হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি বৈকি। কিন্তু এর কারণ কী? কেন এই নাটকের অবতারণা? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? আমি খবর নিয়ে জেনেছি, মিসেস লিডনারের জীবনে বহু চিত্রাভিনেতা এসেছে। তিনি চেয়েছিলেন তাদের মধ্যমণি হবেন নিজেকে লাইমলাইটে নিয়ে এসে। ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিবাহ অসম, তার স্বামী তখন অবসরের বুড়ি প্রায় দুই ছুঁই, তবে স্বামী হিসাবে আদর্শ বলা যেতে পারে। স্ত্রীর আদর-যত্নের ত্রুটি রাখতেন না। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হলে যা হয় তাই আর কি। কিন্তু মিসেস লিডনারের তাতে মন ভরত না। তার চাহিদা ছিল পর্বত প্রমাণ। ছায়াচিত্রের নায়িকা হবার বাসনা তাকে পেয়ে বসেছিল তখন।
সত্যি কথা বলতে, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন মিসেস লিডনার সেই সব চিঠিগুলো নিজে লিখেছিলেন, কিন্তু পরে সে কথা তার মনে ছিল না, ডঃ লিডনারের এই মতবাদ আপনি সমর্থন করেন না?
না, আমি তা মনে করি না। ডঃ লিডনার যা মনে করেন, তা, সত্যি নয়। কারণ কোন স্বামী তার স্ত্রীর অমন নির্লজ্জ অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে না। সত্যি কথা বলতে কি কোন স্বামীকে তার স্ত্রীর সম্বন্ধে সত্য কথা না বলাই ভাল, কারণ স্ত্রীর খারাপ দিকটা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বেশির ভাগ স্ত্রী তার স্বামীকে মাতাল, অবিশ্বাসী জেনেও কেমন আনায়াসে তাকে গ্রহণ করে নেয়। বাস্তবিক নারী জাতির মতো বাস্তববাদী মানুষ বোধহয় কেউ হতে পারে না।
সত্যি করে বলুন তো ডঃ রেলি, মিসেস লিডনারকে আপনার কী রকম মনে হয়?
ডঃ রেলি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ধীরে ধীরে পাইপ টানতে টানতে কী যেন ভাবছিলেন, বোধহয় মনে মনে উত্তরটা তৈরি করে নিচ্ছিলেন তিনি। একটু পরে মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
সত্যি কথা বলতে কি ওঁর সম্বন্ধে কোন মতামত প্রকাশ করা খুব মুশকিল। তাছাড়া ওঁর সম্বন্ধে আমি কতটুকুই বা জানি। তবে ওঁর সম্বন্ধে যেটুকু জানি বলতে পারি, উনি ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সহানুভূতিশীলা তবে কেন জানি না সব সময় আমার একটা কথা মনে হত (কিন্তু তার প্রমাণ আমার হাতে ছিল না।), তিনি ছিলেন একজন মার্জিত রুচিসম্পন্না মিথ্যাবাদী। কিন্তু যে কথাটা আমি জানতাম না (জানতে খুব ইচ্ছা হয়) তা হল, তার সেই সব মিথ্যাভাষণ কী নিজের কাছে কেবল, না অন্য লোকদের উদ্দেশ্যেও? মেয়েরা জন্ম-অভিনেত্রী, মিথ্যাভাষণে পটু, অস্বীকার করি না। তবে আমি মনে করি না, পুরুষ-শিকারী ছিলেন তিনি। পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন খেলোয়াড়ী মনোভাব নিয়ে, তার বেশি কিছু নয়। যাইহোক, এ ব্যাপারে আপনি যদি আমার মেয়ের সঙ্গে–
আপনার মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ আগেই আমরা পেয়েছি, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন।
তাই নাকি? ডঃ রেলি বলেন, আশাকরি, আপনাদের সময় খুব বেশি নষ্ট করেনি ও। তবে ওর কথাবার্তা একটু চাঁচাছোলা গোছের। আজকের যুবক-যুবতীরা মৃত্যুর ব্যাপারে ভাবপ্রবণতার কোন ধার ধারে না, রুচিবাগীশ হয় সাধারণতঃ। তারা পুরনো সংস্কার সব বাতিল করে দিয়ে নিজেদের নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। মিসেস লিডনার-এর কার্যকলাপে ওর হয়তো সমর্থন থাকত। কিন্তু মিসেস লিডনারের নাটুকেপনাটা ও সহ্য করতে পারত না। বিড়াল ইঁদুর দেখলেই তাড়া করবে, এ যে সহজাত প্রবৃত্তি। মিসেস লিডনারের ব্যপারটাও যেন কতকটা তাই। পুরুষরা বাচ্ছা ছেলে নয় যে, তাদের সব সময় চোখে চোখে রাখা যায়। মেয়েদের সঙ্গে তারা মিশবেই, তার উপর মেয়েদের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেলে তো আর কথাই নেই। জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, পিকনিক করার স্থান নয়। লিডনারকে ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ দিল শীলার। মাঝবয়সী ওই ভদ্রমহিলা, বিশেষ করে যাঁর জীবনে দু-দুটির স্বামীর আগমন ঘটেছিল, তার অমন আগুন নিয়ে খেলাটা পছন্দ করত না শীলা। চমৎকার মেয়ে এই শীলা, রীতিমতো সুন্দরী এবং পুরুষদের আকর্ষণ করার মত রূপ আছে ওর। কিন্তু মিসেস লিডনারের ভাবগতিক ছিল অন্য রকম। তাৎক্ষণিক চাতুরির খেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি–ডঃ রেলির এ কথায় মধ্যে কী কোন অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে?
আপনার মেয়ে, কথাটা অসমীচীন হবে না, সম্ভবতঃ এখানকার কোন একটি যুবককে নিজের আপনজন বলে নির্বাচন করে ফেলেছে। এ কথা কী সত্য?
না না না আমি তা মনে করি না। এমাট এবং কোলম্যান ওর নাচের সঙ্গী। আমার তো মনে হয় না, তাদের কাউকে ও পছন্দ করে। তারা ছাড়া বিমান বাহিনীর কয়েকজন সুপুরুষ যুবকও আছে এখানে। আমার ধারণা, তারা সবাই শীলার জালে ধরা পড়তে পারে মাছের মতো। কিন্তু না, তাদের ধরে রাখার কলাকৌশল বোধহয় তার জানা ছিল না। আমার মনে হয় সেই বয়সে যৌবনের অমন বিপর্যয়টা শীলার বিরক্তির কারণ। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে আমার থেকে বেশি ভাল বোধহয় শীলা জানতো না। শীলা সুন্দরী মেয়ে হতে পারে, কিন্তু লুসি লিডনার ছিলেন রূপসী, অপরূপা! উজ্জ্বল চোখ দুটি তার কি অপূর্বই না ছিল। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন সত্যি-রূপসী, অপরূপা!
হ্যাঁ, ডঃ রেলি ঠিকই বলেছেন, সে কথা আমিও ভেবেছি অনেকবার। লুসি লিডনারের চোখ ধাঁধানো অমন রূপ দেখে সত্যি হিংসা করতে হয়। তাকে প্রথম দিন দেখেই এ কথা আমার মনে হয়েছিল। সেই রাত্রেই আমার মনে বার বার উঁকি দিতে থাকে, কেমন অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। এক সময় শীলার কথাগুলো আমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করিনি, আমার তখন মনে হয়েছিল, আর পাঁচটা হিংসুটে মেয়েদের মতো ও বোধহয় মিসেস লিডনারের নামে মিথ্যা কুৎসা রটাচ্ছে।