ঘরের মধ্যে কাপবোর্ড কিংবা আড়াল করার মত কোন জিনিস বড় একটা চোখে পড়ে না। বিছানায় সস্তা দামের সুতির তোশক। দামী শয্যা সামগ্রী বলতে তেমন কিছুই ছিল না, কেবল দামী তিনটি বালিশ ছাড়া।
মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ঠিক কোথায় পাওয়া যায় বোঝাতে গিয়ে অল্প কথায় ডঃ রেলি যেন অনেক কিছুই বলে গেলেন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আমাকে ইশারায় এগিয়ে আসতে বললেন।
দুর্ঘটনার পর আমি যা, দেখেছি তার অনুরূপ বর্ণনা আমি সংক্ষেপে বললাম। ডঃ রেলি আমাকে তার সাধ্য মত সাহায্য করলেন।
ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর অমন অবস্থা দেখে মাথাটা তুলে ধরেন, ডঃ রেলি বলেন, তবু আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিসেস লিডনারের মৃতদেহ যেখানে যে অবস্থায় তিনি প্রথম দেখতে পান সেখানেই আছে, নাকি সরিয়েছেন? ওঁর কথার হাবভাব এবং পরিবেশ দেখে আমার মনে হয়েছিল, মৃতদেহ উনি সরাননি।
মনে হয় মিসেস লিডনার তখন বিছানায় শুয়েছিলেন, পোয়ারো তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন, হয়তো তিনি তখন ঘুমুচ্ছিলেন, কিংবা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেই সময় কেউ দরজা খুলে থাকবে, তাকে দেখে তিনি হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে যান এবং তখনই আততায়ী নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হেনে থাকবেন, পোয়ারো কথাটা শেষ করলেন, সেই একটা ঘুষির আঘাতেই মিসেস লিডনার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে থাকবেন এবং একটু পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দেখুন-
অতঃপর মিসেস লিডনারের আঘাতের বিশদ বিবরণ দিলেন ডঃ রেলি।
তাহলে খুব একটা বেশি রক্ত পড়েনি? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও মনে হয় ব্রেনের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে থাকবে।
তাহলে এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুটা সরাসরিই ঘটে থাকবে, তবে একটা ব্যাপারে কেমন খটকা লাগছে। আততায়ী যদি আগন্তুক, মানে মিসেস লিডনারের অপরিচিতই হয়ে থাকবে, তাহলে তিনি কেন সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেন না। চিৎকার করলে নার্স লিথেরান, এমাট এবং পটবয় নিশ্চয়ই শুনতে পেতো।
তা এর উত্তর তো খুবই সহজ, ডঃ রেলি শুকনো গলায় বলেন, কারণ সে আগন্তুক ছিল না।
হু, গভীর ভাবে চিন্তা করে পোয়ারো বলেন, তিনি হয়তো লোকটিকে দেখে একটু অবাক হয়ে থাকবেন, কিন্তু ভয় পাননি। তারপর সে তার মাথায় অতর্কিতে আঘাত করলে তিনি হয়তো অস্ফুটে চিৎকার করে থাকবেন, কিন্তু তখন অনেক, অনেক দেরি হয়ে যায়।
তবু সেই অস্ফুট চিৎকার মিস জনসন শুনতে পায়।
এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। কারণ এমন মোটা দেওয়াল বিশেষ করে বন্ধ জানালা পেরিয়ে মিস জনসন কি করে তার অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন জানি না?
মিসেস লিডনারের বিছানার দিকে এগিয়ে যান পোয়ারো।
আপনি কী তাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে যান? পোয়ারো এবার আমার উদ্দেশ্যে তার প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন।
জীবিত অবস্থায় মিসেস লিডনারকে আমি ঠিক কি অবস্থায় দেখে যাই, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি তাকে দিলাম। তাকে আমি দু খানি বই দিয়ে যাই। মনে হয় বই পড়তে পড়তে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। হা, তখন তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে আমার নজর এড়াতে না নিশ্চয়ই।
আমার কথাগুলো পোয়ারো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর তিনি তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করলেন ঘরের চারিদিকে।
আর খুনের পর ঘরে ঢুকে আপনি কী আগের মতোই সব ঠিক ঠিক দেখেছিলেন এখানে?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলি, আমার মনে হয় না, ঘরের মধ্যে কোন তফাৎ আমার চোখে পড়েনি।
এই ধরুন, যেমন কোন অস্ত্র, যা দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছিল?
না।
ডঃ রেলির দিকে তাকালেন পোয়ারো। এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত ডঃ রেলি?
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন।
খুব শক্তিশালী কোন একটা বস্তু হতে পারে। তবে খুব একটা ধারালো নয়। এই যেমন, স্ট্যাচুর মতো কিছু একটা বস্তু। মনে রাখবেন, আমার এই অনুমানটা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি না, কিন্তু এ ধরনের অস্ত্রের কথাই আমি বলতে চাইছি। মনে হয়, সেই বস্তু দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়ে থাকবে।
একজন বলিষ্ঠ মানুষের ঘুষির আঘাত? একজন মানুষের কালো হাত?
হ্যাঁ, তা না হলে—
তা না হলে কী?
ডঃ রেলি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, মনে হয় মিসেস লিডনার নতজানু হয়ে বসেছিলেন, উপর থেকে ঘুষির আঘাতে তেমন প্রচণ্ডতা না থাকলেও এক আঘাতেই তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
নতজানু হয়ে বসেছিলেন, পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন, হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়
হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক, ডঃ রেলি নিজেকে সমর্থন করে বলেন, এ ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবা যায় না।
হয়তো সম্ভব।
হুঁ, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করে দেখলে মনে হবে, এটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন, এবং নতজানু হতে বাধ্য হন। তখনো তিনি জানতেন না যে, তিনি খুন হতে যাচ্ছেন। কিন্তু সম্বিৎ যখন ফিরে পেলেন তখন আর ফেরবার পথ ছিল না।
হ্যাঁ, পোয়ারোকে রীতিমত চিন্তান্বিত বলে মনে হল। এটা অনুমেয় বটে।
কিন্তু সেই ধারণাটা বড়ই দুর্বল বলে আমার মনে হল। আমি ভাবতেই পারি না, মিসেস লিডনার কারোর কথায় কিম্বা ভয়ে নতজানু হয়ে বসে থাকতে পারেন।