আর একটু হলে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, মিস জনসন ঠিক সময়ে ধরে ফেললেন তাকে।
শান্ত হন। ধমকের সুরে মিস জনসন তাকে বলেন–ডঃ লিডনার রয়েছেন, আমরা ভেঙ্গে পড়লে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে; তাই এভাবে আমাদের ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়।
বস্তুতপক্ষে সেই মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন ডঃ লিডনার। বিবর্ণ মুখ। চোখের কোলে কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। এই তিন দিনে তার বয়স যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
শান্ত গলায় ধীরে ধীরে তিনি খবরটা দিলেন–কাল সকাল এগারোটায় অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। মেজর ডীন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া পরিচালনা করবেন।
মিসেস মারকাডো আমতা আমতা করে কি যেন বলতে গেলেন, কিন্তু কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে।
অ্যানি, তুমি আসছো তো? মিস জনসনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন ডঃ লিডনার।
হ্যাঁ প্রিয়, নিশ্চয়ই আসব। কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে গলা কেঁপে উঠল মিস জনসনের।
প্রিয় অ্যানি, ডঃ লিডনারের কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া। তুমি আমার পুরানো বান্ধবী, আমার দুঃসময়ের সঙ্গিনী। তোমার কাছে এলে আমার সব দুঃখ জ্বালা যেন নিমেষে জুড়িয়ে যায়।
ডঃ লিডনার কাছে গিয়ে মিস জনসনের হাতে হাত রাখেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম–মিস জনসনের দেহটা ঈষৎ কেঁপে উঠল, মুখের রঙ লাল হল। সেই মুহূর্তে কেন জানি না আমার মনে হল, মিস জনসনের মতো সুখী মহিলা আর কেউ সেখানে ছিল বলে মনে হয় না।
আর একটা সম্ভাবনার কথা হঠাৎ আমার মনে উদয় হল। সম্ভবত পরে কোন এক সময় পুরানো বন্ধুত্বের সুবাদে ওঁরা পরস্পরের কাছে আসার চেষ্টা করবেন এবং এক নতুন সুখী জীবন হয়তো গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার আগে এসব কথা আমার চিন্তা করা উচিত নয়, তবু মনে হয় ওঁদের বন্ধুত্বের পরিণতি এভাবেই হওয়া উচিত। বিশেষ করে মিস জনসন যখন মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি অনুরক্ত বাকি জীবনটা মিলন সুখে গা ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। আর আমি তো জানি, মেয়েরা যে জিনিসটা চাইব মনে করে, না পাওয়া পর্যন্ত থেমে থাকতে পারে না।
তারপর ডঃ লিডনার ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে, জানতে চাইলেন কেসের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি হল কিনা।
ডঃ লিডনারের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস জনসন। তার দৃষ্টি পড়েছিল পোয়ারোর হাতের কার্ডবোর্ডের বক্সের উপরে। চোখে করুণ মিনতি পোয়ারোর প্রতি। তিনি যেন ওই বাক্সবন্দি মুখোশের কথাটা এই মুহূর্তে ডঃ লিডনারকে না বলেন। অন্তত আর একটা দিন তিনি যেন চুপ করে থাকেন এ ব্যাপারে।
পোয়ারো তার অনুরোধ রাখলেন। ধীরে ধীরে ডঃ লিডনারের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললেন–এসব কেসের কাজে অগ্রগতি হয় অতি ধীরে ধীরে মঁসিয়ে।
তারপর দু’একটা দরকারি কথাবার্তা সেরে ডঃ লিডনার স্থান ত্যাগ করে চলে যান।
মিঃ পোয়ারোকে একা পেয়ে আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিল ডজন খানেক প্রশ্ন করি তাঁকে। কিন্তু কিছুই বলা হল না। সার্জেনের সামনে সহকারী নার্স যেমন অসহায় বোধ করে, আমার অবস্থাও ঠিক তাই। ডাক্তারের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া নিজস্ব বক্তব্য বলতে কিছু থাকতে যে পারে না, এই মুহূর্তে সেই সত্যটা বার বার আমি উপলব্ধি করলাম।
কিন্তু মিঃ পোয়ারো আমার সব ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিয়ে বললেন, খুকুমণি, এখন থেকে আপনি আপনার নিজের যত্ন নেবেন। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বলেন, আমার আশঙ্কা এ জায়গাটা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। যত তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে চলে যান।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে ডঃ লিডনারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই, আমি তাকে বললাম। কিন্তু অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কাজ সমাধা না হওয়া পর্যন্ত তো আমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারছি না আঁসিয়ে!
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, সেই সময়টুকু অযথা কোন বাড়তি উৎসাহ দেখাবার চেষ্টা করবেন না। আপনার কাজ হল আমাকে ছুরি কঁচি এগিয়ে দেওয়া আর আমার কাজ হল রুগীর অপারেশন করা বুঝলেন?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। আমি তখন বেশ বুঝে গেছি, এরপর আমার কৌতূহল দমন করতে হলে কি করা উচিত।
পোয়ারো নিজে থেকেই আবার বললেন–ফাদার ল্যাভিগনি বড় অদ্ভুত মানুষ।
একজন সন্ন্যাসীর প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়াটা আমার কাছে কেমন যেন বেমানান বলে মনে হয়। কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না আমি।
আমি প্রোটেস্ট্যান্ট, আমি কিন্তু একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমার বেশ ভাল ধারণা আছে। তারপর তিনি চোখে ভ্রুকুটি টেনে বলেন মনে রাখবেন, ফাদার ল্যাভিগনি আপনার থেকে অনেক বেশি চতুর। যে-কোন মুহূর্তে তিনি আপনার সর্বনাশ করতে পারেন।
আমার তখন মনে হল–গল্পকথা শুনে তিনি যদি আমাকে সতর্ক করে থাকেন, সে সতর্কতায় কোন গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। আমার অন্তত তাই মনে হল।
.
২৩.
মনোবিশ্লেষণের পালা
মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় তার শত্ৰুমিত্র নির্বিশেষে সবাই যোগ দিলেন। এমনকি শীলা রেলি পর্যন্ত। তার পরনে ছিল কালো রঙের কোট এবং স্কার্ট। তাকে খুব শান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে এসে ডঃ লিডনারকে অনুসরণ করলাম এবং আমার প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গটা তুললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। প্রশংসা করে বললেন, আমি নাকি আমার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছি। আমাকে তিনি বাড়তি এক সপ্তাহের বেতন দিতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম–আমার তো একদিনেরও বেতন পাওয়া উচিৎ নয় ডঃ লিডনার। আপনি বরং আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার খরচটা দিন, তাতেই যথেষ্ট বলে মনে করব আমি।