আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ডঃ লিডনারকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম এবং পরে তিনি সবার ঘুম ভাঙ্গালেন হৈ-চৈ করে। ডেভিড এয়োটকে পাঠানো হল হাসানিয়ের ডঃ রেলিকে ডেকে আনার জন্য।
মিস জনসনকে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করলাম। ঝুঁকে পড়ে আমি তাকে মরফিয়া ইনজেকসন দিতে গেলে অস্ফুটে কি যেন বলতে গেলেন তিনি। কোন কথাই স্পষ্ট নয়, শ্বাসরোধ করা কণ্ঠস্বর।
এই জানালা…… কোন রকমে তিনি বলেন, নার্স, ওই জানালা…..
সেই শেষ কথা তাঁর, সেই শেষ তার চোখ মেলে তাকানো। তারপরেই তার দেহের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মিস জনসন। সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় রাত্রির কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। তারপর একে একে এলেন ডঃ রেলি, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, এবং সব শেষে এলেন এরকুল পোয়ারো।
পোয়ারোকে দেখে আমি চোখে জল রাখতে পারলাম না। উঃ কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো। সান্ত্বনার সুরে বললেন–হ্যাঁ, অত উতলা হবেন না। আমি জানি, আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা আপনি করেছেন। আমার মনে হয়, সম্ভবতঃ মিস জনসন ঘুম থেকে সম্পূর্ণ জেগে ওঠার আগে ওই অ্যাসিডের কিছু অংশ গলাধঃকরণ করে থাকবেন। তা আপনার কী ধারণা নার্স?
না, আমার তা বিশ্বাস হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম আমার বিশ্বাস, গতকাল অপরাহ্নে অস্বাভাবিক কিছু একটা তিনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন।
আপনি কী বলতে চাইছেন? তবে কি তিনি কিছু দেখেছেন?
তারপর পোয়ারোকে আমি আমাদের গতকালের সেই কথাবার্তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করে শোনালাম। সব শোনার পর একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। সেই শব্দ আক্ষেপের, দীর্ঘশ্বাসের।
তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ছাদে উঠে এলাম জায়গাটা দেখানোর জন্য। যেখান। থেকে গতকাল অপরাহ্নে মিস জনসন হয়তো কাউকে দেখে থাকবেন, যে তার ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে।
ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে মিঃ রেইটারকে তখন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার কথা এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পেরিয়ে যাওয়ার কথা, সব আমি খুলে বললাম, কোন কথাই গোপন করলাম না কিন্তু আমরা তো তখন অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পাইনি। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–কী তিনি দেখেছিলেন?
ঠিক সেই সময় ভোর হয়ে আসছিল। সারা পূর্ব আকাশে রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে।
আঃ কি চমৎকার সূর্যোদয়! শান্তভাবে বললেন পোয়ারো। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হল পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।
তারপর আমি তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম।
সত্যি আমি কি বোকা, বিড়বিড় করে আপন মনে তিনি বলে চলেন, সত্যি যেখানে এত স্পষ্ট, এত স্পষ্ট–
২৫. আত্মহত্যা নাকি খুন
২৫. আত্মহত্যা নাকি খুন
পোয়ারো কি বলতে চান, তাকে জিজ্ঞাসা করার অবসরটুকুও আমি পেলাম না ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের জন্য। তিনি তখন নিচ থেকে হাত নেড়ে ডাকছিলেন, নিচে নেমে আসুন, জরুরী আলোচনা আছে। তাই আমরা দ্রুত নিচে নেমে আসি।
আর এক বিপর্যয়ের কাহিনী শুনুন মঁসিয়ে পোয়ারো তিনি বললেন, –সেই সন্ন্যাসী ফাদার ল্যাভিগনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেকি? চমকে উঠলেন পোয়ারো তার কথা শুনে।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো, তাকে তার ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে আমাদের কারোরই খেয়াল হয়নি তার সম্বন্ধে। ভোর হতেই আমাদের মনে হল–কই ফাদার ল্যাভিগনিকে তো দেখা যাচ্ছে না। তিনি কোথায়? তারপর তার ঘরে গিয়ে দেখি।
বাড়ির চাকরদের ডাক পড়ল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল, তারা নাকি ফাদার ল্যাভিগনিকে গতকাল রাত আটটার পর তার রোজকার অভ্যাস মত বাড়ির বাইরে বেড়াতে যান, কিন্তু কেউ তাকে ফিরে আসতে দেখেনি। রাত ন’টার পর প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে যায়। আজ সকালে সেই ফটক ঘোলা থাকতে দেখে দু’জন চাকর মনে করে তাদের মধ্যে কেউ একজন নিশ্চয়ই খুলে থাকবে। কিন্তু আসলে তারা কেউই ফটক সেদিন খোলেনি।
তাঁদের আলোচনার মাঝে ডঃ রেলি এসে হাজির হলেন, তার পিছন পিছন এলেন মিঃ মারকাডো।
হ্যালো রেলি, কিছু পেলেন?
হ্যাঁ, ল্যাবরেটরি থেকে অ্যাসিডটা নেওয়া হয়। প্রতিটি অ্যাসিডের বোতল আমি পরীক্ষা করে দেখেছি মিঃ মারকাভোর সঙ্গে। এইচ. সি. এল-র বোতলে এই অ্যাসিডের পরিমাণ একটু কম ছিল। অতএব।
কেন, ল্যাবরেটরিতে চাবি দেওয়া থাকে না?
মারকাডো মাথা নাড়েন। ভয়ে তার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমতা আমতা করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, থাকবে না কেন। তবে কি জানেন, চাবিটা থাকে বসবার ঘরে।
বাঃ, তাহলে তো খুবই মজার ব্যাপার, মেটল্যান্ড মুখ বিকৃতি করে বলে ওঠেন, যে-কেউ যে-কোন ঘরের চাবি নিয়ে যা খুশি করতে পারে। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, এখন দেখতে হবে মিস জনসন নিজের হাতে ল্যাবোরেটরি থেকে সেই অ্যাসিড সংগ্রহ করেছিলেন কি না?
না, তিনি নিজে সংগ্রহ করেননি, হঠাৎ আমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার হাতে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। ফিরে তাকাতেই দেখি পোয়ারো আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে গভীর প্রত্যয়।
প্রসঙ্গটা অবশ্য ধামাচাপা পড়ে গেল হঠাৎ সেখানে একটা গাড়ির আবির্ভাব হতে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন ছোট বেঁটে ধরনের লোক। নাম তার ভেরিয়ার। ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ। আরবী ভাষা জানেন না। ইটালি যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে যান। ডঃ লিডনার তাকে দুর্ঘটনার কথা বলতে ভদ্রলোক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন আপনাদের মাঝে আমি এমন সময় এলাম যখন আপনারা একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।