জোয়ান সাটক্লিফের পাশের ঘরের রমণীটি অলিন্দ থেকে পা টিপে টিপে ফিরে এলে, তার হাতে একটা আয়না। মহিলাটির চিবুকে একটা চুল গজিয়েছে তাই আয়না হাতে মহিলাটি অলিন্দে এসে অনেক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, সেটা উপড়ে ফেলে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে যখন বেশ তৃপ্তি পেল ঠিক তখুনি চোখে পড়লো পাশের ঘরের আয়নায় ঝুলন্ত লোশাক, আলমারির আয়নায় স্পষ্ট প্রতিফলন ফুটে উঠেছিল, আর সেই প্রতিবিম্বে ধরা পড়লো একজন অদ্ভুত পুরুষ কিছু করছে। সেই অবাস্তব ব্যাপারটা দেখে রমণীটি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষটি তাকে দেখেনি। নারী মূর্তিটি শুধু দুই আয়নার প্রতিফলনে ব্যাপারটাকে দেখলো। পুরুষটি যদি একবারও ঝুলন্ত আয়নায় চোখ রাখতো তাহলেই দেখতে পেতে পাশের ঘরে লাগোয়া ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন সুন্দরী রমণী হাতে আয়না নিয়ে কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। লোকটি যতক্ষণ কাজ করল ততক্ষণ অলিন্দে দাঁড়িয়ে রমণীটি আয়না হাতে সব দেখলো, কাজ শেষ করে লোকটি চিঠি লিখে রেখে টেলিফোন করছে। একটু পরেই দরজা বন্ধ হল। রমণীটি নিজের ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে। বারান্দায় শেষ প্রান্তে পালকের ঝাড়ন দিয়ে একজন আরবীয় মন্থর হাতে ময়লা ঝাড়ছিল, মোড় ঘুরে সে চলে গেল। যেতেই মেয়েটি চট করে পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তালা বন্ধ ছোটো চাকুর ফলা আর চুলের কাটা দিয়ে নিপুণ হাতে তালা খুলে ফেললো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিঠিটা তুলে নেয়, চিঠি পড়তেই ভুরু কুঁচকে ওঠে। কোনো ব্যাখ্যা নেই, যথাস্থানে রেখে ঘরের এপাশে এসে দু-হাত বাড়িয়ে হঠাৎ জানলা দিয়ে একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
জোয়ান চেঁচিয়ে বলছিলো, এ যে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার মশাই, এমন পাগলামি কেউ কখনো শুনেছে? চারিদিক শান্তিপূর্ণ, হৈচৈ নেই, গণ্ডগোল নেই, আতঙ্ক নেই, প্রত্যেকের সুন্দর ব্যবহার…না-না এসব আপনাদের অহেতুক বাড়াবাড়ি।
তাই যেন হয় মিসেস সাটক্লিফ। কিন্তু মাননীয় রাজদূত মনে করেন যে বিপদের ঝুঁকি এত বেশি যে তার দায়িত্বে…তার মালপত্র প্রচুর, আমরা সমুদ্রপথে বাড়ি যাব, আগামী বুধবারে আমাদের জাহাজ ছাড়বে। সব পরিকল্পনা ছুঁড়ে ফেলে হুট বলতেই উড়ি এখন ইংল্যান্ডে, প্রতিনিধিটি বিব্রত মুখে আশার বাণী শোনালো, সাটক্লিক ও তার মেয়েকে বিমানে ইংল্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে না, পথে এডেনে নামিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে জাহাজ ধরতে হবে। রমণীটি কথাটি শোনামাত্র দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল। সবার আগে স্যুটকেসের ওপরে ঠিকানা লেখা কাগজটা ভালো করে দেখে নেয়। তার পিছনে পিছনে কেরাণীটি ছুটতে ছুটতে এসে বলে, মিসেস সাটক্লিক আপনার ভাই এসেছিলেন একটু আগেই। আপনার ঘরেও গিয়েছিল, চলে গেছেন বোধহয়। সাটক্লিক ধন্যবাদ জানালো। তারপর তিনি আফশোস করে বললেন, বব মনে হয় বিপ্লবের কথা বলতে এসেছিল। তারপর তার ঘরের দরজা খোলা কেন, কী অসাবধানতা এই লোকগুলোর।
জেনিয়া বলল, বোধহয় বব মামার কাণ্ড।
মিসেস সাটক্লিক বললেন, যে ববের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। তারপর সে চিঠিটা পেল।
চিঠিটা পড়ে যা মনে হয় বব মোটেই ব্যস্ত হয়নি, মনে হল। আমার তো মনে হয় না কোনো কূটনৈতিক ঝগড়া-টগরা বেঁধেছে।
.
মিঃ রবিনসনের পরিচয়
মাস দেড়েক পড়ে একজন যুবক ব্রুমনবেরীর কোনো একটা ঘরের দরজায় সাবধানে টোকা দিতেই ভেতর থেকে আহ্বান এলো। ছোটো ঘরটিতে বড়ো একটা টেবিলের পেছনে মোটাসোটা একজন মাঝবসয়ী ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন, তার স্যুটে ভাজ পড়ে গেছে, সামনের দিকে চুরুটের ছাই লেপটে আছে, জানলা বন্ধ থাকায় ঘরে অসহ্য গুমোট। ঢুলুঢুলু চোখে ভদ্রলোক বলেন, কি হে এবার কিসের দরকার? আজ্ঞে বিদেশ দপ্তর থেকে এডমাণ্ডুসন এসেছেন। আবার চোখ মিটমিট করে বিড়বিড় করে বললেন, রামাতে বিপ্লবের সময় তিনি আমাদের দূতাবাসে তৃতীয় সচিব ছিলেন তাই না, আজ্ঞে হ্যাঁ। কর্নেল বলেন, তাহলে তো দেখা করতেই হবে।
মিঃ এডমাণ্ডুসন বেশ লম্বা, ফর্সা, চমৎকার পরিপাটি পোশাক। কর্নেল পাইক্যাওয়ে আমি জন এডমাণ্ডুসন। ওরা বললো, আপনি নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? এডমাণ্ডুসন বললেন। বলেছেন বুঝি, তা বসুন।
পাইক্যাওয়ের চোখ বুজে আসে। তা বিপ্লবের সময় আপনি রামাতে ছিলেন? এডমাণ্ডুসন বলেন, হ্যাঁ বিশ্রী ব্যাপার। তারপর পাইক্যাওয়ের বলেন, আপনি বব রবিনসনের বন্ধু ছিলেন না, তার সঙ্গে আমার বেশ ভালোই জানাশোনা আছে।
এখানে সতর্ক হয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা সব খবর রাখি। যেদিন বিপ্লব হলো সেদিন বব শাহজাদা ইউসুফকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল। তখন থেকেই বিমানটা নিখোঁজ, হয়তো ওরা কোনো দুর্গম স্থানে নেমেছে নয়তো বিমানখানা ধ্বংস হয়েছে। আরলেজ পাহাড়ে একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে আর দুটি মৃতদেহও ছিল। সেখানে কালকের কাগজে খবরটা বেরুবে কী বলেন।
বড়ই দুঃখের! কী করুণ কাহিনী, শাহজাদা যদি বেঁচে থাকতেন তো রাজার মতো রাজা হতেন, আলোকপ্রাপ্ত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কর্নেল পাইক্যাওয়ে বলেন, হয়তো সেইজন্যই বেচারাকে মরতে হল। স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল থেকে অনুরোধ এসেছে যে কয়েকটি ব্যাপারে আমরা যেন অনুসন্ধান চালাই তাতে আমাদের সরকারের অনুমোদনও রয়েছে। এডমাসন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো, তা হ্যাঁ কিছু কিছু তিনি শুনেছেন বটে। তারপর পাইক্যাওয়ে বলেন যে মৃতদেহের কোনোটা থেকেই কোনো মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়নি, ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও না।