কিন্তু শুরুতেই আমি হোঁচট খেলাম। ডাক্তারকে আমি ঠিকই বলেছিলাম, কীভাবে শুরু করব এটা জানার খুবই অসুবিধা আছে এ ব্যাপারে।
আমার ধারণা আমার নিজের সম্বন্ধে দু-চার কথা অবশ্যই বলা দরকার। আমার বয়স বত্রিশ, নাম অ্যানি লিথেরান। সেন্ট কৃস্টোফারে ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর দু’বছর প্রসুতি-বিদ্যার শিক্ষা নেওয়ার পর ডিভোন-শায়ার প্লেসে মিসেস বেন্ডিক্সের নার্সিংহোমে বছর চারেক কাজ করি। ইরাকে আমি মিসেস কেলসির সঙ্গে এসেছি, তিনি বাগদাদে আসছিলেন তার স্বামীর সঙ্গে। মিসেস কেলসির স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না তখন। বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল একা বহন করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই মেজর কেলসি তাদের সঙ্গে আমায় বাগদাদে আসার ব্যবস্থা করেন। আমার কাজ বরাদ্দ হল তাঁদের ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার ভার নেওয়া। আমার খরচের ভার নিলেন তারা। অন্য আর একজন নার্স পেলেই তারা আমাকে রেহাই দেবেন এরকম কথা হয়েছিল তাদের সঙ্গে।
ভালো কথা, কেলসিদের সম্বন্ধে বেশি বিবরণ দেবার আর দরকার নেই বলে আমি মনে করি। ভারি সুন্দর তাদের ছোট্ট বাচ্চাটি। মিসেস কেলসি একটু খিটখিটে স্বভাবের হলেও ভারি চমৎকার মানুষ ছিলেন। ওরকম দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা আমার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি।
লম্বাটে মুখ ডাঃ রেলির, কালো চুল। কখনো কখনো নিষ্ঠুর এবং বিমর্ষ গলায় খুব মজার মজার কথা বলতেন তিনি। হাসানিয়ে বলে একটি জায়গায় সিভিল সার্জেন ছিলেন তিনি, বাগদাদ থেকে দেড় দিনের যাত্রাপথ।
বাগদাদে সপ্তাহ খানেক থাকার সময় ডঃ রেলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি জানতে চান, আমি কবে নাগাদ কেলসিদের ছেড়ে আসছি। আমি তাঁকে বলি, তার এরকম অদ্ভুত কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে থাকতে পারছি না, কারণ সত্যি কথা বলতে কি রাইটস্ পরিবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেশে ফিরে যাচ্ছেন এবং তাঁদের নার্স ছাড়া পাওয়া মাত্র সোজা চলে আসছে।
প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, রাইটসদের কথা তিনি শুনেছেন এবং সেই জন্যেই নাকি তিনি আমাকে প্রশ্নটা করেছিলেন।
আসল কথা কি জানো, ডঃ রেলি একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যে একটা সম্ভাব্য কাজের সন্ধান আমি পেয়েছি।
কেন?
তার মুখটা একটু কুঁচকে উঠল, তাঁকে একটু চিন্তিত বলে মনে হল।
হ্যাঁ, এটাকে তুমি একটা কেস বলেও ধরে নিতে পারো। প্রসঙ্গ একটি ভদ্রমহিলার, বলা যেতে পারে তার একটা নেশা আছে।
ওঃ! অস্ফুটে একটা ছোট্ট শব্দ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। (এর অর্থ যে কেউ ধরে নিতে পারে–মদ কিংবা মাদকদ্রব্য জাতীয় কিছু!)।
ডঃ রেলি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, বেশি কিছু বলতে চাইলেন না।
হ্যাঁ’, প্রসঙ্গান্তরে ফিরে এলেন তিনি, মিসেস লিডনার। তাঁর স্বামী একজন আমেরিকান, আমেরিকান–সুইডিশ বললেই বোধহয় ঠিক হবে। বিরাট জ্ঞানী মানুষ আমেরিকান খননকার্যের প্রধান তিনি। ডঃ রেলি ব্যাখ্যা করে বললেন, আমিরিয়ানের মতো বিরাট প্রাচীন শহরের নিচে খননকার্যের অভিযান কি করে চালানো হচ্ছে। জায়গাটা হাসানিয়ের থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না, তবে খুব নির্জন। এখন ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
সারাদিন কি তাকে স্থানীয় লোকেদের মধ্যে ছেড়ে রাখা হয়? জিজ্ঞেস করলাম।
না, না, তার কাছে যথেষ্ট ভিড় থাকে, সাতটা আটটা পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় না, তিনি বাড়িতে কখনও একা থাকেন। তবে সন্দেহ নেই, এক অস্বস্তিকর জায়গার মধ্যে তাঁকে কাজ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও স্বীকার করতে হয়, শত কাজের মধ্যেও লিডনার তার স্ত্রীর ভাল-মন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। প্রখর দৃষ্টি থাকে তার স্ত্রীর উপর। এ অবস্থায় কোন অভিজ্ঞ নার্স যদি তার স্ত্রীর উপর নজর রাখার দায়িত্ব নেয়, তিনি তাহলে খুব খুশি হবেন।
তো এ ব্যাপারে মিসেস লিডনার নিজে কী ভাবেন বলুন তো?
ডঃ রেলি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন?
মিসেস লিডনার? চমৎকার মহিলা। দু দিন আগেও এ ব্যাপারে একমত ছিলেন না তিনি। তবে সামগ্রিক বিচারে এই পরিকল্পনাটা তার মনঃপুত বলা যেতে পারে। তিনি আরও বললেন, বড় অদ্ভুত এই মহিলা, মিথ্যা কথায় তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু লিডনারের ধারণা, অন্য কোন কারণে তার স্ত্রী প্রাণের আশঙ্কা করছেন।
বেশ তো সব মানলাম, তা মিসেস লিডনার নিজে আপনাকে কিছু বলেন নি?
ওহো, তিনি আমার সঙ্গে কোন পরামর্শই করেননি। অনেক কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করেন না। আসলে লিডনারই আমার কাছে আসেন এবং এই পরিকল্পনার কথা বলেন। তা তোমার এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে কি অভিমত বল? বাড়ি ফেরার আগে এ দেশটার ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য তুমি সংগ্রহ করতে পারবে। আরো দুমাস খনন কার্যে লিপ্ত থাকছেন তারা, আর এ কাজটা খুবই আকর্ষণীয়।
ডঃ রেলির প্রস্তাবটা আমার মনে ঝড় তুলেছিল তখন। দ্বিধা, জড়তা মুহূর্তে কাটিয়ে উঠে বললাম, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অপূর্ব, ডঃ রেলি উঠতে গিয়ে বললেন, লিডনার এখন বাগদাদে। আমি তাকে বলব, তোমার সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা পাকা করে নেবার জন্য।
সেদিনই অপরাহ্নে ডঃ লিডনার এলেন হোটেলে। ভদ্রলোক মাঝ-বয়সী, দ্বিধাগ্রস্থ মনোভাব, বুঝি বা একটু ভীত সম্প্রদায়েরও। দেখলে মনে হয়, স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত অনুগত তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, স্ত্রীর ঠিক অসুবিধাটা যে কি সেটা তাঁর কাছে এখনও অজ্ঞাত।