আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো বললেন, বিচিত্র নয় ডঃ লিডনার, হ্যাঁ, এটা খুবই সত্য। এ এক বিচিত্র খুনই বটে। সাধারণতঃ খুন জিনিসটা অতি জঘন্য, অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। কিন্তু এ যেন এক বিচিত্র খুন। ডঃ লিডনার, আমার সন্দেহ হয়, আপনার স্ত্রী ছিলেন এক অস্বাভাবিক মহিলা।
কথাটা কি ঠিক নার্স? ডঃ লিডনার শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ওঁকে বলে দাও লুসি মানুষ হিসাবে কি রকম ছিল। তোমার কাছ থেকেই আমি নিরপেক্ষ বিচার আশা করি।
খোলাখুলি ভাবেই আমি বললাম, চমৎকার মহিলা ছিলেন উনি। তোষামোদ করে ওঁর মন জয় করা যেত না। ওঁর মতন সুন্দর মহিলা এর আগে আমি কখনো দেখিনি।
ধন্যবাদ, ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বাইরের লোকের কাছ থেকে পাওয়া এ এক মূল্যবান পরিচয় পত্র। মার্জিত সুরে বললেন পোয়ারো, যাইহোক, ধরে নেওয়া যাক, আমার তৃতীয় অনুমানটাই ঠিক। তার মানে খুনী হয় ফ্রেডরিক, না হয় উইলিয়াম বসনার। আর এই ফ্রেডরিক কিম্বা উইলিয়াম আপনার এক্সপিডিসনেরই একজন সদস্য। আমার সন্দেহের তালিকা সংকুচিত করে চারজনের তালিকা তৈরি করতে পারি। এই চারজন হলেন, ফাদার ল্যাভিগনি, মিঃ মারকাডো, কার্ল রেইটার এবং ডেভিড এমাট।
ফাদার ল্যাভিগনি প্রশ্নাতীত, ডঃ লিডনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি এমন জঘন্য কাজ কিছুতেই করতে পারেন না। এবং তাঁর দাড়ি খাঁটি, নকল নয়! তার সমর্থনে আমি বললাম।
প্রথম শ্রেণির খুনীরা কখনো নকল দাড়ি ব্যবহার করে না। পোয়ারো উত্তরটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
আপনি কী করে বুঝলেন? সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, খুনী প্রথম শ্রেণির?
তা না হলে সমস্ত ব্যাপারটাই জোলো হয়ে যেত। কেসটা এত জটিল হয়ে উঠত না।
এ যেন পুরোপুরি বুদ্ধির খেলা, মনে মনে আমি ভাবলাম।
যাইহোক, দাড়ির প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে আমি বললাম, দাড়ি গজাতে বেশ কিছু সময় নিশ্চয়ই লেগেছিল?।
এটা একটা বাস্তব পর্যবেক্ষণ, পোয়ারো মন্তব্য করেন।
ওদিকে ডঃ লিডনারের কথায় উত্তেজনা প্রকাশ পায়, কিন্তু এ অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। তিনি এবং মারকাডো দুজনেই অতি পরিচিত ব্যক্তি, আর সে পরিচয় দীর্ঘদিনের।
চকিতে ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
আপনাকে ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে আপনি আমল দিতে চাইছেন না। ফ্রেডরিক বসনার যদি মৃতই না হয়, তাহলে এতদিন সে কী করছিলেন? নিশ্চয়ই সে নাম ভঁড়িয়েছে?
আমার মতামত যদি জানতে চান, ডঃ রেলি তাদের আলোচনায় বাধা দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে কার্ল রেইটারের নামটাই যথার্থ এবং আইনত ন্যায়সঙ্গতও বলা যেতে পারে। বয়সে তরুণ, উইলিয়াম বসনারের বয়সের সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে তার। তাছাড়া জার্মান নাম তার। এ বছরই সে প্রথম এসেছে এবং মিসেস লিডনারের ঘরের কাছেই তার ঘর, সুযোগটা বেশি তারই ছিল। কোর্টইয়ার্ডে উল্টোদিকে তার ঘর। ফটোগ্রাফার সে। যদি কেউ বলে যে তার ঘরে তাকে দেখা যায় নি দুর্ঘটনার সময়, জবাব তার মুখেই লেগে থাকার কথা,–অনায়াসে সে বলতে পারবে, সে তখন ডার্করুমে ছিল। জানি না এই যুবকটি আপনার সন্দেহের আওতায় আসে কি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে, তাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকায় তার নাম প্রথমেই লিখতে পারেন।
পোয়ারো তেমন আগ্রহ দেখাল না এ ব্যাপারে। মাথা নেড়ে সায় দিল বটে সে, তবে কেমন দায়সারা গোছের যেন।
হ্যাঁ, তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে তাকে সন্দেহ করাটা ন্যায় সঙ্গত হলেও প্রমাণ করাটা কিন্তু খুব সহজ ব্যাপার নয়। তারপর তিনি একটু থেমে বলেন, এখন আর কোন কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি এখন নিহত মিসেস লিডনারের ঘরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
নিশ্চয়ই! ডঃ লিডনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডঃ রেলির দিকে ফিরে তাকালেন, ঘরের চাবি তো ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের কাছে।
মেটল্যান্ড চাবিটা আমাকে দিয়ে গেছেন। ডঃ রেলি বললেন সেই কুরডিশের ব্যাপারে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। অতঃপর চাবিটা এগিয়ে দেন ডঃ রেলি।
পোয়ারোর হাতে চাবিটা তুলে দিতে গেলে ডঃ লিড়নারকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হয় যেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার সঙ্গে আমি যেতে পারছি না, সম্ভবত নার্স
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনাকে আমি অযথা বিরক্ত করব না। তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যদি আমাকে একট সঙ্গ দেন-
নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
.
১৭.
ওয়্যাশস্ট্যান্ডে রক্তের দাগ
পোস্টমর্টেমের জন্য মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ইতিমধ্যে হাসানিয়েয় চালান করা হয়েছিল। তবে তার ঘরের হেরফের কিছুই হয়নি, যেমনটি আগে ছিল, এখনো ঠিক তেমনি আছে। ঘরটা এতই ছোট যে, ঘুরে দেখার জন্য খুব বেশি সময় লাগেনি পুলিশের।
দরজার ডানদিকে বিছানা। দরজার ঠিক বিপরীত দিকে শহরমুখী গরাদ-বিহীন দুটি জানালা। মাঝ বরাবর ওক কাঠের টেবিল, ড্রেসিংটেবল হিসাবে ব্যবহার করতেন মিসেস লিডনার, সংলগ্ন দুটি ড্রয়ারে তার প্রসাধন সামগ্রী থাকত। পূবদিকের দেওয়ালের বুকে ঝুলছিল সারি সারি পোশাক। দরজার ঠিক বাঁদিকে কাপড় রাখার স্ট্যান্ড। ঘরের ঠিক মাঝখানে ওক কাঠের একটা টেবিল শোভা পাচ্ছিল। টেবিলের উপরে লেখার সরঞ্জাম ও একটি এ্যাটাচি কেস। মিসেস লিডনার সেই অভিশপ্ত চিঠিগুলো ওই এ্যাটাচি কেসের ভিতরে চালান করে দেন। পর্দাগুলো মামুলি ধরনের। পাথরের মেঝের উপরে ছাগলের কার্পেট বিছানো।