কিন্তু এখন হঠাৎ আমার একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। শেষ অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছিল কোর্টইয়ার্ডে। মিসেস লিডনারকে কেমন চঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল। একটু পরেই জানতে পারলাম, তিনি একা একা ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে চান। আমি তাকে বার বার অনুরোধ করলাম, এ সময় আপনার একা একা বাইরে কোথাও যাওয়া উচিৎ নয়, তাই আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। কিন্তু আমার কথায় তিনি কান দিলেন না, একাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন তিনি গোপনে মিঃ ক্যারির সঙ্গে মিলিত হতে যাননি তো? হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে তারা দুজনে কি রকম অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলতেন যেন। অন্যদের তিনি ক্রিশ্চিয়ান নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু মিঃ ক্যারির বেলায় তা করতেন না, কেন এই পার্থক্য?
মিঃ ক্যারিকে কখনো তার দিকে সরাসরি তাকাতে দেখিনি, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারকে ঘৃণা করতেন, কিম্বা এর ঠিক বিপরীতও হতে পারে।
আজ আমি বুঝতে পারছি, শীলার রাগের কারণ। ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ না হলে কেউ হঠাৎ অমন করে ফেটে পড়ে না।
অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, মিসেস লিডনার ওকে সুনজরে দেখতেন না। মিঃ এসোটের সম্মানার্থে সেদিন মধ্যাহ্নভোজের দিন শীলার প্রতি ওঁর অমন দুর্ব্যবহারটা মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। আজ বুঝতে পারছি, শীলার কোন অপরাধ ছিল না। হতে পারে এসোট ওর দিকে যে ভাবে তাকিয়ে ছিল, সেটা অনুরাগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। সম্ভবত সে কিছু ভাবছিল। মিঃ এসোটের ভাবনার কথা কেউ হদিশ করতে পারে না। এমনি চাপা স্বভাবের মানুষ সে। তাবে মানুষ হিসাবে চমৎকার সে। সত্যি কথা বলতে কি তার উপরে নির্ভর করা যায়।
কিন্তু মিঃ কোলম্যানের মত অমন বোকা লোক আমি কখনো দেখিনি। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন রাত নটা বেজে গেছে। দরজায় তালা লাগানো ছিল। ইব্রাহিম তার চাবির গোছা নিয়ে ছুটে এল আমাকে ভিতরে আহ্বান করার জন্য।
একটু তাড়াতাড়ি আমরা যে যার বিছানায় চলে গেলাম। বসবার ঘর অন্ধকার। ড্রইং-অফিস এবং ডঃ লিডনারের অফিস ঘর থেকে আলো চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছিল, তবে অন্য সব জানালাগুলো অন্ধকারে ডুবে ছিল।
আমরা ঘরে যাবার জন্য ড্রইং-অফিসের পাশ দিয়ে দেখলাম, মিঃ ক্যারি তখনো একটা বিরাট প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। আমার মনে হল, তাকে খুব ক্লান্ত বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। তাঁর অমন রূপ আমি তার আগে কখনো দেখিনি। তাঁর দিন যেন সীমিত, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
মুখ ঘোরাতেই তিনি দেখতে পেলেন আমাকে। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাসানিয়ের থেকে ফিরে এলেন?
হ্যাঁ, মিঃ ক্যারি, কিন্তু আপনি এত রাত পর্যন্ত কাজ করছেন? এখন সবাই প্রায় ঘুমে অচৈতন্য।
আগামীকাল থেকে খনন কার্য আবার শুরু হচ্ছে। তাই করণীয় কাজগুলো দেখে নিচ্ছি।
এত তাড়াতাড়ি? আমি চমকে উঠলাম।
অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি।
এ অবস্থায় ঘরে বসে এ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী লাভ? ব্যাপারটা ডঃ লিডনারের উপর ছেড়ে দিয়েছি। আগামীকাল বেশিরভাগ সময় তিনি হাসানিয়েয় থাকছেন। বাকী আমরা সবাই এখানে থাকছি।
ভুল বলেন নি তিনি। আমি তার বক্তব্য সমর্থনে বললাম, এক হিসাবে আপনি ঠিকই বলেছেন, বাড়িতে চুপচাপ বসে থেকে কোন লাভ নেই। কাজের মধ্যে দিয়ে ভুলে থাকা যাবে।
আমি জানতাম পরের দিনের পরদিন মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা হতে যাচ্ছে।
মিঃ ক্যারি আবার তার প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়লেন। কেন, আমি তা জানি না। তবে তার জন্য কেন জানি না আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। আমার মনে হল, আজ রাতে তিনি আর ঘুমাতে যাচ্ছেন না।
মিঃ ক্যারি, আপনার ঘুমের ট্যাবলেট দরকার?
মাথা নাড়লেন তিনি, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়াটা বদ অভ্যাস। রাতটা আমি কাটিয়ে দিতে পারব।
তাহলে শুভরাত্রি মিঃ ক্যারি, চলে আসবার সময় বললাম, যদি কোন প্রয়োজন হয় তো বলবেন আমাকে
ধন্যবাদ নাস, অমন চিন্তা মনে আনবেন না। শুভ-রাত্রি।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিঃ ক্যারি, বিশেষ করে আপনার জন্য আমি ভীষণ চিন্তিত।
আমার জন্য? কিন্তু কেন?
কারণ আপনি ওঁদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন বলে।
ডঃ লিডনারের আমি পুরানো বন্ধু হতে পারি, কিন্তু মিসেস লিডনারের নয়।
মিঃ ক্যারি কথাটা এমন ভাবে বললেন, যেন প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনারকে তিনি দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন, তার বন্ধুত্ব তিনি স্বীকার করতে চান না। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, মিস রেলি যেন তার কথাটা শুনে থাকে।
শুভ রাত্রি, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দ্রুত পায়ে আমি আমার ঘরে চলে এলাম।
পোশাক বদলে বিছানায় দেহটা এলিয়ে দেবার তোড়জোড় করেছিলাম, ডঃ লিডনারের অফিস ঘরে আলো তখনো জ্বলতে দেখে ভাবলাম, একবার ওকে শুভ-রাত্রি জানিয়ে এলে কেমন হয়! একটু ইতস্ততঃ করলাম, তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন, এ সময় তার কাজের মধ্যে তাকে বিরক্ত করলে? কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি মনস্থির করে ফেললাম, শুভ রাত্রি জানালে কোন ক্ষতি নেই। স্রেফ একবার শুভ-রাত্রি জানিয়ে তাকে জিজ্ঞসা করে আসব, তার কোনো প্রয়োজনে তিনি যেন আমাকে ডাকেন।
কিন্তু ডঃ লিডনার তাঁর অফিসঘরে ছিলেন না। ঘরের আলো জ্বললেও মিস জনসন ছাড়া সেখানে কেউ ছিলেন না। টেবিলের উপরে মাথা রেখে কাঁদছিল সে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মিস জনসনকে এ ভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে কেমন অবাক হলাম। তাহলে?