ডঃ লিডনারকে এখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত বলে মনে হল। কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গীতে কোন রকমে তিনি বলেন, তবে তার ব্যাখ্যা আমি করেছি। এটা একান্ত প্রয়োজন ছিল–আমার স্ত্রী স্নায়ুর চাপে ভুগছিল, তাছাড়া ওর ভয় কাটানোর জন্য।
টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়েছিল ডঃ লিডনারের মুখের উপরে। মনে হয় সেই ফাঁকে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন কি ভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবেন। এ যেন প্রাক্ যুদ্ধের প্রস্তুতি।
না, না। এর পরেও এমন একটা ব্যাপার আছে, যেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আপনার স্ত্রী বিপদের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছিলেন, হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে নয়। আর এও সত্যি যে, তাঁকে প্রাণ নাশের ভয় দেখানো হয়েছিল। আর এ সব সত্ত্বেও পুলিশকে আপনি খবর দেন নি, এমন কি আপনি কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের পরামর্শ নেবারও প্রয়োজনবোধ করেননি। কিন্তু নার্সের ব্যবস্থা আপনি কেন যে করতে গেলেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়!
আ–আ–আমি, ডঃ লিডনারের কথা জড়িয়ে যায়। তার মুখের রঙ বদলায়। আমি ভেবেছিলাম- এবার তিনি একেবারে থেমে যান।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এখন সেই কথাতেই আসছি, পোয়ারো তাকে উৎসাহিত করেন, কী, কী ভেবেছিলেন আপনি– ডঃ লিডনার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, আমি জানি না। আমি জানি না।
ইঁদুর ধরবার জন্য ইঁদুরের গর্তের সামনে বিড়াল যেমন, তেমনি ভাবে স্থির চোখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকিয়ে থাকেন পোয়ারো।
তাহলে আপনি আর কী ভাবতে পারেন তখন!
আমি জানি না, বললাম তো, আমি জানি না।
কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন, এবং বেশ ভাল করেই জানেন। হয়তো এ ক্ষেত্রেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। ডঃ লিডনার, সত্যি করে বলুন তো, চিঠিগুলো যে আপনার স্ত্রীই নিজের হাতে লিখতেন, একথা আপনার মনে কখনো সন্দেহ হয়নি?
এরপর ডঃ লিডনারের উত্তর দেবার আর কোন প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। পোয়ারোর অনুমানের মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়েছিল বোধহয়। ডঃ লিডনার তার হাত দুটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে যে ভাবে তুলেছিলেন, তাঁর সেই ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তার নিজের গল্প বলা বোধহয় এখানেই শেষ।
এবার আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম, এই প্রথম। তাহলে আমার অনুমানই ঠিক, ভাবলাম। এই প্রসঙ্গে ডঃ লিডনারের একটি প্রশ্ন আমার মনে পড়ে গেল, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার স্ত্রীর প্রসঙ্গে আমার কী ধারণা? আপন খেয়ালে আমি আমার মাথাটা আস্তে আস্তে দোলাতে গিয়ে দেখি, পোয়ারোর শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার উপরে।
নার্স, আপনিও তো তাই মনে করেন, কেন করেন না?
হ্যাঁ, সত্য কথা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা হয় না, কথাটা আমারও মনে হয়েছিল?
কারণ?
মিঃ কোলম্যান মিসেস লিডনারের হাতে লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখান, সেই চিঠি এবং মিসেস লিডনারকে হুমকি দিয়ে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্যের কথা আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বলি।
ডঃ লিডনারের দিকে ফিরলেন পোয়ারো।
সেই সাদৃশ্য আপনি কী লক্ষ্য করেছিলেন ডঃ লিডনার?
ডঃ লিডনার মাথা নিচু করে বললেন, হ্যাঁ, শুধু একটা নয়, অনেক, অনেক সাদৃশ্য আমি লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে এস, ই অক্ষরগুলো দেখলে মনে হয় সেই চিঠিগুলোর হাতের লেখার সঙ্গে আমার স্ত্রীর হাতের লেখার মধ্যে কোন তফাত নেই; হুবহু এক। তবে আমি হস্তরেখা বিশারদ নই যে জোর করে আমার নিজস্ব ধারণা অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেব। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে পারি যে, সব চিঠিগুলো একই লোকের লেখা। এই
অনিশ্চিত সম্ভাবনার কথা আমাদের মনে অবশ্যই ঠাই দিতে হবে।
তারপর পোয়ারো তার চেয়ারে হেলান দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথায় চিন্তার ছোঁওয়া স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে আমার তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যায়। প্রথমত, হাতের লেখার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। দ্বিতীয়ত, এই হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার পিছনে মিসেস লিডনারের মধ্যে এক দুর্বোধ্য মানসিকতার কারণ আমরা দেখতে পাই। তৃতীয় সম্ভাবনা হল, চিঠিগুলো কেউ হয়তো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে মিসেস লিডনারের হাতের লেখা নকল করে লিখে থাকবে। কিন্তু কেন? এর মধ্যে কোন যুক্তি অবশ্য পাওয়া যায় না। যাইহোক, এই তিনটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি অবশ্যই ঠিক এবং নির্ভুল।
পোয়ারো কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডঃ লিডনার, প্রথম যখন আপনার মনে হল, সেই চিঠিগুলোর লেখিকা মিসেস লিডনার নিজেই, তখন আপনার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া হল বলুন?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই অনুমানটা আমি আমার মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই। কারণ আমার মনে হয়েছিল, আমি যা ভাবছি সেটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
এর কারণ কি আপনি কখনও খুঁজে দেখেছেন?
হ্যাঁ, দেখেছি বৈকি! ডঃ লিডনার একটু ইতস্ততঃ করে বলেন, ইদানিং আমার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হয়েছিল, অত্যাধিক মানসিক চাপে এবং অহেতুক চিন্তা-ভাবনার জন্য হয়তো ও ওর মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে থাকবে সাময়িকভাবে এবং আমার ধারণা সেই সময় –হ্যাঁ, সেই সময়ের মধ্যেই তিনি লিখে থাকবেন। তখন তিনি আর তার মধ্যে ছিলেন না। সম্পূর্ণ অবচেতন মনে লেখা সেই চিঠিগুলো। এটাই সম্ভব তাই না? ডঃ রেলির দিকে ফিরলেন তিনি তার সমর্থন আদায় করার জন্য।