ঠিক বেলা দেড়টার সময় ভেজানো দরজার পাল্লাটা একটু করে খুলে যেতে থাকে।
এবার আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রসারিত হল দরজার উপরে। সেই সময় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা আমি দেখতে চাই, দরজা ঠেলে কে ঘরে ঢোকে?
ধীরে ধীরে দরজার ফাঁক বড় হতে থাকল। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে যেতেই দেখলাম দরজার ওপরে বিল কোলম্যান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে তার এক গুচ্ছ লাল টকটকে ফুল।
আমি দুঃখিত নার্স অপরাধীর মতো তিনি কৈফিয়ত দিতে চাইলেন, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে, আগে থেকে আপনাকে খবর না দিয়ে ঘরে ঢোকাটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
কি সরল যুবক। মায়া হল তার জন্য। হাসতে হাসতে বললাম–আপনি মিঃ কোলম্যান, দেখুন তো কি ভয় না আমাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কোলম্যান আর একদফা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তার এখানে আসার উদ্দেশ্যর কথা জানালেন। মিসেস লিডনারের ছবির সামনে ওই লাল ফুলগুলো তিনি নাকি রোজ রেখে যান তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।
সত্যি তাকে শ্রদ্ধা জানানোর এ এক মহৎ প্রচেষ্টা মিঃ কোলম্যান। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম স্বাভাবিক, আপনি ছিলেন তাঁর সত্যিকারের একজন গুণগ্রাহী। আপনার আচরণে খাঁটি ইংরেজ বনেদিয়ানা পুরোপুরি বর্তমান।
আমি যাচ্ছি শুনে ফাদার ল্যাভিগনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–মিঃ পোয়ারোকে আজ দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় তিনি?
আমি তাকে বললাম আজ সারাদিন তিনি টেলিগ্রাম পাঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকবেন।
ফাদার ল্যাভিগনি ভ্রু কোঁচকালেন।
টেলিগ্রাম? আমেরিকায়?
হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।
তারপর তিনি জানতে চাইলেন মিসেস লিডনার এবং আমি কখন কোথায় কিভাবে জানালার সামনে সেই আগন্তুককে মিসেস লিডনারের ঘরে উঁকি মারতে দেখেছি, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি দিতে পারি কি না। শেষে তিনি তার মতামত জানিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ হয়, নোকটা ইউরোপীয় কি না, কারণ এখানে ইরাকি ছাড়া ওভাবে কেউ উঁকি দিতে পারে না।
ফাদার ল্যাভিগনির ধারণাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো তার কথাই ঠিক, এ কাজ স্থানীয় লোকেরাই করে থাকবে।
তাছাড়া, খুনী নিশ্চয়ই একটা না একটা জিনিস ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়ে থাকবে। ফাদার ল্যাভিগনি বাড়ির বাইরেটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন–গোয়েন্দা গল্পে অপরাধীরা সব সময় এরকম ভুল করে থাকে।
কিন্তু বাস্তব জীবনে অপরাধীরা দারুণ চালাক। আমি তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিলাম।
ফাদার ল্যাভিগনি চলে যাবার পর আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলাম। মিস জনসনকে ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তার দৃষ্টি সামনের দিকে। স্থির চোখে কি যেন লক্ষ্য করছিলেন তিনি। কাছে গিয়ে তার পিঠে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম–অমন নিবিষ্ট মনে কী দেখছেন মিস জনসন?
তাঁর চোখে আতঙ্কের ছায়া থিরথির করে কাঁপতে থাকে–কেমন করে বাইরে থেকে কোন লোক নিঃশব্দে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে, আমি সেটা খুঁটিয়ে দেখছি।
মিস জনসনকে অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সামনের দিকে। দেখলাম, মিঃ রেইটার ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পার হচ্ছিলেন।
সত্যি? কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। একটু খুলে বলবেন মিস জনসন?
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন মিস জনসন, এখন নয়, এখন নয়, পরে। আরও ভাল করে আমাদের দেখতে হবে। আমাকে প্রথমে ভাবতে হবে, তারপর–
কথাটা অসমাপ্ত রেখে নিচে নেমে যান মিস জনসন। আমাকে আহ্বান না জানিয়েই। বেশ বুঝতে পারি, এই মুহূর্তে উনি আমার সঙ্গ চান না। অতঃপর আমি আবার দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম। প্রধান প্রবেশ পথের সামনে ওয়াটার বয় এবং ভারতীয় রাঁধুনি আলাপরত। আমার ধারণা, ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।
.
২৪.
খুন একটা অভ্যাস
সেদিন রাত্রে আমরা একটু সকাল সকাল ঘুমোতে গেলাম। নৈশভোজের সময় মিস জনসনের আচরণ আগের থেকে একটু স্বাভাবিক বলেই মনে হল। তবে সব সময় চুপচাপ ছিল সে। স্তব্ধ, হতবাক। মনে হয়, মনের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই চালাচ্ছিল সে ভিতরে ভিতরে। মাঝরাতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজে আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। কান পেতে শুনি আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে। দরজার বাইরে এসে টের পেলাম শব্দটা আসছে মিস জনসনের ঘর থেকে। তাড়াতাড়ি তার ঘরে ছুটে যাই। আমার ঘরের পাশেই তার ঘর।
বিছানায় মিস জনসনের দেহটা থরথর করে কাঁপছিল। আমার হাতের মোমবাতিটা তার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই কথা বলার জন্য চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু তার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ফিস্ ফিস্ শব্দের মত শোনাল। বোঝা গেল না একবর্ণও। ভাল করে তাকাতে গিয়ে আমি দেখলাম মিস জনসনের ঠোঁট দুটি এবং চিবুকের একটা অংশ পুড়ে গেছে।
মিস জনসন তার দৃষ্টি আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা একটি গ্লাসের উপরে ফেললেন, যেটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি সেটা হাতে তুলে নিয়ে তার ভিতরে একটা আঙুল রাখতে গিয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে উঠলাম। আমার আঙুলটা তখন জ্বলে যাচ্ছিল যেন। পরক্ষণে আমি মিস জনসনের মুখের দিকে তাকালাম।
ঘটনাটা যে কি, বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হল না। যেভাবেই হোক, ইচ্ছাকৃত কিম্বা জোর করেই হোক, কিছু পরিমাণ, অক্সালিক কিম্বা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তাকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। আমার তাই সন্দেহ।