কি হয়েছে মিস জনসন? তার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলোতে গিয়ে শুধালাম, এখন এভাবে ভেঙ্গে পড়লে, চলবে না। ওঠো, কেঁদো না।
মিস জনসন আমার কথার উত্তর দিল না। বরং সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শোনো এ ভাবে কেঁদো না, শান্ত হও, আমি তোমার জন্য চা তৈরি করে নিয়ে আসছি।
এবার সে মাথা তুলে তাকাল। না, না, আমি ঠিক আছি নার্স। বোকার মত আমি-
তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না সে, পরে এক সময় সে বলে, সে বড় ভয়ঙ্কর, বড়-
এখন, এসব কথা চিন্তা করো না, আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, যা হবার হয়ে গেছে, ভুল তত আর সংশোধন করা যাবে না।
মিস জনসন এবার সোজা হয়ে বসল। চুলে বিলি কাটতে কাটতে সে বলে, আমি কী বোকা? অফিসঘর পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম। তারপর হঠাৎ ধূমকেতুর মতো–
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি বৈকি। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, এক কাপ কড়া চা আর গরম জলের বোতল তোমার বিছানার পাশে দেখতে চাও, এই তো?
ধন্যবাদ নার্স, আমি বিছানায় তার পাশে বসলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে বলে, তোমার মতো কর্তব্য পরায়ণ মহিলা আমি এর আগে দেখিনি। চমৎকার মেয়ে তুমি। তারপর একটু থেমে সে অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করে, একটু আগে কী যেন বলছিলে তুমি? কথাটা কী সত্যি? যা ঘটে গেছে তা আর সংশোধন করা যায় না–
মিনিট দুই নীরব থেকে সে একটা অদ্ভুত কথা শোনাল, জানো নার্স, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।
আমি তার কথার কোন প্রতিবাদ করলাম না। আমার আশঙ্কা, তবে কি মিস জনসন তার মৃত্যুতে মনে মনে খুশি হয়েছিল? তারপর এখন সেই কথা ভেবে সে লজ্জাবোধ করছে!
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আমি তৎপর হলাম। চেয়ারের উপর থেকে তার পরণের কোর্ট, স্কার্ট হ্যাংগারে রাখতে গিয়ে মেঝের উপরে একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলাম। মনে হয়, তার কোটের পকেট থেকে সেটা পড়ে গিয়ে থাকবে।
কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে জানালা গলিয়ে ফেলতে যাব, মিস জনসন চিৎকার করে উঠল, ওটা আমায় দাও!
আমি তার কথা মতো কাগজের টুকরোটা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সে একরকম ছিনিয়ে নিল আমার হাত থেকে সেটা এবং সেটা সে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় মেলে ধরল যতক্ষণ না সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু তার আগে দূর থেকে সেই কাগজের হাতের লেখাটা দেখে আমি স্তব্ধ, হতবাক।
বিছানায় শুয়েও প্রসঙ্গটা আমার মনে দারুণ আলোড়িত হতে থাকে। এখন বুঝতে পারছি, ওঁরা কেন আমাকে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আমি একজন মহিলা বলেই মিস জনসনের বেডরুমে প্রবেশ করতে পেরেছি। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, সেই একই হাতের লেখা, বেনামা চিঠিগুলোতে সেই একই রকম হাতের লেখা আমি দেখেছিলাম।
তবে কী এই কারণেই সে তখন অনুতাপ করছিল? সেই বেনামা চিঠিগুলো কী তাহলে মিস জনসন এতদিন লিখে আসছিল?
২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার
২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার
আমি ভাবতেই পারিনি, সেই বেনামা চিঠিগুলোর সঙ্গে মিস জনসন জড়িয়ে পড়বে। সম্ভাব্য নাম মিসেস মারকাডো। কিন্তু মিস জনসনের মতো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, সমঝদার এবং খাঁটি মহিলা নয়। এ যেন অবিশ্বাস্য একটি নাম।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে আজ সন্ধ্যায় পোয়ারো এবং ডঃ রেলির সন্দেহের কথা মনে পড়ে যেতেই নিজেকে আমি প্রশ্ন করি, কেন, কেন সে এ কাজ করতে গেল? মিস জনসন এই খুনের ব্যাপারে জড়িত, এক মুহূর্তের জন্যও সে কথা অস্বীকার করা যায় না, মিসেস লিডনারকে সে অপছন্দ করত, কেন? এমনও তো হতে পারে, মিসেস জনসনের প্রতি তার সেই বিরূপ মনোভাব তাকে এ কাজে প্রলোভিত করে থাকবে।
তবে মিসেস লিডনারের খুন হওয়ার পর তার মনে অনুশোচনা জেগে থাকবে, হ্যাঁ, ঠিক অনুশোচনা নয়, ভয় বলা যেতে পারে। সেই ভীতির কারণ দুটি প্রথমতঃ তার সেই নিষ্ঠুর চতুর খেলার জন্য দ্বিতীয়ত খুনের পর সে বুঝতে পারে, সেই চিঠিগুলো প্রকৃত খুনীর স্বপক্ষে একটা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সে ওভাবে ভেঙ্গে পড়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু এখনো আমি বিশ্বাস করি, তার মত কোমল নারী সচরাচর খুব কম দেখা যায়। এর প্রমাণ আমি তার কথায় প্রতিফলিত হতে দেখেছি। তা না হলে আমি যখন তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম, যা ঘটার ঘটে গেছে, সে ভুলের সংশোধন আর হতে পারে না, কেন মিস জনসন সে কথায় আগ্রহ দেখাতে গেল?
এবং তারপরে নিজের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য তার সেই রহস্যময় উক্তি, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।
প্রশ্ন হল, আমার এখন কী করা উচিত? অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি ঠিক করলাম, প্রথম সুযোগেই খবরটা দিতে হবে মিঃ পোয়ারোকে।
পরদিন তিনি আবার এলেন, কিন্তু বলার সুযোগ বলতে যা বোঝায়, মানে সেই গোপন পরিবেশটা আমি পেলাম না। সুযোগ এসেছিল মাত্র এক মিনিট, সেই এক মিনিট সময়ে যখন আমি ভাবছি, কি করে প্রসঙ্গটা শুরু করব ঠিক সেই সময় তিনি আমার কাছে এসে কানে কানে মন্ত্র দেওয়ার মতো করে বললেন।
মিস জনসন এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমি আলোচনা করব বসবার ঘরে সম্ভবত। আপনার কাছে মিসেস লিডনারের ঘরের চাবি আছে না?
হ্যাঁ, আছে বৈকি!
তাহলে মিস লিডনারের ঘরে ঢুকে অতি সন্তর্পনে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করবেন। তারপর কান্নার মতো করে চেঁচাবেন, তবে ঠিক আর্তচিৎকার নয়, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। স্রেফ বাইরের লোকদের সতর্ক করে দেওয়া আর কি!