সভা ভাঙ্গার সংকেত জানিয়ে দিলেন পোয়ারো। আমরা সবাই যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করলাম। ওদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমি প্রায় দরজার ওপারে পা রাখতে যাব, মঁসিয়ে পোয়ারোর ডাকে ফিরে আসতে হল।
সম্ভবত মঁসিয়ে পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নার্স লিথেরান দয়া করে থেকে যাবেন। আমার অনুমান, আপনার সহযোগিতা আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে।
তাই আমাকে ফিরে আসতে হল। আমি আমার আগের আসন দখল নিলাম আবার।
১৫. পোয়ারোর পরামর্শ
১৫. পোয়ারোর পরামর্শ
ডঃ রেলি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই চলে যাবার পর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি। তারপর পোয়ারোর দিকে চকিতে একবার তাকালেন, ইশারায় তাদের মধ্যে কি কথা হল কে জানে, তবে পরমুহূর্তে ডঃ রেলিকে কোর্টইয়ার্ডের দিকের জানালাটা বন্ধ করতে দেখা গেল। তারপর তিনি তার আসনে আবার ফিরে এলেন।
চমৎকার! পোয়ারোর কথায় খুশির আমেজ, আমরা এখন এক গোপন আড্ডা গড়ে তুলেছি। কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না এখানে। আমরা এখন স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারি। এক্সপিডিসনের সদস্যরা কে কি বলেছে, তা আমরা ইতিমধ্যে শুনেছি। কিন্তু ও হ্যাঁ, সে যাইহোক, মাদাম বলুন, এ কেসের ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? আপনার কী চিন্তা ভাবনা দয়া করে আমাদের বলুন!
পোয়ারোর কথায় আমার সারা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। এখন আর অস্বীকার করবার উপায় নেই, পোয়ারো ছোট-খাটো বেঁটে লোক হলে হবে কি তার চোখ দুটো বড় তীক্ষ্ণ, বড় কৌতূহলোদ্দীপক! মনে হয়, আমি তার চোখে ধরা পড়ে গেছি, আমার ভাবনার কথা তিনি জেনে গেছেন।
ও কিছু নয়, উত্তরে আমি বললাম।
এবার তুমি নির্ভয়ে মুখ খুলতে পার নার্স, ডঃ রেলি তাড়া দেন, বিশেষজ্ঞদের অযথা দাঁড় করিয়ে রেখো না।
সত্যি বলছি, ও কিছু নয়, আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এমনি কথাটা আমার মনে হঠাৎ উদয় হল, তাই বলছিলাম। ধরা যাক, কেউ হয়তো জানেন কিংবা সন্দেহ করেন কাউকে মিসেস লিডনারের খুনী হিসাবে, কিন্তু প্রকাশ্যে বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সামনে তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। আশ্চর্য, আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো আমার সমর্থনে মাথা নাড়লেন।
কথাটা একেবারে খাঁটি সত্যি। ওঁদের সঙ্গে আলোচনার মাঝেও আপনি এ কথাটাই বলেছিলেন। ভাবছেন হয়তো, তবু কেন আলাদা করে আপনাকে আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনার মধ্যে রেখে দিলাম? তবে কী একটু আগের আলোচ্য সভার কোন অর্থ নেই? না, ঠিক তা নয়। একটু আগে যে ছোট খাট জমায়েত এখানে হয়ে গেল, তারও প্রয়োজন ছিল বৈকি, সেটা বর্তমান কেসের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী যে হতে পারে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। কেন নেই, তার ব্যাখ্যা আমি করছি। আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, ইংলন্ডের রেসের মাঠে ঘোড়দৌড় শুরু হবার আগে প্রতিযোগী ঘোড়াদের একটা প্যারেড হয়ে থাকে। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা, যাতে করে সবার পক্ষে তাদের দেখবার এবং বিচার করবার সুযোগ পাওয়া যায়। এই ছোট খাট জমায়েতের এটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। খেলোয়াড়ী দৃষ্টি নিয়ে আমি সম্ভাব্য স্টার্টারদের নিরীক্ষণ করেছি।
ডঃ লিডনার প্রবলভাবে আপত্তি জানালেন, আমার এই এক্সপিডিসনের কোন সদস্য বা সদস্যা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে বলে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না।
তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে আমার সমর্থন লাভের আশায় বললেন, নার্স, তুমি যদি মঁসিয়ে পোয়ারোকে বুঝিয়ে বল আমার স্ত্রীর সঙ্গে গত দুদিন থাকার সময় কি কি তোমার নজরে পড়েছিল, কিংবা তোমাদের দুজনের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল আমি তাহলে বাধিত হব এই কারণে যে, বুঝতে পারব প্রকৃত তথ্য আমরা তুলে ধরতে পেরেছি ওঁর কাছে।
ডঃ লিডনারের অনুরোধ আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। তবে আমি যেটুকু জেনেছি তার থেকে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলবার প্রয়োজন মনে করলাম না। এমন কি মিসেস লিডনার যে সব কথাগুলো ব্যবহার করেছিলেন, ঠিক সেই কথাগুলোই আমার বক্তব্যে স্থান দিলাম। আমার মনে হল, এই মুহূর্তে মিসেস লিডনার যেন আমার উপরে ভর করেছেন।
আমার বলা শেষ হতেই মঁসিয়ে পোয়ারো বলে উঠলেন, খুব ভাল, খুব ভাল। দেখছি আপনার সব ঠিক মনে আছে। আমার ধারণা, এখানে আপনি আমার অনেক কাজে লাগতে পারেন।
তারপর তিনি ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে বললেন, চিঠিগুলো আপনার কাছে আছে?
হ্যাঁ। চিঠিগুলো আমি সঙ্গে নিয়েই এসেছি। আমার অনুমানই ঠিক ভেবেছিলাম প্রথমেই আপনি চিঠিগুলো দেখতে চাইবেন।
তাঁর হাত থেকে নিয়ে পোয়ারো পড়তে শুরু করে দিলেন এবং তার অভ্যাস মত খুব সতর্কতার সঙ্গে চিঠিগুলো পড়লেন। কিন্তু তার একটা কাজের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমি লক্ষ্য করলাম, চিঠিগুলোর উপরে গুঁড়ো পাউডার ব্যবহার করলেন না তিনি, এমন কি মাইক্রোস্কোপ কিংবা ওই রকম জাতীয় কিছু ব্যবহার করলেন না তিনি চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে। সাধারণ যেমন চিঠি পড়ে থাকেন, ঠিক সেই ভাবেই চিঠিগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলেন তিনি এবং চিঠিগুলো টেবিলের উপরে রেখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন।