পোয়ারো জানালা দুটির সামনে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সেই পথে মাথা গলানো যেখানে মুশকিল সেখান দিয়ে আততায়ীর পক্ষে পালানো একরকম অসম্ভব ব্যাপারই বটে। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটার সময় জানালাগুলো বন্ধ ছিল বলেই তাকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ এবং প্রস্থানের একটি মাত্রই পথ হল দরজা। আর সেই দরজার সামনে আসা একটি মাত্র পথ হল কোর্টইয়ার্ড এবং সেই কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করতে হলে খিলান পথ দিয়ে আসতে হবে। সেই খিলান পথের বাহিরে তখন পাঁচজন কর্মচারী আড্ডা দিচ্ছিলেন এবং তারা সবাই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছে। পোয়ারো মনে করেন, তারা মিথ্যা বলেনি বা তারা কখনোই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। কিম্বা ঘুষ দিয়ে তাদের মুখও বন্ধ করা হয়নি। অতএব খুনী এখানে এঁদের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
আমি কোন কথা বললাম না। গোল টেবিলের বৈঠকে আমরা যখন আটক হয়ে পড়ি কথাটা তখনি আমার মনে উদয় হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি।
পোয়ারো নিঃশব্দে কখন যে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একজন বয়স্ক লোকের ফটো বার করে নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন আমরা কেউ খেয়াল করিনি। বয়স্ক লোকটির মুখে ছাগলের মতো সাদা দাড়ি। আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন পোয়ারো।
ফটোটা মিসেস লিডনারের বাবার, প্রত্যুত্তরে আমি বলি, উনি আমাকে সেরকমই বলেছিলেন।
ফটোটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর ছড়ানো প্রসাধন সামগ্রীগুলো এক নজরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সাধারণ প্রসাধন, তবে গুণগত বিচারে বেশ ভাল। তারপর বুকসেলে রাখা বইগুলোর নাম জোরে জোরে পড়তে থাকলেন।
হুঁ, ওয়ার দ্যা গ্রীজ? ইনট্রোডকশনস টু রিলেটিভিটি। লাইফ অফ লেডি হেস্টার স্ট্যানহোপ। ফ্রিউ টেন। ব্যাক টু মেথুমেলা। লিন্ডা কনডন। হ্যাঁ, এই বইগুলো যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনাদের মিসেস লিডনার বোকা ছিলেন না।
ও হ্যাঁ। অত্যন্ত, বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন তিনি, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, সাধারণ মহিলা ছিলেন না তিনি।
তার দৃষ্টি আমার দিকে, ঠোঁটে হাসি।
না, সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম।
কথা বলতে বলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়্যাশস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে থামলেন পোয়ারো। সেখানে সারি সারি বোতল সাজানো, সেই সঙ্গে টয়েলেট ক্রীম। তারপর হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে কম্বলটা পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন তিনি।
ডঃ রেলি এবং আমি দ্রুত তার কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তখন সেই কম্বলের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের দাগটা লক্ষ্য করছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেই দাগটার প্রতি ডঃ রেলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের কী মনে হয়, ওটা রক্তের দাগ?
ডঃ রেলির নতজানু হয়ে বসলেন, হতে পারে, তবে আপনি চাইলে আমি পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
আপনি যদি দয়া করে ।
তারপর পোয়ারো জাগ এবং বেসিনটা ভাল করে পরীক্ষা করতে থাকলেন। ওয়্যাশস্ট্যান্ডের পাশে পড়ে ছিল জাগটা। ফাঁকা বেসিন। তবে ওয়্যাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা নোংরা জল ভর্তি কেরোসিন টিন পড়ে থাকতে দেখা গেল।
আমার দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
নার্স, আপনার মনে আছে। আপনি যখন মিসেস লিডনারের ঘর ছেড়ে যান তখন এই জাগটা বেসিনের বাইরে না উপরে রাখা ছিল?
ঠিক খেয়াল করতে পারছি না, মিনিট দুই পরে কি ভেবে বললাম, তবে মনে হয়, ওটা বেসিনের উপরেই ছিল। লাঞ্চের পর পরিচারকরা বেসিনের উপরেই ওটা রেখে গিয়ে থাকবে হয়তো। না থাকলে আমার দৃষ্টি এড়াতো না। তবে এ সবই আমার অনুমান মাত্র। বুঝলেন?
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। এ সবই আপনার হাসপাতাল থেকে পাওয়া ট্রেনিং-এর ফসল। রুগীদের প্রতিটি ব্যবহৃত জিনিসের উপরে আপনার সজাগ দৃষ্টি থাকে, এদিক ওদিক হবার উপায় নেই। যাইহোক, এবার বলুন খুনের পর কী দেখেছিলেন? এখন যেমনটি দেখছেন ঠিক তেমনি?
সঙ্গে সঙ্গে আমি মাথা দোলাই।
তখন আমি লক্ষ্য করিনি, উত্তরে আমি বলি, তখন আমার লক্ষ্য ছিল আততায়ী পালালো কোথায়? ঘরের মধ্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের লুকানোর মত জায়গা কোথায় থাকতে পারে? আমার আর একটা দেখার ছিল, খুনী তার ব্যবহৃত কোন জিনিস ভুলে ফেলে গেছে কিনা।
হ্যাঁ, এটা রক্তেরই দাগ বটে। ডঃ রেলি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
পোয়ারোর পিঙ্গল চোখে ভ্রুকুটি, মেজাজটা হঠাৎ যেন একটু খিটখিটে হয়ে যায়।
আমি বলতে পারি না। কি করেই তা বলব আমি? হয়তো, আদৌ এর কোন সম্পর্ক নেই মিসেস লিডনারের খুনের সঙ্গে। তবে আমি বলতে পারি যে, এ সবই আমার অনুমান। সেই অনুমানের উপরে ভিত করেই বলতে পারি, খুনী হয়তো তাকে স্পর্শ করে থাকতে পারে এবং তার হাতে হয়তো সেই কারণে একটু আধটু রক্ত লেগে থাকবে, তবু রক্ত রক্তই এবং সেই রক্ত মুছে ফেলবার জন্যই এই ওয়্যাশস্ট্যান্ডে তার আসা, হ্যাঁ এ রকমই একটা কিছু ঘটে থাকবে। তবে তাই বলে এই নয় যে, এ ব্যাপারে তাড়াতাড়ি আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। এমনও তো হতে পারে, ওই রক্তের দাগের সঙ্গে এই কেসের কোনও সম্পর্কই নেই।
খুব সামান্য রক্ত, ডঃ রেলি মন্তব্য করেন, মনে হয় নিহত মিসেস লিডনারের ক্ষত স্থানের রক্ত সেটা অবশ্য আততায়ী যদি সেই ক্ষত স্থানে হাত দিয়ে থাকে, তবেই রক্তের দাগ এখানে লাগতে পারে।