মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি মৃদু চিৎকার করে উঠি, সত্যি কী ঘটেছে বলে আপনার মনে হয়?
চিন্তিত মুখ পোয়ারোর। ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন।
তার আগে বলুন, আজ রাতে সেখানে ফিরে যেতে আপনার ভয় হচ্ছে না?
ওহো, না না, আমি বললাম, অবশ্য আপনার কথা আমার মনে আছে। কে, কে আমাকে খুন করতে পারে মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমার মনে হয় না কেউ আপনাকে খুন করতে পারে, ধীরে ধীরে বললেন পোয়ারো, আপনাদের কাছ থেকে এমনি আশঙ্কার কথা আমি আশা করছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কেউ যদি বাগদাদে আমাকে বলত– কথা বলতে গিয়ে মাঝ পথে থামলাম।
মিস রেলি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন, হাতে র্যাকেট, টেনিস খেলে ফিরছে ও।
হাসানিয়েয় পৌঁছেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পোয়ায়োর।
আমার কুশল সংবাদ নিয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরল ও, মঁসিয়ে পোয়ারো, হত্যা রহস্যের ব্যাপারে কতদূর এগুলেন বলুন!
খুব বেশি এগুতে পারিনি।
যাইহোক, বিপদের হাত থেকে নার্সকে রক্ষা করতে পেরেছেন দেখতে পাচ্ছি।
নার্স লিথেরানের কাছ থেকে আমি এক্সপিডিসনের সদস্যদের সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে নিহত মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক অজানা খবর এখন আমার হাতের মুঠোয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিই সেই খুনের কেসে একটা উল্লেখযোগ্য ক্লু হয়ে উঠেছে।
এ আপনার বুদ্ধিরই পরিচয় মঁসিয়ে পোয়ারো, মিস রেলির কথায় আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া, মিসেস লিডনার খুন হওয়ার মতই মহিলা ছিলেন।
মিস রেলি? রাগে, উত্তেজনায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, এ আপনি কী বলছেন?
থামল সে, তার হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল আমার।
নার্স লিথেরান, আপনি হয়তো সত্য ঘটনা জানেন না বলেই এমন আশ্চর্য হচ্ছেন। আর পাঁচজনের মত আমার এই স্পষ্ট কথাগুলো আপনার কানে ঔদ্ধত্যের মত শোনাচ্ছে। পেটে খিদে, মুখে লাজের মত স্বভাব আমার নয়, আমি স্পষ্ট বক্তা। তারপর সে পোয়ারোর দিকে ফিরে বলে, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই প্রথম বোধহয় আপনাকে অসাফল্যের মালা ঝোলাতে হবে গলায়। আমি চাই না মিসেস লিডনারের খুনী ধরা পড়ুক।
মেয়েটি ক্রমশঃ আমার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। জানি না, পোয়ারো তার কথাগুলো কিভাবে নিচ্ছিলেন।
তাহলে, পোয়ারো এই প্রথম মুখ খুললেন, মনে হচ্ছে, গতকাল অপরাহ্নের ঘটনার ব্যাপারে আপনার এ্যালিবি আছে, আছে না?
মুহূর্তের নীরবতা, হাতের র্যাকেট খসে পড়ে যায় তার মেঝের উপরে। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ঢিলে-ঢালা স্ন্যাক্স আঁটো করার খেয়াল নেই এখন তার। তারপর সে এক নিঃশ্বাসে কথা বলে গেল, ও হা, আমি তখন ক্লাবে টেনিস খেয়াল বস্ত ছিলাম। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনারকে আপনি ঠিক চেনেন না। চিনলে আপনার ধারণা বদলে যেত নিশ্চয়ই।
আবার সেই অদ্ভুত চোখে তাকালেন পোয়ারো, আপনি আমাকে সব খুলে বলতে পারেন?
একটু ইতস্ততঃ করে সে আবার মুখ খোলে। কিন্তু তার কথার মধ্যে কেমন বোকা বোকা ভাব, সৌন্দর্যের অভাব, সেটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিল।
মৃত লোক, সে যতই খারাপ হোক না কেন, তার সমালোচনা করা মানবিক দিক থেকে বাঞ্ছনীয় নয়। আমি মনে করি, এ অন্যায়, এ পাপ। সত্য সব সময়ই সত্য। সত্য কখনো গোপন থাকে না। তবে তাই বলে জীবিত লোকের ব্যাপারে মুখ না খোলাই ভাল। তাতে তার ক্ষতি হতে পারে, মৃত্যু এখন অতীত। শেক্সপীয়রের সেই বিখ্যাত উক্তিটা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে হয়। তেল ইয়ারিমাহর সেই ভয়ঙ্কর আবহাওয়ার কথা কী নার্স আপনাকে বলেছে? এখানে এখন সবাই সবাইকে ঘৃণার চোখে দেখে, শত্রু বলে মনে করে। এর জন্য দায়ী লুসি লিডনার। তিন বছর আগে আমার অল্প বয়সেই অনুভব করতে পারতাম, তখন তারা সবাই বেশ সুখে শান্তিতে ছিল, এমন কি গত বছরেও সেই সুখী পরিবারে ব্যাঘাত ঘটতে দেখেনি। কিন্তু এই বছর তাদের মধ্যে হঠাৎ কেমন রেষারেষি মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। আমার ধারণা, এর জন্য মিসেস লিডনারই দায়ী ছিল। কাউকে সুখে থাকতে দিতে চাইতেন না, তার মনোভাব ছিল এমনই। আর তার একটা বাজে অভ্যাস ছিল, পুরুষদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলতে ভালবাসতেন ভীষণ। উঃ! কি সাংঘাতিক মহিলা তিনি–
মিস রেলি? আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমার মনে হয়, এসব সত্য নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এ সব সত্যি নয় বলেই আমি এমন জোর দিয়ে বলতে পারছি।
কিন্তু শীলা রেলি আমার কথায় কান দিল না। নিজের কথায় নিজেই ব্যস্ত সে তখন। শুনেছি ডঃ লিডনার নাকি তাঁর স্ত্রীকে দেবীর মত পুজো করতেন। তাতেও খুশি ছিলেন না মিসেস লিডনার। মার্কোডার মত ইডিয়ট, যার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই, তাকে তিনি বশ করেছিলেন, বোকা বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতেন। তারপর তিনি বিলকেও তার মোহজালে জড়িয়ে ফেলেন ধীরে ধীরে। আর কার্ল রেইটার? মিসেস লিডনার নাকি তাকে কোনদিন সুনজরে দেখেননি। তাকে অত্যাচার করে একটা বিজয়ীর আনন্দ অনুভব করতেন। একধরনের মহিলা আছেন, যারা পুরুষদের উপরে প্রভুত্ব করে সুখ পায়, মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। কিন্তু ডেভিড ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান। মিসেস লিডনারের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করলেও নিজের সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিল সে। তাছাড়া তাকে খুব একটা পাত্তাও দিত না সে। তিনি যে কি ধরনের মহিলা তার জানা হয়ে গিয়েছিল।