তুমি অহেতুক কিন্তু উতলা হচ্ছ। ওসব কথা মাথায় এনো না। আমি তো আর তোমাকে মহিলা গোয়েন্দা হিসাবে নিযুক্ত করিনি। তাছাড়া আমার স্ত্রীর এমন আসন্ন বিপদের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, স্নায়ুর চাপে ভুগছে, সাময়িক, কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শেষ দু’তিন দিন ওকে আমি বেশ খুশিই বলে মনে করেছিলাম। তোমাকে বিশ্বাস করে নিয়েছিল ও। অতএব তোমার অনুতাপ করার কিছু নেই এই ব্যাপারে।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর তাঁর। আমি জানি কি ভাবছেন তিনি। মিসেস লিডনারের ভয়কে তেমন কোন গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য একমাত্র তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। ডঃ লিডনার, আমার কেমন কৌতূহল হল, জিজ্ঞাসা করলাম–সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনি কী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন?
কোনটা যে বিশ্বাস করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা, মিঃ পোয়ারো কি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন?
আমি জানি গতকাল পর্যন্ত কোন খবর নেই। তবে একবার ভাবলাম মিস জনসনের নামটা উল্লেখ করে দেখি তার মনে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়। চিঠিগুলোর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গত পরশু ডঃ লিডনার এবং মিস জনসনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গভাব আমি দেখেছি, তাতে আমার আগ্রহটা নতুন করে আবার জেগে উঠল। তবে মিস জনসন যদি একান্তই চিঠিগুলো লিখে থাকেন তাহলে এ কথা ঠিক যে, মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পরে তার সময়টা সত্যি ভাল যাচ্ছে বলে মনে হয় না।
সেই বেনামা চিঠিগুলো কোন এক মহিলার লেখা বলেই সন্দেহ হয়।
হয়তো বা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন–কিন্তু নার্স, তুমি ভুলে যাচ্ছ, চিঠিগুলো প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিক বনসারেরই লেখা। ওর মতো পাগল ছাড়া অন্য আর কে এ কাজ করতে পারে? দুর্ঘটনার দিন যেভাবেই হোক (হয়তো চাকরদের ঘুষ দিয়ে থাকবে সে) আমার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করে থাকবে সে। আমিও তাই বিশ্বাস করি।
ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকালেন, আমি তার কথা মন দিয়ে শুনছি কি না দেখার জন্য বোধহয়, কিন্তু মিঃ পোয়ারো সে কথা বিশ্বাস করেন না। তার ধারণা চিঠিগুলো—
হয়তো আপনার অনুমানই ঠিক,আমার কথায় সন্দেহের অবকাশ রেখেই আমি তার কথায় সায় দিলাম।
ডঃ লিডনার তখন উত্তেজিত অবস্থায় বলতে থাকেন, মিঃ পোয়ারো আমার এক্সপিডিসনের লোকেদের সন্দেহ করছেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা কেউই এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন না। আমি তাদের সবাইকে খুব ভাল করে চিনি।
কিন্তু পত্র লেখকের হাতের লেখায় যে মেয়েলী টান আছে ডঃ লিডনার!
আমার অনুমান, মিসেস মারকাডোকে তুমি সন্দেহ করছে। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? না, না এ কাজ তিনি করতে পারেন না।
তাহলে, তাকে বাদ দিলে বাকি থাকেন কেবল মিস জনসন, কথাটা বলে আমি তার ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম।
সে চিন্তা তো আরও অবিশ্বাস্য!
তার স্বল্প হাসির মধ্যে একটা কিছু গোপন করার ভাব যেন লুকিয়ে ছিল। আমার দৃষ্টি এড়ালো না। মিস জনসন যে চিঠিগুলো লিখতে পারেন, এ কথাটা তিনি কিছুতেই মাথায় আনতে চান না। কিন্তু আমি কোন কথা বললাম না। আমি তো জানি, আমি নিজের চোখে মিস জনসনকে অনুতাপ করতে দেখেছি। ডঃ লিডনার তাকে যত আড়ালই করুন না কেন, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না।
যাইহোক, ঠিক হল পরদিন আমি ইংলন্ডে ফিরে যাব। ডঃ রেলির মাধ্যমে ব্যবস্থা করলাম, হসপিটালে মেট্রনের সঙ্গে দু-একদিন আমি থাকব। তারপর ইংলন্ডে ফিরে যাব –গাড়ি এবং ট্রেন পথে বাগদাদ কিম্বা সরাসরি লিসবন হয়ে।
ডঃ লিডনার অনুগ্রহ দেখালেন আমাকে, তার একান্ত ইচ্ছা মিসেস লিডনারের স্মৃতি হিসাবে আমি যেন তার স্ত্রীর ব্যবহৃত দামী কচ্ছপের খোলে তৈরি টয়লেট সেটটা সঙ্গে নিয়ে যাই।
না, না ডঃ লিডনার এ অনুরোধ আমাকে করবেন না, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম, অত দামী সেট আমি নিতে পারব না।
জানো, আমার স্ত্রীর কোন বোন নেই, আর এ জিনিস অন্য কাউকে দেওয়াও যায় না।
তার কথা শুনে মনে হল, ওই দামী টয়লেট সেটটা তিনি লোভী মিসেস মারকাভোকে দিতে চান না। আর আমার মনে হয় না, সেটা তিনি মিস জনসনকে উপহার হিসাবে দিতে চাইবেন।
একটু ভেবে দ্যাখো, ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর আলমারির চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন–আলমারির মধ্যে লুসির অলঙ্কার আছে, তোমার পছন্দ মত একটা বেছে নিও। আর একটা কথা, ওর সব পোষাকগুলো সঙ্গে নিয়ে যেও। ডঃ রেলি হাসানিয়ের গরীব খ্রিশ্চিয়ান পরিবারদের মধ্যে ওর সেই পোষাকগুলো বিতরণ করার ব্যবস্থা করবেন।
ওঁর অমন সৎ প্রস্তাব শুনে আমি খুব খুশি হলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ওঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
মিসেস লিডনারের ঘর। আমার কাজ সেরে তার আলমারিতে চাবি দিয়ে ফিরে আসার আগে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিতে ভুললাম না। ওই সেই খাট, ওই খাটের পাশে দুর্ঘটনার দিন আমি একটা চেয়ারে বসে তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। তিনি বই পড়তে পড়তে আমার কথার জবাব দিচ্ছিলেন। তারপর ওঁর ঘর থেকে চলে আসার পর কি যে হল
আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই। তবু কেন জানি না আমার মনে হল, মিসেস লিডনারের আত্মা বোধহয় এই ঘরের ভিতরে বিচরণ করছে নিশ্চয়ই। হাসপাতালে মেয়েদের সেই প্ল্যানচেট করার কথা আমার মনে পড়ে গেল। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সেই প্ল্যানচেটে লেখা হয়েছিল। কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই যেন নিজেকে সম্মোহিত করে ফেললাম। আমি আর তখন আমি নই। আমি তখন মিসেস লিডনারে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। সময় সেদিনকার সেই দুপুরবেলা। আমি মিসেস লিডনার! নিজের মনেই আমি নিজেকে মিসেস লিডনার হিসাবে জাহির করতে থাকলাম। তার বিছানায় চোখ বন্ধ করে আধো ঘুমে ঘুমিয়ে আছি আমি।