ওই একই ব্যাপার, মেজর পেনিম্যান কি যেন চিন্তা করে বললেন, মিসেস কেলসির সব বক্তব্য সত্য বলে ধরে নিলেও, আমি মনে করি না, তার সেই কৌতূহলের কোন রেশ থাকতে পারে। বরং আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, একটা বিরাট ঝড় উঠতে যাচ্ছে এবং সে ঝড় যে কোন মুহূর্তে উঠতে পারে।
তাই বলে এই নতুন নার্সটিকে শুরুতেই ভয় পাইয়ে দেবেন না, মিসেস কেলসি সতর্ক করে দেন, দিন তিনেকের মধ্যে ও সেখানে যাচ্ছে। এ সময় এমন কিছু বলবেন না, যাতে ও ঘাবড়ে যায়।
ওহো, আপনারা আমাকে কিছুতেই ভয় পাওয়াতে পারবেন না। কথাটা বলে আমি হাসলাম।
যাইহোক, ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু কানে তখন বাজছিল। বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সেই অদ্ভুত মন্তব্য তার স্ত্রীর সম্বন্ধে। আমার সঙ্গ পেলে ওঁর স্ত্রী নাকি নিরাপদ বলে মনে করবে নিজেকে। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রকৃত ভয়ের কারণটা সবার কাছে তখন অজ্ঞাত? আর সেই জন্যই কী তাদের এত মাথা ব্যথা? নাকি তার ভয়ের কারণটা তারা জেনে গেছেন বলেই তাঁদের এত ভয়, কখন কি হয়, কে জানে?
মিসেস কেলসির শেষ মন্তব্যের অর্থটা এখন আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না।
ঠিক আছে, আমি নিজের মনে ভাবলাম, আমি অপেক্ষা করে দেখব।
.
০৪.
হাসানিয়েয় পৌঁছে
তিনদিন পরে আমি বাগদাদ ছেড়ে এলাম।
মিসেস কেলসি এবং বেবীকে ছেড়ে আসতে গিয়ে আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল। মেজর কেলসি নিজে আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনে এলেন। আগামীকাল সকালে কিরকুকে আমার পৌঁছানোর কথা, যেখানে হয়তো কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
বিশ্রীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ট্রেনে কখনো আমার ভাল ঘুম হয় না। যাইহোক, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার বাইরে নজর পড়তেই চোখ সার্থক হল, দিনটা চমৎকার বলে মনে হল, চলমান দৃশ্যগুলো আরো বেশি চমৎকার যেন। আমার খুব কৌতূহল হল লোকগুলোর সম্বন্ধে, যাদের আমি দেখতে যাচ্ছি।
আমার দৃষ্টি প্রসারিত প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে, বুঝি বা একটু ইতস্ততঃ। চেয়ে থাকতে গিয়ে আমার মনে হল একটি যুবক আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফ্যাকাশে লাল গোল মুখ। সত্যি কথা বলতে কি জীবনে এ রকম আর কাউকে দেখিনি যার সঙ্গে মিঃ পি. জে. উডহাউসের বইয়ের সেই যুবকটির সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই মুখ, সেই চোখ।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো,তার চোখে এক অজানা কৌতূহল, আপনি নার্স লিথেরান না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি নার্স লিথেরান নিশ্চয়ই। হ্যাঁ হ্যাঁ! অধমের নাম কোলম্যান। ডঃ লিডনার আমাকে পাঠিয়েছেন। কেমন বুঝছেন? জঘন্য ট্রেন যাত্রা, এই তত? এই দেখুন, আমি খুব বেশি কথা বলছি, না? চলুন, এবার যাওয়া যাক, বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বাস নয়, স্টেশন-ওয়াগান বলা যেতে পারে, আবার ছোট লরী কিংবা বড় গাড়িও বলা যেতে পারে। মিঃ কোলম্যান আমাকে চালকের পাশের আসনে বসার পরামর্শ দিল, ঝাঁকুনি কম হবে।
ঝাঁকুনি! এখানে এসে পথ চলতে গিয়ে আমার দেহের সব হাড়গুলো যে এখনো আস্ত আছে সেটাই এখন বড় বিস্ময়। এখানকার জীর্ণ ক্ষত-বিক্ষত রাস্তাগুলো দেখে আমাদের ইংলণ্ডের দৃষ্টি নন্দনকারী রাস্তাগুলোর কথা মনে পড়লে দেশে ফেরার জন্য মনটা কেমন উতলা হয়ে ওঠে।
কোলম্যান বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েছিল, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে সে বলে, ট্রাকটার অবস্থা মোটামুটি ভালই! ভয়ের কোন কারণ নেই। তাছাড়া আপনার পক্ষে খুব ভাল, লিভারটাকে ঝাঁকুনি দেয়। বললো সে, আপনার সেটা জানা দরকার নার্স।
যদি আমার মাথা ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে লিভার ভাল রেখে কী লাভ?
বৃষ্টির পর আপনার আসা উচিত ছিল। নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারতেন।
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
চারঘন্টা লাগল হাসানিয়েতে আসতে। জায়গাটা বেশ বড়। নদী পেরিয়ে শহর। চোখ ধাঁধান মনোরম দৃশ্য। দূর থেকে শ্বেত পাথরের সাদা ধবধবে মিনারগুলো পরীদের মতো মনে হয়।
মিঃ কোলম্যান আমাকে ডঃ রেলির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ডঃ রেলি লাঞ্চের অপেক্ষায় বসেছিলেন। চির হাস্যময় শান্ত সুন্দর মেজাজের ডঃ রেলির মতোই তাঁর বাড়িটাও বেশ ঝকঝকে উজ্জ্বল, ঘর বাথরুম সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। স্নান সেরে গায়ে ইউনিফরম চাপাবার পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে খোশ মেজাজের বলে মনে হল।
লাঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ডঃ রেলি তার মেয়ের দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলেন। লাঞ্চের মাঝে তার মেয়ে এসে হাজির হল। ডঃ রেলি পরিচয় করিয়ে দিলেন, নার্স, এ আমার মেয়ে শীলা।
টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে করমর্দন করল সে এবং আশা করল, আমার ট্রেন যাত্রা সুখকর হয়েছে নিশ্চয়ই। তারপর কোলম্যানের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নেড়ে বসল শীলা।
আচ্ছা, বিল, জিজ্ঞাসা করল সে, সব কেমন চলছে?
তারা ক্লাব আর পার্টি নিয়ে আলোচনা করছিল। ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু আমার ঠিক পছন্দের নয়। মনে হয় মেয়েটি একটু হাল্কা ধরনের, যদিও সে দেখতে ভাল, নীল চোখ, কালো চুল, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে ক্লান্তির ছাপ, দেখলে মায়া হয়। কিন্তু ওদের বিদ্রুপে ভরা কথাবার্তা আমাকে দারুণ আঘাত করল। কোলম্যানের কথাবার্তাও এখন কেমন বিসদৃশ্য। শীলার সংস্পর্শে এসে সে তার সেই আগেকার স্বাভাবিক কথাবার্তা ভুলতে বসেছে। কেমন নিরেট নির্বোধের মতো কথা বলার ভঙ্গি তার। সে আমাকে এমন একটা কুকুর সম্বন্ধে সতর্ক করে দিল, যাকে আমি আদৌ চোখে দেখিনি এখনো।