- বইয়ের নামঃ অথৈ সাগর ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অ্যাডভেঞ্চার
অথৈ সাগর ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
১
কাপড় খুলল কুমালো। লম্বা, শক্ত, বাদামী শরীর, যেন নারকেলের কাণ্ড। দেয়ালের গা থেকে উপসাগরের ওপর বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে গিয়ে দাঁড়াল। পরনে সাঁতারের পোশাক বলতে কিছু নেই, হাতে শুধু দস্তানা। ধারাল প্রবাল থেকে তার আঙুল বাঁচাবে ওগুলো। খসখসে খোসাওয়ালা ঝিনুক খামচে ধরে তুলতে সুবিধে হবে।
ডুব দেয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগল সে। ডুবুরিরা এই পদ্ধতিটাকে বলে টেকিং দ্য উইণ্ড বা বাতাস নেয়া। দম নিতে আরম্ভ করল সে, একটা থেকে আরেকটা আরও ভারি, আরও লম্বা। ঠেলে, জোর করে বাতাস ঢোকাচ্ছে ফুসফুসে। সেই বাতাস আটকে রাখতে বাধ্য করল ফুসফুসকে।
তারপর আস্তে করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পানিতে। ঝাঁপ দিল না বলে আলগোছে শরীরটাকে ছেড়ে দিল বলা ভাল। মাথা নিচু করে ডাইভ দেয়নি। সোজা হয়ে পড়েছে। পা নিচের দিকে দিয়ে নেমে যাচ্ছে খাড়া।
এভাবে নেমে গেল দশ ফুট। তারপর ডিগবাজি খেয়ে ঘুরিয়ে ফেলল শরীরটা, এবার মাথা নিচে পা ওপরে। একই সঙ্গে হাত পা নাড়ছে, কাছিমের মত।
পানির নিচে সাঁতারের অনেক দৃশ্য দেখছে মুসা, সে নিজেও ভাল সাঁতারু। কিন্তু এরকম দৃশ্য কখনও দেখেনি। ডুবুরির পোশাক ছাড়া তিরিশ ফুট নিচে নামতে পারলেই ধন্য হয়ে যায় ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান সাঁতারুরা। চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। ওই গভীরতায়ই পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে শরীরের ওপর। নিচের পানি ওপরের দিকে ঠেলতে থাকে, পারলে গ্যাসভর্তি বোতলের মুখের কর্কের মত ফটাস করে ছুঁড়ে মারতে চায়।
কিন্তু কুমালো পরোয়াই করল না চাপের। নেমে যাচ্ছে…চল্লিশ ফুট…পঞ্চাশ …ষাট।
আমার বিশ্বাস, এর ডবল নিচে নামতে পারবে ও, কিশোর বলল। সাঁতার জানে বটে পলিনেশিয়ানরা।
হ্যাঁ, যোগ করল রবিন। বয়েস দুবছর হওয়ার আগেই সাঁতার শিখে ফেলে। হাঁটা শেখার আগে সাঁতার শেখে অনেক পলিনেশিয়ান শিশু। ডাঙা আর পানি ওদের কাছে সমান। উভচর। সীল, কাছিম, ব্যাঙ, বীবরের মত।
আবছা দেখতে পাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, থেমেছে কুমালো। প্রবাল আঁকড়ে ধরে যেন ঝুলে রয়েছে, পা ওপরের দিকে। হাতের জোরে টেনে শরীরটাকে নামাল খানিকটা, ছেড়ে দিল, তারপর ধরল আরেক জায়গার প্রবাল। এরকম করল কয়েক বার। মনে হচ্ছে, হাতের ওপর ভর দিয়ে সাগরের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সে।
তারপর কালো কিছু একটা আঁকড়ে ধরে মাথা ঘোরাল, তীব্র গতিতে উঠতে শুরু করল ওপরে। ভুস করে ভেসে উঠল তার মাথা, শরীর, কোমর পর্যন্ত, আবার ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল, পরিষ্কার করে নিল মাথার ভেতরটা। হাত বাড়িয়ে ধরল পাথরের কিনার, যেটা থেকে লাফ দিয়েছিল।
হিসহিস করে তার ফুসফুস থেকে বেরোচ্ছে চেপে রাখা বাতাস। ব্যবহৃত বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার পর বুক ভরে টেনে নিল বিশুদ্ধ বাতাস। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ, ছেলেদের কথা যেন কানে ঢুকছে না।
ধীরে ধীরে ঢিল হয়ে এল শরীর। স্বভাবিক হল চেহারা। ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তার বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে তাকে টেনে ওপরে তুলল ছেলেরা।
হাতের কালো বস্তুটা পাথরে রাখল কুমালো।
আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল কিশোর, সঠিক দ্বীপটা খুঁজে পাওয়ায়। উপসাগরটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, পেয়েছে প্রফেসর ইস্টউডের মুক্তার খামার। নিশ্চিত হওয়ার কারণ আছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুক সাধারণত এতবড় হয় না, বাইরে থেকে বীজ আনার ফলেই হয়েছে।
এরকম আর আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল কুমালো। বিছিয়ে আছে তলায়। সেজন্যেই ওপর থেকে কালো লাগে। একটার গায়ে আরেকটা লেগে রয়েছে। শয়ে শয়ে।
উত্তেজনায় প্রায় নাচতে শুরু করল মুসা। তারমানে শত শত মুক্তা!
না, শান্তকণ্ঠে বলল কুমালো। সব ঝিনুকে মুক্তা থাকে না। একটা মুক্তার জন্যেই হয়ত একশো ঝিনুক খুলতে হবে।
হ্যাঁ, সে-রকমই হবার কথা, একমত হল রবিন। তবে এখানে একটু অন্য রকম হতে পারে। বিশেষ ব্যবস্থায় ঝিনুকের চাষ করেছেন প্রফেসর।
দেখা যাক তাহলে এটাতে কিছু আছে কিনা, বলতে বলতে কোমর থেকে ছুরি খুলল মুসা। ঝিনুকটা নিয়ে চাড় মেরে খোলা দুটো খোলার চেষ্টা করতে। লাগল। অনেক চেষ্টা করল, ঘামতে শুরু করল সে, কিন্তু ঝিনুক আর খুলতে পারল না।
এভাবে পারবে না, কায়দা আছে,কুমালো হাত বাড়াল। দেখি, দাও আমার কাছে। চাড় দিয়ে ডালা খোলার বদলে ছুরির ফলাটা সে ঢুকিয়ে দিল দুই ডালার মাঝের ফাঁক দিয়ে, যতখানি যায়, কেটে ফেলল খোলাকে চাপ দিয়ে বন্ধ করে রাখে যে মাংসপেশি, সেটা। পেশি কেটে যেতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ডানা দুটো।
মুসার হাতে ঝিনুকটা দিল কুমালো। নাও, এবার খুঁজে দেখ। থাকলে কিনারের মাংসের ভেতরেই থাকবে।
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে, কাঁপা হাতে মুক্তা খুঁজল মুসা। পেল না। হতাশ হল খুব। কিন্তু হাল ছাড়ল না। আরও ভেতরেও থাকতে পারে, কে জানে। অনেক খুঁজল সে। ঝিনুকের আঠাল পিচ্ছিল মাংস আর দেহযন্ত্রের কোনা কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু মুক্তা মিলল না।
ধুত্তোর, খামোকা ঘাটলাম! বিরক্ত হয়ে প্রবালের একটা স্তপের ওপাশে ঝিনুকটা ছুঁড়ে মারল মুসা। অন্য পাশে গিয়ে শক্ত কিছুতে লাগার বদলে লাগল নরম কিছুতে, বিচিত্র একটা শব্দ শোনা গেল। লাফ দিয়ে উঠে স্কুপের কাছে দৌড়ে এল মুসা। আবিষ্কার করল রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশনকে। মুখ থেকে ঝিনুকের রস আর মাংস মুছছে লোকটা।