হঠাৎ আমার শরীরটা কেঁপে উঠল ভয়ে, বিস্ময়ে। একটা বিশ্রী কুৎসিত চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটি মুখের ছবি, মনে হয় সেই ফটোগ্রাফারের মুখ, প্রথমে মিসেস লিডনারকে খুন করে সে, তারপর তার ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে দেখতে যায় ক্ষতের গভীরতা এবং সম্ভবতঃ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে তার মুখের রঙ বদলে যায়, পাগলের মত ছুটে যায় ওয়্যাশস্ট্যান্ডের দিকে।
ডঃ রেলির চোখে আমার কাপনের ছায়া পড়েছিল বোধহয়।
কী ব্যাপার নার্স জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
কিছু নয়, হঠাৎ গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল, এই আর কি!
ডঃ পোয়ারো আমার দিকে তাকায়। তার চোখে কৌতূহল।
আমি জানি আপনার কি প্রয়োজন। পোয়ারো বলতে থাকেন, আমাদের এখানকার কাজ আপাততঃ শেষ। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাসানিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ভাবছি আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। তার আগে ডাক্তার, নার্স লিথেরানকে আপনি
আনন্দ মানে একটু সুখ!
না, না ডাক্তার, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম। ও সব কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না।
বন্ধুর মতো আমার পিঠের উপরে আলতো করে একটা টোকা মারলেন পোয়ারো। একেবারে ব্রিটিশ কায়দায়, বিদেশীদের মতো নয়।
ম্যাডাম, আপনি যা বলবেন তাই হবে। পোয়ারো এবার তার কাজের প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। আপনাকে সঙ্গে পেলে আমার খুব উপকার হয়। এমন কতকগুলো কথা আছে, সব জায়গায়, সবার সামনে বলা যায় না। ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে বলতে গেলে একরকম দেবদেবীর চোখে দেখতেন, তাঁকে সময় সময় পুজোও করতেন এবং তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন, তাঁর মতো অন্য সবাই তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। মানুষের মন না মতিভ্রম, ভুল-ভ্রান্তি, এই নিয়েই তো মানুষের জীবন। তাই আমি এ ব্যাপারে বিশেষ করে মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে একান্তে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। আপনার মতে ভদ্রমহিলা কেমন ছিলেন, সেটা আমার আগে জানতে হবে। হাসানিয়েয় গিয়ে এ নিয়ে আপনার সঙ্গে বিশদ ভাবে আলোচনা করতে চাই।
আমার মনে হয়, একটু ইতস্ততঃ করে আমি বলি, এই অবস্থায় এখান থেকে চলে গেলে এখানকার সবাই সেটা খুব একটা ভাল চোখে দেখবেন না।
তাতে কি হয়েছে, দু-একদিনে কিছু এসে যায় না, পোয়ারোর হয়ে ডঃ রেলি বলেন, মিসেস লিডনারকে কবর দেবার আগে তো আর আপনি যেতে পারছেন না।
তা অবশ্য ঠিক, আমার পরবর্তী প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত ধরনের হল, ধরুন, আমিও যদি খুন হই?
কথাটা আমি বললাম ঠাট্টার ছলে, এবং ডঃ রেলিও হাল্কা ভাবে গ্রহণ করলেন সেটা। কিন্তু পোয়ারো আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত মুখ নেড়ে বললেন নাটকীয় ভঙ্গিতে।
আঃ, তাই যদি হয়, অস্ফুট কণ্ঠস্বর, বিপদ, হা, মহা বিপদ, তাই যদি হয় তাতে কার কী করার থাকতে পারে? কতক্ষণ বা একজনকে চোখে চোখে রাখা যায়?
কেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি বললাম, আমি তো ঠাট্টা করেই কথাটা বলেছিলাম, আপনার কথা সত্যি ধরে নিলে স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে, কে, কে আমাকে খুন করতে পারে?
শুধু আপনি কেন, অন্য কেউও খুন হতে পারেন, পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে গভীর প্রত্যয়ের ছাপ। জানি না, তাঁর এ কথা বলার কি অর্থ থাকতে পারে।
কিন্তু কেন? কেন আমরা যে কেউ খুন হতে পারি? আমার মধ্যে কেমন একটা জিদ চেপে গেল, পোয়ারোর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ আমাকে জানতেই হবে।
আমার দিকে সরাসরি তাকালেন পোয়ারো।
আমি ঠাট্টা করছিলাম, পোয়ারো বললেন, কিন্তু এমন এক একটা ব্যাপার আছে, যা নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলে না। আমি আমার পেশাদার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, খুন করা মানুষের একটা স্বভাব……..
.
১৮.
ডঃ রেলির বাড়িতে চায়ের আসর
ফিরে যাবার আগে এক্সপিডিসন হাউস এবং তার চারপাশ একবার ঘুরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায় পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুললেন না তিনি। তবে পোয়ারোর প্রশ্নগুলো ইংরিজি থেকে আরবী ভাষায় এবং পরিচারকদের উত্তরগুলো আরবী থেকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে দিলেন ডঃ রেলি। প্রশ্নগুলো সেই আগন্তুককে ঘিরে, যাকে মিসেস লিডনার, আমি এবং ফাদার ল্যাভিগনি দেখেছিলাম জানালা পথে।
আপনার কি ধারণা সেই আগন্তুকের কোন প্রয়োজন হতে পারে এই কেসের ব্যাপারে? হাসানিয়ের যাবার পথে ডঃ রেলি জানতে চাইলেন পোয়ারোর কাছ থেকে।
পোয়ারোর উত্তর, সবরকম খবর সংগ্রহ করে রাখাই হল আমার কাজ।
পোয়ারোর এই কাজের পদ্ধতিটা আমার খুব ভাল লাগল। দেখলাম, সত্য ঘটনা থেকে শুরু করে খোশগল্প কথা, কোন কিছুই বাদ দিলেন না, খুব মন দিয়ে তিনি তাঁর নোটবুকে লিপিবদ্ধ করলেন প্রশ্নোত্তরগুলো।
স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ডঃ রেলির বাড়িতে চা খুব ভাল লাগল, অনেকক্ষণ থেকে এর অভাব বোধ করছিলাম। লক্ষ্য করলাম পোয়ারো যেন একটু বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন, এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি।
চায়ের চামচটা রাখতে গিয়ে পোয়ারো বললেন, এখন আমরা খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করতে পারি, কেন পারিনা? আমরা এখন মনস্থির করতে পারি, এই অপরাধ কে বা কারা করতে পারে?
ল্যাভিগনি, মারকাডো, এমাট কিংবা রেইটার? ডঃ রেলি জিজ্ঞাসা করলেন।
না, না, ওটা তো সেই তিন নম্বর থিয়োরি। আমি এখন দু নম্বর থিয়োরির উপরে মনোনিবেশ করতে চাই। মিসেস লিডনারের সেই রহস্যময় স্বামী কিংবা তার দেওরের প্রসঙ্গ এখানে ভোলা থাক। এখন আসুন এই এক্সপিডিসন হাউসে দেখা যাক মিসেস লিডনারকে খুন করার সুযোগ কার সব থেকে বেশি ছিল এবং সম্ভাব্য খুনী কে হতে পারে? আমার মনে হয়, পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, এই এক্সপিডিসনের সদস্যদের মধ্যে কে তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়ে ডঃ লিডনারের সামনে আলোচনা করলে কেমন হয়? মনে হয় তাতে খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আর একটা কথা বলে রাখি এ প্রসঙ্গে, তার স্ত্রী সবার শ্রদ্ধেয় ছিলেন এবং এখানকার সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো, বিতর্কিত প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি রাখতে চাই।