না।
দশ মিনিট, ধ্যান মগ্ন সন্ন্যাসীর মত আপন মনে চোখ বন্ধ করে ভাবলেন পোয়ারো, সেই সর্বনাশা দশ মিনিট।
সেই সময় একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে তাদের আলোচনার মাঝে।
হঠাৎ, হা হঠাই মিস জনসন মাথা তুলে বললেন, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার । মনে হয় অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমি আপনাকে ভুল বুঝিয়েছি। ভাল করে ভেবে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমার বিশ্বাস হয় না, আমার ঘরের অবস্থান যা, যেখান থেকে মিসেস লিডনারের চিৎকার আমি শুনতে পেয়েছিলাম। মাঝখানে এ্যান্টিক রুম। তাছাড়া আমি শুনেছি, ওঁর ঘরের জানালাগুলো বন্ধ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল সেই সময়।
সে যাই হোক, নিজের উপর অমন করে আস্থা হারাবেন না মাদাম। বিনয়ের সঙ্গে বললেন পোয়ারো। এটা খুব একটা জরুরী ব্যাপার নয়।
না, অবশ্যই নয়, সে কথা আমি জানি। কিন্তু দেখুন, আমার কাছে সেটা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আমি মনে করি, একটু সজাগ থাকলে হয়তো কিছু একটা আমি করতে পারতাম।
প্রিয় অ্যানি, ওভাবে নিজের উপর আস্থা হারিও না। ডঃ লিডনারের কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়, সমস্ত ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করো। এমনও হতে পারে, যে শব্দটা তুমি শুনেছিলে সেটা কোর্টইয়ার্ডের বাইরে কোথাও দূর থেকে এসে থাকবে।
ডঃ লিডনারের সান্ত্বনায় মিস জনসনের মুখ থেকে আংশিক মেঘ সরলেও আমি লক্ষ্য করলাম, দীর্ঘ সময় ধরে চোখের জল কষ্ট করে ধরে রাখার সেই ধৈর্য্যের বাঁধটা হঠাৎ ভেঙ্গে রেণু রেণু হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে নিল ও, হয়তো চোখের জল ঢাকবার জন্য এবং কথা হল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, প্রসঙ্গ বিক্ষিপ্ত।
মিস জনসনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিয়োগান্ত নাটকের শেষ অঙ্কে মাঝে মাঝে কল্পনার প্রভাব পড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক।
পোয়ারো আর একবার তার নোটবুকের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর মিঃ রিচার্ড ক্যারির দিকে ফিরলেন তিনি।
মিঃ ক্যারি, আমার ধারণা, এর পরেও আপনাকে বেশি কিছু বলতে হবে।
দম দেওয়া পুতুলের মত ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন রিচার্ড ক্যারি।
আমার আশঙ্কা, এ ব্যাপারে আমি আপনাদের খুব বেশি সাহায্য করতে পারব না। দুর্ঘটনার সময় আমি খনন কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, খবরটা আমাকে সেখানেই দেওয়া হয়।
খুন হওয়ার আগে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ে না যা এ কেসের ব্যাপারে সাহায্যে আসতে পারে?
না, তেমন কিছুই তো মনে পড়ছে না।
মিঃ কোলম্যান?
সমস্ত ব্যাপারটাই আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেছে?মিঃ কোলম্যানের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়, সে যেন বলতে চাইছে, আমাকে এ ব্যাপারে আর জড়ানো কেন।এখানে সবাই জানে শ্রমিকদের বেতনের টাকা অনার জন্য গতকাল সকালেই আমি চলে যাই হাসানিয়েয়। ফিরে এসে মিঃ এমাটের কাছ থেকে দুর্ঘটনার কথা শুনতে পাই। পরমুহূর্তে আমি গাড়ি ঘোরাই, গন্তব্যস্থল পুলিশ স্টেশন এবং ডঃ রেলিকে দুঃসংবাদটা পরিবেশন করার কথাটাও আমার মনে পড়ে যায় তখন।
আর তার আগে?
বলছি স্যার, মিঃ কোলম্যানের চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া কাপে, আপনি নিশ্চয়ই এখানকার অ্যান্টিক-রুমের কথা শুনেছেন। বুঝলেন, সেই ঘরের জানালার সামনে অপরিচিত মুখ দুর্ঘটনার দিন কয়েক আগে দেখা সেই অদ্ভুত দৃশ্য। সেই দৃশ্যপটের আড়ালে যে-ই কলকাঠি নাড়ুক না কেন, আজও সে পলাতক। আপনার মনে আছে? ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন তার সমর্থন পাবার জন্য, তিনি মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানালেন।
আমার ধারণা, মিঃ কোলম্যান বললেন, হয়তো তদন্ত করতে গিয়ে আপনি জনি নামে এক ভিখারীকে আবিষ্কার করবেন, যে লোকটা সেদিন কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করে থাকবে।
দু-এক মিনিট নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন পোয়ারো, তাকে বোঝবার জন্য।
মিঃ কোলম্যান, আপনি কী ইংলিশম্যান? অবশেষে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন পোয়ারো তার দিকে।
হ্যাঁ, আপনার অনুমানই ঠিক স্যার, খাঁটি ব্রিটিশ।
এ বছরই কী আপনার প্রথম এখানে আসা?
হুঁ।
আপনি কী আন্তরিকভাবে প্রত্মতত্ত্বে আগ্রহী?
এই একটা প্রশ্নে মিঃ কোলম্যানকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হল। অপরাধী ছাত্রের মত তাকাল সে ডঃ লিডনারের দিকে। তারপর কি ভেবে সে বলে, নিশ্চয়ই, আমার আগ্রহ আছে বৈকি। আমতা আমতা করে সে, না-মানে আমি খুব একটা মেধাবী ছাত্র নই।
অসমাপ্ত তার বক্তব্য। তবু পোয়ারো তার কাছ থেকে বাকী কথা আদায় করার তেমন কোন আগ্রহ দেখালেন না। তাকে এখন ঠিক ধ্যানমগ্ন যোগীর মত দেখাচ্ছিল। টেবিলের উপর পেন্সিলের দাগ কাটা, সেকি অন্যমনস্কতার দরুন, নাকি তিনি সময় নিচ্ছিলেন নিজেকে তৈরি করতে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসাবে।
তাহলে এর থেকে মনে হচ্ছে, পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন, যে কোন মুহূর্তে আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে পারি। আপনাদের মধ্যে যদি কারোর মনে হয় যে, আপনারা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানেন, যা আপনারা মনে করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারছেন না ঠিক এই মুহূর্তে, আমি তাদের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, সেই কথাটা আপনাদের স্মরণ-বীণায় যে মুহূর্তে ঝঙ্কার তুলবে আমার কাছে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। এখন আপনারা যে যার কাজে ফিরে যেতে পারেন। আমি এখন ডঃ লিডনার এবং ডঃ রেলির সঙ্গে কয়েকটা জরুরি আলোচনা করতে চাই।