ওঁকে প্রথমে দেখা মাত্রই আপনাদের হাসির উদ্রেক হবে। মনে হবে রঙ্গমঞ্চে কিম্বা ছায়াচিত্রের সঙ্গে তিনি যেন জড়িত আছেন। প্রথম থেকে শুরু করা যাক, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির বেশি লম্বা তিনি নন। একটু বেঁটেই বলতে হয় বুঝি বা একটু বয়স হয়েছে, প্রকাণ্ড দেহ, ডিম্বাকৃতি মুখ। কতকটা কৌতুক নাটকে নরসুন্দরের মত দেখতে তাকে।
হ্যাঁ, এই লোকই মিসেস লিডনারের খুনীর সন্ধান করতে যাচ্ছেন।
মনে হয় আমার মুখের উপর বিরক্তির ছায়া পড়ে থাকবে এবং সেটা পোয়ারোর চোখে ধরা পড়ে গেছে। তা না হলে সরাসরি কি করে তিনি বললেন, আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি ম্যাডাম? মনে রেখো, পুডিং খেতে কেমন কেবল মুখে দিলেই বোঝা যায়।
উপমাটা মন্দ নয়। কিন্তু নিজের মধ্যে তেমন আস্থা অনুভব করতে পারলাম না।
রবিবার, মধ্যাহ্নভোজের পর ডঃ রেলি তাঁর গাড়িতে চড়িয়ে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে এলেন। পোয়ারোর পরবর্তী কাজ হল আমাদের এক সঙ্গে জড়ো করে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার সুবিধার জন্য আমরা সবাই ডাইনিংরুমে সমবেত হলাম। ডাইনিং টেবিলের সামনে এরকুল পোয়ারো বসেছিলেন, তার একপাশে ডঃ লিডনার, অন্য দিকে ডঃ রেলি তার সঙ্গে নিচু গলায় কি যেন আলোচনা করছিলেন তখন, হয়তো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছিলেন, কি ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পালাটা শুরু করা যায়।
আমাদের সবাইকে সমবেত হতে দেখে ডঃ লিডনার গলা পরিষ্কার করেও দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন। আজ তিনি হাসানিয়ে হয়ে বাগদাদে ফিরে যাচ্ছিলেন। দয়া করে তিনি তার যাত্রাপথে বিরতি ঘটিয়ে আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন। ইরাকের পুলিশ এবং ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিন্তু এ এক বিচিত্র কেস, ডঃ রেলির দিকে ফিরে তিনি আবার বলতে থাকেন, মনে হয় তাদের পক্ষে এই জটিল কেসের সঠিক সমাধানে পৌঁছুতে অসুবিধা হবে।
সব দিক থেকে তারা তেমন দক্ষ নন, তাই কী? টেবিলের মধ্যমণি সেই ছোট বেঁটে খাটো লোকটি মন্তব্য করে তাকান চারদিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী, ভাল করে ভাষাটা রপ্ত করতে পারেন নি কেন, কে জানে?
ওহো, যে ভাবেই হোক তাকে ধরতেই হবে। মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন, সে যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সেটা আমাদের কাছে অসহ্য হবে।
দেখলাম মিসেস মারকাডোর কথাটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করছেন পোয়ারো। তার চোখের চাহনিতে অন্তত সেই কথা মনে হল আমার।
কে, কে সে ম্যাডাম?
কেন, সেই খুনী ছাড়া আর কার কথা বলতে পারি?
খুনী? ও, হ্যাঁ
কথাটা এমন হাল্কা ভাবে বললেন এরকুল পোয়ারো যে খুনীর ব্যাপারটা যেন কিছুই নয়।
আমাদের সবার অবাক চোখ তার দিকে। এবং তার সন্ধানী চোখ এক এক করে আমাদের মুখের উপর পরিক্রমারত।
আপনাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, পোয়ারো বলেন, আপনারা কেউই এর আগে কোন খুনের মুখোমুখি হননি।
একটা সমবেত আক্ষেপধ্বনি বেরিয়ে এল। এরকুল পোয়ারো হাসলেন।
তাহলে এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনাদের কারোরই খুনের অ, আ, ক, খ সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। অপ্রীতিকর, হা এখানে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপার রয়েছে। যেমন প্রথমেই ধরা যাক, এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।
সন্দেহ?
মিস জনসন এই প্রথম মুখ খুলল। মিঃ পোয়ারো চিন্তিত ভাবে তাকালেন তার দিকে। আমার ধারণা, মিস জনসনের কথায় তার সায় আছে। সেই মনোভাব তার কথায় প্রকাশ পেল। দেখছি এখানে একজন সমঝদার বুদ্ধিমতী মহিলা আছেন। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, হ্যাঁ, ম্যাডাম, সন্দেহজনকই বটে! এ বাড়িতে এখন আপনারা সবাই সন্দেহজনক ব্যক্তি। পাঁচক, হাউস-বয়, পরিচারক, পট বয়, হা, সবাই, এমন কি আপনাদের এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যই পুলিশের চোখে এখন সন্দেহজনক ব্যক্তি।
মিসেস মারকাডো সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠলেন, আপনার সাহস তো কম নয়? এ কথা বলার স্পর্ধা হল কী করে আপনার? এ উক্তি জঘন্য এবং অসহনীয়। ডঃ লিডনার আপনি চুপ করে বসে থাকবেন না। এই লোকটাকে –হ্যাঁ এখুনি এই লোকটাকে আপনি
ডঃ লিডনার ফলাত ভাবে বলেন, একটু শান্ত হবার চেষ্টা কর মেরী।
মিঃ মারকাডোও উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাত, রক্তবর্ণ চোখ। এ অন্যায় অপমান, আমাদের সম্মানের পক্ষে হানিকর।
না, না, মিঃ পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনাদের অপমান করতে চাই না। আমি আপনাদের সবাইকে এক অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে বলেছি মাত্র। যে বাড়িতে কেউ খুন হয়, সেই বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দাই সন্দেহের ভাগীদার হয়ে থাকে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। তারপর আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, খুনি যে বাইরে থেকে এসেছিল তার প্রমাণই বা কোথায়?
মিসেস মারকাডো গর্জে উঠলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই সে বাইরে থেকে এসেছে।
একথা ভাববার যথেষ্ট কারণ আছে! কেন জানেন? একটু থেমে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে এনে তিনি বললেন, এ ছাড়া অন্য সব কিছুই অবিশ্বাস্য।
ম্যাডাম, এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহ, অস্বীকার করছি না, পোয়ারো মাথা নিচু করে বলেন, আমি তো আপনাদের আগেই বলেছি, এই পরিস্থিতিতে প্রথমে আমি আপনাদের সবাইকে নিরপরাধ ভেবে প্রকৃত অপরাধীর খোঁজ করব। আর সেই সময়টুকু, শুধু সেই সময়টুকুর জন্য আমরা এখন আপনার হাতের মুঠোয়, ফাদার ল্যাভিগনি বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলেন, আমরা যে নির্দোষ, এ ব্যাপারে নিজেকে সন্তুষ্ট করবার ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করুন, যাতে করে আমরা এই অস্বস্তিকর অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।