল। এর থেকে বোঝা যায় লেডী হেস্টার স্ট্যানহোপের ব্যক্তিত্ব তাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। লিনডা কনডন-এ দেখা যায়, ভদ্রমহিলা তার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে বড্ড বেশি সচেতন। এসব পর্যালোচনা করে আমি বেশ বুঝতে পারছি–এই মৃত ভদ্রমহিলা ঠিক কি ধরনের ছিলেন।
ডঃ রেলি এবং অন্যদের সঙ্গে আমি গোপনে আলোচনা করে জেনেছি–মিসেস লিডনার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দারুণ সচেতন এবং অহঙ্কারী ছিলেন। এই সব মহিলারা ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে–সময় সময় নিজের ক্ষেত্রে এবং কখনও বা অপরের ক্ষেত্রে। মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। নারী-পুরুষ ভক্তবৃন্দের মধ্যে মক্ষিরানী হয়ে বসে থাকতে ভালবাসতেন তিনি। নার্স লিথেরান, যিনি একজন উদার মনোভাবাপন্ন মহিলা–যাঁর একটা কাব্যিক চেতনাবোধ আছে, তিনিও মিসেস লিডনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মানুষের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে আর একটা উপায় জানা ছিল মিসেস লিডনারের, মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের প্রভাবিত করা।