এরপর ওঁর সঙ্গে কথা আর এগোয়নি, কারণ মিস জনসনের হঠাৎ কোর্টইয়ার্ডে সেই সময় আবির্ভাব হবার জন্য।
আমি জানি, মিঃ পোয়ারোর উদ্দেশ্যটা কি। মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বসবার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র আমি মিসেস লিডনারের ঘরের তালা খুলে চকিতে ঢুকে পড়লাম। পিছন ফিরে একবার তাকালাম, না, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে না।
বন্ধ ঘরের ভিতরে আমি একা। পোয়ারোর নির্দেশ মতো আমি মৃদু চিৎকার করে উঠলাম ওঃ! খুব জোরেও নয়, আবার খুব আস্তেও নয়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম পা টিপেটিপে।
তবে অতো সাবধান হবার কোন দরকার ছিল না। পোয়ারো এবং মিস জনসন গভীর মনোযোগ দিয়ে দুজনে আলোচনা করছিল এবং কোন ব্যাঘাত ঘটল না তাদের সেই আলোচনায়। ঘরের ভিতরে গিয়ে তাদের আলোচনায় আমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। বারান্দায় একটা খালি চেয়ারে বসলাম। সেখান থেকে তাদের কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
কেসটা অত্যন্ত জটিল, বুঝতে পারছেন, পোয়ারো তখন তাকে বোঝাচ্ছিলেন, ডঃ লিডনার নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রীকে আদরযত্ন করতেন–
তিনি তাকে পুজোও করতেন, জনসন তাকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ডঃ লিডনার বলেছেন, তার কর্মচারীরাও খুব শ্রদ্ধাশীল ছিল তার স্ত্রীর প্রতি। খুবই স্বাভাবিক, প্রভুপত্নীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাটাই ভদ্রতা। তাদের সেই ব্যবহারে হয়তো আন্তরিকতা থাকতে পারে, সততা থাকতে পারে। আবার নাও থাকতে পারে। মাদমোয়াজেল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই প্রহেলিকার চাবিকাঠি মিসেস লিডনারের চরিত্রে নিহিত আছে। তাই বলছি, আমি যদি এখানকার প্রতিটি সদস্যদের কাছ থেকে সৎ পরামর্শ পেতাম, তাহলে ওই ব্যাপারে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি এই কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। আর আমি এও জানি, ডঃ লিডনার এখন হাসানিয়েয় থাকবেন। ওঁর অনুপস্থিতিতে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার কাজটা একটু সহজ হবে বলেই মনে হয়। আমি আপনাদের সাহায্য প্রার্থী।
ঠিক আছে, মিস জনসন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।
পোয়ারোর দৃষ্টি পড়েছিল তার উপরে। কি ভেবে তিনি বললেন–তবে আনুগত্যের খাতিরে সময় সময় অনেক অপ্রিয় কথা চেপে যেতে হয়। অপরাধ জগতে এই আনুগত্যের ভাবটা একটা মস্তবড় অপরাধ। সেটা বার বার সত্যকে গোপন করে।
এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহে থাকতে পারেন,মিস জনসনের ঠোঁটে শুকনো হাসি, মিসেস লিডনারের প্রতি আমার কোন বিশেষ আনুগত্য নেই। মিসেস লিডনারের প্রসঙ্গে তার কথার মধ্যে কিসের একটা জ্বালা অনুভূত হয় যেন। ডঃ লিডনারের ব্যাপার আলাদা। যাইহোক, তিনি ছিলেন তার স্ত্রী।
তা অবশ্য ঠিক, তা অবশ্য ঠিক। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি আপনার চীফের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে চান না। কিন্তু এটা কোন সাক্ষ্য প্রমাণের প্রশ্ন নয়। এ প্রশ্ন হঠাৎ এবং রহস্যজনক একটি মৃত্যুকে ঘিরে। মিসেস লিডনার ছিলেন দেবদূত, নিহত হয়ে আজ তিনি শহীদ হয়েছেন, আমার এই বিশ্বাস তবু কাজটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
আমি অবশ্যই তাকে দেবদূত আখ্যায় ভূষিত করব না। মিস জনসনের কথায় আগের থেকে বেশি উত্মা প্রকাশ হতে দেখা যায়।
একজন নারী হিসাবে লিডনারের সম্বন্ধে আপনার মতামত কী পরিষ্কার করে বলুন তো?
হুঁ বলছি। তবে শুরুতেই আপনাকে বলে রাখি আঁসিয়ে পোয়ারো, আমি পক্ষপাত দুষ্ট। আমি, শুধু আমি কেন বলছি, আমরা সবাই ডঃ লিডনারের এখানে আসায় শুরুতে আমরা ঈর্ষান্বিত ছিলাম তার প্রতি। আমরা চাইতাম না বাড়তি সময় খরচ করুন, আদর যত্ন করুক। মিসেস লিডনারের এখানে আসাতে আমরা বিরক্তবোধ করেছিলাম। তবে এ কথা ঠিক যে, মিস জনসন তার কথার জের টেনে বলে–আমার মনের ভাবটা আমি কখনো বাইরে প্রকাশ করতাম না। অন্য সবার থেকে আমাদের তফাত হল এইখানে, বুঝলেন?
আমাদের? আমাদের কেন বলছেন আপনি?
মিঃ ক্যারি এবং আমি। কারণ কি জানেন, দুজনই কেবল বহুদিনের পুরনো কর্মচারী এখানকার। তাই আমরা কোন পরিবর্তন বরদাস্ত করতে পারতাম না। সেটাই তো স্বাভাবিক, কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
কেন, পরিবর্তনটা কিসের বলুন তো?
ওঃ! পরিবর্তন তো সবেতেই। আগে আমরা এখানে কতই না সুখে ছিলাম। ডঃ লিডনার খুব আমুদে লোক ছিলেন, তাঁকে নিয়ে আমরা কতই না ঠাট্টা তামাশা করতাম। আমাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে তিনি একেবারে বাচ্চা ছেলে হয়ে যেতেন।
আর মিসেস লিডনার আসার পর তিনি বদলে যান, এই তো?
সে যাইহোক আমি কিন্তু মনে করি না, এর জন্য মিসেস লিডনার দায়ী। বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, গত বছরটা আমাদের খুব একটা খারাপ যায়নি, আর আমাদের বিরক্তিকর কোন কাজ তিনি করেননি। আমার কাছে তিনি সব সময় চমৎকার মহিলা বলেই মনে হত। তাঁর মতো অমন ভাল মহিলা কেউ আর হতে পারে না।
সে যাইহোক– পোয়ারো স্মরণ করিয়ে দেন, পরিবর্তনটা কিন্তু এ বছরই লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াটা কেমন বদলে যায় এখানকার তাই না?
হ্যাঁ, সত্যি সম্পূর্ণ আবহাওয়াটাই কেমন বদলে যায়। মিস জনসন ভাবতে থাকে, কেন, কেন এই পরিবর্তন? সবেতেই কেমন ভুল-ভ্রান্তি, অবশ্য তাদের কাজকর্মে নয়। ভুল-ভ্রান্তি তাদের মেজাজে, তাদের স্বভাবে।
আর তার জন্য সব দোষ আপনারা চাপাতে চান মিসেস লিডনারের ঘাড়ে?