- বইয়ের নামঃ খোঁড়া গোয়েন্দা
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
খোঁড়া গোয়েন্দা
১
ইস, কি বৃষ্টিরে বাবা! বলল, রেনকোট পরা মহিলা।
এক ঝলক ঝড়ো হাওয়া হয়ে গেল, উইলশায়ার বুলভারের ওপর দিয়ে। টান দিয়ে কেড়ে নিতে চাইল মহিলার ছাতা, পারল না। কিন্তু পুরোপুরি উল্টে গেল ছাতাটা, মট মট করে ভাঙল তিনচারটা শিকের জোড়া। ধেয়ে গেল বাতাস, ঝাপটা মেরে বৃষ্টি দিয়ে ভিজিয়ে দিল জানালার কাচ।
বাস স্টপ-এ দাঁড়ানো রবিনের মনে হল, ছাতাটার জন্যে চিৎকার করে কাঁদরে মহিলা। চেয়ে আছে দোমড়ানো কাপড়ের দিকে। রবিনের দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল, যেন সব দোষ তার। তারপর, হঠাৎ হাসল মহিলা। আক্কেল হয়েছে আমার। ময়লা ফেলার ড্রামে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাতিল ছাতাটা। ক্যালিফোর্নিয়ার বৃষ্টি কেমন জানি না আমি? কেন বেরোলাম? বাস স্টপ লেখা সাইনবোর্ডের পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল সে।
ভেজা ঠাণ্ডা কাঁপুনি তুলল শরীরে, কাঁধ বাঁকা করে ফেলল রবিন। এপ্রিলে এরকম বৃষ্টি আর দেখেনি কখনও। ঈস্টার মানডের দিন, সন্ধ্যা প্রায় ছটা বাজে। ঠাণ্ডা তো আছেই, ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে অসময়েই অন্ধকার হয়ে এসেছে। সান্তা মনিকায় যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল সে, মা পাঠিয়েছেন একটা ফ্যাব্রিক স্টোর থেকে পোশাকের নতুন ডিজাইন আনার জন্যে। স্কুল ছুটি। এরকম আবহাওয়া থাকলে মাঠে মারা যাবে ছুটিটা। বাসের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
ওই দেখ, আসছে মানুষটা, মহিলা বলল। আহারে, চোখে দেখে না।
পথের দিকে তাকাল রবিন। বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে কানে এল লোকটার লাঠি ঠোকার ঠক ঠক। আরেক হাতে মগু, তাতে পয়সা।
বেচারা! আফসোস করল মহিলা। অন্ধ হওয়ার যে কি জ্বালা। প্রায়ই দেখি। কদিন হল এসেছে। রোজ ভাবি, কিছু পয়সা দেব।
পার্স খুলে ভেতরে হাতড়াতে শুরু করল, মহিলা। কাছে এল লোকটা। রবিন দেখল, পাতলা শরীর তার, সামান্য বাঁকা হয়ে হাঁটে। কানের কাছে তুলে দিয়েছে কোটের কলার। ভুরুর ওপর টেনে দিয়েছে কাপড়ের টুপি। চোখে কাল চশমা। উইন্ডব্রেকারের বুকের কাছে মলাটে লেখা রয়েছেঃ অন্ধকে দয়া করুন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন। ভিজে যাতে লেখাটা নষ্ট না হয় সেজন্যে মলাটটা মুড়ে রেখেছে প্লাস্টিক দিয়ে।
ইস, কি জঘন্য আবহাওয়া, মহিলা বলল। রাতও হয়ে এল। উঠে দাঁড়িয়ে হাতের মুদ্রাটা ফেলে দিল অন্ধের মগে।
গলা থেকে বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল লোকটার। লাঠি ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করছে কোথায় কি আছে। বেঞ্চটা কোথায়, আন্দাজ করে নিয়ে বসে পড়ল।
রবিন আর মহিলা দুজনেই এক মুহূর্ত দেখল লোকটাকে। তারপর ফিরল রাস্তার ওপাশে ব্যাংকের আলোকিত জানালার দিকে।
ঝাড়ু দেয়ার পর মোছার কাজ সবে শেষ করেছে ব্যাংকের ঝাড়ুদার। চকচক করছে সব কাউন্টার। চেয়ারগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে জায়গামত। ঝাড়ুদার মোট দুজন। একজনের গায়ে ওভারঅল, লম্বা এলোমেলো ধূসর চুল। সে পুরুষ। আরেকজন মহিলা, সে বেঁটে, মোটা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ওখান থেকে লবি ধরে অফিস বিল্ডিঙে যাওয়া যায়।
হাতে চাবির গোছা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংকের পেছন দিক থেকে এল সিকিউরিটি ম্যান। ব্যাংকের দরজার কাচ লাগানো পাল্লা খুলে দিল, ঝাড়ুদারদের বেরোনোর জন্যে। দুচারটা কথা বলল ওদের সঙ্গে।
লবি পেরিয়ে গিয়ে এলিভেটরে ঢুকল দুই ঝাড়ুদার। আবার অন্ধের দিকে ফিরল রবিন। টুপির নিচ দিয়ে বেরিয়ে আছে ধূসর চুল। গালে অযত্নে বড় হওয়া দাড়ি। চওড়া কুৎসিত একটা কাটা দাগ গালের ওপর থেকে ঢুকে গেছে দাড়ির ভেতর। বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেছিল নিশ্চয়, ভাবল রবিন, আর বোধহয় তাতেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে লোকটা।
সামনে বাঁকা হয়ে উঠতে গেল লোকটা। পা বেঁধে গেল লাঠিতে। আধ-বসা অবস্থায়ই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাত হয়ে গেল একপাশে।
আরি! লাফ দিয়ে এগোল মহিলা। লোকটার হাত চেপে ধরল, যাতে পড়ে যায়। হাত থেকে মগ ছুটে গেল লোকটার। মাটিতে পড়ল। ঝনঝন করে সমস্ত পয়সা ছড়িয়ে পড়ল এদিক ওদিক।
আমার পয়সা! প্রায় কেঁদে উঠল অন্ধ।
দিচ্ছি দিচ্ছি, তুলে দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি বলল মহিলা। আপনি বসে থাকুন।
ভেজা চত্বর থেকে মুদ্রাগুলো কুড়াতে শুরু করল মহিলা। খাজ আর পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলোতে খুঁজতে গেল রবিন। ময়লা ফেলার ড্রামের কাছে মগটা গিয়ে পড়েছে, তুলে এনে তাতে মুদ্রাগুলো ফেলল মহিলা।
সব পাওয়া গেছে? ককিয়ে উঠল লোকটা, আমার সারাদিনের কামাই!
তিনটে মুদ্রা পেয়েছে রবিন, সেগুলো মগে ফেলে বলল, মনে হয় না আর আছে।
মগটা অন্ধের হাতে ধরিয়ে দিল মহিলা। হাতের তালুতে ঢেলে পয়সাগুলোয়। আঙুল বোলাতে লাগল লোকটা, সব আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। আগের মতই বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই আছে।
বাস ধরবেন? মহিলা জিজ্ঞেস করল। ওই যে, আসছে।
নাহ্। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, ম্যাডাম। আমি এই কাছেই থাকি।
রাস্তার ওপাশে তাকাল রবিন। আবার ফিরে এসেছে ঝাড়ুদার লোকটা। ব্যাংকের দরজায় খটখট করছে। হাতে চাবির গোছা নিয়ে পেছন থেকে এল গার্ড। রজা খুলে দিল। সংক্ষিপ্ত কথা হল দুজনের মাঝে। তারপর ব্যাংকে ঢুকল ঝাড়ুদার।
উঠে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চত্বর ধরে রওনা হল অন্ধ।
আহা বেচারা! জিভ দিয়ে চুকচুক করল মহিলা। কতদূর যেতে হবে কে মানে।
এই যে, শুনুন, রবিন ডাকল। এই সাহেব।
শুনল না লোকটা। লাঠি ঠুকতে ঠকতে চলেছে।, এইই! গলা চড়াল রবিন। এগিয়ে গিয়ে চত্বর থেকে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিল।
ততক্ষণে একটা সাইড স্ট্রীটের কাছে পৌঁছে গেছে লোকটা। লাঠির ডগা ঠুকে অনুমান করল কোথায় রয়েছে, তারপর নেমে গেল সাইড স্ট্রীটে। হেডলাইটের আলো পড়ল তার গায়ে। বেশ জোরে ছুটে আসছে একটা গাড়ি। স্টপ সাইন দেখে ব্রেক কষল, চাকা পিছলে গেল ভেজা পথে। প্রায় একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল রবিন আর মহিলা। আবার জোরে ব্রেক কষল কারের ড্রাইভার, কিইইচ করে আর্তনাদ করে উঠল টায়ার। পাশ কাটাতে চাইল। সরতে গিয়েও পারল না লোকটা। ধাক্কা দিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিল গাড়িটা।
থেমে গেছে গাড়ি। লাফিয়ে বেরিয়ে এল ড্রাইভার। দৌড় দিয়েছে রবিন, মহিলাও ছুটে আসছে তার পেছনে। পড়ে থাকা লোকটার ওপর একসাথে এসে ঝুঁকল তিনজনে।
হাঁটু গেড়ে পাশে বসে লোকটার হাত ধরার চেষ্টা করল ড্রাইভার।
নাআআ! চেঁচিয়ে উঠল অন্ধ। ঘুসি মারল। ঝটকা দিয়ে মুখ সরিয়ে ফেলল ড্রাইভার।
আ-আমার চশমা! রাস্তা হাতড়াচ্ছে অন্ধ।
কালো চশমাটা তুলে নিল মহিলা। ভাঙেনি। ধরিয়ে দিল অন্ধের হাতে।
চশমা পরে লাঠি খুঁজতে শুরু করল অন্ধ।
গাড়ির ড্রাইভার এক যুবক। হেডলাইটের আলোয় তার মুখের দিকে তাকাল রবিন,ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা, ভয়ে। লাঠিটা তুলে রাখল সে অন্ধের হাতের তালুতে।
লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল অন্ধ। মাথা নাড়ল, বঁকি দিল, হাঁটতে পারবে কিনা বোধহয় আন্দাজ করে নিল, এগোতে শুরু করল আবার সাইড স্ট্রীট ধরে। এখন খোঁড়াচ্ছে। পা ফেলেই গুঙিয়ে উঠছে ব্যথায়।
এই মিস্টার, শুনুন, ডাকল ড্রাইভার।
পুলিশকে ফোন করা দরকার, মহিলা বলল। লোকটা অনেক ব্যথা পেয়েছে।
চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে অন্ধ। লাঠি ঠুকছে, খোঁড়াচ্ছে, গোঙাচ্ছে, কিন্তু হাঁটছে আগের চেয়ে জোরে।
দৌড় দিল রবিন। থামতে বলছে।
একসারি দোকানের ওপাশে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল লোকটা। পিছু নিল রবিন। এত অন্ধকার, প্রায় কিছুই দেখা যায় না। সামনে হাত বাড়িয়ে যেন বাতাস হাতড়ে হাতড়ে রবিনও এগোল অনেকটা অন্ধের মতই। বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়ির পেছনের দরজার ওপরে বাল্ব জ্বলছে। তলায় একটা ময়লা ফেলার ড্রাম। মলাটের একটা বাক্স পড়ে আছে ড্রামের পাশে, ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আরেকটা রাস্তা চোখে পড়ল রবিনের। ঘুরে আরেকদিক দিয়ে গিয়ে উইলশায়ার বুলভারে উঠেছে।
কিন্তু অন্ধকে দেখতে পেল না। বাতাসে মিলিয়ে গেছে যেন।
২
অন্ধ না-ও হতে পারে, রবিন বলল। চোখে না দেখলে এত তাড়াতাড়ি পালাল কি করে?
কেউ কেউ পারে, বলল কিশোর। চোখ হারালে কানের ক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রায় চোখওয়ালা লোকের মতই চলতে পারে তখন। চোখওয়ালাদের অন্ধকারে চলতে অসুবিধে, অন্ধের সেই অসুবিধেও নেই।
পরদিন সকালে, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে আগের দিন সন্ধ্যার কথা আলোচনা করছে তিন গোয়েন্দা। বৃষ্টি শেষ। উজ্জ্বল, পরিষ্কার সকাল। যে মানিব্যাগটা কুড়িয়ে পেয়েছিল রবিন, সেটা পড়ে আছে ওঅর্কশপের ওঅর্কবেঞ্চের ওপর।
ধরে নিলাম অন্ধ নয়। তাহলেও দৌড় দেবে কেন? রবিনের প্রশ্ন। এমন ভাব দেখাল, যেন আমাদের ভয় পেয়েছে। এক মুহূর্ত ভাবল সে। সবাই বোধহয় কাল বোকামি করেছি আমরা। গলি থেকে ফিরে এসে দেখি মহিলা চলে গেছে। বাস আসতেই হয়ত উঠে পড়েছে। কারের ড্রাইভার তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকে পাইনি, একথা জানাতেই গাড়িতে উঠে চলে গেল। হাতে মানিব্যাগটা নিয়ে গাধার মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একবারও মনে হয়নি, আমার নাম, অন্ধ লোকটার নাম তাকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিল।
একে বোকামি বলা যায় না, কিশোর বলল। ওরকম জরুরি পরিস্থিতিতে অনেকেই অমন করবে।
কাজ করতে করতে রবিনের কথা শুনছে সে। হপ্তাখানেক আগে পুরানো একটা নষ্ট টেলিভিশন সেট কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা, সেটা মেরামত করছে। বাতিল পার্টসগুলো বদলে নতুন লাগাচ্ছে। কদিন ধরেই করছে কাজটা, এখন শেষবারের মত ফাইন টিউনিং করে সকেটে ঢোকাল প্লগ।
সুইচ অন করতেই মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। হুঁ, ঠিক হয়েছে মনে হয়।
হবেই, হেসে বলল মুসা। কার হাত লেগেছে দেখতে হবে না।
জবাব না দিয়ে একটা নবে মোচড় দিল গোয়েন্দা প্রধান। পুরানো যন্ত্রপাতি মেরামতের হৰি আছে কিশোরের, অসাধারণ মেধার পরিচয় দেয়। তিনটে মিনি ওয়্যারলেস সেট বানিয়েছে, যেগুলো অনেক কাজে লাগে তিন গোয়েন্দার। ওঅর্কশপের এক কোণে দাঁড়ানো ছাপার মেশিনটাও বাতিল হিসেবে কিনে আনা হয়েছিল, সারিয়ে নেয়ার পর এখন দিব্যি কাজ চলে। হেডকোয়ার্টারের ছাতে লাগানো পেরিস্কোপ সর্বদর্শন তৈরির কৃতিত্বও অনেকখানিই তার। ট্রেলারে ঢোকার গোপনপথগুলোর পরিকল্পনাও সে-ই করেছে।
মনে হচ্ছে, আবার বলল মুসা। হেডকোয়ার্টারের জন্যে একটা টিভিও হয়ে গেল আমাদের।
তাঁর কথায় বাধা দিল টেলিভিশনের ঘোষকঃ …সকালের খবর নিয়ে। উপস্থিত হচ্ছি আপনাদের সামনে।
সংবাদ-পাঠকের ছবি ফুটল পর্দায়। গুড মর্নিং জানিয়ে শুরু করল। প্রথমেই জানাল ঝড়ের খবর। প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি বিশেষ কোন ক্ষতি না করে লস অ্যাঞ্জেলেস আর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। তবু আগামী কিছুদিন আবহাওয়া অস্থির থাকবে।
…ম্যালিবুর পাহাড়ে ধস নেমেছে, বলে চলেছে সংবাদ পাঠক। কাদাপানিতে একাকার হয়ে গেছে বিগ টুজুংগা ক্যানিয়ন। ময়লা সাফ করতে ব্যস্ত এখন ওখানকার অধিবাসীরা।
এক দুঃসাহসী ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে সান্তা মনিকার খ্রিফট অ্যাণ্ড সেভিংস কোম্পানিতে। ঝাড়ুদারের ছদ্মবেশে কাল সন্ধ্যায় ব্যাংকে ঢুকে বসেছিল ডাকাত। ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ডকে বোর্ড রুমে আটকে রেখে অপেক্ষা করছিল ওরা। আজ সকালে আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে টাইম লক খুলে দেয়া হয়, কর্মীদের ঢোকার জন্যে, ব্যাংকের একজিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্ক জনসনকে ভল্ট খুলতে বাধ্য করে ওরা। নগদ প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার আর সেফ-ডিপোজিট বক্সে রাখা দামি মালামালসহ নিরাপদেই পালিয়ে গেছে ডাকাতেরা। আমাদের সাংবাদিকেরা চলে গেছে ঘটনাস্থলে। দুপুরের খবরে বিস্তারিত জানাতে পারব আশা করি।
সুইচ অফ করে দিল কিশোর।
সর্বনাশ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। দি সান্তা মনিকা খ্রিফট অ্যাণ্ড সেভিংস! ওখানেই তো ছিলাম কাল সন্ধ্যায়, অন্ধ লোকটা রাস্তা পেরোচ্ছিল… থেমে গেল সে। উত্তেজিত। কিশোর, একটা ডাকাতকে বোধহয় দেখেছি!
রবিনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে অন্য দুজন।
হ্যাঁ, দেখেছি। বাস স্টপ থেকে ব্যাংকের ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। ঝাড়ুদার দুজন বেরিয়ে গিয়ে এলিভেটরে উঠল, একজন পুরুষ, একজন মহিলা। কিছুক্ষণ পর লোকটা এসে খটখট করলে দরজা খুলে দেয় সিকিউরিটি গার্ড।
ফিরে এল? জিজ্ঞেস করল কিশোর। সেই ঝাড়ুদার লোকটাই?
মনে তো হল… সেরকমই লাগল…, সন্দেহ জাগল রবিনের চোখে। নাহ, শিওর না।…হাত থেকে মগ ফেলে দিল অন্ধ, পয়সাগুলো সব ছড়িয়ে পড়ল। আমি আর মহিলা কুড়িয়ে তুলে মগটা দিলাম লোকটার হাতে, তখন ব্যাংকের দরজায় দাঁড়াতে দেখলাম ঝাড়ুদারকে।
তারমানে অন্য লোকও হতে পারে?
কি বুদ্ধি করেছে ব্যাটারা! খাইছে! মুসা বলল। ঝাড়ুমোছা শেষ করে ওপরতলায় চলে গেল ঝাড়ুদারেরা। তখন লোকটার ছদ্মবেশে অন্য কেউ এসে দরজায় দাঁড়ালো। সিকিউরিটি ম্যান দরজা খুলে দিল। তারপর তাকেই আটকে রেখে ডাকাতেরা ব্যাংকটাকে একেবারে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলল। অ্যালার্ম বাজল না। আরামসে কাটিয়ে দিল সারাটা রাত, পরদিন সকালে কর্মচারীরা আসার, অপেক্ষায় রইল।
রবিন, ঝাড়ুদার লোকটা কোত্থেকে এসেছিল দেখেছ? কিশোর জানতে চাইল। এলিভেটর থেকে বেরিয়ে লবি দিয়ে, নাকি রাস্তা থেকে?
মাথা নাড়ল রবিন। দেখিনি। দরজায় দাঁড়ানো দেখলাম। ভেবেছি, এলিভেটর থেকে নেমেই বুঝি এসেছে। এখন মনে হচ্ছে, রাস্তা থেকেও এসে থাকতে পারে। আমার ধারণা, ঝাড়ুদারদের কেউ নয়।
চমৎকার, খুশি হল কিশোর। ভাবনার খোরাক পাওয়া গেল। ওঅর্কবেঞ্চে পড়ে থাকা মানিব্যাগটা তুলে নিল। তুমি বললে, রাস্তা ধরে এসেছিল অন্ধ লোকটা। মগটা ফেলল এমন সময়, যখন ঝাড়ুদার আসছে। ওর পয়সা কুড়াতে ব্যস্ত হলে তোমরা, অবশ্যই মাথা নুইয়ে রাখতে হয়েছে। মাটি থেকে কিছু তুলতে গেলে নোয়াতেই হবে। তোমরা পয়সা কুড়ানোয় ব্যস্ত, ডাকাতটা ঠিক সেই সময় এল। কিছু বুঝতে পারছ।
ঢোক গিলল রবিন। অন্ধও ডাকাতের দলের!
মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দেখছে কিশোর। সুন্দর। উটপাখির চামড়ায় তৈরি। নেইম্যান-মারকাস কোম্পানির জিনিস। শহরের সব চেয়ে দামি স্টোরগুলোর একটা।
এটা তো খেয়াল করিনি, রবিন বলল। আমি শুধু দেখেছি, ভিখিরি লোকটার কোন টেলিফোন আছে কিনা। যাতে ফোন করে তার ব্যাগটা ফিরিয়ে দিতে পারি। নেই।
ব্যাগটার ভেতরে কি আছে বের করতে লাগল কিশোর। একটা ক্রেডিট কার্ড, নগদ বিশ ডলার, একটা টেমপোরারি ড্রাইভিং লাইসেন্স। অন্ধ এক ভিখিরি ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে কি করে?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। ঠিক। অন্ধ নয় লোকটা। ভিখিরিও নয়।
ভিকটর সাইমন, লাইসেন্সে লেখা নামটা পড়ল কিশোর। একশো বিরাশি সাইপ্রেস ড্রাইভ ক্যানিয়ন। ম্যালিবু।
সুন্দর জায়গা, মুসা বলল। ওখানে থাকে। খুব ধনী ভিখিরি মনে হচ্ছে।
অন্ধের ঠিকানা না-ও হতে পারে এটা, বলল কিশোর। হয়ত সে পকেটমার, চুরি করেছে। কিংবা পথে-টথে পেয়েছে কোথাও। রবিন, টেলিফোন ডিরেক্টরিতে, ভিকটর সাইমনের নাম আছে?
খুঁজেছি। পাইনি।
উঠে দাঁড়াল কিলোর। ব্যাগটা নাড়তে নাড়তে বলল, এটার ব্যাপারে আগ্রহী হবে পুলিশ। হয়ত, এই ব্যাগ ফেলে যাওয়াটা তেমন কিছু নয়। অন্ধের তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যাওয়াটাও কিছু মিন করে না। আর সাইপ্রেস ক্যানিয়নও এখান থেকে দূরে নয়। পুলিশকে জানানোর আগে ওখানে গিয়ে একবার খোঁজ করা দরকার, কি বল?
নিশ্চয়ই, রবিন একমত।
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে চলল উত্তরে, ম্যালিবুর দিকে। বিখ্যাত বীচ কমিউনিটির প্রধান বাজার এলাকা পেরোল আধ ঘন্টার মধ্যেই।
সরু একটা পথ সাইপ্রেস ক্যানিয়ন ড্রাইভ, কোস্ট হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে সরে গেছে দুশো মিটার। তারপর হাইওয়ের সঙ্গে প্রায় সামান্তরালে এগিয়েছে। ওটা ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে হাইওয়ের যানবাহনের শব্দ কানে আসছে ছেলেদের। বায়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ছে সমুদ্র। ডানে পাহাড়ের ঢাল নেমে গিয়ে পথ পেরিয়ে আবার উঠেছে ওপাশে। পর্বতের চূড়ার ওপরে ঝকঝকে আকাশ ঘন নীল।
এখানে কেউ থাকে বলে তো মনে হয় না, কাদাভরা পথ ধরে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বলল রবিন। একটা বাড়িও দেখলাম না। লাইসেন্সের ঠিকানাটাও নকল না তো?
জমাট বাঁধছে রহস্য, গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল মুসা। অন্ধের কি দরকার ড্রাইভিং লাইসেন্স? তা-ও ভিখিরি। তার পরেও আবার নকল।
হঠাৎ ঝুপ করে যেন নিচে পড়ে গেছে পথটা। জায়গাটাকে দেখে মনে হয় পাহাড়কে আঙুল দিয়ে টিপে ওখানটায় বসিয়ে দিয়েছে কোন মহাদানব। সরু একটা নহর বইছে ওখানে। খাদের মত জায়গাটার ওপাশ থেকে আবার উঠে গেছে পথ। ওখানে উঠে থামল ছেলেরা। সামনে একটা গিরিখাত। শুকনো মৌসুমে। বোধহয় শুকনোই থাকে, কিন্তু এখন বাদামী ঘোলাটে পানির তীব্র স্রোত বইছে। পথের বাঁয়ে গিরিখাতের একেবারে ধার ঘেঁষে পুরানো একটা গোলাবাড়ি জাতীয় বাড়ি, দোতলায় বড় বড় জানালা। ছাঁইচে লাগানো একসারির টিউব লাইট। এক প্রান্তে বড় করে সাইনবোর্ড লেখাঃ নুমেরি ইন।
নুমেরির সরাইখানা, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
রেস্টুরেন্ট মনে হচ্ছে? রবিন বলল।
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে লাইসেন্সে লেখা ঠিকানাটা দেখল আবার কিশোর। একশো বিরাশি নম্বর। হ্যাঁ, ঠিকই আছে। ওই যে, নতুন মেইলবক্সটার নম্বর লেখা রয়েছে।
পেছনে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। নিচু জায়গায় জমে থাকা পানি ছিটিয়ে এল একটা লাল স্পোর্টস কার? গাড়ির চালক হালকা পাতলা, ধূসর চুল, বিষণ্ণ চেহারা, ছেলেদেরকে যেন চোখেই পড়ল না। মুমেরিজ ইন-এর কঁচা চত্বরে কাদা জমে আছে। সেখানে গিয়ে থামল গাড়ি। নেমে একটা লাঠি বের করল চালক। তাতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠল বাড়ির সিঁড়িতে। প্রায় ভাঙা একটা স্ক্রীন ডোর টান দিয়ে খুলে চলে গেল ওপাশে, পেছনে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।
খোঁড়া! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। কাল রাতে খোঁড়াতে দেখেছ না লোকটাকে?
অ্যাক্সিডেন্টের পর। গাড়ির ধাক্কায় পায়ে আঘাত লেগেছিল হয়ত। এই লোকটা কি ওই লোকটার মত? কিশোর জিজ্ঞেস করল। দেখতে?
শ্রাগ করল রবিন। সাইজটাইজ তো একই রকম। বয়েসও এক। একজনের সঙ্গে আরেকজনের এরকম মিল থাকতেই পারে।
বেশ। আমি যাচ্ছি।
গিয়ে কি করবে? মুসা বলল। হ্যামবার্গার কিনবে?
পাওয়া গেলে। কিংবা ঠিকানা জিজ্ঞেস করব। আসলে জানার চেষ্টা করব লোকটা কে? রবিন, লুকিয়ে পড়। তোমাকে চিনে ফেলতে পারে। গণ্ডগোল করতে পারে।
আমিও থাকি, মুসা বলল। গণ্ডগোল করে যারা, তাদের পছন্দ করি না। আমি।
ভয় পাও? হাসল রবিন।
না। বুড়ো হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু আমার কাম্য।
বাহ্, ভাল কথা শিখেছ আজকাল, কিশোরও হাসল। রাস্তার ধারে দুই বন্ধুকে রেখে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চলে এল চত্বরে। দেয়ালে ওটা ঠেস দিয়ে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল বারান্দায়। ছোট বারান্দা পেরিয়ে এসে দাঁড়াল স্ক্রীন ডোরের সামনে। হাতল ধরে টানতেই খুলে গেল পাল্লা।
ভেতরে আবছা অন্ধকার। পালিশ করা শক্ত কাঠের মেঝে, গাঢ় রঙের কাঠের প্যানেলিং। নাক বরাবর সামনে চওড়া দরজার ওপাশে বিশাল একটা ঘর, শূন্য। ওটার সামনের দেয়াল পুরোটাই জানালা। বাইরের গাছপালা, রোদে আলোকিত সাগর, সব চোখে পড়ে। কিশোর অনুমান করল, একসময় ওটা রেস্টুরেন্টের মেইন ডাইনিং রুম ছিল। বোঝা যায়, রেস্টুরেন্ট আর নয় এখন বাড়িটা।
প্রশস্ত একটা প্যাসেজওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে সে, যেটাকে বড় ঘরটার লবি বলা চলে। লবির প্রান্তে ছড়ানো একটা জায়গায় অবহেলায় পড়ে রয়েছে কফি বানানোর সরঞ্জাম, কাঠের কাউন্টার, টুল, বুদ, ধুলোয় ঢাকা। কফি শপ ছিল ওটা এককালে। ডানের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা দরজা। নানারকম বাক্স স্তূপ হয়ে আছে কফি শপ আর লবিতে। বড় ঘরটার কাঠের মেঝেতে রয়েছে আরও কিছু বাক্স। একটা বাক্স খোলা।
ধীরে ধীরে এগোল কিশোর। ডাক দিতে যাবে এই সময় কানে এল ক্রেডল থেকে রিসিভার ওঠানোর শব্দ। স্থির দাঁড়িয়ে কান পাতল। বড় ঘরটায় কেউ রয়েছে, দেখতে পাচ্ছে না সে, টেলিফোন করছে।
কথা শোনা গেল, ভিকটর বলছি।
এক মুহূর্ত নীরবতার পর আবার কথা, হ্যাঁ, জানি, দামি। দাম বেশি তো হবেই, এটা একটা কথা হল নাকি। খরচ করতে রাজি আছি আমি। ঠিক এই সময় কিশোরের পিঠে শক্ত কিছু চেপে ধরা হল।
স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে নড়ো না, পেছন থেকে ভাঙা ইংরেজিতে বলল কেউ। দুটুকরো করে ফেলব।
৩
মাথার ওপর হাত তুলল কিশোর। ঘাড়ের কাছে শিরশির করছে। আমি…আমি…।
চুপ কর, শান্তকণ্ঠে আদেশ হল।
কাঠের মেঝেতে পায়ের শব্দ। চওড়া দরজায় দেখা দিলেন ধূসর চুল মানুষটা। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা সামান্য কাত করে তাকালেন কিশোরের দিকে। ভুরু কোঁচকানো। কি হয়েছে, কিম? ছেলেটা কে? …
ভ্রূকুটি করল কিশোর। লোকটাকে কোথায় দেখেছে। কণ্ঠস্বর, ওভাবে মাথা কাত করে কথা বলার ভঙ্গি…কোথায় দেখেছে? কবে?
চুরি করে ঢুকেছে এখানে, জবাব দিল কিম। এখানে দাঁড়িয়ে আড়িপেতে, আপনার কথা শুনছিল।
আমি শুধু ঠিকানা জানতে এসেছি, নিরীহ কণ্ঠে বলল কিশোর। সাইনবোর্ড দেখলাম, মুমেরিজ ইন। রেস্টুরেন্ট, তাই না? চুরি করে ঢুকিনি। দরজা খোলাই ছিল।
ছিল, হাসলেন তিনি। লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন কাছে। রেস্টুরেন্ট ছিল আগে। তা দরজা খোলা ছিল, না?
রক্তিম গাল তার। চোখা পাতলা নাক। রোদে পোড়া মুখের চামড়া। কালচেধূসর ঘন ভুরুর নিচে চোখ দুটো নীল। রিল্যাক্স, ইয়াং ফ্রেণ্ড, ভয়ের কিছু নেই। ইচ্ছে করলেও কিম তোমাকে গুলি করতে পারবে না।
সাবধানে হাত নামাল কিশোর। ফিরে তাকাল কিমের দিকে।
তুমি মনে কুরেছিলে পিস্তল ঠেকিয়েছি, নিজের চালাকিতে খুব সন্তুষ্ট কিম। বাড়ি এশিয়ায়, চেহারা দেখেই বোঝা যায়। কিশোরের সমান লম্বা, স্বাস্থ্যও প্রায় তার মতই, মুখের চামড়া মসৃণ। হাতে একটা কাঠের চামচ, সেটাই ঠেকিয়ে রেখেছে কিশোরের পিঠে। দেখলে তো, পিস্তল নয়। টেলিভিশন দেখে শিখেছি।
ও নিসান জাং কিম, ভিয়েতনামে বাড়ি। পরিচয় দিলেন ধূসর-চুল দ্রলোক। অল্প দিন হল এসেছে এদেশে। সুযোগ পেলেই টেলিভিশনের সামনে। গিয়ে বসে, ইংরেজি শেখার চেষ্টা করে। এখন তো দেখি আরও অনেক কিছুই। শিখছে।
বাউ করল ভিয়েতনামী। ওপর তলায় আটকা পড়লে কি করতে হবে জান? কিশোরকে বলল সে। বিছানার চাদর ছিঁড়ে পাকিয়েলড়ি বানাতে হবে। সেটা বেয়ে নেমে গেলেই হল। আর যদি বিছানা না-ই পাও, নাগালের মধ্যে পাইপ পেয়েই যাবে।
আরেকবার বাউ করে কফি শপের দিকে চলে গেল কিম। কৌতূহলী চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
কি যেন শুধু জানতে এসেছিলে? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
আঁ, ও! ও, হ্যাঁ…এদিকে একটা নদী আছে। নদীর ওপারেও কি আছে রাস্তাটা? নদী পেরোনোর ব্যবস্থা আছে?
রাস্তা এপারেই শেষ। আর নদী পেলে কোথায়, ওটা তো গিরিখাত। এখন পেরোনোর চেষ্টাও কর না, নির্ঘাত মরবে। যা স্রোত।
অ, আনমনে বলল কিশোর, কথা শুনছে বলে মনে হল না। লবির কোণে রাখা একটা বাক্সের দিকে চেয়ে আছে। ওটার ওপরে ছটা বই, একই বইয়ের ছটা কপি। কালো মলাটের ওপর উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা নাম। কভারের ছবি-নীল পায়রার বুকে ছুরি বিদ্ধ। বইটার নাম বু পিজিয়ন।
ভিকটর সাইমন! হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। এগিয়ে গিয়ে একটা বই তুলে পেছনটা উল্টে দেখল। পেছনের কভারে একটা ফটোগ্রাফ।
এ-তো আপনার ছবি! বলল সে। আপনিই ভিকটর সাইমন। টেলিভিশনে দেখেছি আপনাকে।
দেখতে পার। কয়েকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছি।
ব্লু পিজিয়ন পড়েছি আমি, নিজের কানেই অদ্ভুত লাগছে কিশোরের কণ্ঠস্বর। ভীষণ উত্তেজিত। সাংঘাতিক বই! দারুণ লেখা! কিলারস গেমও পড়েছি। মিস্টার সাইমন, আপনার তো ব্যাংক ডাকাতির দরকার পড়ে না!
করেছি ভাবছ নাকি! হাসলেন সাইমন। নদীর খোঁজ নিতে এখানে আসনি তুমি। কেন এসেছ?
লাল হল কিশোরর গাল। আমি…আমি…সরি, মিস্টার সাইমন, মিথ্যে কথা বলেছি। আপনার মানিব্যাগ হারানো গেছে?
তাকিয়ে আছেন সাইমন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালেন। চাপড় দিয়ে দেখলেন অন্যান্য পকেটগুলো। আরে! নেই তো। তুমি পেয়েছ?
রবিন পেয়েছে, আমার বন্ধু! সংক্ষেপে সব জানাল কিশোর।
আশ্চর্য! একেবারে ডেভিস ক্রিস্টোফারের সিনেমার মত। …কি ব্যাপার? হাসছ যে?
উনি আমাদের বন্ধু, স্যার। আমাদের কেসের কাহিনী লেখে রবিন, গল্প ভাল হলে সেটা দিয়ে ছবি করে ফেলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।
কি ধরনের কেস? আর তোমার বন্ধু রনি এখন কোথায়?
রাস্তায়। নিয়ে আসছি। ছুটে ঘর থেকে চত্বরে বেরোল কিশোর। পার্কিং লটে এসে হাত নেড়ে ডাকল, এই, তোমরা এস। কাছে এল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল রবিন। মিস্টার ভিকটর সাইমন। জান তিনি কে? পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। মাথা নাড়ল মুসা। জানি না।
হাসল কিশোর। বু পিজিয়নের লেখক। কিলারস গেম, শক ট্রিটমেন্টও তিনিই লিখেছেন। টিভিতে দেখাল না তাঁর সাক্ষাৎকার? একটা বই সিনেমাও হতে, যাচ্ছে, কিলারস গেম।
ও, হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা। মনে পড়েছে। কিলারস গেম-এর কথা সেদিন বাবা আলোচনা করছিল। ইনিই ভিকটর সাইমন?
হ্যাঁ, কণ্ঠের উত্তেজনা যায়নি এখনও কিশোরের। নিউ ইয়র্ক সিটিতে গোয়েন্দা ছিলেন তিনি অনেকদিন, রিপোর্টেও থেকেছেন। প্লেন চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন। একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। পা সারার জন্যে ঘরে বসে থাকতে হয় অনেকদিন। তখনই ঠিক করলেন, বই লিখবেন। নিজের জীবনের
অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেও ফেললেন শক ট্রিটমেন্ট। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেস্টসেলার হয়ে গেল বইটা। এই সেই ভিকটর সাইমন, গোয়েন্দা-কাম-লেখক। চল, চল, দেখা করবে না তার সঙ্গে? রবিন, মানিব্যাগটা আছে তো?
তোমাকেই তো দিয়েছিলাম, রবিন বলল। ভুলে গেছ?
আঁ, ও তাই তো, নিজের পকেট চাপড়াল কিশোর। আছে। চল।
লেখকের সঙ্গে দুই সহকারীর পরিচয় করিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। ওদেরকে বড় জানালাওয়ালা ঘরটায় নিয়ে এলেন সাইমন। কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। একটা টেবিল ঘিরে রাখা হয়েছে চেয়ারগুলো। টেবিলটার ওপরের অংশ কাচের তৈরি। টেবিল, চেয়ার, টেলিফোনটা ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র নেই ঘরে।
মাত্র গত হপ্তায় এসে উঠেছি, জানালেন সাইমন। আমি আর কিম।
এখানে থাকবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে লবিতে গিয়ে কিমকে ডাকলেন তিনি।
কফির সরঞ্জাম নিয়ে এল ভিয়েতনামী। তাকে জিজ্ঞেস করলেন লেখক, ছেলেদের জন্যে কিছু আছে ফ্রিজে?
লেমোনেড। একেবারে খাঁটি জিনিস, নেচারাল ফ্লেভার।
হাসল কিশোর। নেচারাল ফ্লেভার শব্দটাও নিশ্চয় টেলিভিশন থেকে শিখেছে কিম, লেমোনেডের বিজ্ঞাপন দেখে।
লেমোনেড চলবে? ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন সাইমন। মাথা ঝাঁকাল তিনজনে।
রান্নাঘরে চলে গেল কিম। বাড়ির একেবারে দূরতম কোণে রান্নাঘরটা, কফি শপ ছাড়িয়ে ওপাশে।
বিজ্ঞাপনগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে ও, হেসে বললেন লেখক। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনাগুলো শোনে। ইস্, খাবার যা এনে হাজির করে না, ভয়ঙ্কর।
পুরানো রেস্টুরেন্টের কথা তুললেন এরপর সাইমন। কি করে এখানে এলেন, এটাকে মেরামত করে কি করবেন, এসব। বসবাসের যোগ্য সুন্দর একটা বাড়ি বানানোর ইচ্ছে আছে তাঁর। বললেন, কফি শপটাকে করব ডাইনিং রুম। লবির একধারে একটা স্টোর আছে, ওটাকে কিমের বেডরুম বানানো হবে। আর ওর বাথরুমটা করব ওই যে ওই ওদিকে, সিঁড়ির নিচে।
লবির দেয়াল ঘেঁষে উঠে যাওয়া সিঁড়িটা দেখল ছেলেরা। সিঁড়ির মাথায় একটা গ্যালারি, অনেক বড়। ওখান থেকে এ ঘর দেখা যায়, যেখানে ওরা বসেছে। ঘরটার ছাত অনেক ওপরে, প্রায় দোতলার সমান উচুতে। এই ঘরটাই বাড়ির প্রায় অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের নিচের তলায় রয়েছে লবি, স্টোররুম, কফি শপ, রান্নাঘর। আর ওগুলোর ওপরে রয়েছে দোতলার অন্যান্য ঘর, সবগুলোর দরজা দিয়েই গ্যালারিতে আসা যায়।
অনেক কিছুই ভেঙেচুরে গেছে, সাইমন বললেন। তবে কাঠামোটা অত্যন্ত মজবুত, আর্কিটেক্ট আর একজন বিল্ডিং কন্ট্রাকটরকে দেখিয়ে তবেই কিনেছি। সাগরের ধারে এরকম জায়গায় এত বড় বাড়ি কিনতে খরচ কত পড়েছে কল্পনা করতে পার?
নিশ্চয় অনেক, কিশোর বলল।
মাথা ঝাঁকালেন লেখক। আরও অনেক খরচ আছে। তবে মেরামত হয়ে গেলে দেখার মত বাড়ি হবে। এত বড়, উঁচু একটা ঘর পেয়েছি। সাগর দেখা যায়। ছাতে একটা ফুটোও নেই। থাকলে এরকম জায়গায়ই থাকা উচিত। অথচ তেইশটা বছর কি এক খুপরিতে যে কাটিয়েছি, ব্রুকলিনের এক অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে। বৃষ্টি হলেই ছাত দিয়ে পানি পড়ত। সব সময় হাতের কাছে কয়েকটা বালতি রাখতে হত, বৃষ্টি নামলেই ফুটোর তলায় বসানোর জন্যে।
হাসলেন সাইমন। কেউ কেউ যে বলে ধনী হওয়ার চেয়ে গরিব থাকা ভাল, ওগুলো গাধা। আরে ব্যাটা পয়সাই যদি না থাকল আরামে থাকবি কি করে?
লেমোনেড নিয়ে হাজির হল কিম। মানিব্যাগটা বের করে কাচের সুন্দর টেবিলটায় রাখল কিশোর।
তুলে নিলেন সাইমন। অন্ধ ভিখিরি ফেলে গেছে, না? টাকার ঠেকা নেই ওর, মনে হচ্ছে। একটা পয়সাও খরচ করেনি।
কিন্তু সে ভিক্ষে করছিল, রবিন বলল। হাতে টিনের মগ। তাতে পয়সা।
চিন্তিত দেখাল তাঁকে। পেল কি করে ব্যাগটা? যদি অন্ধই হবে…।
ঠিক বলেছেন, স্যার, কিশোর বলল। চোখে দেখে না, রাস্তায় পড়া থাকলে দেখল কি করে? তবে, ব্যাগটার ওপর লাঠি লাগলে বোঝার কথা…এটা কোথায় রেখেছিলেন?
পেশাদারি গন্ধ পাচ্ছি তোমার কথায়? এখুনি নোটবুক আর পেন্সিল বের করবে না তো? ও, কেসের কথা বললে না তখন? কি কেস? গোয়েন্দাগিরির তালিম নিচ্ছ নাকি?
তালিম নয়, গোয়েন্দাই আমরা, বলতে বলতে পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল কিশোর।
কার্ডটা দেখে আনমনে মাথা দোলালেন সাইমন। ইউ। ভাল।
সামনে ঝুঁকল রবিন। আমরা সন্দেহ করছি, ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে অন্ধ ভিখিরির সম্পর্ক আছে। কাল কি সান্তা মনিকায় গিয়েছিলেন আপনি? ওখানেই কোথাও মানিব্যাগটা ফেলেছেন? নাকি আপনার পকেট মেরে দিয়েছে?
না, চেয়ারে হেলান দিলেন লেখক। কাল সকালেও এটা আমার পকেটে ছিল। মনে আছে। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলাম, তখন দেখেছি। তারপর আর এটার খোঁজ করিনি। তোমরা মনে করালে। মনে হয় নিকারোদের ওখানেই কোথাও ফেলেছি। কাল ওখানে ছাড়া আর কোথাও যাইনি। কি করে পড়ল জানি না। ভিড়ের মধ্যে যাইনি, কারও সঙ্গে ধাক্কাও লাগেনি, পকেটমারা গেল কখন? কোন অন্ধকেও দেখিনি, তাহলে মনে থাকত।
নিকারো? মুসা বলল। উপকূলের ওদিকে না? শখের মাছশিকারিদের নৌকা ভাড়া দেয় যারা? নিকারোজ অ্যাণ্ড কোং?
মাথা ঝোঁকালেন সাইমন। আমার স্পীডবোট ওখানেই রাখি। এখান থেকে সর চেয়ে কাছের ম্যারিনা ওটাই। বোট নিয়ে বেরোনোর দরকার হলে ওদের ওখানে চলে যাই। মিসেস নিকারোর ওখানে চাকরি করে দুটো ছেলে। নৌকায় করে আমাকে বয়ার কাছে নিয়ে যায়, ওখানেই আমার বোট বাঁধা থাকে। কাল বোটে করে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে এসেছি। পকেট থেকে ব্যাগটা কোনভাবে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। পার্কিং লটে, কিংবা ডকের কাছে।
এবং অন্ধ সেটা কুড়িয়ে নিয়েছে, মুসা বলল।
ওটা নিয়ে তারপর চলে গেছে সান্তা মনিকায়, রবিন বলল। ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হয়েছে বাস স্টপে, ঝাড়ুদারের ছদ্মবেশে যখন ডাকাত ঢুকেছে ব্যাংকে। মগ ফেলাটা তার একটা ছুতোই, যাতে আমরা পয়সা কুড়ানোয় ব্যস্ত থাকি, ব্যাংকের দিকে চোখ না দিতে পারি।
না-ও হতে পারে, বললেন সাইমন। ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল মগটা, হাত থেকে সত্যি হয়ত ছুটে গিয়েছিল, অভিনয় নয়। মপ ফেলার মধ্যে তেমন কোন গুরুত্ব দেখি না।
চলে যাওয়ার সময় ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল, কিশোর বলল। রবিন সেটা পেয়ে তাকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, এই সময় একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল লোকটাকে।
অস্বাভাবিক নয়। অন্যের জিনিস তার কাছে ছিল, সেটা পড়ল আরেকজনের কাছে। যদি তাকে চোর মনে করে বসে? যদি পুলিশ এসে ধরে, জিজ্ঞেস করে কি করে পেল সে? ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। তাড়াহুড়ো করে ছুটে চলে যাচ্ছিল হয়ত সে-কারণেই। মগ পড়া, মানিব্যাগ পড়া, পালিয়ে যাওয়া, কোনটাই প্রমাণ করে না সে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এসব কথা পুলিশকে গিয়ে জানাচ্ছ না কেন? ইচ্ছে করলে আমার নামও বলতে পার ওদের। পুলিশকে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হব।
যাব, হতাশ মনে হল কিশোরকে। আপনি ঠিকই বলেছেন, অন্ধ ভিখিরির ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে। আমার দুঃখ, কেসটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল।
তাই? শোন, কষ্ট করে ব্যাগটা নিয়ে আসায় খুব খুশি হয়েছি।
না না, কষ্ট আর কি? তাড়াতাড়ি বলল মুসা।
লেখককে ব্যাগ থেকে নোট বের করতে দেখে হাত নাড়ল রবিন, না না, আমাদেরকে কিছু দেবেন না, প্লীজ।
তাহলে কি পুরস্কার দেয়া যায়? জিজ্ঞেস করলেন সাইমন। আমার বোটে চড়ে হাওয়া খেতে যাবে? পরের বার যখন যাব আমি?
খালি জানাবেন, আনন্দে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। আধ ঘন্টার মধ্যে হাজির হয়ে যাব।
বেশ, তোমাদের ফোন নাম্বার দাও।
বাড়ির ফোন নাম্বার জানাল মুসা। রবিন আর কিশোরও জানাল যার যারটা।
বারান্দায় ওদেরকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন গোয়েন্দা-কাম-লেখক। ওরা সাইকেলে উঠে রওনা হওয়ার পরও দাঁড়িয়ে রইলেন।
দারুণ লোক, মুসা বলল।
হ্যাঁ, একমত হল কিশোর। আমাদের দেখে খুব খুশি হয়েছেন। লোকটাকে নিঃসঙ্গ মনে হল। ক্যালিফোর্নিয়ায় কেমন লাগছে কে জানে, নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছেন
তো?
মুখ খুলতে যাচ্ছিল রবিন, একটা গাড়ি দেখে থেমে গেল। বাদামি রঙের একটা। সেডান। ওদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে মিস্টার সাইমনের বাড়ির সামনের চত্বর থামল। গাড়ি থেকে নেমে বারান্দায় উঠল একজন বয়স্ক লোক, সাইমন তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
কি কথা হল, শোনা গেল না।
দুজনে ঢুকে গেলেন ভেতরে।
কিশোর, রবিন বলল। কেসটা বোধহয় শেষ হয়নি।
কেন? মুসার প্রশ্ন।
সিকিউরিটি ম্যান। যে ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে ওটার সিকিউরিটি গার্ড, ওকেই দেখেছি কাল সন্ধ্যায়। এই লোক মিস্টার সাইমনের বাড়িতে কেন?
৪
বুঝতে পারছি না! কিশোর বলল। ভিকটর সাইমনের টাকার অভাব হবার কথা নয়। তাঁর সব বই বেস্টসেলার।
কিন্তু ব্যাংক ডাকাতিতে যদি জড়িতই না হবেন, প্রশ্ন তুলল রবিন।
সিকিউরিটি গার্ড এখানে কেন?
জানি না।
বিকেলের শুরু। হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। ওরা সাইপ্রেস ক্যানিয়ন ড্রাইভে থাকতে থাকতেই আবার ফিরে গেছে সিকিউরিটি ম্যান। সেই কথাই আলোচনা করছে এখন।
কাল রাতে অন্ধ লোকটা খুঁড়িয়েছে, রবিন বলল। মিস্টার সাইমনও খোঁড়ান।
অন্ধ লোকটা কি অ্যাক্সিডেন্টের আগে খুঁড়িয়েছিল? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
খেয়াল করিনি।
খোঁড়ানোর ব্যাপারটা হয়ত কাকতালীয়, বলল মুসা। মানিব্যাগ পাওয়াটাও। মিস্টার সাইমনের বাড়িতে গার্ডের যাওয়াটাকেও যদি সেরকম কিছু ধরা যায়, অনেকগুলো কাকতালীয় ব্যাপার হয়ে গেল না?
পুলিশের কাছে যাচ্ছি না কেন আমরা? রবিন বলল। মিস্টার সাইমনও তাই বললেন। ডাকাতিতে জড়িত থাকলে বলতেন কি?
অনেক অপরাধী বলে ওরকম, বলল মুসা। নিজেকে নির্দোষ বোঝানোর জন্যে।
পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না, কিশোর বলল। অন্তত মিস্টার সাইমনের ব্যাপারে। আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তার যে সুনাম, এই জিনিস নষ্ট করতে চাইবে না কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক। তবে মনে হচ্ছে এই ডাকাতির সঙ্গে কিছু একটা যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। মিস্টার রোজার হয়ত আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
মিস্টার রোজার? চিনতে পারল না রবিন।
ডেস্কে রাখা একটা খবরের কাগজ টেনে নিল কিশোর। সান্তা মনিকা ইভনিং আউটলুকের একটা সংখ্যা। সেদিনই বেরিয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে নাস্তা খেতে থেমেছিল তিন গোয়েন্দা, তখন পত্রিকাটা কিনেছে সে।
ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ডের নাম ড্যানি রোজার, জানাল কিশোর। এই পত্রিকায় লিখেছে। টেলিফোন ডিরেক্টরির জন্যে হাত বাড়াল সে। অল্পক্ষণেই পেয়ে গেল যা খুঁজছে।
ম। একজন ড্যানি রোজারের নাম আছে। তিনশ বারো ডলফিন কোর্টে থাকে। সৈকতের ধারে।
কিশোওর! বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল। আরে এই কিশোর, কোথায়
তুই?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। চাচী। সেই সকালের পর থেকে আর আমাকে দেখেনি তো। অস্থির। কত খাবার আর কাজ জমিয়ে রেখেছে কে জানে!
আমার মা-ও নিশ্চয় রেগে ভোম, বলল মুসা। বহুত কাজ ছিল। ফেলে রেখে পালিয়েছি। গেলেই এখন ঘর মোছাবে কিংবা বাগানের ঘাস কাটাবে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, কিশোর বলল। আমরা মিস্টার রোজারের সঙ্গে দেখা করব। সম্ভব হলে আজ বিকেলেই। তোমরা আসতে পারবে? রকি বীচ মার্কেটে, সন্ধ্যা সাতটায়। ওখান থেকে যাব তার বাড়িতে।
পারব মনে হয়, জবাব দিল মুসা।
আমিও পারব, হেসে বলল রবিন। কাল তো আর ইস্কুল নেই যে পড়া লাগবে। সন্ধ্যায় দেখা হবে।
ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
বিকেলটা স্যালভিজ ইয়ার্ডে কাজ করতে হল কিশোরকে। সকাল সকাল রাতের খাওয়া সেরে সাইকেল নিয়ে বেরোল।
সাতটার পাঁচ মিনিট আগে এল মুসা আর রবিন। সান্তা মনিকায় চলল তিনজনে।
পথের শেষ মাথায় ছোট ছোট কয়েকটা বাড়ির একধারে খুঁজে পাওয়া গেল তিনশ বারো নাম্বার। রাস্তার নাম ডলফিন কোর্ট। ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি সেডান, সকালে যেটা দেখেছিল ছেলেরা। বাড়ির সামনের দিকে অন্ধকার, পেছনের একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। সাইকেল রেখে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিল ওরা। ওটা রান্নাঘর।
লোকটা আছে। একা। জানালার ধারে বসে আছে। সামনে একগাদা খবরের কাগজ। হাতের কাছে টেলিফোন। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেবিলক্লথের দিকে। সকালের চেয়ে বয়স্ক লাগছে এখন তাকে। চুল পাতলা। চোখের নিচে কালি।
চুপচাপ দেখল ছেলেরা। তারপর ঘুরে, সামনের দরজায় বেল বাজাতে চলল কিশোর।
ড্রাইওয়েতে পথ রোধ করল পিস্তলধারী এক লোক। কি চাই?
তাদের দিকে নিশানা করেনি পিস্তল, শান্ত, সংযত কণ্ঠ। শঙ্কিত হল কিশোর। লোকটার ঠাণ্ডা ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝল, বিপজ্জনক লোক। চোখে সানগ্লাস।
হাত নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, চুপ! বলে তাকে থামিয়ে দিল লোকটা।
জানালা খুলে গেলু। মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল রোজার, রক, কে?
পিস্তল নেড়ে রক বলল, এই ছেলেগুলো চুরি করে জানালা দিয়ে দেখছিল।
হুঁ? অবাক মনে হল রোজারকে। কিছুটা কৌতূহলী। আবার বলল,? এবার সতর্ক।
ঘরে ঢোক, আদেশ দিল পিস্তলধারী। ওদিকে। হ্যাঁ, হাঁট।
আবার রান্নাঘরের পেছনে নিয়ে আসা হল ওদেরকে। পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকানো হল।
এসব কি? রোজার জিজ্ঞেস করল। সকালে তিনটে ছেলের কথা বলেছিলেন মিস্টার সাইমন। তোমরাই দেখা করতে গিয়েছিলে, না? তোমাদেরকে পথেও দেখেছি আমি।
হ্যাঁ, মিস্টার রোজার, জবাব দিল কিশোর।
বস, চেয়ার টেনে দিল রোজার।
ঘটনাটা কি, ড্যানি? জানতে চাইল রক। ওরা কারা?
এখনও জানি না। তোমার পিস্তল সরাও। ভয় লাগে, কখন গুলি ছুটে যায়।
দ্বিধা করল রক। তারপর পাজামার নিচের দিক তুলে, হাঁটুর নিচে বাঁধা, হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল পিস্তলটা।
চোখ মিটমিট করল মুসা। কিছু বলল না। টেবিলের কাছে বসেছে ওরা।
মিস্টার সাইমন বললেন, রোজার বলল। তোমাদের একজন নাকি এই সন্দেহজনক লোককে ব্যাংকের কাছে দেখেছ।
ঘটনাটা কি, খুলে বলবে? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রক।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রোজার। খবর শোননি? আজ সকালে ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে।
ডাকাতি? কই, শুনিনি তো। কি করে ঘটল? এই ছেলেগুলো কে? কিছুই বুঝতে পারছি না।
দ্রুত, সংক্ষেপে সব জানাল রোজার শেষে বলল, আর আমি গাধাই ব্যাটাদের ঢুকতে দিয়েছি। পুলিশের সন্দেহ, আমিও জড়িত। করবেই, আমি যেমন গর্দভ। ভাল করে তাকালাম না কেন তার মুখের দিকে? তাহলেই তো চিনতে পারতাম।
উকিলের কাছে যাও, রক বলল। ব্যবস্থা একটা করে দেবে। তুমি অপরাধী না হলে জোর করে তো পুলিস কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এই ছেলেগুলো কেন এসেছে? জানালা দিয়ে উঁকি মারছিল কেন?
গম্ভীর হয়ে গেল রোজার। নিশ্চয় ওরাওঁ সন্দেহ করছে। কিশোরের দিকে কাত হল সে। প্রথমে ভাবলাম, মিস্টার সাইমন সাহায্য করতে পারবেন। গত হপ্তায় টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন তখন। বলেছিলেন, মাঝে মাঝে নিরপরাধ লোক অহেতুক বিপদে পড়ে, কারণ, ভুল সময়ে ভুল জায়গায় হাজির থাকে তারা। সোজা কথা কপাল খারাপ। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। মিস্টার সাইমনের কথা মনে পড়ল। ব্যাংকের একজন। সেক্রেটারিও তার কাছে যাবার পরামর্শ দিয়েছে আমাকে। ডাউনটাউন ক্রেডিট রিপোর্টিং সার্ভিস থেকে ঠিকানা জোগাড় করে দিয়েছে। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে নাম নেই তার। আমার বিশ্বাস, অনেক বিখ্যাত লোকেরই থাকে না। দেখা করতে গেলাম…।
একেবারে বক্তৃতা শুরু করেছ, বাধা দিয়ে বলল রক। মিস্টার সাইমন কে, সেটাই তো জানি না।
কেশে গলা পরিষ্কার করল কিশোর। তিনি একজন লেখক। শখের গোয়েন্দা। আজ সকালে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার একটা মানিব্যাগ ব্যাংকের বাইরে রাস্তায় এক লোক ফেলে যায়, সেটা কুড়িয়ে পায় রবিন মিলফোর্ড, রবিনকে দেখাল সে।
ডাকাতটাকে দরজা খটখট করতে দেখেছি আমি, মিস্টার রোজার, রবিন বলল। তালা খুলে আপনি তাকে ঢুকতে দিয়েছেন।
আজ সকালে মিস্টার সাইমনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে, মুসা বলল। আপনাকে যেতে দেখেছি। সন্দেহ হয়েছে। ভেবেছি, সাইমনের সঙ্গে আপনার কোন যোগাযোগ আছে। ডাকাতির সঙ্গে…। থেমে গেল সে। সরি, খোলাখুলি। বলে ফেললাম।
আমি শুধু তাঁর সাহায্য চাইতে গিয়েছিলাম, রোজার বলল। কিন্তু তাঁর এখন সময় নেই। নতুন একটা বই লেখায় হাত দিয়েছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের কয়েকজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের নাম-ঠিকানা দিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, গোয়েন্দার চেয়ে এখন উকিলের সঙ্গে দেখা করা আমার জন্যে জরুরি। বিকেলে কয়েকজনকে ফোন করেছি। ফিস জান? পিলে চমকে গেছে আমার। গোয়েন্দার ফিস্ আরও বেশি। কোনটার খরচ জোগানোরই সাধ্য আমার নেই।
চেয়ারে সোজা হয়ে বসল কিশোর। মিস্টার রোজার, আগে আপনার ওপর সন্দেহ ছিল আমার। এখন নেই। আপনাকে সাহায্য করতে পারব। আমরা গোয়েন্দা।
পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল সে।
তোমরা ছেলেমানুষ…।
বাধা দিয়ে বলল কিশোর, বয়েস কম হতে পারে, কিন্তু সত্যিই আমরা গোয়েন্দা। পুলিশ পারেনি, এমন অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি, বিশ্বাস না হলে পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করুন। মিস্টার রোজার, আমি বুঝতে পারছি আপনি ডাকাতিতে জড়িত নন।
রবিন আর মুসাও একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল।
মিস্টার রোজার, আবার বলল কিশোর। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের সাহায্য নিতে পারেন।
দ্বিধায় পড়ে গেছে সিকিউরিটি ম্যান। কিন্তু তোমাদের বয়েস এত কম!
এটা কি কোন বাধা?
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল রোজার, আঙুল মটকাল। কি জানি। সত্যিকার গোয়েন্দা সংস্থাকেই ভাড়া করা উচিত…কিন্তু…কিন্তু..।
তাতে কত খরচ লাগবে ভেবে দেখেছ? রক বলল।
টেবিলের কাছে একটা চেয়ারে বসেছে সে, রোজারের চেয়ে বয়েস কম। জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্রূকুটি করল। আঙুল চালিয়ে ব্যাকব্রাশ করল সোজা সুন্দর চুল। সানগ্লাস খুলে নিয়ে রাখল জ্যাকেটের পকেটে। তারপর বলল, এত ভাবছ কেন বুঝতে পারছি না। তোমাকে অপরাধী বলতে হলে, আগে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে পুলিশকে।
আমিই তো আমাকে অপরাধী মনে করছি। নিজের হাতে চাবি দিয়ে তালা খুলে ডাকাত ঢুকতে দিয়েছি।
এ-জন্যে তোমাকে জেলে পাঠাতে পারবে না পুলিশ। আর এতই যদি ভাবনা, এই ছেলেগুলোকেই ভাড়া কর। কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, ওরা তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। কি করে করবে, জানি না।
সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা,কথা দিয়ে ফেলল মুসা।
যেচে পড়ে আমার উপকার করতে চাইছ তোমরা, রোজার বলল। আজকাল কজন করে এরকম? বেশ…করলাম ভাড়া। নেব তোমাদের সাহায্য। তবে বেশি পয়সা দিতে পারব না, আগেই বলে দিচ্ছি।
শখে গোয়েন্দাগিরি করি আমরা, মিস্টার রোজার, রবিন বলল। পয়সা নিই, না।
৫
খুব খারাপ অবস্থা আমার! রোজার বলল। প্রাস্টিকের টেবিলক্লথের ডিজাইনে আঙুল বোলাচ্ছে। উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে। এই ডাকাতি কেসের মীমাংসা যতদিন না হবে, আমাকে কাজে যেতে মানা করে দিয়েছে ওরা। মুখ ফুটে ডাকাত বলে না, তবু বুঝতে তো পারি। আচ্ছা, তোমরাই বল, আমাকে কি ডাকাত মনে হয়? আমার ঘর দেখে মনে হয় এটা ডাকাতের আড্ডা?
ডাকাত কি না বোঝার জন্যেই যেন রোজারের দিকে তাকাল ছেলেরা, রান্নাঘরে চোখ বোলাল আরেকবার। হাসল কিশোর। না, লোকটাকে ডাকাত কিংবা ডাকাতের সহযোগী ভাবতে পারছে না সে। আর ঘরটাকেও ডাকাতের ঘর বলে মনে হচ্ছে না।
হায়, হায়! চেঁচিয়ে উঠল রক, আমার মাল ! মুদী…।
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল সে। দড়াম করে বন্ধ হল পেছনের দরজার পাল্লা।
গোড়া থেকেই শুরু হোক, কি বলেন, মিস্টার রোজার? কিশোর বলল। সব খুলে বলুন আমাদের। নুতন কিছু হয়ত বেরিয়েও যেতে পারে। এমন কিছু, যা আগে আপনার মনে দাগ কাটেনি।
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রোজার। মিস্টার সাইমন বলেছেন, কোন অ্যালিবাই না থাকলে, দোষী প্রমাণ করা যত সহজ, নির্দোষ প্রমাণ করা তারচে অনেক কঠিন।
আপনার কি সত্যিই কোন অ্যালিবাই নেই? ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। আপনি ডাকাতদের একজন হলে, গত কয়েক দিনে আপনার বেশ কিছুটা সময় আলাপ-আলোচনা আর পরিকল্পনায় ব্যয় হওয়ার কথা। অন্য ডাকাতদের সঙ্গে চেনা-পরিচয় করতেও সময় লাগে। গত দুই হপ্তা আপনি কি কি করেছেন, মনে আছে? বলতে পারবেন ঠিকমত?
বিষণ্ণ হয়ে মাথা নাড়ল রোজার।
আপনার বন্ধু রকের কথা বলুন। এখানেই থাকেন? তিনি কি বলতে পারবেন, গত কিছুদিন আপনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কি কি করেছেন?
আবার মাথা নাড়ল রোজার। এখানেই থাকে রক, তবে বাড়িতে বেশি সময় থাকে না। সিসটেম টি এক্স ফোর-এর ফিল্ড রিপ্রেজেন্ট্যাটিভ সে। ওটা একটা কম্পিউটার কোম্পানি। নানা অফিসে যায় সে, বোঝানোর চেষ্টা করে কম্পিউটার দিয়ে কাজের কত সুবিধে। বিজ্ঞাপন করে আরকি। গত পুরোটা হপ্তা, এমনকি উইকএণ্ডেও বাইরে ছিল রক। ফ্রেজনোর একটা ফার্ম টি এক্স বিলিং সিসটেম কিনছে, তাদের সঙ্গেই কাজ করেছে ওই কদিন। ফিরেছে এই খানিক আগে। আজকাল বাড়িতে ফিরেও খুব একটা কথা বলে না আমার সাথে। তবে টি এক্স ফোর-এ যখন একসঙ্গে কাজ করতাম, অবস্থা অন্যরকম ছিল তখন।
আপনি টি এক্স ফোর-এ কাজ করতেন?
করতাম। আগে ওটার নাম ছিল রিং-বার অফিস মেশিন কোম্পানি, পরে হাত বদল হয়, নামও। গর্বের আভাস দেখা গেল রোজারের চেহারায়, রিং-বারদের ওখানে তিরিশ বছরের বেশি চাকরি করেছি আমি। প্রথমে ছিলাম ওদের ডাক বিভাগে, তারপর চলে গেলাম ক্রয় বিভাগে। ধীরে ধীরে চাকরিতে উন্নতি হল। ডিপার্টমেন্টের বারোজনের মধ্যে আমি হলাম দ্বিতীয়, অর্থাৎ বিভাগীয় প্রধানের পরেই আমার স্থান। সে-সময় আমার ছেলেরা বড় হচ্ছে। বাসা ভাল, ছেলেরা আরামেই থাকত। বাসা বদলের দরকার হয়নি।
উঠে লিভিং রুমে চলে গেল রোজার। ফিরে এল একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ নিয়ে। তাতে তার যুবক বয়েসের ছবি, ঘন কালো চুল। পাশে দাঁড়ানো গোলগাল, চেহারার মোটামুটি সুন্দরী এক মহিলা। দুজনের পাশে দাঁড়ানো দুটো বাচ্চা।
আমার স্ত্রী, নীনা, মহিলার ছবির ওপর আঙুল রেখে বলল রোজার। বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পর বিয়ে করেছিলাম আমরা। হার্টফেল করে মারা গেছে বছর কয়েক আগে… গলা ধরে এল তার।
সমবেদনা জানাল কিশোর।
বড় এলা লাগে এখন, রোজার বলল। বাচ্চারাও বড় হয়ে যার যার মত চলে গেছে। সানিডেল-এর এক ইলেকট্রোনিক কোম্পানিতে চাকরি করে ছেলেটা, প্রােডাকশন কো-অরডিনেটর। মেয়েটা বিয়ে করেছে। স্বামী কাজ করে বীমা কোম্পানিতে। বেকারসফিল্ডে থাকে, দুটো বাচ্চা।
ভাল আছে দুজনেই। কিন্তু আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। আরও কাছাকছি থাকত যদি! ওরা চলে গেল, খালি হয়ে গেল বাড়িটা। একা একা খুব খারাপ লাগত। শেষে আরেকজনকে ভাড়া দেব ঠিক করলাম। কিছু পয়সাও আসবে, সঙ্গীও পাব। রককে বললাম। বলতেই রাজি হয়ে গেল সে। উঠে এল এখানে…।
দরজা খুলে গেল। একটা থলেতে কতগুলো প্যাকেট নিয়ে ঢুকল রক। থলে থেকে খুলে প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখতে লাগল রেফ্রিজারেটরে।
কাল রাতে কি কি ঘটেছে, খুলে বলবেন? অনুরোধ করল কিশোর।
বেশ, যদি তাতে কোন কাজ হয়, বলছি। অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি প্রথমে। প্রায় বছরখানেক ধরে চাকরি করছি ব্যাংকে। দুপুরে যাই, দুচারটা টুকিটাকি কাজ সারি, তেমন ইমপরট্যান্ট কিছু নয়। কাজটা নিয়েছিই আসলে সময় কাটে না বলে…টি এক্স ফোর থেকে রিটায়ার করার পর। নইলে কম্পিউটার কোম্পানির একজন অফিসার ব্যাংকের দারোয়ান হয়?
যা-ই হোক, অফিস ছুটি হওয়ার পর ঝাড়ুদার আসে, আমি দেখাশোনা করি। বেশিক্ষণ লাগে না ওদের। ছটার মধ্যে সেরে ফেলে। ওরা বেরিয়ে গেলে তালা লাগাই, আরেকবার চেক করে দেখি সব ঠিক আছে কিনা। তারপর বাড়ি যাই। নাইট গার্ড নেই ওই ব্যাংকের ভল্টে টাইম লক লাগানো, কাজেই গার্ডের দরকার পড়ে না। জোর করে কেউ খুলতে গেলেই পুলিশ স্টেশনে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।
সেজন্যেই আপনাকে আটক করেছিল ডাকাতেরা, রবিন বলল। নইলে টাইম লকের জন্যে কিছু করতে পারত না ওরা। ভেতরে ঢুকলেই, ঘন্টা।
হ্যাঁ। তিনজন এসেছিল, টাইম লক সিসটেমের কথা ভাল করেই জানত। নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে থেকে চোখ রাখছিল। ঝাড়ুদারেরা কাজ শেষ করে বেরিয়ে গিয়ে এলিভেটরে উঠল। তারপর এল এক ডাকাত। দরজা ধাক্কা দিল। লবিতে তখন আলো খুব সামান্য। দেখলাম ওভারঅল পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে, টুপির নিচে ধূসর চুল। টুপিটা চোখের ওপর টানা। ভাবলাম জ্যাকই বুঝি ফিরে এসেছে। কোন দরকারে। দরজা খুললাম। ও ভেতরে ঢোকার পর চিনলাম, জ্যাক নয়। হাতে পিস্তল। আর কিছু করার নেই তখন আমার।
ওর পর পরই ঢুকল আরও দুজন। মাথায় পরচুলা, নকল দাড়ি, নকল গোঁফ। ব্যের্ড রুমে ঢুকতে বাধ্য করল আমাকে। রাস্তা থেকে ঘরটা দেখা যায় না। আমাকে সরািরাত আটকে রাখল। ভল্টের ধারেকাছেও ঘেষল না। সকালে স্টাফরা আসতে লাগল। একজন করে ঢোকে, আর ধরে এনে তাকে বোর্ডরুমে আটকায়। তারপর এলেন মার্ক জনসন, ভল্টের লক কম্বিনেশন তিনি জানেন। বোঝা গেল, ডাকাতেরা তাকে চেনে টাইম লক অফ করিয়ে ভল্ট খুলতে তাকে বাধ্য করল ওরা।
মুসার পাশের চেয়ারে এসে বসল রক রেনাল্ড। নিশ্চয় তোমার ওপর চোখ রেখেছে কেউ। ব্যাংকের কাছাকাছিই থাকে সে, বা থাকত। কিংবা তোমার পরিচিত কেউ।
পরিচিত কেউ হলে চিনতাম, রোজার বলল। তিনজনের একজনকেও চিনি। দেখিইনি কখনও।
উঠে গিয়ে চলায় কেটলি বসাল রক। আমাদের পড়শীদের কেউও হতে পারে। নিশ্চয় ছদ্মবেশে গিয়েছিল। পড়শীদের ওপর চোখ রাখতে বল ছেলেগুলোকে।
রাখাটা কি জরুরি?
সামনে ঝুঁকল কিশোর। পড়শী কিংবা বন্ধু-বান্ধবকে সন্দেহ করা কঠিন। কিন্তু মিস্টার রোজার, বোঝা যাচ্ছে, ডাকাতেরা আপনাকে চেনে, ব্যাংকে আপনার কখন কি কাজ ভালমত জানে। গত কদিন ধরে কেউ নজর রেখেছে আপনার ওপর, টের পেয়েছেন? আপনার কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন কেউ?
না, একেবারে মুষড়ে পড়েছে রোজার।
কেটলিতে কফি ফুটছে। একটা কাপে ইনসট্যান্ট কফি রেখে তাতে গরম পানি ঢালল রক। টেবিলের কাছে বসে চুমুক দিল কাপে। কিশোরের দিক থেকে রোজারের দিকে ফিরল, আবার তাকাল কিশোরের দিকে।
আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হবে আগে, কিশোর বলল। সেজন্যে সূত্র দরকার।
সূত্র? সূত্র কোথায় পাবে?
জানি না। তবে আশা করছি, পাওয়া যাবে। এখন এ-ব্যাপারে আলোচনা করছি না আপনার সঙ্গে। তদন্ত চালিয়ে যাব আমরা। দুএক দিনের মধ্যেই খবর জানাব আপনাকে। ইতিমধ্যে, অস্বাভাবিক কোন কিছু আপনার চোখে পড়লে জানাবেন। আমাদের কার্ডের পেছনে টেলিফোন নাম্বার আছে।
জানাব।
বেরিয়ে এল ছেলেরা। পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেলে রবিন বলল, সূত্র? ওই মানিব্যাগের কথা ভাবছ?
খুবই সামান্য, তবু সূত্র তো বটে, জবাব দিল কিশোর। আপাতত ওটা ধরেই তদন্ত চালাতে হবে আমাদের। আর একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেলাম, রোজার কিংবা মিস্টার সাইমন অপরাধী নন। তবে, অন্ধ লোকটা ডাকাতদের কেউ হলে, মানিব্যাগ ধরে তদন্ত করে লাভ হবে না আমাদের।
হোক বা না হোক, হাত নাড়ল মুসা। কথায় কথায় পিস্তল বের করে, এমন – লোকের সামনে না পড়লেই আমি খুশি।
৬
পরদিন সকাল নটায় রকি বীচ ছাড়ল রবিন মিলফোর্ড। কোস্ট হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালাল দক্ষিণে, সান্তা মনিকায় যাবে। থিফট অ্যাণ্ড সেভিংস কোম্পানির আশেপাশের স্টোরগুলোতে খোঁজখবর নেবে অন্ধ লোকটার, আর এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। তারপর আবার রকি বীচে ফিরে যাবে লাইব্রেরিতে, যেখানে পার্টটাইম চাকরি করে।
রবিনকে চলে যেতে দেখল কিশোর আর মুসা। তারপর ওরা রওনা হল উত্তরে। সাড়ে নটা নাগাদ ম্যালিবু ছাড়ল। শহরের পর থেকে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ, পাহাড়ের পিঠের ওপাশ থেকে আবার ঢালু হয়ে নেমেছে। নিকারো অ্যাণ্ড কোম্পানিটা ওখানেই।
জেটির কাছে এসে থামল ওরা। হাইওয়ে ধরে যাবার সময় হাজারবার দেখেছে এই জায়গা ওরা। এর আগে কখনোই নজর দেয়নি তেমন। কিছু ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে একধারে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা ভ্যান। জেটির দক্ষিণে সৈকতের এক প্রান্তে মাছ ধরছে কিছু লোক, তাদের মাঝে মহিলাও আছে কয়েকজন। এই ঠান্ডার মাঝেও ওয়েটসুট পরে ঢেউয়ের ওপরে সার্ফিং করছে কিছু লোক।
চমৎকার ঢেউ আজ, মুসা বলল। সে নিজে খুব ভাল সাফার, লোকগুলোকে দেখে সার্ফবোর্ড নিয়ে তারও সাগরে নামতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু ওসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কিশোরের। সে তাকিয়ে আছে জেটিতে বাঁধা একটা ফিশিং বোটের দিকে। ছোট্ট নাম বোটটার, টিনা। পনেরো মিটার লম্বা। পাইলটের জন্যে হুইল-হাউস আছে, যারা মাছ ধরবে তাদের জন্যে খোলা ডেক। ডেকের হ্যাচ খোলা। নীল উইণ্ডব্রেকার পরা এক তরুণ ঝুঁকে ইঞ্জিনে কি যেন করছে।
বোটটার উল্টোদিকে, জেটির উত্তরে একটা ভেলা বাধা রয়েছে, গ্যাংওয়ে দিয়ে তাতে নামার ব্যবস্থা। ভেলার সঙ্গে বাঁধা একটা দাঁড়টানা নৌকা। জেটি থেকে দূরে গভীর পানিতে ভাসছে বয়ায় বাঁধা সাদা একটা সুন্দর মোটরবোট। ককপিট ঢেকে রাখা হয়েছে তেরপল দিয়ে।
নিশ্চয় ওটাইমিস্টার সাইমনের বোট, কিশোর বলল।
হুঁম, সার্ফারদের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না মুসা।
তুমি থাক এখানে। সাইকেল দেখ।
হুঁম। হাসল কিশোর। রাস্তা পেরোল।
রাস্তা থেকে একটা ড্রাইভওয়ে সোজা নেমে গেছে জেটিতে। বাঁয়ে একটা ছোট পার্কিং লট, শূন্য, একটা গাড়িও নেই। ডানে আরেকটা ড্রাইভওয়ে চলে গেছে একটা বাড়ি পর্যন্ত। টালির মত করে লাগানো কাঠের হাত বাড়িটার, ধূসর রঙ বিবর্ণ হয়ে এসেছে। কাঠের দেয়াল সাদা রঙের। কারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। একটা স্টেশন ওয়াগন।
বাড়ি আর জেটির মাঝামাঝি ছোট একটা কেবিন। তিন দিকে বড় বড় জানালা, আর একদিকে দরজা, ডকের দিকে ফেরানো। ওটা অফিস। জানালা দিয়ে কিশোর দেখল, ভেতরে বসা ধূসর-চুল কালো পোশাক পরা এক মহিলা হিসেবের খাতা দেখছে। কাছেই বসা এক তরুণী, কোঁকড়া লাল চুল, টেলিফোনে কথা বলছে।
অফিসের কাছে এসে কাচের এপাশ থেকে তরুণীর দিকে চেয়ে হাসল কিশোর, তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
অফিসে নোনা পানি, রবারের বুট, সাগরের শ্যাওলা আর ছত্রাকের মিশ্র গন্ধ। একধারে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা কাঠের বেঞ্চ। ওটার সামনে টেবিলে রাখা মাছ-ধরার ওপর লেখা ছোট ছোট পুস্তিকা। চ্যানেল আইল্যাণ্ডস, আর উপকূলের কাছাকাছি কোথায় কোথায় ভাল বেড়ানোর জায়গা আছে, মাছ ধরা যাবে, তারও উল্লেখ রয়েছে ওগুলোতে।
হাত দিয়ে মাউথপিস ঢেকে কিশোরকে বলল তরুণী, এক মিনিট।
আমার তাড়াহুড়ো নেই,কিশোর জানাল।
মুখ তুলে তাকাল বয়স্ক মহিলা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। কেন যেন ভয় লাগে ওই চোখের দিকে তাকালে। কালো চোখের তারা স্থির, কিশোরের মনে হল তার মনের, কথা সব পড়ে ফেলছে মহিলা। আনমনা হাসি। একবার তাকিয়েই আবার খাতায় চোখ ফেরাল সে।
অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর। ফিরে চাইল ডকের দিকে। টিনার ইঞ্জিন পরীক্ষা শেষ করেছে উণ্ডব্রেকার পরা তরুণ। হ্যাচ লাগিয়ে ডেকের কিনারে এসে লাফ দিয়ে নামল জেটিতে। শিস দিতে দিতে এগিয়ে এল অফিসের দিকে।
ও-কে, কথা বলছে লাল-চুল তরুণী। তাহলে শনিবার দিন। তেতাল্লিশ। আরও বেশি হলে জানাবেন, ঠিক আছে? রিসিভার রেখে এগিয়ে আসা তরুণকে দেখল এক মুহূর্ত। তারপর ফিরল কিশোরের দিকে। কি সাহায্য করতে পারি?
একটা মানিব্যাগ পেয়েছেন? কোন রকম ভূমিকা করল না কিশোর। কেউ দিয়ে গেছে আপনাদের কাছে? মিস্টার সাইমন তার মানিব্যাগ হারিয়েছেন, দুএক দিন আগে।
মিস্টার সাইমন? এসেছিলেন নাকি? কই, দেখিনি তো। উইণ্ডব্রেকার পরা লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, বিল, মিস্টার সাইমনকে নিয়ে গিয়েছিলে? নৌকাটায় খুঁজে দেখ তো আছে কিনা।
নেই, জবাব দিল তরুণ। দুদিন আগে এসেছিলেন। বোটে তুলে দিয়ে এসেছিলাম, তারপর আবার ডকে ফিরিয়ে এনেছি। নৌকায় মানিব্যাগ পড়লে অবশ্যই দেখতাম।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল সে, মিস্টার সাইমন এলেন না কেন? টেলিফোনও তো করতে পারতেন?
উনি ব্যস্ত। গত দুদিনে আরও দুজায়গায় গিয়েছেন। কোথায়, ফেলেছেন মনে করতে পারছেন না। তাঁকে বলেছি, আমি খুঁজে দেখব। ফোন করেননি তার কারণ, ফোন করলে পাত্তা দেয় না লোকে। দায়সারা গোছের একটা জবাব দিয়ে রেখে দেয়।
অন্ধ এক ভিখিরিকে দেখেছেন মিস্টার সাইমন, সবে বানিয়ে বলতে যাচ্ছিল কিশোর, বলে উঠল বয়স্ক মহিলা, মানিব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করছ? আশ্চর্য! কাল রাতে মানিব্যাগ স্বপ্নে দেখেছি আমি।
তরুণী হাসল। আমার শাশুড়ি খুধ আজব মানুষ। তার স্বপ্ন প্রায়ই ফলে যায়। ভয়ঙ্কর মহিলা।
স্বপ্ন দেখলেই ভয়ঙ্কর হয়ে যায় নাকি মানুষ? মহিলার কথায় বিদেশী টান, রেগে যাওয়ায় জোরাল হল। তোমাদেরকে কতবার বলেছি, স্বপ্ন দেখলে ভয় পাই আমি। কাল রাতে দেখলাম, আজব একটা লোক এল। মাটি থেকে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে চট করে পকেটে রেখে দিল।
লোকটা অদ্ভুত। ধূসর চুল, মৃত্যুর আগে আমার কাসটে লিনির যেমন ছিল। তবে কাসটেলিনির মত ছোট আর বুড়ো নয় লোকটা। বয়েস আরও কম, চোখে কালো চশমা। মুখে কাটা দাগ, মনে হয় কেউ কেটে দিয়েছে ছুরি দিয়ে। হাতের লাঠি অন্ধের মত ঠকঠক করছিল। বুঝতে পারছিল আমি ওকে দেখছি। আমার জন্যে ও বিপজ্জনক, আমি জানি। সাংঘাতিক এক দুঃস্বপ্ন, অথচ কত বাস্তব। তরুণীর দিকে তাকাল মহিলা। খুব ভাবনা হচ্ছে আমার, এলসি।
বিচিত্র একটা শব্দ, কিশোরের মনে হল লোকটার গলা চেপে ধরা হয়েছে। ফিরে তাকাল সে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বিল। মৃদু কাপছে।
কি হল, বিল? এলসি জিজ্ঞেস করল। ওরকম চেহারার কাউকে চেন নাকি?
না না, আমি চিনব কোত্থেকে? কথাটা বেশ জোরেই বলে ফেলল বিল মিসেস নিকারো এমন ভাবে বলে না, যেন একেবারে সত্যি সত্যি দেখেছে।
তোমার কথা বুঝতে পারছি।
এক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না। তারপর দুই মহিলাকেই ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত চলে এল মুসার কাছে। তখনও স্বপ্নিল চোখে সাফারদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দা সহকারী।
মনে হয় আসল জায়গায় ঢিল মেরেছি! কিশোর জানাল। অফিসের বৃদ্ধা মহিলা মিসেস নিকারো। আর তরুণী তার ছেলের বৌ। সে বলল, তার শাশুড়ির স্বপ্ন নাকি সব ফলে যায়।
তারমানে বলতে চাইছ, ঘটনা ঘটার আগেই সেটা স্বপ্নে দেখে মহিলা?
হয়ত। যা ঘটে গেছে, সেটাও বোধহয় দেখে। এবার দেখেছে, একটা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখছে এক লোক, অন্ধ, হাতে লাঠি। গালে কাটা দাগ। লোকটা নাকি মহিলার জন্যে বিপজ্জনক।
যাহ্, বানিয়ে বলছ!
মোটেও না। মহিলা যা বলল, তা-ই বললাম। ভয় পাচ্ছে। ভয় ওই লোকটাও পেয়েছে, উইণ্ডব্রেকার পরা, খানিক আগে ইঞ্জিনে কাজ করছিল যে। মহিলার স্বপ্নের কথা শুনেই আঁতকে উঠেছে। নিশ্চয় অন্ধ লোকটার কথা কিছু জানে সে। এবং সেটা প্রকাশ করতে চায় না। আমাদের এই রহস্যের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার।
৭
মুসা নিজেই প্রস্তাব দিল, জেটির কাছে থেকে বিলের ওপর নজর রাখবে। বলল, যদি কিছু করে, দেখতে পারব। তোমাকে চিনে ফেলেছে সে। আমাকে চেনে না, কাজেই কাছাকাছি থাকা সহজ হবে। খেয়ালই করবে না।
খুব সাবধান, সতর্ক করল কিশোর।
থাকব।
সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল কিশোর। রাস্তা পেরিয়ে সৈকতের দিকে চলল মুসা। তাপর সাইকেল ঘুরিয়ে চলে এল একটা খিলানের নিচে, পানির কিনারে। খিলানের সঙ্গে শেকল পেঁচিয়ে তালা দিয়ে রাখল সাইকেল। ভাবসাব এমন, যেন নিকারোদের ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। যে-ই দেখুক, ভাববে, সাইকেল রাখার নিরাপদ জায়গা খুঁজছে।
সৈকত ধরে কিছুদূর এগোল সে, কয়েকজন মাছশিকারির পাশ কাটাল। তারপর একটা শুকনো জায়গা বেছে বসে পড়ল বালিতে। চোখ রাখল টিনার ওপর। আবার বোটে উঠেছে বিল। পেতল ঘষছে৷৷
সুন্দর কাটছে সকালটা। খিলানের কাছে সৈকতে খেলতে এল একদল ছেলেমেয়ে। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল মুসা। কথায় কথায় জানল, ওরা কাছাকাছিই থাকে। আরও জানল, হাইওয়ের ধারে ছোট একটা বাড়িতে বাস করে বিল। আরও দুজন বন্ধু থাকে তার সাথে। বিদেশী ভাষায় কথা বলে। সহজেই এত তথ্য জানতে পেরে খুশি হল মুসা। ভাবল, কিশোরও এরচেয়ে বেশি কিছু করতে পারত না।
কাছের একটা ছোট বাজার থেকে স্যাণ্ডউইচ কিনে লাঞ্চ সারল মুসা। আবার ফিরে এসে বসল আগের জায়গায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পাঁচটা বাজল। পাঁচটার সামান্য পরে জেটি থেকে রাস্তায় গিয়ে উঠল বিল। পিছু নিল মুসা।
রাস্তার দিকে মুখ করে আছে ছোট কটেজটা। পুরানো। দেখে মনে হয় ধসে পড়বে যে-কোন সময়। বালিতে অসংখ্য খুঁটি গাড়া, তার ওপর রয়েছে বাড়িটার পেছনের ভার। ঢুকে গেল লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুসা ভাবতে লাগল, এবার কি করবে? কি করে জানবে বিলের সঙ্গে অন্ধ ভিক্ষুকের কি সম্পর্ক?
পুরানো একটা ট্রাক বিকট গর্জন তুলে ছুটে এল হাইওয়ে ধরে। কটেজের কাছে এসে থামল। নামল এক যুবক। হাত নেড়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঢুকল বাড়িতে।ট্রাক চলে গেল নিজের পথে।
কয়েক মিনিট পর এল তৃতীয় আরেকজন, সে-ও যুবক। পুরানো একটা বুইক চালিয়ে। বাড়ির পাশে ঘাসে ঢাকা একটুকরো সমতল জমিতে গাড়িটা পার্ক করে রেখে গিয়ে বাড়িতে ঢুকল সে, দড়াম করে বন্ধ করল সামনের দরজা।
সৈকতে মাছশিকারির সংখ্যা কমে এসেছে। পশ্চিমে ডুব দেয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যেন সূর্য। মুসা ঠিক করল, আর দশ মিনিট, তারপর বাড়ি রওনা হবে।
কথাটা ভেবে সে শেষও করতে পারল না, খুলে গেল কটেজের দরজা। তিনজনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাইওয়ে ধরে এগোল। পিছু নিল মুসা। নিকারোদের বাড়ি পেরোল তিন যুবক, উঠতে শুরু করল আঁকাবাঁকা একটা ড্রাইভওয়ে ধরে। চূড়ায় একটা বাড়ি, সাগরের দিকে মুখ। সাইনবোের্ড রয়েছেঃ প্যাসিফিক মোটেল।
প্রায় চূড়ার কাছে পৌঁছে গেছে তিনজন, এই সময় একটা গাড়ি এসে মোেড় নিয়ে মোটেলের ড্রাইভওয়ে ধরে উঠতে শুরু করল। ওটার পর পরই এল আরেকটা গাড়ি, প্রথমটাকে অনুসরণ করল। তারপর এল আরেকটা, দাঁড়িয়ে গেল পথের ধারে। তৃতীয় গাড়ি থেকে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ নেমে ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে উঠতে লাগল। ঠিক তাদের পেছনেই এল মোটরসাইকেল আরোহী দই তরুণ, ইঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জন তুলে উঠে চলল ড্রাইভওয়ে দিয়ে।
দেখছে আর ভাবছে মুসা, অবাক হওয়ার মত কিছু আছে কি? যখন এক ভ্যান বোঝাই তরুণ তরুণী এসে হাজির হল, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, এবার কিছু একটা করা দরকার। ছোট একটা সেডান এসে রাস্তার পাশে থামতেই হাইওয়ে পেরোল সে। গাড়ি থেকে নামল মাঝবয়েসী এক দম্পতি। তাদের সঙ্গে দুটো ছেলে, তেরো থেকে পনেরোর মধ্যে ওদের বয়েস। দম্পতির পেছনে হেঁটে চলল ছেলেদুটো। ওদের কয়েক গজ পেছনে রইল মুসা।
পরিবারটার পিছু পিছু চূড়ায় উঠে এল সে। ঘুরে এগোল মোটেলের পেছনে পার্কিং লট আর সুইমিং পুলের ধার দিয়ে। পেছন দিকের সব দরজা খোলা। ওদের মাথার ওপরে বাড়ির ছাঁইচে ইতিমধ্যেই হেসে উঠেছে উজ্জ্বল আলো। পুলের চারপাশে আর পার্কিং লটের কালো রঙ করা চত্বরের কিছুটা জুড়ে সাজানো হয়েছে ফোল্ডিং চেয়ার। পুল থেকে দূরে একটা খোলা জায়গায় রয়েছে বিল আর তার দুই বন্ধু, তাদের সামনে মস্ত ইজেলে বিশাল তিনটে ফটোগ্রাফি। সাদা-কালো একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাদা-চুল একজন মানুষ, পরনে নানারকম কাজ করা ইউনিফর্ম। আরেকটা রঙিন ছবি, একটা শহরের ওপর পড়েছে সোনালি উজ্জ্বল রোদ। তৃতীয় ছবিটা দেখে চমকে গেল মুসা। এটাও একজন লোকের, ধূসর চুল, গালে কাটা দাগ, চোখে কালো চশমা। রবিনের অন্ধ ভিখারির প্রতিকৃতি।
অস্বস্তি লাগছে মুসার। এখানে তার কোন অধিকার নেই। পালিয়ে যাওয়ার জোর ইচ্ছেটা দমন করল কিশোরের কথা ভেবে, কিশোর অসন্তুষ্ট হবে। নিশ্চয় কোন ধরনের সভার আয়োজন হয়েছে এখানে, যাতে অন্ধ লোকটার কথা আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর এই সভায় টিকেটের প্রয়োজন নেই, যে খুশি আসতে পারে, মুসার অন্তত তা-ই মনে হল। তার দিকে তাকাচ্ছেও না কেউ। সন্দেহজনক কিছু না করলে তাকাবে বলেও বোধহয় না।
একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। পাশে এসে বসল মোটাসোটা এক লোক। ওপরে ওঠার পরিশ্রমে বেজায় হাপাচ্ছে। তার দিকে চেয়ে খাতির-জুমানো-হাসি হাসল মুসা।
আরও লোক আসছে। সব চেয়ার ভরে গেল। এরপরও যারা এল, মোটেলের সিঁড়িতে, সুইমিং পুলের ধারের দেয়ালে উঠে বসতে লাগল। মোটেলের ভেতরে কোন আলো নেই। ব্যাপার কি?-ভাবল মুসা। গরমের সময় ছাড়া এই মোটেল, খোলে না নাকি?
অন্ধকার হয়ে আসছে, এই সময় একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল বিল। ছবিগুলোর সামনে রাখা হয়েছে টেবিলটা। মোটেলের অফিসের পেছন থেকে মার্চ করে এগিয়ে এল তার এক বন্ধু, হাতে নীল মখমলের পতাকা, সোনালি বর্ডার, মাঝে একগুচ্ছ সনালি ওকপাতা।
গান শুরু করল এক মহিলা। যোগ দিল আরেক মহিলা। তাদের সঙ্গে গলা মেলাল এক লোক। তারপর একে একে সবাই। উঠে দাঁড়িয়ে গাইছে। মুসাও গাওয়ার ভান করছে। সুরটা তার অপরিচিত, কখনও শোনেনি। লড়াইয়ের গানের মত মনে হল তার। শেষ হল গান। গুঞ্জন শুরু হল। কেশে উঠল মুসা। চেয়ারে বসার মচমচ। টেবিলের সামনে থেকে সরে এল বিল।
তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল এক স্প্যানিশ ভদ্রলোক, বৃদ্ধ। দেশী ভাষায় কথা শুরু করল। মনে মনে গুঙিয়ে উঠল মুসা। স্প্যানিশ বোঝে না সে।
মোলায়েম ভঙ্গিতে আরম্ভ করেছিল, ধীরে ধীরে গলার জোর বাড়ল বক্তার। মুঠো তুলে আঁকাতে লাগল, যেন শাসাচ্ছে উপস্থিত জনতাকে। কিংবা এই মোটেলের সীমানার বাইরে কোন জনগোষ্ঠীকে।
বক্তৃতা শেষ হতেই তুমুল করতালি আর চিৎকার করে তাকে সমর্থন করল জনতা। তারপর বক্তৃতার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল অল্পবয়েসী এক মহিলা, মাথায় লম্বা সোনালি চুল। জনতার দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে কিছু বলল, মুসার মনে হল, শ্লোগান। আবার হাততালি, চিৎকার, শিস। মাটিতে পা ঠুকল কেউ কেউ।
মহিলা হাত তুলতেই চুপ হয়ে গেল জনতা। কথা শুরু করল সে। ভাষা না বুঝলেও মুসার অনুমান করতে কষ্ট হল না, জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা চলছে। ফ্লাডলাইটের আলোয় জ্বলছে, যেন বক্তার-চোখ। মাঝে মাঝেই হাত তুলে ইঙ্গিত করছে অন্ধ লোকটার ছবির দিকে, হুল্লোড় করে উঠছে জনতা।
বক্তৃতা শেষ হলে আবার কোলাহল। মহিলা সরল। আবার সে-জায়গায় এসে দাঁড়াল বিল। ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেল জনতা। তারপর, মুসাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে লোক বাছাই করতে আরম্ভ করল সে, যাদেরকে বক্তৃতা দিতে হবে। যাদেরকে ইশারা করল, এক এক করে বক্তব্য রাখল তারা। প্রথম সারি থেকে বলল একজন লোক, তারপর মাঝখান থেকে এক মহিলা, শেষে সিঁড়িতে বসে থাকা এক কিশোর। স্প্যানিশ ছাড়া আর কিছু বলছে না। কি বলল তিনজুনে, এক বর্ণ বুঝতে পারল না মুসা।
হঠাৎ মুসার দিকে হাত তুলল বিল। সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
মাথা নাড়ল মুসা। কিন্তু তাকে ঠেলে তুলে দিল পাশে বসা মোটা ভদ্রলোক।
দুঃস্বপ্ন দেখছে যেন মুসা। ভাবনাও চলছে না আর, জমে গেছে যেন মগজ।
কিছু বলল বিল। হেসে উঠল জনতা,। ওদের মুখের দিকে তাকাল সে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, অপেক্ষা করছে।
দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে তার। দ্রুত তাকাল এদিক ওদিক। চেয়ারগুলোর পাশ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভওয়েতেও পৌঁছতে পারবে না, তার আগেই ধরা পড়ে যাবে। সে গুপ্তচর, এটা যদি বুঝে যায় ওরা…
মোলায়েম গলায় কিছু বলল পাশে বসা ভদ্রলোক। প্রশ্ন করল? নাকি হুমকি?
আচমকা গলা চেপে ধরল মুসা। হাঁ করে বিচিত্র একটা শব্দ করল। মাথা নাড়ল জোরে জোরে।
ও! বলল পাশে বসা লোকটা। ল্যারিনজাইটিস!
মাথা ঝাঁকাল মুসা, জোর করে হাসল। আবার হেসে উঠল জনতা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে, বসে পড়ল। তার পিঠ চাপড়ে সহানুভূতি জানাল ভদ্রলোক। অন্যদিকে চোখ ফেরাল জনতা। আরেকজন লোকের দিকে হাত তুলল বিল। সেই লোকটা উঠে কিছু বলল।
বক্ততার পালা শেষ। একটা ঝুড়ি নিয়ে এগোল বিল আর তার এক বন্ধু, দুজনে দুদিকে ধরেছে। এগোল সারির ভেতর দিয়ে। থামছে প্রতিটি লোকের সামনে। উঠে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী কণ্ঠে জনতাকে কি সব বলছে সেই অল্পবয়েসী মহিলা। বোধহয় মুক্ত হস্তে দান করার অনুরোধ জানাচ্ছে।
মুসার সামনে যখন এল ঝুড়িটা, অনেক টাকা জমে গেছে। সে-ও ফেলল একটা ডলার। ড্রাইভওয়ে থেকে চেঁচিয়ে কি যেন বলল একজন। চোখের পলকে কোথাও উধাও হয়ে গেল ঝুড়ি।
দেখতে দেখতে জনতার সামনে দুটো গিটার আর একটা অ্যাকর্ডিয়ন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বিল আর তার দুই বন্ধু। গিটারে টোকা দিল বিল। বেজে উঠল অ্যাকর্ডিয়ন। মিষ্টি সুরে গান ধরল অল্পবয়েসী মহিলা।
তার সঙ্গে গলা মেলাল অনেকে। আঞ্চলিক গান, সুরে বোঝা যায়।
মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। ফিরে চেয়ে মুসা দেখল, উঠে এসেছে একজন পুলিশ, হাইওয়ে পেট্রলম্যান।
হাত নাড়ল গায়িকা। থেমে গেল সঙ্গীত।
মোটর সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তুলে চেয়ারগুলোর পাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়াল পুলিশ অফিসার। হাত তুলে বলল, সরি, বাধা দিলাম। কিছু মনে করবেন না। আপনাদের লীডার কে?
আমি, বিল বলল। কি ব্যাপার, অফিসার? রিহারসালের অনুমতি নিয়েই এসেছি মিস্টার বারকেনস্টিনের কাছ থেকে।
বারকেনস্টিন? অফিসের দিকে তাকাল অফিসার। মোটেলের মালিক?
হ্যাঁ। কমুনিটি রুম ভাড়া নিয়েছি। রসিদ দেখতে চান?
না, বিশ্বাস করছি। কিন্তু ওটা তো কমুনিটি রুম নয়। তাছাড়া বারকেনস্টিন বলেনি জায়গাটা নিরাপদ নয়? মোটেল বন্ধ কেন, জানেন? এর নিচের মাটি আলগা, অতিবৃষ্টিতে এরকম হয়েছে। যে কোন সময় ধস নামতে পারে। আসলে কি করছেন এখানে, বলুন তো? এত লোক কেন?
নিস্পাপ হাসি ফুটল বিলের ঠোঁটে। একটা গানের দল গঠন করেছি আমরা, কান্ট্রি সং ফেডারেশন। রিহারসাল দিচ্ছি, কলিসিয়ামে সাতাশতম কান্ট্রি মিউজিক জাম্বােরিতে প্রতিযোগিতা করব।
জনতার ওপর চোখ বোলাল অফিসার। এত লোক? সবাই…সবাই যাবেন প্রতিযোগিতা করতে?
অ্যামেচারদেরই প্রতিযোগিতা হয় ওখানে, ধৈর্যের সঙ্গে জবাব দিল বিল। লোক কম-বেশির প্রশ্ন নেই। আপনি বলছেন ধস নামবে, মিস্টার বারকেনস্টিন তো তা বললেন না। তিনি বলেছেন ঠিকই আছে। তাছাড় এখন আর রিহারসাল ক্যান্সেল করা যাবে না। দূর থেকে এসেছে ওরা, এমন কি ল্যাগুনা থেকেও এসেছে অনেকে। ভোলা জায়গায়ই তো প্র্যাকটিস করছি। মোটেল যদি বসেও যায়, আমাদের কিছু হবে না।
সেটা আপনি বলছেন। আপনার কথায় তো আর হবে না, গলা চড়াল অফিসার। জনতার দিকে ফিরল, সরি, আপনাদের চলে যেতে হবে এখান থেকে। যত তাড়াতাড়ি পারেন। সাংঘাতিক বিপদ হতে পারে। তাড়াহুড়ো করবেন না। আস্তে আস্তে শৃঙ্খলা বজায় রেখে নেমে যান। যান, উঠুন। না না, চেয়ার গোটানোর দরকার নেই। যেমন আছে থাক।
অফিসারের কথা মানল জনতা। উচ্ছল হল না। শান্ত হয়ে সারি দিয়ে নেমে যেতে শুরু করল। ড্রাইভওয়ে দিয়ে নামার সময় মুসার কানে এল, বিল বলছে, এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? যাচ্ছি তো। গিটারটা তো নিতে দেবেন?
৮
কি যে করছে ওরা আল্লাই জানে, মুসা বলল। তবে বাজি রেখে বলতে পারি, ফোক সং-টং সব বাজে কথা।
পরদিন সকালে হেডকোয়ার্টারে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে ও।
বাজিতে হেরেও যেতে পার, বলল কিশোর। সামনে ডেস্কের ওপর রাখা লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এর একটা সংখ্যা। সাতাশ তারিখে কলিসিয়ামে সত্যিই মিউজিক জাম্বােরি হচ্ছে।
রবিন বসেছে টুলে। আগের দিন সান্তা মনিকায় গিয়ে অন্ধ লোকটা সম্পর্কে খোঁড়া গোয়েন্দা কিছুই জানতে পারেনি সে। কোলের ওপর বিছানো একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুসা আর কিশোরের আলোচনা শুনছে।
এই শোন, হঠাৎ মুখ তুলল রবিন। মুসা, তুমি কাল যে পতাকা দেখে এসেছ, ওটা মেকসিকান নয়। মেকসিকান পতাকা লাল, সাদা আর সবুজ। ওটা স্প্যানিশও নয়, এমনকি সেন্ট্রাল আমেরিকার কোন দেশেরও নয়।
হয়ত দেশের পতাকা নয় ওটা, বলল কিশোর। কোন সংগঠনের ব্যানার হতে পারে।
আবার ম্যাপের পাতায় মনোনিবেশ করল রবিন। খানিক পরে চেঁচিয়ে উঠল, মেসাডিওরো!
কী? মুসা অবাক। কি বললে?
মেসা ডিওরো। দক্ষিণ আমেরিকার একটা ছোট্ট রাজ্য। এই যে, দেখ ম্যাপটা। পাশে আরও দুটো ম্যাপ। একটা সবুজ, মাঝখানে স্টেট-এর সীল, আরেকটা নীল, মাঝে একগুচ্ছ সোনালি ওকপাতা। সবুজ রঙেরটা দেশের অফিশিয়াল ফ্ল্যাগ, আর নীলটার নিচে লেখা রয়েছে ওল্ড রিপাবলিক। নোট লেখা রয়েছে, দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে নীল পতাকাটাকে বিশেষ ছুটির দিনে এখনও ব্যবহার করে রক্ষণশীল গোষ্ঠী। দুই বন্ধুর দিকে তাকাল একবার রবিন, আবার মুখ নামাল ম্যাপের দিকে। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরেই অবস্থিত মেসা ডিওরো। বন্দর আছে। কফি আর পশম রপ্তানি করে। রাজধানীটাও একটা বন্দর, নাম ক্যাবো ডি র্যাযোন। এর দক্ষিণের উঁচু অঞ্চলে বার্লির চাষ হয়। লোক সংখ্যা পঁয়ত্রিশ লাখ।
তাই? মুসা বলল। আর কিছু?
ম্যাপ বইতে বেশি তথ্য থাকে না। যা দিয়েছে এইই বেশি, তা-ও ভাল ম্যাপ বলে।
মম, মাথা দোলাল কিশোর। মুসা, কাল যেটা দেখে এসেছ সেটাও বোধহয় কোন ধরনের সাংগঠনিক দল। দেশের কোন কাজের জন্যে টাকা সংগ্রহ করছে। কিন্তু নেতা সুবিধের নয়। পুলিশকে মিথ্যে কথা বলেছে। বোঝাই যায়। নইলে পুলিশ আসায় সতর্ক হয়ে যেত না। তাছাড়া, মিসেস নিকারো অন্ধ লোকটাকে স্বপ্নে দেখার কথা বলায় চমকে উঠেছে বিল। মুসার দিকে চেয়ে ভুরু নাচাল সে। কাল রাতে আসলে কি করছিল ওরা? ওদের সঙ্গে কি ব্যাংক ডাকাতির কোন সম্পর্ক আছে, না সভা করাটা ভিন্ন আরেক রহস্য? একটা ব্যাপার পরিষ্কার, সভা করার আসল কারণ পুলিশকে জানতে দিতে চায়নি ওরা।
চায়নি বলেই যে অপরাধ করেছে, সেটা না-ও হতে পারে, বলল রবিন। তবে ব্যাপারটা অদ্ভুত। পুলিশ জানলে অসুবিধে হবে মনে করে, অথচ কোনরকম গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়নি। সোজা গিয়ে বসে পড়েছে মুসা, কেউ বাধা দেয়নি।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। নিচের ঠোঁট ধরে জোরে টান দিয়ে ছেড়ে দিল। এর অর্থ, প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টায় পুরোদমে চালু করে দিয়েছে মগজ।
এমনও হতে পারে, আমি যার ছবি দেখেছি, মুসা বলল। রবিন সেই লোককে দেখেনি। দুজনই অন্ধ, তবে আলাদা লোক।
বেশি কাকতালীয়, বলল কিশোর। তুমি যার ছবি দেখেছ তার গালেও কাটা দাগ। মিসেস নিকারো স্বপ্নে দেখা লোকটার চেহারার বর্ণনা দিতে চমকে উঠেছে। বিল, তারমানে ওই লোক তার পরিচিত। আর পরিচিত লোকটা ছবির লোক ছাড়া
আর কে? কিন্তু মেসা ডিওরোর সঙ্গে ওদের কি সম্পর্ক? ব্যাংক ডাকাতি কি ওরাই করেছে?
হতে পারে বিল বিদেশী এজেন্ট, আর অন্ধ লোকটা তার কনট্যাক্ট, মুসা বলল। স্পাই হলে পুলিশের কাছে অবশ্যই নিজের পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করবে। গায়ক সেজে বসাটা বিচিত্র কিছু নয়।
টেলিভিশন খুব বেশি দেখ তুমি, বলল রবিন।
গল্পের চেয়েও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে বাস্তবে, কিশোর বলল। বিলের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানি না আমরা এখনও। কাজেই কি যে ঘটছে অনুমান করা মুশকিল। তবে, মেসা ডিওরো সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে হবে আমাদের।
ঘড়ি দেখল রবিন। দশটায় লাইব্রেরিতে যেতে হবে। বইপত্র ঘেঁটে দেখব তখন।
কিশোওর! মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল। এইই কিশোওর।
হাসল মুসা। যাও, আজও কাজ চাপাবে ঘাড়ে।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
ওঅর্কশপের বাইরেই অপেক্ষা করছেন মেরিচাচী। দেখেই বলে উঠলেন, এই কিশোর, ডাকলে জবাব দিস না কেনরে? বলেই তাড়াতাড়ি স্বর নরম করে ফেললেন, ওই যে, বোরিস ডাকছে তোকে। মাল তুলবে। মুসা, বাবা, তুমিও একটু যাও, সাহায্য কর ওদের। ওই দেখ না, কি সব জিনিস নিয়ে এসেছে তোমার আংকেল। কতগুলো ভাঙা চেয়ার-টেবিল। কখন যে কোত্থেকে কি নিয়ে আসে …।
আনুক না, অসুবিধে কি? কিশোর বলল। বিক্রি তো হয়ে যায়।
তা যায়। তোর চাচার চেয়েও বোকা লোক আছে দুনিয়ায়। এই তো, কাল এক মহিলা ওগুলোর অর্ডার দিয়ে গেল। আজ আবার পৌঁছে দিতে হবে। সান্তা মনিকার ডেলটন অ্যাভেন্যুতে নাকি একটা বাচ্চাদের স্কুল খুলবে। খুলুক, আরও বেশি করে খুলুক, আমাদের ভালইআরে, রবিন, তুমি কোথায় যাও?
চাকরি, তাড়াতাড়ি জবাব দিল রবিন। আর দশ মিনিট সময় আছে।
তাহলে দেরি করছ কেন? কখনও কাজে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে না। অফিসে লেট করে যাওয়া কোনমতেই উচিত নয়। যাও, যাও।
মাল তুলতে বেশিক্ষণ লাগল না। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর, সে আর সুজাও যাবে সান্তা মনিকায়।
চাচীকে রাজি করাতে কষ্ট হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণে রওনা হল ট্রাক।
সাগরের ধারে একটা সাইড স্ট্রীটের পাশে নার্সারি স্কুলটা। ট্রাক রাখল বোরিস। ওখান থেকেই দেখা যায় ওশেন ফ্রন্ট সিনিয়র সিটিজেন সেন্টারটা। একতলা একটা বাড়ি, চারপাশে লন, বসার জন্যে বেঞ্চ আছে। চারজন বৃদ্ধ এক জায়গায় বসে তাস খেলছে। কাছেই আরেকজন লাঠিতে ভর দিয়ে খেলা দেখছে। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। দেখে দুঃখ হল কিশোরের। লোকটা আর কেউ নয়, ড্যানি রোজার।
সারারাত ঘুমায়নি মনে হয়, মুসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ওই চারজন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে না?
তাই তো মনে হচ্ছে। কারও ওপর সন্দেহ ঝুলে থাকাটা এজন্যেই খুব খারাপ। এসপার-ওসপার হয়ে যাওয়া ভাল।
লোকটাকে চেন নাকি? জিজ্ঞেস করল বোরিস।
আমাদের মক্কেল। তাহলে আর ওর ভাবনা নেই, হাত ঝাড়ল বোরিস। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ট্রাক থেকে নেমে স্কুলের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল বোরিস। বেল টিপল। মুসা তাকিয়ে আছে সেন্টারের দিকে, হঠাৎ আরি! বলে উঠল।
কি হল? কিশোর জানতে চাইল।
ওই মেয়েটা, বলতে বলতে মাথা নুইয়ে ফেলল মুসা। যাতে তাকে দেখতে
পায়।
ফুটপাত ধরে সুন্দরী এক মেয়েকে হাঁটতে দেখল কিশোর। অল্প বয়েস। মাথায় লম্বা সোনালি চুল, হাঁটার তালে তালে নাচছে। পরনে স্ন্যাকস আর গায়ে বেঢপ এক সোয়েটার। পাশে পাশে প্রায় দৌড়ে চলেছে একটা সেইন্ট বার্নার্ড কুকুর, হাঁ করা মুখ, জিভ বেরিয়ে পড়েছে।
কে? চেন নাকি?
কাল মীটিঙে ছিল, মুসা বলল। বক্তৃতা দিয়েছে। জন তার সমর্থন পেয়েছে খুব।
হুঁম! সোজা হয়ে বসল কিশোর। তীক্ষ্ণ হল দৃষ্টি। খুঁটিয়ে দেখছে মেয়েটাকে। বাহ্, খুব ভাল তো…মিস্টার রোজারের কাছে যাচ্ছে…আরে, হাতও মেলাচ্ছে দেখি।
কীই? মাথা তুলল মুসা।
কুকুরের শেকল ছেড়ে দিয়ে রোজারের দুই কাঁধে হাত রাখল মেয়েটা। উষ্ণ হেসে চুমু খেল লোকটার গালে।
খুশি মনে হল রোজারকে।, খাইছে! রোজার, ব্যাংক ডাকাতি, প্যাসিফিকে মোটেলের সভা, মিস্টার সাইমনের মানিব্যাগ, অন্ধ লোক, সবই দেখি একই সুতোয় গাঁথা!
সুতো কি ওই মেয়েটা?
নিশ্চয়ই, মুসা বলল। খুব সহজ ব্যাপার। ওই গায়ক গোষ্ঠীর সদস্য মেয়েটা। রোজারকেও চেনে বোঝা যাচ্ছে। তার কাছ থেকে ব্যাংকের খবরাখবর ওই মেয়েই নিয়েছে। অন্ধটা হল ডাকাত দলের সর্দার। ব্যাংকে যে তিনজন ঢুকেছিল, তাদের মধ্যে মেয়েটাও থাকতে পারে। ছদ্মবেশ নিয়েছিল। তাই চিনতে পারেনি রোজার। কিংবা হয়ত শুধু ইনফর্মারের কাজই করেছে মেয়েটা।
হতেও পারে, আনমনা হয়ে গেছে কিশোর। কিন্তু সভার অন্য লোকগুলো কারা? সবাই ডাকাত হতে পারে না।
ওরা…ওরা। জবাব দিতে পারল না মুসা। ওরা হয়ত নির্দোষ। ডাকাতগুলো ওদের ব্যবহার করছে…
কি কাজে ব্যবহার করছে বলতে না পেরে চুপ হয়ে গেল সে।
আড়াই লাখ ডলারে হল না, আরও টাকা দরকার? একেবারে চাঁদা তুলতে শুরু করল? নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর।
হ্যাঁ, কেমন জানি ব্যাপারটা!
কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে রোজারের পরিচয় হল কিভাবে? দেখি, একলা পেলে জিজ্ঞেস করব।
হাসছে মেয়েটা। হিবিসকাস ঝোপের সঙ্গে শেকল জড়িয়ে ফেলেছে তার কুকুর, ছুটতে পারছে না, তাই দেখেই হাসি।
তুমি থাক, কিশোর বলল। মেয়েটার পিছু নেব আমি। দেখব, কোথায় যায়। মাথা নোয়াও, মাথা নোয়াও। এদিকেই আসছে।
মেঝেতে বসে পড়ল মুসা। শুনতে পেল, মেয়েটা বলছে, আয়, আয়, আর জ্বালাসনে। আবার ওদিকে ফেরে!
জুতোর গোড়ালির খটাখট আওয়াজ তুলে ট্রাকের পাশ দিয়ে চলে গেল মেয়েটা।
আস্তে দরজা খুলে নেমে গেল কিশোর।
৯
পথের শেষ মাথায় পৌঁছে ডানে মোড় নিল মেয়েটা। চোখের আড়াল হয়ে গেল। দ্রুত পা চালাল কিশোর। মোড় ঘুরতেই আবার দেখল ওকে, পুরানো একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ঢুকছে।
ধীরে এগোল কিশোর। একটা সুইমিং পুলকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। চতুর্থ দিকে সাদা রঙ করা লোহার বেড়া। মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে একটা দরজা খোলা দেখতে পেল। বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করছে। কিশোর, এই সময় দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল সেইন্ট বার্নার্ড।
টিমি, জলদি আয়! টিমি, এই টিমি!
ছুটে গিয়ে পুলের এক প্রান্তে একটা ফুলের বেডের ওপর বসল কুকুরটা।
আরে এই শয়তান, জলদি আয়! বাড়িওলি দেখলে আমাকে সুদ্ধ বের করবে।
গেট খুলে চত্বরে ঢুকল কিশোর। গেটের পাশের মেইলবক্সের দিকে তাকিয়ে রইল চিন্তিত ভঙ্গিতে।
কাউকে খুঁজছ? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
না, মানে…না, যেন বলতে ভয় পাচ্ছে। ইয়ে…।
কি?
সান্তা মনিকা ইভনিং আউটলুক। গ্রাহক হবেন?
সরি। কাগজ পড়ার সময় নেই আমার।
পকেট থেকে ছোট প্যাড আর পেন্সিল বের করল কিশোর। রাখুন না? না হয় খালি রোববারেরটাই রাখুন?
থ্যাংকস। লাগবে না।
ও, খুব হতাশ মনে হল কিশোরকে। আজকাল কাগজই রাখতে চায় না লোকে। পড়ে না।
দিনকাল খুব খারাপ তো। বাঁচার তাগিদেই হিমশিম খেতে হয়, পড়ার সময় কোথায়, হাসল মেয়েটা। কুকুরটা এসে বসল তার পায়ের কাছে। তো, কি পাবে? একশোজনকে গ্রাহক করতে পারলে একটা সাইকেল পুরস্কার?
একজনই পারি না, একশো পাব কোথায়? আপনার কি মনে হয়? এবাড়িতে আর কেউ হবে?
বাড়িতে তো এখন কেউ নেই। সবাই কাজে গেছে। বিষ্যুৎবার তো।
ও, ঠোঁটের এক কোণ ঝুলে পড়ল কিশোরের। হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল পুলের কিনারে রাখা একটা চেয়ারে। লোকের কাছে জিনিস বিক্রি যে কত কঠিন…আপনি…আপনি…।
কি ব্যাপার? কি হয়েছে তোমার?
না না, কিছু হয়নি। আমাকে…এক গেলাস পানি খাওয়াতে পারেন?
হেসে উঠল মেয়েটা। পারব না কেন? বস। নিয়ে আসছি।
খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল ও, কুকুরটা গেল পেছনে। খানিক পরেই একটা জগ আর গেলাস নিয়ে বেরোল মেয়েটা, দরজা বন্ধ করে কুকুরটাকে আটকে রাখল ভেতরে।
কাছে এসে বলল, পাজি কুকুর। কিছুতেই সামলাতে পারি না।
মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলাসে চুমুক দিল কিশোর। ওর পাশে আরেকটা চেয়ারে বসল মেয়েটা, রোদ লাগে, তাই মুখ ফিরিয়ে রাখল।
রাতে চেষ্টা করা উচিত তোমার। তখন বাসায় থাকে লোকে।
তাই তো মনে হচ্ছে, চেহারাটাকে বোকা বোকা করে তুলল কিশোর। আচ্ছা, এখন কি কেউ নেই? আপনি তো আছেন। দিনে আর কেউ থাকে না?
থাকে, মাঝেসাঝে।
ও। আপনি কাজ করেন না?
করি। এখন করছি না।
ও। কেন, চাকরি চলে গেছে?
না, তা যায়নি। সিনেমায় কাজ করি তো, নির্দিষ্ট কোন টাইম নেই। মেকাপের কাজ। যখন শুটিং চলে, যাই, যখন চলে না, যাই না।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমার একজন বন্ধু আছে। তার বাবাও ছবিতে কাজ করেন। স্পেশাল ইফেক্ট বিশেষজ্ঞ।
কি নাম? হয়ত চিনব।
আমান। মিস্টার রাফাত আমান।
মাথা নাড়ল মেয়েটা। না, ওই নামে কাউকে চিনি না। উনি হয়ত অন্য স্টুডিওতে কাজ করেন। স্পেশাল ইফেক্টের লোকদের দাম আছে। একেকবার ভাবি, মেকাপ ছেড়ে ওই লাইনে চলে যাব কিনা। আবার ভাবি, না, মেকাপ মন্দ কি? তবে ইচ্ছে করলে মেকাপ করার পরেও স্পেশাল ইফেক্ট শেখার সময় পাব।
ইস্কুল-টিস্কুলে যান?
না, লেখাপড়ার ইস্কুলে যাই না। তবে অভিনয় শিখতে যাই। মিখাইল পালোসকির ওখানে। একদিন না একদিন সিনেমায় অভিনয়ের চান্স পাবই।
মাথা ঝোকাল কিশোর। ঘুম ঘুম চোখ। অনেকেই অভিনয় শিখতে চায়। তবে মেকাপ শেখা আরও সাংঘাতিক। গত হপ্তায় একটা ছবি দেখলাম। ওই যে, মন্দির থেকে মূর্তি চুরি করে লোকটা। দেবতার অভিশাপ লাগে তার ওপর।
ওরকম ছবি অনেক আছে। তা অভিশাপে কি হয়? সে-ও পাথর হয়ে যায়?
না না, তাহলে তো ভালই হত। সাপ হয়ে যায়। মুখটা মানুষেরই থাকে।
অ, স্নেকম্যান ছবির কথা বলছ। ভালই। ওটার মেকাপম্যানকে চিনি, নিরো বেকারো। গুণী লোক। অ্যাকাডেমি পুরস্কারই পেয়ে যাবে কোনদিন।
আপনি কোন স্পেশাল মেকাপ করেছেন? মানে রক্তচোষা মানুষ-বাদুড়, মায়ানেকড়ে…
নাহ, আমি জোয়ান লোককে বয়স্ক বানাই বেশি। কঠিন না কাজটা। দৈত্যদানব বা মায়ানেকড়ে বানাইনি কখনও।
তাই? আচ্ছা, কাটাকুটির দাগ বানাতে পারেন? ওই যে, অনেক ভিলেন আছে না, মুখে কাটা দাগ থাকে?
শ্রাগ করল মেয়েটা। সময় লাগে অনেক সময় দিলে অনেক কিছুই করা যায়। শুধু, মেকাপ করে বুড়োকে জোয়ান বানানো যায় না। চিহ্ন থাকবেই। পুরোপুরি লুকানো সম্ভব না। এই কিছুটা তাজা করা যায় আরকি। দেখ না, যত নামকরা অভিনেতাই হোক, বুড়ো হয়ে গেলে তাকে দিয়ে আর রোমান্টিক নায়কের অভিনয় করানো যায় না।
কথার ফাঁকে ফাঁকে গেলাসে চুমুক দিয়েছে কিশোর। পানি প্রায় শেষ। আরেক গেলাস চাইতে পারে। কিন্তু দরকার কি? আর তেমন কিছু জানার নেই। এক ঢোকে বাকি পানিটুকু শেষ করে গেলাসটা পাশের টেবিলে রেখে দিল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আর দেব?
না, লাগবে না। মিস্টার আমানকে আপনার কথা বুলব। বলা যায় না, কোন ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতেও পারেন দুজনে।
ভালই হবে।
ও, এতক্ষণ কথা বললাম, আপনার নামটাই জানা হল না।
সিনথিয়া ব্যানালিস। ডাক নাম সিনথি।
ও-কে। পানি খাইয়েছেন, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
গেট দিয়ে বেরিয়ে নার্সারি স্কুলের দিকে রওনা হল কিশোর। মনে মনে খুশি। বোকার অভিনয় করে অনেক কথাই জেনে এসেছে। কিন্তু মোড় নিয়ে ডেলটন অ্যাভেন্যুতে পড়েই গুঙিয়ে উঠল।
ট্রাকটা নেই। চলে গেছে মুসা আর বোরিস, বোধহয় তার দেরি দেখেই।
দূর! দেরি করতে বলা উচিত ছিল, জোরে জোরে বলল সে। বাস ছাড়া আর উপায় নেই।
উইলশায়ারের দিকে রওনা হল সে। হাঁটতে হাঁটতেই একটা সন্দেহ মাথা চাড়া দিল তার মনে।
১০
ডেস্কের ওপাশ থেকে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। লাঞ্চের পর হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে। সিনথিয়ার সঙ্গে কি কি কথা হয়েছে, জানিয়েছে দুজনকে।
ধর, কিশোর বলল। অন্ধ ভিক্ষুকটা যদি পুরুষ না হয়ে মেয়েমানুষ হয়?
এক মুহূর্ত ভাবল রবিন। মাথা নাড়ল। আমার মনে হয় না।
কিন্তু হতে তো পারে? সিনথি মেকাপ আর্টিস্ট। রোজারের সাথে পরিচয় আছে। মুসা, তোমার কথাই হয়ত ঠিক। সিনথির সঙ্গে ওই ডাকাতি, অন্ধ ভিখিরি আর মীটিঙের সঙ্গে কোন যোগাযোগ আছে।
ওই লোকটা সিনথি নয়, জোর দিয়ে বলল রবিন। খুব কাছে থেকে দেখেছি অন্ধকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। দু-দিন শেভ করেনি। মেকাপ করে ওরকম দাড়ি বানানো সম্ভব?
হুঁম্ম্! হতাশ হল কিশোর। যা-ই হোক, রোজারের কাছ থেকে ব্যাংকের খবর জানাটা তো কঠিন না, চেনা যখন। তারপর অন্ধ গালকাটাকে…।
কাটাটা নকল, রবিন বলল।
ভুরু কোঁচকাল কিশোর। লাইব্রেরিতে জেনে এসেছ নাকি?
হ্যাঁ, কোলের ওপর ফেলে রাখা বড় খামটা হাতে নিল। কয়েকটা ম্যাগাজিন বের করল ওটা থেকে। মেসা ডিওরো একটা দেশ বটে। ছোট, মাত্র পনেরো হাজার বর্গমাইল, লোক সংখ্যা চল্লিশ লাখের কম, কিন্তু গণ্ডগোল কম নয়। একটা ম্যাগাজিন খুলল সে। ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় কয়েক বছর আগে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছিল। সেটারই সারমর্ম তুলে দেয়া হয়েছে এই ম্যাগাজিনে। দেশটার ইতিহাস অনেকখানি জানা যায় শুধু এটুকু পড়লেই। একসময় স্প্যানিশ কলোনি ছিল ওখানে। তারপর আঠারশো পনেরো সালে ওদেশী জমিদারেরা একজোট হয়ে উৎখাত করল ওখানকার বিদেশী সরকারকে। নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করে নর্জুন সংবিধান চালু করল।
ভাল করেছে, মুসা বলল। কিন্তু এর সঙ্গে অন্ধ আর ডাকাতের কি সম্পর্ক?
হয়ত কিছুই না। আমি ব্যাকগ্রাউণ্ড বলছি। তারপর আঠারশো বাহাত্তর সালে একটা বিদ্রোহ হয়। অনেক লোক মারা যায়। মরছে এখনও।
রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আঠারশো বাহাত্তরে শুরু হয়ে এখনও চলছে? তুমি বানিয়ে বলছ।
আমাকে বলতে দাও, হাত তুলল রবিন। অনেকটা ফরাসী বিপ্লবের মত। ঊনিশশো সতেরো সালে রাশিয়ায়ও হয়েছিল এরকম। মেসা ডিওরোর জমিদারেরা ভয়ানক দুর্নীতি শুরু করল। দিনকে দিন বড়লোক হতে লাগল ওরা, গরিব হল আরও গরিব। তাদেরকে কিছুই দিত না ধনীরা। অথচ এসব জমির মালিক একসময় ওই গরিবেরাই ছিল। ওরা জাতে ইনডিয়ান।
অবশেষে হুয়ান করুসসা নামে এক ইনডিয়ান একটা দল গঠন করল। বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগল দেশের এখানে সেখানে। গরিবের অধিকার আদায়ের কথা বলল। তাকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দিল কর্তৃপক্ষ।
বিপ্লবের কথা বলছিলে তুমি, মনে করিয়ে দিল কিশোর।
সেকথাই তো বলছি। সাংঘাতিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ততদিনে কসো। তাকে জেলে ভরায় লোকে গেল আরও খেপে। দলে দলে রাজধানীতে এসে চড়াও হল ওরা, জেল থেকে বের করে আনল করসোকে। প্রেসিডেন্ট অ্যারতোরো রডরিগেজকে ধরে ফাঁসি দিয়ে দিল। প্রেসিডেন্টের ছেলে অ্যানাসত্যাসিও রডরিগেজ পাল্টা আক্রমণ চালাল। অনেক রক্তক্ষয় হল, কয়েকবার সরকার বদল হল। অবেশেষে কসোই হল প্রেসিডেন্ট। অ্যানাসত্যাসিও পালিয়ে গেল মেকসিকো সিটিতে।
ওখানে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেলেই ভাল হত, বলে যাচ্ছে রবিন। কিন্তু অ্যানাসত্যাসিও পরাজয় মেনে নিতে পারল না, রাজ্যহারা রাজার মত গুমড়াতে লাগল। কিন্তু কিছু করার ছিল না তার। জমিদাররা যারা বেঁচে রইল, তারাও পালিয়ে আসতে লাগল মেকসিকোয়, কারণ মেসা ডিওরোতে তাদের টেকা মুশকিল হয়ে উঠেছিল। শ্রমিকেরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। ভোট দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ধনীদেরকে বাধ্য করেছে বেশি ট্যাক্স দিতে।
হুঁ, বুঝতে পারছি শোচনীয় হয়ে পড়েছিল জমিদারদের অবস্থা,মুসা বলল।
খুবই শোচনীয়। একজোট হল আবার জমিদারেরা। পুরানো দিনের কথা মনে করে আফসোস করত তারা। বলত, আহা, কি সব দিনই না ছিল। প্রেসিডেন্ট অ্যারতোররার সময়। ওরা গঠন করল আরেকটা দল, দেশের মধ্যে থেকেই, নাম দিল সোলজার্স অভ দ্য রিপাবলিক। প্রতিজ্ঞা করল, তারা জিততে পারলে অ্যানাসত্যাসিওকে এনে প্রেসিডেন্ট করবে। পুরানো পতাকাই ব্যবহার করল ওরা, নীলের মাঝে সোনালি ওকপাতা। হুয়ান করুসসা নতুন পতাকা চালু করেছে, সবুজের মাঝে নীল।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। কিন্তু এসব তো ঘটেছে একশো বছরেরও বেশি আগে। আমাদের মক্কেলের সঙ্গে মেসা ডিওরোর রাজনীতির কি সম্পর্ক? নাকি এখনও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে জমিদারেরা? আগের প্রেসিডেন্টের ছেলের তো। এতদিনে মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা।
তাই তো গেছে। এখন সংগ্রাম চালাচ্ছে অ্যানাসত্যাসিওর নাতি, ফেলিপ রডরিগেজ। মেকসিকো সিটিতেই বাস করে। সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে ফেলিপ, কবে দেশে ফিরে গিয়ে সিংহাসনে বসবে, যে দেশকে সে চোখেই দেখেনি কখনও। অনেক গুপ্তচর আছে তার, দেশের খবরাখবর এনে দেয়।
আশ্চর্য তো! মুসা বলল। তিন পুরুষ পরে এখনও প্রসিডেন্ট হওয়ার শখ?
শখ হলে আর কি করা। তবে কথাটা সত্যি। ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স বলছে সোলজার্স, অভ দ্য রিপাবলিক দলটা বেআইনী নয় মেসা ডিওরোতে। দলের সদস্যরা রিপাবলিকান বলে পরিচয় দেয় নিজেদের। রোববারে জমায়েত হয়ে বিবৃতি-টিবৃতি দেয়।
বিরোধীরা কেয়ারও করে না। রিপাবলিকানদের কেউ কেউ চায় বর্তমান প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করতে। ওরা আবার আরেকটা বিশেষ নাম নিয়েছে, ফ্রিডম ব্রিগেড। ওদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, রাষ্ট্র, ওদেরকে আউট ল ঘোষণা করেছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে ওরা, কিডন্যাপ করে, বোমাবাজি করে। বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় অনেকে, পালিয়ে আসে মেকসিকো কিংবা আমেরিকায়।
তারমানে, ঢোক গিলল মুসা। কাল রাতে টেরোরিস্টদের সভায় যোগ দিয়েছিলাম? সন্ত্রাসবাদী? সব্বোনাশ!
হতে পারে, না-ও হতে পারে। মেসা ডিওরোর লোক অনেক আছে আমেরিকায়। সোলজার্স অভ দ্য রিপাবলিকের একদল সন্ত্রাস পছন্দ করে, আরেক দল করে না। তবে দুই দলই চায় ফেলিপ প্রেসিডেন্ট হোক। টাকা সংগ্রহ করে, দলের জন্যে।
চমৎকার!
সে যা হোক, এই তো গেল মেসা ডিওরোর রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের কাহিনী। এখন আসা যাক অন্ধের কথায় পুলিশের নাম শুনেই সে-রাতে ভয়ে পালাল অন্ধ। মিসেস নিকারোর স্বপ্নের কথা শুনে চমকে উঠল বিল। তুমি কাল রাতে দেখে এলে তার ছবি। বোঝাই যায়, ছবির ওই লোককে নেতা বানিয়েই মীটিং করছিল ওরা।
ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টালো রবিন। এই দেখ, তুলে দেখাল সে, বেশ বড় একটা ছবি। কালো চশমা, গালে কাটা দাগ। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, বক্তৃতার ভঙ্গিতে হাত তোলা। মুখ দেখেই বোঝা যায়, ছবিটা তোলার সময় চেঁচিয়ে কথা বলছিল। মুসা, এই ছবিটাই দেখেছিলে?
হ্যাঁ, এটাই। অবিকল এক চেহারা।
আমিও এই চেহারাই দেখেছি, তবে একেই কিনা জানি না। এর নাম লুই প্যাসক্যাল ডোমিনিগেজ ডি অ্যাট্রানটো। একসময় ফেলিপ রডরিগেজের সহযোগী ছিল। এ-ব্যাটা টেরোরিস্ট। মেসা ডিওরোতে বোমা মেরে চোদ্দটা বাচ্চাকে খুন করেছে একবার, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। দোষ চাপিয়েছে সরকারের ঘাড়ে। তার যুক্তি, শয়তান সরকার চেয়ার দখল করে আছে বলেই তাকে টেরোরিস্ট হতে হয়েছে, আর সে টেরোরিস্ট হয়েছে বলেই বাচ্চাগুলো মরেছে।
আস্ত ফ্যানাটিক, অনেকক্ষণ পর কথা বলল কিশোর। কিন্তু তুমি যাকে দেখেছ, সে আর এই ছবির লোক এক ময় বলে সন্দেহ করছ কেন?
কারণ অ্যাট্রানটো মৃত। মারা গেছে কয়েক বছর হল। কিছুক্ষণ নীরবতার পর জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। যদি সে মৃতই হয়।
তাকে কথা শেষ করতে দিল না কিশোর। কিন্তু চেহারা তো অবিকল এক। রবিন, অ্যাট্রানটো কি অন্ধ ছিল?
হ্যাঁ। এক ওয়্যারহাউসে আগুন লাগাতে গিয়ে হয়েছিল। নিজের আগুনে নিজেই। এতেই হিরো হয়ে যায় সে।
তাহলে অন্ধ ভিক্ষুক আর অ্যাট্রানটোর চেহারা এক, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। শুধু মেকাপ আর একটা কালো চশমা দরকার, কাউকে অ্যাট্রানটো বানানোর জন্যে। আমি ভাবছি, এসবের পেছনে সিনথিয়ার হাত নেই তো? কিন্তু কেন কেউ ওই ছদ্মবেশ নেবে? কি লাভ তার? কেউ…।
ফোন বাজল। বাধা পেয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল কিশোর। তারপর তুলে নিল রিসিভার। হ্যালো…ও, মিস্টার রোজার!
এক মিনিট চুপচাপ শুনল সে। তারপর বলল, হুঁ, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। যদি বলেন, আসতে পারি। এমনিতেও আপনার সঙ্গে কথা আছে।
আরেক মিনিট শুনল। বলল, হ্যাঁ। আসতে আধ ঘন্টা লাগবে।
রিসিভার রেখে দিল কিশোর। আবার রোজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। খুব মুষড়ে পড়েছে। দেখি, যাই, কি বলে? সিনথিয়ার কথাও জিজ্ঞেস করতে হবে। দুই সহকারীর দিকে তাকাল সে। মেয়েটার ওপর নজরও রাখতে হবে আমাদের। বিলের দলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা জানা দরকার।
আমার দিকে চেয়ে লাভ নেই, মাথা নাড়ল মুসা। মা-র কড়া আদেশ, বিকেলের মধ্যে লনের ঘাস কেটে সাফ করতে হবে। আর আমাদের বাগানে যা ঘাসরে, ভাই, জানই তো। এক হপ্তায় ছইঞ্চি হয়ে যায়, আরও পেয়েছে বৃষ্টি। থামল এক মুহূর্ত। তাছাড়া, মেয়েটা আমাকে চিনে ফেলার ভয় আছে।
রবিন? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল কিশোর।
আমি পারব। বিকেলে কাজ নেই।
হুঁশিয়ার, সাবধান করে দিল মুসা। বোমা মেরে যারা শিশু খুন করতে পারে, তাদেরকে বিশ্বাস নেই। জানোয়ারেরও অধম।
১১
আধ ঘন্টা পর রোজারের দরজায় টোকা দিল কিশোর। খুলে দিল রক রেনাল্ড। গলাবন্ধ কালো শার্ট গায়ে, চোখে সানগ্লাস।
ও, তুমি, রক বলল। আমাদের মহাগোয়েন্দা। কিছু জেনে এসেছ? রোজার খুশি হবে তো?
রেগে গেল কিশোর। কিছু বলল না। ঝকঝকে পরিষ্কার লিভিং রুম পেরিয়ে রান্নাঘরে এসে ঢুকল। জানালার ধারে সেই একই জায়গায় চেয়ারে বসে আছে রোজার, হাতে কফির কাপ। তার সামনাসামনি বসল কিশোর। কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করল রক।
কফি খাই না, ভদ্রভাবে বলল সে।
নিশ্চয়, রক বলল। ভুলেই গিয়েছিলাম, আমেরিকান ছেলেরা কফি খায় না। তোমাকে কিন্তু আমেরিকান লাগছে না।
আঙুরের রস মেশানো সোডা আছে, রোজার বলল। খাবে?
কিছুই লাগবে না আমার, ধন্যবাদ। লাঞ্চ সেরেই চলে এসেছি।
আমি জানতাম বাচ্চারা খাওয়া পেলেই খায়, পেটে জায়গা থাক আর না থাক, বলল রক। তুমি কি আলাদা? স্বাস্থ্য দেখে অবশ্য মনে হয় না, খাওয়ার প্রতি তেমন টান আছে।
অনেক কষ্টে চেহারা স্বাভাবিক রাখল কিশোর।
খাও না কেন? এই বয়সেই ডায়েট কন্টোল?
জবাব দিল না কিশোর। আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
স্টোভের কাছে ফিরে গেল রক। কেটলিতে পানি ফুটছে। কাপে ইনসট্যান্ট কফি বানিয়ে নিয়ে এসে বসল দুজনের কাছে। টেবিলে রাখা চিনির পাত্র থেকে চিনি নিয়ে কাপে মিশাল।
তারপর, কি খবর নিয়ে এলে? জিজ্ঞেস করল সে।
এই আরকি, কিশোর বলল। তেমন কিছু না।
তেমন কিছু পেলে কি করতে?
অবশ্যই পুলিশকে জানাতাম। –
হ্যাঁ, সেটাই উচিত। কফি শেষ করে উঠে গিয়ে কাপটা সিংকে ভেজাল রক। বেরিয়ে গেল। ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হল। রান্নাঘরের জানালার পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা নতুন মডেলের স্পোর্টস কার।
বিমর্ষ হয়ে আছে রোজার।
পুলিশ এসে দোষী বলেনি তো আপনাকে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল রোজার। নাহ, তবে একই গল্প তিনবার বলিয়েছে আমাকে দিয়ে। কিশোরের দিকে তাকাল সে। ওরা চাইছে আমি একটা ভুল করে বসি। কিন্তু আমি…আমি ভুল করছি না।
সত্যি যা ঘটেছে, তা হাজারবার বললেও ভুল হওয়ার কথা নয়। মিস্টার রোজার, আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। আপনি একটা দুর্ঘটনার শিকার মাত্র। পুলিশও নিশ্চয় বুঝতে পারছে। আপনার জায়গায় অন্য কোন গার্ড থাকলেও একই ব্যাপার ঘটতে পারত। ডাকাতেরা যে মারধর করেনি, এইই বেশি।
না, তা করেনি। বরং বলা যায় দ্র ব্যবহারই করেছে। বিশেষ করে যে লোকটা কথা বলছিল।
কান খাড়া করে ফেলল কিশোর। কথা কি শুধু একজনই বলেছে?
হ্যাঁ, ঝাড়ুদারের ছদ্মবেশে যে এসেছিল।
সব কথা? আর কেউ কিছু বলেনি?
না, কিছু বলেনি।
পুরো একটা রাত তিনজন লোকের সঙ্গে কাটালেন, দুজন কোন কথাই বলল?
না।
একটা বর্ণও না?
না। তুমি বলায় এখন আমার কাছেও অদ্ভুত মনে হচ্ছে ব্যাপারটা।
হুম। ডাকাতদের কেউ কি মেয়েলোক ছিল? বোঝা গেছে?
মেয়েলোক! তা হতেও পারে। তিনজনেই প্রায় একই রকম লম্বা। পাঁচ ফুট সাতের মত। ঢোলা শার্ট আর ওভারঅল, পরে এসেছিল। হাতে গ্লাভস। মুখে এত কিছু লাগিয়েছিল, কে যে পুরুষ আর কে মেয়ে বোঝাই যায়নি। দুজন পরেছিল সানগ্লাস, আয়নার মত কাচ, চোখ দেখা যায়নি। একজনের দাড়ি ছিল, আমার মনে হয় নকল। আরেকজনের লাল পরচুলা, লাল গোঁফ। ভুরু এত মোটা, প্রায় চোখের ওপর এসে ঝুলে পড়েছিল।
যে কথা বলছে তার কথায় বিদেশী টান ছিল? বয়েস কম, না বেশি?
বুড়ো মানুষের গলা নকল করছিল। আমার বিশ্বাস, সে অল্পবয়েসী। বিশতিরিশের বেশি না। না, কথায় টান ছিল না।
আবার হুম্! বলে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল কিশোর। তারপর বলল, মিস্টার রোজার, আপনি নিকারো অ্যাণ্ড কোম্পানিটা চেনেন? ফিশিং কোম্পানি। বোটও ভাড়া দেয়। ম্যালিবুর পরে ওদের ডক।
চিনি। আমার ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যেতাম, তখনও সে বিয়ে করেনি। মিসেস নিকারোকেও চিনি। এককালে সুন্দরী ছিল মহিলা। তার ছেলের বৌ এলসিকেও চিনি। মেয়েটা আইরিশ। সে-ও, সুন্দরী। খুব অল্পবয়েসে স্বামী মারা গেছে। বোট অ্যাক্সিডেন্ট। সেদিন এলসিই বোট চালাচ্ছিল। লাইসেন্স আছে তার।
ওদের ওখানে বিল নামে একটা লোক কাজ করে।
করে নাকি? আমরা যখন যেতাম, তখন ওই নামে কেউ ছিল না। জিম না কি যেন, এরকমই নাম ছিল একটা ছোকরার। ঘন ঘন লোক বদলায় হয়ত ওরা।
ইদানীং কখনও গিয়েছেন?
না।
তাহলে বিলকে চিনবেন না। অন্ধের ব্যাপারে কিছু জানেন?
অন্ধ? শূন্য দৃষ্টি ফুটল রোজারের চোখে। লোক?
হ্যাঁ। ডাকাতরা যখন ঢোকে, ওকেও দেখা গেছে ব্যাংকের কাছাকাছি। গালে কাটা দাগ। চোখে কালো চশমা। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসেছিল।
মাথা নাড়ল রোজার। বলতে পারব না।
আজ সকালে একটা মেয়েকে দেখলাম, আপনি যখন তাস খেলা দেখছিলেন? মেয়েটা কে?
সিনথিয়া ব্যানালিস? তুমি জানলে কি করে?
আপনার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি।
কি হয়েছে তাতে? একটা মেয়ের বয়েসী মেয়ে কি কোন বুড়োর সঙ্গে কথা বলতে পারে না?
পারে, আমি সেকথা বলছি না। গোয়েন্দাদের কোন কিছুই উপেক্ষা করতে নেই। সিনথিয়ার সঙ্গে আপনার কেমন পরিচয়?
দেখা হলে কথা বলি। সময় পেলেই কুকুর নিয়ে বেরোয়, হাঁটাহাঁটি করে। মনে হয় কোন সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করে। ভাল মেয়ে। দেখা হলে দাঁড়াবেই। দুচারটা কথা না বলে যাবে না।
আপনি ব্যাংকে চাকরি করেন, একথা জানে?
কি জানি। বলেও থাকতে পারি। কোন তথ্য জানতে চেয়েছে কিনা এটাই তো জানতে চাইছ? চায়নি। জাস্ট কথা বলে।
অ। তা আরও বন্ধু নিশ্চয় আছে আপনার। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন? ব্যাংকের কাজকর্ম সম্পর্কে?
করি। তবে কেউ এ নিয়ে ইন্টারেস্টেড হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না।
রক রেনাল্ড?
ও নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, এসব ফালতু আলোচনার সময় কই? বাইরে বাইরেই থাকে বেশি। এখানে যখন থাকে, তখনও কথা বিশেষ হয় না। খাওয়ার সময় খায়, বাকি সময় ঘরে দরজা আটকে বসে থাকে। মিথ্যে কথা বলছি না। ওর দরজার তালা দেখবে?
দরকার নেই, উঠে দাঁড়াল কিশোর। হতাশ হবেন না, মিস্টার রোজার। পুলিশ ঘন ঘন আসে, বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করে, তার কারণ, ওদের ধারণা আপনি কোন জরুরি তথ্য জানাতে ভুলে যাচ্ছেন। কয়েক বার বললে হয়ত মনে পড়বে, এই আরকি।
জবাব দিল না রোজার।
সাড়ে চারটা নাগাদ ইয়ার্ডে ফিরে এল কিশোর। গেট দিয়ে না ঢুকে চলে এল বেড়ার পেছনে, যেখানে ছবিতে আঁকা একটা মাছ মাথা তুলে একটা জাহাজকে দেখছে। মাছের চোখ টিপল সে। ওপরে উঠে গেল দুটো বোর্ড। বেরিয়ে পড়ল প্রবেশ পথ, তিন গোয়েন্দার কয়েকটা গোপন পথের একটা। এটার নাম সবুজ ফটক এক।
ওখান দিয়ে ঢুকে আউটডোর ওঅর্কশপে এসে ঢুকল কিশোর। মুসার সাইকেলটা আছে। মুচকি হেসে নামিয়ে দিল আবার বোর্ড দুটো।
এই সময় কানে এল শব্দটা। কাপড়ের মৃদু খসখস আর নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ।
ঝট করে ফিরে তাকাল সে।
দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধ ভিক্ষুক! মাথা সামান্য কাত করে রেখেছে, গালের কাটা, দাগটা কিশোরের দিকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি এখন নেই। লাঠিও নেই হাতে। কাটা দাগের কারণে ভয়ঙ্কর লাগছে মুখটা।
একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল কিশোরের। তারই মত লোকটাও স্থির হয়ে আছে। শ্বাস টানল কিশোর, নড়ে উঠল লোকটা। আরেকটু কাত করল মাথা, চমুকে গেছে বোঝা যায়। হাতে কি যেন আছে, তার ওপর আঙুলগুলো শক্ত হল।
হঠাৎ মাইকেলের হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপ দিল কিশোর। চেপে ধরল লোকটার হাত।
চেঁচিয়ে উঠে ঝাড়া মেরে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল লোকটা।
ছাড়ল না কিশোর, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছে। কজিতে মোচড় দিতে লাগল দুহাতে। লোকটার আঙুল খুলে গেল, মাটিতে পড়ে গেল হাতের জিনিস।
গায়ের জোরে ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়াল লোকটা। তারপর হামলা চালাল। প্রচণ্ড ঘুসি এসে লাগল কিশোরের চোয়ালে। চোখে সর্ষে ফুল দেখল সে। বো করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। অবশ হয়ে গেল দেহ।
খুব সামান্য সময়ের জন্যে জ্ঞান হারাল কিশোর। চোখ মেলে দেখল, তাকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে লোকটা। পৌঁছে গেল সবুজ ফটক এক-এর কাছে। ওপরে উঠল বোর্ড দুটো, আবার নামল। বেরিয়ে গেছে অন্ধ ভিক্ষুক।
১২
মাটিতে বসে আছে কিশোর। অল্প অল্প মাথা ঘুরছে এখনও। দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই লোকটার ফেলে যাওয়া জিনিসটার ওপর চোখ পড়ল। ওঅর্কবেঞ্চের নিচে। প্লাস্টিকের বাক্স, একপাশে কিছু ছিদ্র।
ইনটারেসটিং, বলল সে। যেন তার কথার জবাবেই দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা সরিয়ে উঁকি দিল মুসা। জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? কি বলছ?
মেহমান এসেছিল, বলে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল জিনিসটা তোলার জন্যে। হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কোন ধরনের শ্রবণ যন্ত্র। একধরনের খুদে মইক্রোফোন, স্পাইরা বলে বাগ। পত্রিকায় ছবি দেখেছি। অন্ধ লোকটা এসেছিল, বুঝলে, মোটেই অন্ধের মত আচরণ করেনি। মনে হয় ওঅর্কশপে মাইক্রোফোন লাগানোর জন্যে এসেছিল।
কানা ফকিরটা? কিশোরের হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। কেন লাগাবে? আমাদের খোঁজই বা পেল কিভাবে? চারপাশে তাকাল সে, যেন এখনও এখানেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে লোকটা। আশ্চর্য!
ওঅর্কবেঞ্চের কাছে চেয়ারে বসল কিশোর। মুসার হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে পেনোইফ দিয়ে খুলল। যা বলেছি। মিনিয়েচার ব্রডকাস্টিং ইউনিট। রেঞ্জ বড় জোর কোয়ার্টার মাইল।
এখন চালু নেই তো? আমরা যা বলছি, সব শুনে ফেলছে না তো ব্যাটা?
ছুরির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা পার্টস খুলে ফেলল কিশোর। বাক্সটা বন্ধ করতে করতে বলল, এবার পারলে শুনুক। পুরো এক মিনিট নীরবে ভাবল সে, তারপর মুসার দিকে তাকাল। স্যালভিজ ইয়ার্ডে কতক্ষণ আগে ঢুকেছ?
মিনিট বিশেক।
সবুজ ফটক এক দিয়ে?
হ্যাঁ।
গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। তোমার পিছে পিছেই এসেছে ব্যাটা। মনে হল।
কি করে?
কাল রাতে মীটিঙেই হয়ত তোমার ওপর নজর পড়েছে। অনুসরণ করে এসেছে এখানে। কিংবা আমাদের দুজনকেই দেখেছে নিকারোদের ওখানে। কিংবা তিনজনকে, মিস্টার রোজারের বাড়িতে। যেভাবেই হোক, গত তিন দিনে কোন এক সময় তার চোখে পড়েছি আমরা, বা আমাদের কেউ। ভাবছি, আর একআধটা বাগ লুকিয়ে রেখে যায়নি তো?
আবার চারপাশে তাকাল মুসা, যেন তাকালেই যন্ত্রটা চোখে পড়বে। তারপর খুঁজতে শুরু করল দুজনে। পাওয়া গেল না। জিনিস নড়াচড়া করা হয়েছে, এমন কোন চিহ্নও নেই। আগের মতই আছে ওঅর্কশপকে ঘিরে রাখা জঞ্জাল।
অস্বস্তিতে পড়ে গেছে মুসা। বাড়ি থেকে এসেছি আমি। আমাকে অনুসরণ করলে…আচ্ছা, আমাদের বাড়ির ওপর চোখ রাখেনি তো?
মনে হয় না। ইয়ার্ডের ওপর চোখ রাখলেই যথেষ্ট।
হাতুড়ি আর পেরেক বের করে সবুজ ফটক, এক-এর বোর্ড দুটো সাময়িকভাবে আটকে দিতে চলল কিলোর। এই সময় এল রবিন। তিনজনে মিলে আটকে দিল ফটকটা। তারপর হেডকোয়ার্টারে ঢুকল।
ইন্টারেস্টিং নিউজ আছে, রবিন বলল। বিল এসেছিল সিনথিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। চেহারা দেখে চিনেছি, তোমার বর্ণনার সাথে মিলে যায়। পুলের পাড়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেঁচাল দুজনে, তর্কাতর্কি করল। স্প্যানিশ ভাষায়।
ঠিক? ভুরু কোঁচকাল মুসা।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। বেশি চেঁচাল মেয়েটাই। কিছু একটা বোঝনোর চেষ্টা করেছে বিল, শুনতে চায়নি সিনথিয়া। শেষে লোকটাও গেল রেগে। চেঁচামেচি শুনে পাশের বাড়ির এক মহিলা বেরোল, গলিতে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনল খানিকক্ষণ। তারপর পুলিশ ডাকার হুমকি দিল।
আর থাকতে সাহস করল না লোকটা। সে চলে যেতেই ঘরে ঢুকে হ্যাণ্ডব্যাগ নিয়ে এল সিনথিয়া। কয়েক মিনিট পরে দেখলাম একটা গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছে। আরও আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলাম। আসছে না দেখে চলে এসেছি।
হুঁম! মাথা দোলাল কিশোর। কি নিয়ে ঝগড়া করল কে জানে। যাকগে। এখন দেখি, আমরা কতটা এগিয়েছি? টেবিলে কনুই রেখে সামনে ঝুঁকল সে। অন্ধ ফকির ডাকাতিতে জড়িত, এটা বলা যায় এখন। বিল জড়িত, তার দুই বন্ধু জড়িত। বিল আর মিস্টার রোজারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে সিনথিয়ার। যেহেতু সে মেকাপ আর্টিস্ট, সন্দেহ করতে বাধা কোথায় সে-ই মেকাপ করে কাউকে অ্যাট্রানটো বানিয়েছে? সে নিজেও পুরুষ সেজে ডাকাতিতে গিয়ে থাকতে পারে। রোজার বলেছে, তিনজন ডাকাতের মাত্র একজন কথা বলেছে, অন্য দুজন। কিছুই বলেনি।
মেয়েলি গলা চিনে যাবে, এই ভয়ে? মুসার প্রশ্ন।
হতে পারে। কিংবা ওরা ইংরেজি জানে না। স্প্যানিশ বললে ধরা পড়ার ভয় আছে। হয়ত মেসা ডিওরোর নাগরিক ওরা।
বিলের দুই বন্ধুও হতে পারে, বলল মুসা। কোত্থেকে এসেছে ওরা, বলতে পারব না। স্প্যানিশ বলেছিল। হয়ত ইংরেজি জানেই না।
বিল জানে। দুটো ভাষাই জানে চমৎকার। ওদের সম্পর্কে ভালমত খোঁজখবর করা দরকার। রবিন, নিকারোদের ওখানে এখন একমাত্র তোমাকেই কেউ চেনে না। জেটির কাছে গিয়ে চোখ রাখবে। পারবে তো?
পারব।
আমি যাব সিনথিয়াদের ওখানে। মুসা, তুমি হেডকোয়ার্টারেই থাক। কানাটা আবার আসতে পারে। নাম তো জানি না ব্যাটার, কানা না হলেও কানা বলতে হচ্ছে।
গালকাটাও বলা যায়, মুসা বলল। যদিও সত্যি কাটা কিনা বলা মুশকিল। এলে কি করব? পুলিশকে ফোন করব?
পারলে অবশ্যই করবে। খুব সাবধানে থাকবে। আমাদের ঠিকানা জেনে গেছে সে। হয়ত জানে, কিংবা আন্দাজ করেছে আমরা কি করছি। একবার পালিয়েছে বটে, আবার না-ও পালাতে পারে। বাগের বদলে বোমা ফেলে গেলে সর্বনাশ!
১৩
মজার কাজ করছেন, রবিন বলল।
জেটির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে। শুক্রবারের সকাল। জোয়ার নেমে গেছে। বিল রয়েছে টিনার ডেকে, হুইলহাউসের দেয়াল রঙ করছে। জবাব দিল না লোকটা। এমনকি মুখ তুলেও তাকাল না।
গত বছর আমাদের বাড়ি রঙ করা হয়েছিল, আবার বলল রবিন। মিস্ত্রিদের সাহায্য করেছিলাম। জানালার চৌকাঠগুলো রঙ করেছিলাম আমি।
ফিরে তাকাল বিল। হাতের ব্রাশের দিকে তাকাল একবার। হুইল হাউসের কাছ থেকে সরে এসে ওটা বাড়িয়ে দিল রবিনের দিকে।
লাফ দিয়ে ডেকে উঠল রবিন। হেসে ব্রাশটা নিয়ে রঙ.শুরু করল। তার কাজ দেখছে বিল।
কয়েক মিনিট নীরবে ব্রাশ ঘষল রবিন। তারপর বলল, বাহ, বোটে রঙ করা তো আরও মজার।
ঘোঁৎ করল শুধু বিল।
একবার বোটে করে বেড়াতে গিয়েছিলাম, রবিন বলল। বন্ধুর চাচার সঙ্গে। কি যে দারুণ লাগছিল না। হঠাৎ ঝড় এসে সব মজা নষ্ট করল। বানিয়ে বানিয়ে সমুদ্র যাত্রার রোমাঞ্চকর এক গল্প বলতে লাগল সে। বিল না হাসা পর্যন্ত বলেই গেল।
হ্যাঁ, একে বলে সী-সিকনেস, বলল বিল। বমি আর পেসাব-পায়খানা করে সব নষ্ট করে ফেলে। আমার অবশ্য কখনও ওরকম হয়নি।
বিলও একটা ভয়াবহ ঝড়ের গল্প শোনাল। শুনে অবাক হওয়ার ভান করল রবিন। যেন সমুদ্র সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই এমন ভাব করে নানারকম প্রশ্ন করল। কিন্তু দরকারি কিছু জানার আগেই জেটিতে এসে দাঁড়াল দুজন লোক। স্প্যানিশ ভাষায় ডাকল। ফিরে তাকাল বিল। রবিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একজন ইশারা করল বিলকে, নেমে গেল সে। হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গেল।
কথা বলছে তিনজনে। এতদূর থেকে শোনা যায় না। কিন্তু ওদের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করল রবিন। হাত তুলে তীরের দিকে দেখাল একজন। আরেকজন দেখাল উত্তরে, যেন বোঝাচ্ছে ওদিক থেকে উপকূল ধরে কিছু আসছে। শ্রাগ করল বিল। হাত তুলে ঝাঁকাল একজন। অন্যজন ঘড়ি দেখিয়ে জরুরি কিছু বলল বিলকে।
অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল বিল। অন্য দুজন হাঁটতে লাগল পুরানো একটা ছোট কেবিনের দিকে। রবিন অনুমান করল, ওরাই বিলের রুমমেট।
রবিনের কাজের প্রশংসা করল বিল।
দারুণ স্প্যানিশ বলেন তো আপনি, রবিন বলল। আপনার বন্ধুরাও।
আমার সেকেণ্ড ল্যাংগুয়েজ। আমার বন্ধুরা এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, ভাল ইংরেজি বলতে পারে না। তাই ওদের সঙ্গে স্প্যানিশই বলতে হয়।
পার্কিং লটের কাছে বাড়িটা থেকে মিসেস নিকারোকে বেরোতে দেখল রবিন। হাতের ট্রেতে একটা থার্মোস জগ আর কয়েকটা কাপ। বাড়ি আর ছোট অফিসটার মাঝামাঝি পৌঁছে এদিকে ফিরে তাকাল মহিলা। রবিনের হাতে ব্রাশ দেখেই বুঝে থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। প্রায় তিরিশ মিটার দূর থেকেও মহিলার চেহারার উত্তেজনা নজর এড়াল না রবিনের।
কয়েক সেকেণ্ড পর গিয়ে অফিসে ঢুকল মিসেস নিকারো। একটু পরেই অফিস থেকে বেরিয়ে জেটির দিকে এগিয়ে এল এলসি। গায়ে নীল ওঅর্ক শার্ট, গলার কাছটায় খোলা। একটা নীল-সাদা রুমাল বাঁধা গলায়। পরনে রঙচটা জিনস, পায়ে মলিন স্নিকার। রেগে আছে মনে হল।
রঙ তো তোমার করার কথা, কাছে এসে বলল এলসি। গলা চড়াল না বটে, তবে কণ্ঠে ঝাঁঝ ঠিকই প্রকাশ পেল।
ছেলেটা সাহায্য করতে চাইল, তাই, মিনমিন করে বলল বিল। রঙ করতে নাকি ভাল লাগে।
ঠিকই, ম্যাডাম, খুব ভাল লাগে আমার।
বেশ, যা করেছ করেছ, বাকিটা বিল করবে। আমার শাশুড়ি দেখা করতে। বলেছে তোমাকে।
আমাকে? নিজের বুকে হাত রাখল রবিন।
অফিসে আছে, অফিসটা দেখাল এলসি। তোমাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলল। ব্রাশটা দিয়ে চলে এস। বিল, শোন, বেশি দেরি কর না। লারমারদের ওখানে গিয়ে তেল আনতে হবে আমাদের। তেতাল্লিশজন লোক আসবে কাল সকালে, সাতটায়। সময় বেশি নেই হাতে। সব রেডি রাখতে হবে।
আচ্ছা, বলে জোরে জোরে ব্রাশ ঘষতে আরম্ভ করল বিল।
হাসল রবিন। বুঝল, আদেশ দিতে এবং সেটা মানাতে পছন্দ করে এলসি নিকারো। আগে আগে প্রায় লাফাতে লাফাতে চলল সে, হাঁটার তালে তালে নাচছে লাল চুল। পিছে চলল রবিন। ওরা ঢোকার আগেই দরজায় এসে দাঁড়াল মিসেস নিকারো।
বাড়িতে যাচ্ছি, বউকে বলল মহিলা। রবিনের দিকে ইশারা করে বলল, ইয়াং ম্যান, তুমি এস আমার সঙ্গে।
চলল রবিন। অবাক হয়ে ভাবছে, ঘটনাটা কি? লিভিং রুমে নিয়ে এল তাকে মহিলা। বিদেশী গন্ধ যেন সব কিছুতেই লেগে রয়েহে, এমনকি পিঠ উঁচু আর্মচেয়ার আর লম্বা, বিচ্ছিরি দেখতে সোফাগুলোতেও।
বস, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল মহিলা।
দুজনেই বসল। মিসেস নিকারোর পরনে কালো পোশাক। কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখল হাত। রবিনের দিকে তাকাল। চোখের সে-তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সইতে পারল না রবিন, মুখ ফেরাল।
তোমাকে আগে দেখেছি, মহিলা বলল।
আ-আমার মনে হয় না।
না হলে কি হবে, আমি দেখেছি। স্বপ্নে। বাস্তবে দেখব ভাবিনি।
জবাব আশা করছে মিসেস নিকারো। কিন্তু কি জবাব দেবে রবিন? কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন। খানিক পর জোর করে মুখ দিয়ে যা বের করল, সেটা কাশি আর কোলাব্যাঙের ঘড়ঘড়ানির মিশ্রণ। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি…আমি শুধু সাহায্য করছিলাম…আগে আর কক্ষণও এখানে আসিনি…। থেমে গেল সে। মিসেস নিকারো ভুল করছে, একথা প্রমাণ করে তার মনে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে নেই রবিনের কিন্তু মহিলা ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। বিশ্বের এই আধুনিকতম শহরে এই শতাব্দিতে যেন মানায় না মহিলাকে। তার জন্মানো উচিত ছিল পৌরাণিক আমলে, গুহায় বসে লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ বলত আর তাদেরকে হুঁশিয়ার করত।
ঘরটা গরম। তবু শীত শীত লাগল রবিনের।
হাত কোলের ওপর রেখেই সামনে ঝুঁকল মহিলা। মুখে বয়েসের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হল আরও। এখানে থাকার কথা নয় তোমার। নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ। সেটা কী?
কো-ক্কোন উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে রবিন। এমনি…এমনি এসেছি…সময় কাটাতে…। চোখ সরিয়ে নিল আরেকদিকে। ভয়, মহিলা তার মনের কথা পড়ে ফেলবে।
বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি চলে যাও। আর কখনও এখানে আসবে না। আমার কথা না শুনলে বড় বিপদে পড়বে। সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটবে। আমার স্বপ্নে ভয়াবহ ঝড়ের মধ্যে দেখেছি তোমাকে। প্রচণ্ড শব্দ হল। ঝড়ের কেন্দ্র থেকে নিচে পড়তে লাগলে তুমি, নিচে, নিচে, আরও নিচে…ফাঁক হয়ে গেল ধরণী, তলিয়ে গেলে তুমি।
হাত কাঁপছে রবিনের। শান্ত করার চেষ্টা করল। কিশোরের মুখে শুনেছে, মহিলার স্বপ্ন নাকি ফলে যায়। কিশোরও অবশ্য শুনেছে অন্যের মুখে। ধরণী ফাঁক হয়ে গেল বলে কি বোঝাতে চাইল? ভূমিকম্প? তাহলে আর হুঁশিয়ার করে লাভ কি? শুধু জেটিতে না এলেই কি ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাবে রবিন?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা, যেন ফুঁসে উঠল একটা সাপ। নিশ্চয় ভাবছ আমি পাগল। তোমাকে বলা হয়ত উচিত হয়নি। ফিরে গিয়ে ছেলেমেয়ের দল নিয়ে আসবে হয়ত, পাগলি বুড়ি; ডাইনী বুড়ি, ইটালিয়ান ভূত বলে খেপাবে আমাকে। কিন্তু সত্যি বলছি, তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি আমি। তোমার মৃত্যুর সময় ওখানে হাজির ছিলাম!
সামনের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল এক ঝলক বিশুদ্ধ হাওয়া। কাছে এসে দুজনের মুখের দিকে তাকাল এলসি। জোর করে হাসল। কি ব্যাপার? নিশ্চয় আরেকটা দুঃস্বপ্ন, নাকি?
যদি হয়, কি করবে? ভুরু কোঁচকাল বৃদ্ধা। রবিনের হাঁটু ছুঁল। আমি বুঝেছি, এই ছেলেটা ভাল, পরিশ্রমী। সেজন্যেই চলে যেতে বলছি। ওর ভাল চাইছি বলে। নইলে আমার কি ঠেকা? উঠে দাঁড়াল মিসেস নিকারো। যাই। অনেক কাজ। বিকেলেই মেহমান আসছে। সব কিছু গুছিয়ে রাখতে না পারলে…।
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল মিসেস নিকারো।
তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? এলসি জিজ্ঞেস করল।
না, ঠিক আছি। থ্যাংক ইউ।
ঘরটা আর সহ্য করতে পারছে না রবিন। মনে হল, তার গায়ের চামড়ায় কিলবিল করছে হাজারখানেক শুয়োপোকা। দমকা হাওয়ার মত ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে।
১৪
সৈকত ধরে এগিয়ে আসছে বিলের দুই বন্ধু। এখনও হুইলহাউস রঙ করার্য ব্যস্ত বিল। বিশ মিনিট আগে সব কিছু যেমন দেখে গিয়েছিল রবিন, তেমনি রয়েছে, শুধু বদলে গছে তার মন। বিপদ আসছে! হুঁশিয়ার করে দিয়েছে তাকে মিসেস নিকারো।
হাইওয়ের একশো মিটার ভাটিতে একটা খুদে শপিং প্রাজা। একটা ছোট মার্কেট, একটা পোবাখানা আর একটা রীয়্যাল-এস্টেট অফিসও দেখতে পেল রবিন। মার্কেটের সামনে টেলিফোন বুদ। গিয়ে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে ফোন করল সে।
সঙ্গে সঙ্গে ধরল মুসা। রবিনের গলা শুনে বলল, ভল আছ?
ভালই। মিসেস নিকারোর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, সব খুলে বলল রবিন।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর মুসা বলল, রবিন, ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না। তুমি চলে এস। একা আসতে পারবে? না আমি আব?
দরকার নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই, মুসাকে নয়, নিজেকে বোঝাল রবিন।
আসবে না? খুব সাবধানে থাকবে তাহলে, বুঝেছ?
থাকব। এখন আসা ঠিক হবে না। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে। বিলের দুই দোস্তের কথা মনে আছে না? ওরা ঘোরাঘুরি করছে ডকের কাছে। কোন কারণে উত্তেজিত।
হাইওয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল একটা পিকআপ ট্রাক। নিকারোদের ড্রাইভওয়ে ধরে গিয়ে থামল পার্কিং লটে খাকি পোশাক পরা লম্বা এক লোক নেমে এগিয়ে গেল জেটির দিকে।
ফোনের কাছে থাক, বলে লাইন কেটে দিল রবিন।
হাইওয়ের ধারে গাড়ি জমছে-ক্যাম্পারদের ভ্যান, কার এ-সবই বেশি। ওগুলোকে এক পাশে, জেটিকে অন্য পাশে রেখে মাঝখান দিয়ে এগোল রবিন।
টিনার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বিলের দুই বন্ধু। ওদের কাছে এগিয়ে গেল লম্বা লোকটা। ওদের কথা শোনার জন্যে থামল রবিন। রেগে গেছে বিল, তার হাত নাড়া দেখেই বোঝা যায়।
একটা ভ্যানের পাশ ঘুরে বালিতে নামল রবিন, সৈকত ধরে এগোল জেটির দিকে। চলে এল একটা খিলানের নিচে, খেয়াল করল না লোকগুলো। খিলানের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে তার সাইকেল। সেদিকে একবার তাকিয়েই হাঁটা দিল পানির দিকে।
পানির কিনারে পৌঁছে থামল। কান পাতল কথা শোনার জন্যে। চারজনের গলাই শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারল না.কিছু। এখনও অনেক দূরে। ওদের কথার চেয়ে ঢেউ ভাঙার শব্দ এখানে জোরাল।
ভ্রূকুটি করল রবিন। কাছে গিয়ে কি কোন লাভ হবে? ওরা স্প্যানিশ বললে কিছু বুঝতে পারবে না সে।
জেটিতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে লোকগুলো। হাঁটছে, কথা বলার জন্যে থামছে। বলা শেষ করে আবার হাঁটছে। কাছে, আরও কাছে, একেবারে রবিনের মাথার ওপরে চলে এল ওরা। জেটির নিচ দিয়ে ওদেরকে অনুসরণ করে চলল সে। বালিতে হাঁটছে, ফলে পায়ের শব্দ হচ্ছে না তার।
ওকে, মাইস, বিলের গলা। দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুঝলাম। টাকা না দেখে কিছু করবে না তুমি। আমরাও মাল দেখতে চাই। ভাল হতে হবে।
গুড, নিশ্চয় মাইস, কারণ কথায় কোনরকম টান নেই। কিন্তু তোমরা কি পারবে? দেখে তো মনে হচ্ছে না। তোমাদের সঙ্গে কথাই বা বলছি কেন? আমি জিনোর সঙ্গে দেখা করতে চাই। লেনদেনটা তার সঙ্গে হওয়াই বোধহয় ভাল।
আমি জিনোর প্রতিনিধি, বিল বলল। বেশ, কিছু অগ্রিমের ব্যবস্থা নাহয় করি।
কর। কত দেবে।
চার ভাগের এক ভাগ। মাল বুঝে পেয়ে তারপর বাকিটা দেব।
অর্ধেক অগ্রিম, ভোতা গলায় বলল মাইস। বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। বাকিটা নেব মাল ডেলিভারি দিয়ে। নো অগ্রিম, নো মাল। তোমাদের কাছে বেচার এত ঠেকা নেই আমার, ভাল করেই জান। কেনার অনেক মক্কেল আছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। অবশেষে বিল বলল, বেশ, অর্ধেকই দেব। কিন্তু বাকি টাকা পাবে মাল আমাদের হাতে আসার পর। প্যাসিফিক স্টেটসে চলে যাও, ওখানেই থাকবে। টাকা জোগাড় করেই খবর দেব।
এখানে থাকলে ক্ষতি কি? এসব ছোটাছুটি ভাল্লাগছে না আমার।
অসুবিধে আছে। টাকা জোগাড় করতে সময় লাগবে। মিসেস নিকারোও পছন্দ করবে না তোমার সঙ্গে আমাকে দেখলে। তার ধারণা, আমি খালি কাজে ফাঁকি দেয়ার তালে থাকি। যা বলছি তা-ই কর।
আবার চুপচাপ। রবিন অনুমান করল, অফিসের দিকে তাকিয়ে আছে মাইস। আর কোন সন্দেহ নেই, অফিস থেকে তার ওপর নজর রাখছে এলসি নিকারো।
ঠিক আছে, রাজি হল মাইস। এখানে আসাটাই বোধহয় উচিত হয়নি আমার। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। বেশি দেরি করবে না, তাহলে পস্তাবে। আমার চেয়ে তোমাদের ঠেকা বেশি, মনে রাখবে কথাটা।
চলে গেল মাইস। কথা শুরু করল বিল আর তার দুই বন্ধু। এবার ইংরেজি নয়, স্প্যানিশ। বোধহয় মাইসের সঙ্গে কি কথা হয়েছে, সেটাই বলছে বিল। শুনে রেগে গেল দুই বন্ধু, তাদের কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল।
হালকা পদশব্দ শোনা গেল। কে ওই লোকটা? কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল এলসি।
ওই একটা ফিশিং ক্লাবের মালিক, জবাব দিল বিল। রাস্তা থেকে নাকি বোটটা দেখেছে, টিনাকে। জানতে চাইল ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা।
এরপর কেউ বোট ভাড়া চাইতে এলে সোজা আমার কাছে পাঠাবে।
আচ্ছা।
যাও, লাঞ্চ সেরে এস। একটার মধ্যে আসবে। তারপর পেট্রল আনতে যাব। আর তোমার দুই দোস্তকে ঘরে থাকতে বলবে, বুঝেছ? সারাক্ষণ এখানে ঘুরঘুর করে কেন? যত্তোসব!
আচ্ছা, বলব।
ওরা চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রবিন। ভাবছে, প্যাসিফিক স্টেটসটা কোথায়? শহর? নামও শোনেনি কোনদিন। আবার এসে টেলিফোন বুদে ঢুকল সে। ডিরেক্টরিতে ওরকম কোন শহরের নাম খুঁজে পেল না। তবে পি-এর সারিতে পাওয়া গেল একটা কোম্পানির নাম, প্যাসিফিক স্টেটস মুভিং অ্যাণ্ড স্টোরেজ কোম্পানি, অক্সনার্ডের ওয়েস্ট অ্যালবার্ট রোড-এ। ওই নাম্বারে ফোন করে মিস্টার মাইসকে চাইল।
একটা লোক জানাল, তিনি নেই এখন। এলে কিছু বলব? না। আবার ফোন করব আমি।
লাইন কেটে দিল রবিন। হেডকোয়ার্টারে করতে যাবে, এই সময় দেখল মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসছে একটা লোক। গাড়ির দিকে এগোচ্ছে। বুদ থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে ওর দিকে এগোেল রবিন।
আরে, রবিন, এখানে কি?
লোকটা রবিনদের প্রতিবেশী, ওদের বাড়ির উল্টোদিকে থাকে, রাস্তার অন্যপাড়ে, মিস্টার ওয়াগনার। এই এমনি এলাম, জবাব দিল রবিন। মাছধরা দেখতে। আগামী হপ্তায় ভাবছি আমিও আসব ধরতে, বাবার সঙ্গে।
অ, চারপাশে তাকাল ওয়াগনার। সাইকেল এনেছ?।
মাথা নাড়ল রবিন। না। এক বন্ধু লিফট দিয়েছে। প্রয়োজনের সময় কিশোরের মত মিথ্যে বলতে পারে না সে, তবু চেষ্টা করে মাঝে মাঝে। গোয়েন্দাগিরিতে মিথ্যে বলতেই হয়, উপায় নেই। আপনি উত্তরে যাবেন, না?
হ্যাঁ। কি করে বুঝলে? এমনি, আন্দাজ করলাম।
ক্যারপিনটেরিয়ায় যাচ্ছি, বোনকে দেখতে।
আমিও ভাবছিলাম ওখানেই যাবেন। অক্সনার্ডে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অসুবিধে হবে নিতে?
না না, অসুবিধে কিসের? একাই যাচ্ছি। কিন্তু আজ তো আমি ফিরব না। একা বাড়ি যাবে কিভাবে?
বাসে চলে যাব। এখন নিতে আপনার অসুবিধে না হলেই হয়।
ওয়াগনারের ছোট সেডানে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল রবিন।
১৫
রাস্তার মোড়ে বসে আছে কিশোর। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে। সিনথিয়াকে গ্রাহক বানানোর চেষ্টা করেছে। আরেকবার। সকাল নটায়। আগের বার তো অন্তত কথা বলেছিল, এবার তা-ও বলল না।
ফিরে এসে পথের মোড়ে বসেছে কিশোর। দেখেছে, ময়লা কতগুলো কাপড় নিয়ে বাড়ির পেছনের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকেছে সিনথিয়া, কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসেছে ধোঁয়া, ইস্তিরি করা কয়েকটা কাপড় নিয়ে। এখন পুলের কিনারে বসে বসে নখের পরিচর্যা করছে। আবার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে কিশোরের। ছুতো দরকার। বলবে নাকি গিয়ে অর্ডার বুক হারিয়ে ফেলেছে, খুঁজতে এসেছে? উঠে পড়ল সে। রাস্তা পেরোল। কিন্তু বাড়ির গেটে পৌঁছেই থমকে গেল। লম্বা কর্ড লাগানো একটা টেলিফোন বের করে এনে সিনথিয়া কথা বলছে, লোরিনা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে।
দূর, অভিনয় একদম ভাল না, সিনথিয়া বলছে। তবে শুনলাম ইফেক্ট নাকি সাংঘাতিক। স্পেসশিপটা ফাটার সময় নাকি দর্শকের কাপ তুলে দেয়। ফোন করেছি, ওরা বলল দুটোয় শো। যাওয়ার আগে একআধটা স্যাণ্ডউইচ খেয়ে নিলে। কেমন হয়?
ফিরল কিশোর। সিনেমায় যাবে সিনথিয়া। পিছু নিয়ে গিয়ে লাভ নেই, অযথা বসে থাকতে হবে হলের বাইরে। সে তো কিছুই করতে পারল না, রবিন কি করছে? কিছু করতে পারছে? রোজারকে আদৌ কোন সাহায্য করতে পারবে তো ওরা? বিল আর দুই বন্ধু-ই কি ডাকাত? কিভাবে প্রমাণ করা যাবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ টেলিভিশনে দেখানো একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের। তাড়াতাড়ি সাইকেলে উঠে ফিরে চলল ইয়ার্ডে।
হেডকোয়ার্টারেই রয়েছে মুসা। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে অলস ভঙ্গিতে। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। কিশোরকে দেখে বলল, যাক, এলে। আর ভাল্লাগছিল না একা একা। হ্যাঁ, রবিন ফোন করেছিল।
তাই? কি বলল? তার মনে হয়েছে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে নিকারোদের ওখানে। বিলের দুই বন্ধু ডক এলাকায় ঘুরঘুর করছে। উত্তেজিত। আর মিসেস নিকারো নাকি স্বপ্নে দেখেছে রবিনকে। স্বপ্ন-বৃত্তান্ত জানাল মুসা।
উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। কতক্ষণ আগে করেছে?
এই আধ ঘন্টা। কিছু বেশিও হতে পারে। আমি বললাম চলে আসতে। ও রাজি হল না।
মাথা দোলাল কিশোর। শোন, আমিও যাচ্ছি ওখানে। ওই তিনজনের ছবি
তোলার চেষ্টা করব। রোজারকে দেখালে হয়ত চিনতে পারবে।
ডার্করুম থেকে একটা ক্যামেরা বের করে আনল কিশোর, টেলিফটো লেন্স লাগানো। ফোনের কাছে থাকবে।
আধ ঘন্টা পর নিকারোদের ওখানে পৌঁছল সে। টিনা নেই। কাচেঘেরা ছোট অফিসটা শূন্য। এলসি বা মিসেস নিকারো, কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
খিলানে বাঁধা রবিনের সাইকেলটা দেখতে পেল সে। তারটাও নিয়ে বাঁধল ওখানে। সৈকতে মানুষ আছে। কেউ হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের মধ্যে মাছ ধরছে। কুকুর নিয়ে খেলছে একটা বাচ্চা। কিন্তু রবিন নেই। পার্কিং লটে চলে এল সে। সেখানেও কেউ নেই। একটা স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল নিকারোদের বাড়ির কাছে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। বেল বাজানোর আগেই খুলে গেল পাল্লা। দাঁড়িয়ে আছে মিসেস নিকারো। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।
মিসেস নিকারো, আমার বন্ধুকে দেখেছেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
তোমার বন্ধু?
সকালে আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাকে নাকি স্বপ্নে দেখেছেন।
অ, ওই ছেলেটা। সে তোমার বন্ধু। বোঝা উচিত ছিল আমার। এমন ভাবে তাকাল মহিলা, যেন রাগ করেছে, কিন্তু কিশোর বুঝতে পারল আসলে রাগেনি।
খিলানের নিচে ওর সাইকেলটা বাঁধা দেখলাম, ওকে দেখছি না। গেল কোথায়? আপনার বউমার সঙ্গে বোটে করে যায়নি তো কোথাও?
মাথা নাড়ল মিসেস নিকারো। না। এলসি গেছে বিলের সঙ্গে, টিনাকে নিয়ে। আর কাউকে দেখিনি বোটে।
তাহলে গেল কোথায়!
জানি না, বলতে বলতে পিছিয়ে গিয়ে পাল্লা পুরো খুলে দিল মহিলা। খারাপ কিছু একটা ঘটবে, বুঝতে পারছি। আমার স্বপ্ন মিথ্যে হয় না। এস, ভেতরে এস।
রবিনের বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত হল কিশোর।
স্টোরেজ কোম্পানির দিকে এগোচ্ছে রবিন। এলাকাটা নির্জন। শেকলের তৈরি উঁচু বেড়া। বিল্ডিংটায় কোন জানালা দেখা যাচ্ছে না। কাদামাথা কয়েকটা সাদা রঙের মুভিং ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। গেট থেকে সোজা চলে গেছে ড্রাইভওয়ে, এবড়োখেবড়ো, জায়গায় জায়গায় গর্ত, পানি জমে আছে। গেট বন্ধ।
কাউকে চোখে পড়ছে না। বাইরে থেকে কোম্পানি-এলাকার চারদিকে চক্কর দিতে শুরু করল রবিন। ঘাস জন্মে আছে জায়গায় জায়গায়। বাড়ির একধারে ভাঙা বাক্স আর বাতিল কাগজের স্তূপ। ভ্যান গাড়িগুলোর জন্যে পেছনদিকটা ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না। চত্বরের ভেতরে কোথাও থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে কান পাতল সে। কথা বোঝা যাচ্ছে না। বেড়ার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি, ওটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে, লম্বা দম নিয়ে উঠতে শুরু করল বেড়া বেয়ে ওপরে উঠে বেড়া ডিঙিয়ে নামল ভ্যানের ছাতে।
ছাতের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। দম নিয়ে, উঠল। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল চত্বরের দিকে।
সময় মত শুকায় না, বলল একজন। না শুকাক, বলল আরেকটা কণ্ঠ। এভাবেই নেব।
রবিন যেটার ছাতে রয়েছে, ওটার কাছাকাছি আরেকটা ভ্যান। মাঝে ফাঁক সামান্য। উঠে এক লাফে চলে এল দ্বিতীয় ভ্যানের ছাতে। পায়ে স্নিকার থাকায় শব্দ হল না। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। উঁকি দিতেই চোখে পড়ল লোকদুটোকে। তার দিকে পেছন, তাকিয়ে রয়েছে চকচকে রঙ করা সাদা একটা ট্রাকের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল আবার রবিন, সাবধানে মুখ তুলে দেখতে লাগল।
ও-কে, ডিক, বলল একজন। চিনতে পারল রবিন, মাইস। কোমরে হাত দিয়ে, মাথা একপাশে কাত করে দেখছে লোকটা। ভাল কাজ দেখিয়েছ।
বিচিত্র একটা শব্দ করল শুধু ডিক, কথা বলল না। এক হাতে রঙের টিন, আরেক হাতে ছোট ব্রাশ। বাতাসে রঙের কড়া গন্ধ। নতুন করে নাম লেখা হয়েছে সাদা ট্রাকটায়। প্যাসিফিক স্টোরেজ কোম্পানির নাম বদলে লেখা হয়েছেঃ রিচার্ডসনস মেরিটাইম সাপ্লাইজ।
আপনমনেই হাসল রবিন। ছদ্মবেশী ট্রাক।
ব্রাশ নেড়ে ট্রাকটার দিকে ইঙ্গিত করল ডিক। এত কষ্টের দরকার ছিল?
কোন ঝুঁকি নিতে চাই না, জবাব দিল মাইস। এ-ধরনের গাড়ি নিকারোদের ওখানে দেখলেই লোকে ভুরু কুঁচকে তাকাবে।
ঘুরল মাইস। হেঁটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল জানালা-বিহীন বিরাট বাড়িটার ভেতরে। মুহূর্ত পরে তার সঙ্গীও পিছু নিল। কিছুক্ষণ কংক্রিটের মেঝেতে শুধু কাঠ ঘষার শব্দ কানে এল রবিনের। অবশেষে আবার বেরোল মাইস। একটা ডোলিতে করে তিনটে কাঠের বাক্স নিয়ে আসছে। ট্রাকের দিকে এগোল।
ডিক বেরোল আরেকটা ডোলি নিয়ে। তাতেও একই রকম বাক্স। মাইসের মত নিরাপদে যেতে পারল সে, দুই মিটার যেতে না যেতেই গর্তে পড়ল ডোলি। ঝাঁকুনি লেগে মাটিতে পড়ে খুলে গেল একটা বাক্স। ছড়িয়ে পড়ল ডজনখানেক ছোট ছোট বাক্স।
অ্যাই, কি করছ! চিৎকার করে বলল মাইস।
ঠিক আছে ঠিক আছে, তুলে ফেলছি।
ছোট বাক্সগুলো কুড়িয়ে আবার বড় বাক্সটায় ভরল ডিকু। ডোলিতে তুলল। মাটিতে পড়ে ছোট বাক্সও দুএকটা খুলে গিয়েছিল। ভেতরের জিনিস ছিটকে পড়েছে মাটিতে। ওপর থেকে রবিন দেখলেও ডিক বা মাইস কেউই খেয়াল করেনি। দম বন্ধ করে পড়ে রইল সে, উত্তেজনায় দুরুদুরু করছে বুক ট্রাকে মাল তুলে আরও আনার জন্যে আবার বাড়িটাতে গিয়ে ঢুকল দুজনে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল।
প্রায় আধ ঘন্টা ধরে মাল বোঝাই করল ওরা। নানারকম বাক্স। কোনটা কাঠের, কোনটা ঢেউ খেলানো মলাটের। কোনটা এত ভারি, দুজনে ধরে তুলতেও কষ্ট হল। মাল তোলা হলে ট্রাকের দরজা বন্ধ করে হুড়কো লাগিয়ে দিল শক্ত করে।
ইহ্, মেলা পরিশ্রম, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল ডিক। আরেকজন লোক আনলে পারতাম।
না, এইই ভাল হয়েছে। কষ্ট একটু বেশি হয়েছে, তবে সাক্ষী থাকল না।
আবার বাড়িতে গিয়ে ঢুকল ওরা। অপেক্ষা করছে রবিন। পাঁচ মিনিট গেল…দশ…বেরোচ্ছে না একজনও। অনুমান করল সে, ট্রাক নিয়ে ওই দুজনের কেউ যাবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের সামনের দিকে চলে এল রবিন। নিঃশব্দে হুডের ওপর নামল, সেখান থেকে মাটিতে। দ্রুত এগোল যেখানে জিনিসগুলো পড়ে আছে। ঘাসের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সামান্য খুঁজতেই হাতে লাগল একটা। তুলে দৈখেই চমকে উঠল। বুলেট!
মৃদু একটা শব্দ হল, বোধহয় নিঃশ্বাসের। নীরবতার মাঝে কান এড়াল না রবিনের। ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল, যেন জমাট বরফ। ঢোক গেলার চেষ্টা করল, গলা শুকিয়ে কাঠ। এমনকি ভয়ে যে কাপবে, সেই শক্তিও নেই যেন।
তার দিকে তাকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক কুকুর! ডোবারম্যান পিনশার! কুকুর গোষ্ঠীর হিংস্রতম প্রাণীগুলোর একটা। মাত্র তিন মিটার দূরে। কুচকুচে কালো চোখের তারা স্থির হয়ে আছে রবিনের ওপর, কান খাড়া। ঘেউ ঘেউ করছে না। দৃষ্টি দিয়ে ঘায়েলের চেষ্টা করছে যেন অনধিকার প্রবেশকারীকে।
অ্যাইই! ফিসফিসিয়ে বলল রবিন, কুকুর! লক্ষ্মী কুকুর!
খুব ধীরে ধীরে নড়ল সে। সোজা হল। পিছাল এক পা।
ওপরে ঠোঁট উঠে গেল কুকুরটার। ভীষণ দাঁত বের করে ভেঙচি কাটল নীরবে। ধীরে ধীরে গলার গভীর থেকে বেরোল অতিচাপা গর্জন।
অ্যাইই! বলল রবিন।
গর্জন জোরাল হল। আগে রাড়ল কিছুটা। তারপর দাঁড়িয়ে গেল।
আর নড়ল না রবিন। ওটা প্রহরী কুকুর, বুঝল। সে নড়লে কুকুরটা নড়বে, না নড়লে নড়বে না। আসল উদ্দেশ্য, আটকে রাখা। প্রয়োজন হলে সারাদিন একই ভাবে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকবে ডোবারম্যানের বংশধর!
ধরা পড়ে গেছে রবিন!
১৬
ঘরের ভেতর খাবারের চমৎকার গন্ধ, বিশেষ করে পনির আর টোম্যাটো সস। অন্য সময় হলে অবশ্যই ভাল লাগত কিশোরের, এখন লাগছে না। লিভিং রুমে বসে মিসেস নিকারোর স্বপ্ন বিবরণ শুনছে।
একঘেয়ে কণ্ঠে বলেই চলেছে মহিলা।
ভুরু কোঁচকাল কিলোর। বাধা দিয়ে বলল, আপনার স্বপ্ন কি সব সময়ই সত্যি হয়?
না, বেশির ভাগই সাধারণ স্বপ্ন, পুরানো স্মৃতি। তবে কিছু আছে ভিন্ন। হয়ত এমন কাউকে দেখলাম, যাকে জীবনেও দেখিনি। জেগে উঠে কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যায় তার সঙ্গে। দুঃস্বপ্ন…।
বেশি দেখেন?
না না, হাসল মিসেস নিকারো। ভাল স্বপ্নও দেখি। একদিন দেখলাম সুন্দর লাল চুলওয়ালা একটা মেয়ে। পরে তাকেই বিয়ে করে আনল আমার ছেলে। এলসির কথা বলছি…।
পারিবারিক ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছে মহিলা, বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আগের প্রসঙ্গে ফিরে এল কিশোর, বিলের কথা বললেন। আপনার আত্মীয়?
না। তবে ছেলেটা ভালই। ওই যে, রাস্তার ধারের পুরানো, কটেজটায় থাকে। ওর দুই বন্ধুও থাকে, ওরা দক্ষিণ আমেরিকার লোক। ওর বেশিরভাগ বন্ধুই ওই দেশের। আসে, বেকার থাকে যতদিন ওর সঙ্গেই থাকে, চাকরি-টাকরি পেলে চলে যায়। আমার মনে হয় বিলের বাবা ছিল সাউথ আমেরিকান। সেই সূত্র ধরেই চলে আসে দেশের লোক। আর উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ আসে না, ভ্রূকুটি করল মহিলা। এই যেমন তুমি। মানিব্যাগ খুঁজতে আসনি তখন, তাই না? তোমার বন্ধু ও মাছধরা দেখতে আসেনি, নজর রাখতে এসেছিল। সোজা কথা, স্পাইগিরি, ঠিক না? আর বিল? কিছু একটা করতে যাচ্ছে সে, যা আমরা জানি না। কিছু একটা গোপন করছে, আমার আর এলসির কাছে।
কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, সেটা আমিও বুঝতে পারছি, বলল কিশোর। কিন্তু কি ঘটবে, জানি না। আচ্ছা, মিসেস নিকারো, একটা অন্ধ লোককে স্বপ্ন দেখেছেন বলেছেন। তারপর কি বাস্তবেও দেখেছেন ওকে?
না।
কিন্তু রবিন দেখেছে। আমিও।
পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর। ওকে দেখলে দয়া করে এই নাম্বারে একটা ফোন করবেন? আমি না থাকলেও যে-ই থাকুক, শুধু মেসেজটা দিয়ে দেবেন।
দেব।
আপনার ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?
হলরুমের দিকে ইঙ্গিত করল মহিলা। উঠে গিয়ে হেডকোয়ার্টারে ফোন করল কিশোর। রিসিভার তুলেই মুসা বলল, কিশোর, রবিন ফোন করেছিল। তুমি বেরোনোর পর পরই। অক্সনার্ডে গেছে। নতুন আরেকটা নাম বলল, মাইস। রবিনের বিশ্বাস, ওই লোকটাও এই রহস্যের সঙ্গে জড়িত। বিকেলেই আবার ফোন করবে বলেছে।
সাইকেল ফেলে গেছে। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, কোন বিপদে না পড়ল।
না। ভালই আছে। তুমি কোত্থেকে?
মিসেস নিকারোর ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরে আসব। লাইন কেটে দিল কিশোর। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মহিলা। বলল, তোমার বন্ধু তাহলে ভালই আছে?
কিশোর হাসল। হ্যাঁ। অক্সনার্ড থেকে ফোন করেছিল। একটা কাজে গেছে ওখানে।
ভাল। যাক, শুনে স্বস্তি পেলাম। নিশ্চিন্তে এখন মেহমানদারি করতে যেতে পারি। তোমারও নিশ্চয় কাজ আছে। সাবধানে থাকবে।
থাকবে, কথা দিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। চলল বিলের কটেজের দিকে।
বসে অপেক্ষা করার উপযাগী ভাল একটা জায়গা পছন্দ করল সে। আরাম করে বসল, হাতে ক্যামেরা। এক ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর এল পুরানেট্রাকটা। রাস্তার পাশে নামিয়ে দিল বিলের এক বন্ধুকে।
ক্যামেরা তুলল কিশোর। ক্লিক করে উঠল শাটার। লোকটা কটেজে ঢুকতে ঢুকতে তার মোট ছয়টা ছবি তুলে ফেলল সে।। আবার অপেক্ষার পালা। সাগরের দিকে চেয়ে টিনাকে আসতে দেখে হাসি ফুটল মুখে। ডকে পৌঁছল বোট। বাঁধা হল ওটাকে। দুজন নামল। বিল আর এলসি। বিলের জন্যে ভাবনা নেই, এক সময় না একসময় সামনে দিয়ে যেতেই হবে তাকে, কটেজে ঢুকতে হলে। তার দ্বিতীয় বন্ধুর ছবি তোলাটা এখন জরুরি।
কাটছে অপেক্ষার দীর্ঘ মুহূর্তগুলো। সৈকত আর সাগরের ওপর উড়ছে সীগাল, মাঝেমাঝে ডাইভ দিয়ে পড়ছে পানিতে, ঠোঁটে মাছ চেপে ধরে উড়াল দিচ্ছে, উড়তে উড়তেই গিলে নিচ্ছে মাছটা। বাঁ দিকে নিকারোদের ড্রাইভওয়ে, একআধটা গাড়ি এসে ঢুকছে, কিছুক্ষণ থাকছে, আবার চলে যাচ্ছে। বাড়িটার জন্যে অফিস চোখে পড়ছে না কিশোরের, তবে এলসি ভেতরেই রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিলও নিশ্চয় অফিসেই।
ডানে সৈকতের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর। পানির কিনারে ছিপ হাতে ব্যস্ত সৌখিন মাছশিকারিরা। হাতে একটা মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে সৈকত ধরে হাঁটছে একজন লোক। সাফাররা বসে আছে ভাল ঢেউয়ের আশায়। দিগন্তে দানা বাঁধছে মেঘ, ইতিমধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছে বাতাস। সকালটা ছিল সুন্দর, দিনটাও ভালই গেছে, শেষ হবে ঝড়বাদলের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়।
কটেজ থেকে বেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে জেটির দিকে এগোল বিলের বন্ধু।
ঘড়ি দেখল কিশোর। প্রায় তিনটে। সকালেই রবিন দেখেছে তৃতীয় লোকটাকে। গেল কোথায়?
নিকারোদের বাড়ির দিকে তাকাল কিশোর। হঠাৎ মনে পড়ল, একটা স্টেশন ওয়াগন দেখেছিল ওখানে। এখন নেই। গেল কখন? পাখি, মেঘ, ঢেউ আর বাতাস যেন সম্মােহিত করে রেখেছিল তাকে, গাড়িটাকে যেতেও দেখেনি, ইঞ্জিনের শব্দও শোনেনি।
উঠল সে। হাঁটতে শুরু করল রাস্তা ধরে। ড্রাইভওয়ের উল্টো দিকে এসেই দেখতে পেল অফিসে নেই এলসি। মিসেস নিকারোর চেয়ারে বসে ডেস্কে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করছে বিল। সিগারেট টানছে, ধোঁয়া ছাড়ছে ছাতের দিকে। ডেস্কের ওপর আসন-পিড়ি হয়ে বসেছে তার বন্ধু। ভাবসাব দেখে মনে হয় গল্প শোনাচ্ছে বিলকে। মাঝে মাঝে হাত নেড়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু এলসি গেল কোথায়? বাড়িতে, শাশুড়ির সঙ্গে রয়েছে? বিল আর তার বন্ধুকে এখন ওই অবস্থায় দেখলে কি করবে মেয়েটা, ভেবে হাসি পেল কিশোরের।
ভালমত খেয়াল করতে বাড়িটাও শূন্য মনে হল। জানালার পাল্লাগুলো বন্ধ, পর্দা টানা। এই সময় ড্রাইভওয়েতে ঢুকল একটা গাড়ি, বাড়ির সামনে গিয়ে থামল। গাড়ি থেকে নামল সাদা-চুল এক বৃদ্ধা, বোধহয় মিসেস নিকারোর মেহমান, হাতে একটা প্যাকেট। দরজায় গিয়ে বেল বাজাল। কেউ বেরোল না। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে আবার বেল বাজাল বৃদ্ধা। সাড়া না পেয়ে চলল অফিসের দিকে।
দেখতে পেয়েছে বিল। উঠে দাঁড়াল। তার বন্ধু আগের মতই বসে রয়েছে।
বিলের সঙ্গে কি কথা হল বৃদ্ধার। তারপর একটুকরো কাগজে কিছু লিখে ভঁজ করে দিল বিলের হাতে। ফিরে এল গাড়ির কাছে। রেগেছে খুব।
গাড়িটা চলে গেলে আবার চেয়ারে বসল বিল। ভাঁজ করা কাগজটা দলেমুচড়ে ফেলে দিল ময়লা ফেলার ঝুড়িতে।
হেসে উঠল তার বন্ধু।
এবার সতর্ক হল কিশোর। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল উল্টো দিকে। চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে বাড়িটার জন্যে অফিস দেখা যায় না। তারমানে অফিস থেকে এখন কেউ দেখতে পাবে না তাকে। রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত বাড়িটার দিকে এগোল সে।
রান্নাঘরের দরজার পাশে একটা জানালা, ছিটকানি খোলা। টান দিতেই পাল্লা খুলে গেল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দরজার নব নাগাল পাওয়া গেল, মোচড় দিতেই কট করে খুলে গেল তালা। ঘরে ঢুকে আস্তে লাগিয়ে দিল পাল্লাটা, তালা খোলাই রাখল। তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর দরকার হতে পারে।
রান্নাঘরের ভেতরটা প্রমোট। খাবারের গন্ধে বাতাস ভারি। স্টোভে বসানো পাত্রে সুপ তৈরি হচ্ছে। গরম রোস্ট ঠাণ্ডা হয়নি এখনও। সালাদের সজি কেটে রাখা হয়েছে।
নিঃশব্দে ডাইনিং রুমে চলে এল কিশোর। টেবিলে বাসনপেয়ালা সাজানো, তিনজনের জন্যে। পর্দা টেনে দেয়ায় ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। লিভিং রুমেও একই অবস্থা। বাতাসে খাবারের গন্ধের পাশাপাশি ঝাঁঝালো আরেকটা গন্ধ। কিছুক্ষণ আগে এই গন্ধ ছিল না, সে যখন কথা বলছিল মিসেস নিকারোর সঙ্গে। একটা সিগারেটের পোড়া টুকরো চোখে পড়ল, পা দিয়ে পিষে নেভানো হয়েছে।
সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল কিশোর। আস্তে ডাকল। জবাব নেই। গলা আরেকটু চড়িয়ে ডাকল, মিসেস নিকারো? আছেন? আমি, কিশোর।
সাড়া নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল কিশোর।
বেডরুমের জানালার খড়খড়ি ভোলা। আলো আসছে। বড় বড় কাঠের আসবাব এঘরে। একটা দেরাজ বোঝাই ছবি। হলরুমে ঢুকল সে। এঘরের আসবাবগুলো সাদা দেয়ালে টাঙানো রঙিন ফটোগ্রাফ। ঘরটায় খোঁজাখুজি করছে কিশোর, এই সময় বাজল টেলিফোন। রীতিমত চমকে উঠল সে। ফোনটা একটা টেবিলে রাখা। জানালা দিয়ে উঁকি দিল অফিসের দিকে।
অফিসের সেটটার দিকে তাকিয়ে আছে বিল। দ্বিধা করছে মনে হয়।
আবার রিঙ হল।
রিসিভার তুলল বিল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল বেডরুমের ফোনের রিঙ। হাসল কিশোর। এটা অফিসের ফোনের এক্সটেনশন। আস্তে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল সে।
সি, বলল বিল।
স্প্যানিশ ভাষা। কিছু কিছু বোঝে কিশোর। রিসিভার জোরে কানে চেপে ধরে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করছে।
ওপাশের লোকটা নিজের নাম বলল জিনো। বলল, মাইসের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। টাকার কথা কি যেন বলল। নিকারোর নাম বলল, তারপর বলল কিশোরের নাম! মনে করিয়ে দিল, রোজারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কিশোর পাশা, সেখানে মিসেস নিকারো আর অন্ধ লোকটার কথা আলোচনা করেছে। বিলকে হুঁশিয়ার থাকতে বলল। বিল জবাব দিল, থাকবে। জানাল, সে আর পেক সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। পেক বোধহয় অফিসে বসা লোকটার নাম, আন্দাজ করল কিশোর। আরও কয়েকটা কথা বলে লাইন কেটে দিল জিনো।
রিসিভার রেখে আবার জানালা দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। অফিসের বাইরে। বেরোল বিল। সৈকতে চোখ বোলাল একবার। তারপর ফিরে চেয়ে ডাকল বন্ধুকে।
সে বেরোল, ইশারায় কটেজটা দেখাল।
কটেজের দিকে হাঁটতে শুরু করল পেক।
নিকারোদের বাড়ির দিকে ফিরল বিল। কৌতূহলী হয়ে উঠেছে যেন হঠাৎ করেই। পায়ে পায়ে রওনা হল এদিকে।.
চট করে সরে এল কিশোর। নিশ্চয় রিসিভার রাখার শব্দ পেয়েছে বিল। নইলে সন্দেহ হল কেন?
সিঁড়িতে উঠে থামল পায়ের শব্দ। তালায় চাবি ঢোকানো হল। পৌঁছে গেছে বিল। যে-কোন মুহূর্তে উঠে আসবে ওপরে। নিচে নামার আর সময় নেই। ধরা পড়ে যাবে কিশোর, তারপর…।
তারপর-কি?
বেডরুমের লাগোয়া বাথরুম আছে। টিপ টিপ করে পানি পড়ার শব্দ আসছে ভেতর থেকে।
সামনের দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ হল।
তিন লাফে ঘর পেরিয়ে আরেক ঘরে চলে এল কিশোর। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। ফিরে এল বেডরুমে। খাটের নিচে ক্যামেরাটা লুকিয়ে রেখে নিজে এসে লুকাল দরজার আড়ালে।
দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠল বিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলল বেডরুমের দরজা। দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত, বাথরুমের দিকে চেয়ে। তারপর এগিয়ে গেল সেদিকে।
মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না কিশোর। দরজার আড়াল থেকে বেরিয়েই দিল দৌড়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় শুনল বিলের চিৎকার। ফিরেও তাকাল না। নিচে নেমে, রান্নাঘরের দরজা খুলেই একলাফে একেবারে বাইরে।
১৭
একছুটে নিকারোদের সীমানা পেরিয়ে গিয়ে হাইওয়েতে উঠল কিশোর। লুকাতে হলে, বিলের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাড়াতাড়ি কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কোথায়?
পথের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি, কোন ক্যাম্পারের হবে। পেছনের দরজা খোলা। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যাম্পারের মালিক। কাগজের তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছে।
বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না কিশোর। নিঃশব্দে উঠে পড়ল গাড়িতে। কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেয়, কতগুলো ঝিনুকের ঝুড়ির পাশে। গায়ের ওপর টেনে দিল একটা পুরানো তেরপল। খানিক পরেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল ক্যাম্পারের দরজা। ইঞ্জিন স্টার্ট নিল।
চলতে শুরু করল গাড়ি। শখানেক মিটার দক্ষিণে এগিয়ে, পুরো ঘুরে আবার উত্তরে রওনা হল। গতি বাড়ছে। তেরপল সরিয়ে উঠে বসল কিশোর, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। নিকারোদের সীমানা পার হওয়ার সময় বিলকে দেখতে পেল সে। রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় চোখ বোলাচ্ছে লোকটা। হাতের মুঠো শক্ত। অবাক।
হেসে উঠল কিশোর।
নিকারোদের ডক আর অক্সনার্ডের মাঝামাঝি এসে প্রথমবারের মত থামল ক্যাম্পার, ট্রাফিক সিগন্যাল দেখে। এই অপেক্ষাতেই ছিল কিশোর। গাড়ির গতি কমে আসতেই খুলে ফেলল পেছনের দরজা, থামার সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল। হাঁটা দিল মোড়ের দিকে।
দশ মিনিটে পৌঁছে গেল একটা বাস টার্মিনালে। সান্তা মনিকার বাস এল, উঠে পড়ল তাতে।
দক্ষিণে ছুটেছে বাস। ভাবছে কিশোর। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আর, বিল নজর রাখে রোজারের ওপর। কিশোরের সাথে কি কি কথা হয়েছে রোজারের, সব জানে। কিন্তু কিভাবে? নিশ্চয় কারও কাছে বলেছে রোজার। কার কাছে? সিনথিয়া?
নিকারোদের ডক পার হচ্ছে বাস। পার্কিং লটে কেউ নেই। অফিসটা নির্জন। বিল আর তার বন্ধু গেল কোথায়? এলসি আর তার শাশুড়িই বা কোথায়? ওদের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে বিলের হাত নেই তো? …আরও নানারকম প্রশ্ন ভিড় করে এল কিশোরের মনে। হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। রোজার কি নিরাপদ?
সান্তা মনিকায় বাস থামতে প্রথম নামল কিশোর, নামল না বলে দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোল বলা যায়। মোড়ের কাছ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলল ডলফিন কোর্টে।
চারটে চল্লিশ মিনিটে রোজারের দোড়গোড়ায় কিশোরকে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। বেল বাজাল। রোজারকে দরজা খুলে দিতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
কি ব্যাপার? এত উত্তেজিত? কোন খবর আছে নাকি? জিজ্ঞেস করল রোজার।
আছে। রোজারের পিছু পিছু রান্নাঘরে এসে বসল কিশোর। বসেই জিজ্ঞেস করল, মিস্টার রোজার, কাল আমি যাওয়ার পর কার সঙ্গে কথা বলেছেন?
কথা বলেছি! কই, কারও সঙ্গে না তো। ঘর থেকেই বেরোইনি।
তাহলে কেউ ফোন করেছিল। কিংবা আপনার ঘরে এসেছিল। যার সঙ্গে বলেছেন।
না, কেউ ফোনও করেনি; আসেওনি। আমার অত বন্ধুবান্ধব নেই। কেন? খুব জরুরি। ভাবুন, মিস্টার রোজার। ভাল করে ভেবে দেখুন। কাল বিকেলে অন্ধ ভিখিরি আর নিকারোদের কথা আলোচনা করেছিলাম। নিশ্চয় সেসব কথা কারও কাছে বলেছেন। জিনো নামে কাউকে চেনেন?
ভাবল রোজার। মাথা নাড়ল, না, চিনি না। কেউ আসেনি এখানে, রক ছাড়া। তাকেও কিছু বলিনি। রাতে ফিরেই ওপরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে তালা লাগিয়ে দিল।
আজ সকালে?
না, আজ সকালেও না। শুধু কেমন আছ, ভাল, ওই পর্যন্তই।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। শূন্য চোখে চিনির পাত্রটার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। রক রেনান্ডের কথা ভাবছে। কালো গলাবন্ধ শার্ট, কালো চশমা। অদ্ভুত! আনমনে বলল সে।
কি বললে?
আচ্ছা, আপনার পড়শীদের সম্পর্কে কি ভাবে রক?
কি আর ভাববে? খুব সাধারণ লোক।
সে নিজে খুব অসাধারণ, না?
শ্রাগ করল রোজার।
আবার চিনির পাত্রের দিকে তাকাল কিশোর। আচ্ছা, কবে থেকে কফিতে চিনি খাওয়া আরম্ভ করেছে রক? আচমকা প্রশ্নটা যেন ছুঁড়ে দিল সে। সব সময় খায় না, তাই না? সেরাতে প্রথম যেদিন এলাম আমরা, শুধু কালো কফিই খেয়েছে, চিনি ছাড়া।
আঁ…হ্যাঁ, তা ঠিক। এই দুএকদিন আগে থেকে চিনি খাওয়া আরম্ভ করেছে। চিনি খেলে নাকি দ্রুত শক্তি পায় সে।
চকচক করছে কিশোরের চোখ। টেনে নিল পাত্রটা। চিনির ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। উজ্জ্বল হল চেহারা। আস্তে করে বের করে আনল প্লাস্টিকের একটা বাক্স, একপাশে ছোট ছোট ছিদ্র।
জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে রোজার। ওটা কি?
একধরনের শ্রবণ-যন্ত্র, মিস্টার রোজার, স্পাইরা বলে বাগ। রকের কথা বলার প্রয়োজন ছিল না আপনার সঙ্গে। চিনির পাত্রে এই জিনিস ঢুকিয়ে টেবিলে রেখে গেছে। আমাদের কথা সব শুনেছে সে। উঠে টেলিফোনের দিকে এগোল কিশোর। টি এক্স ফোর-এ কাজ করেছেন। নিশ্চয় নাম্বার জানেন।
নাম্বার বলল রোজার। ডায়াল করল কিশোর। রিসিভার কানে ধরে রেখে ঘড়ি দেখল। চারটে ঊনষাট। ওপাশে রিসিভার ভোলা হলে রক রেনাল্ডকে চাইল সে। ওরা জানাল ওই নামে ওখানে কেউ কাজ করে না।
কিন্তু টি এক্স ফোরেই তো কাজ করতেন মিস্টার রেনাল্ড। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন?
সেটা আমি বলতে পারব না, জবাব এল। সোমবার সকালে যোগাযোগ করলে হয়ত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট জানাতে পারবে।
অপারেটরকে ধন্যবাদ দিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। ওখানে কাজ করে? রোজার অবাক। বুঝতে পারছি না! করার তো কথা। এই তো সেদিন ফ্রেজনোতে গেল একটা বিশেষ কাজ নিয়ে।
যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। এগিয়ে গিয়ে টান দিয়ে রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলল কিশোর। কয়েক দিন আগে যেসব খাবারের প্যাকেট রেখেছিল, সেগুলো নেই। এককোণে যেন অসহায় হয়ে পড়ে রয়েছে শুধু একটা আইসক্রীমের প্যাকেট। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল সে, এখানেই ছিল।
কী?
না, কিছু না। আমি শিওর না। বোধহয় দেরিই করে ফেললাম। মিস্টার রোজার, রক ঘরে তালা দিয়ে রাখে বললেন না?
হ্যাঁ। একা থাকতে ভালবাসে সে।
ওর ঘরটা দেখতে চাই আমি। এক্ষুনি।
১৮
গ্যারেজ থেকে ধরাধরি করে একটা মই নিয়ে এল দুজনে। লাগাল রকের ঘরের জান্নালায়। জানালা খোলা, কাজেই ঢুকতে অসুবিধে হল না কিশোরের।
প্রথমেই চোখ পড়ল, ড্রেসারের ওপর রাখা একটা রেকর্ডিং সিসটেমের ওপর। যন্ত্রে লাগানো টেপটা রিউণ্ড করে প্লে করল সে। এইমাত্র রোজারের সঙ্গে রান্নাঘরে বসে যা যা বলেছে, সব রেকর্ড হয়ে আছে। এমনকি রেফ্রিজারেটরের দরজা খোলার শব্দও স্পষ্ট।
মুচকি হাসল কিশোর। মুছে ফেলল সমস্ত রেকর্ডিং। তারপর টেপটা আবার শুরুতে এনে রেখে, ঘর দেখায় মন দিল। সব কেমন যেন খালি খালি। ডেস্কে চিঠির খাম বা পোস্টকার্ড নেই, বেডসাইড টেবিলে বই নেই। দেয়ালে ছবি নেই, টবে গাছ নেই। দেখে মনে হয়, মানুষই থাকে না এখানে।
ক্লোজেট খুলে দেখল। কিছু জ্যাকেট, শার্ট আর স্ন্যাকস আছে, পকেটগুলো খালি। ড্রেসারের ড্রয়ারে দেখা গেল আণ্ডারওয়্যার, মোজা, গেঞ্জি।
একেবারে নিচের ড্রয়ারে ভঁজ করা সোয়েটারের মধ্যে পাওয়া গেল একটা ছুরি। চামড়ার চমৎকার একটা খাপে ভরা। তীক্ষ্ণ ধার। পেন্সিল কাটা থেকে শুরু করে থ্রোইং নাইফ হিসেবে ব্যবহার, সব কিছু চলতে পারে।
যেখানে পেয়েছে সেখানেই ছুরিটা রেখে দিল সে। জানালা দিয়ে বেরিয়ে মই বেয়ে নিচে নেমে এল আবার। কি কি দেখেছে, জানাল রোজারকে। শেষে বলল, ছুরিটাও বোধহয় তার পিস্তলের মত করেই পায়ে বাঁধে।
মাথা নাড়ল রোজার, বিশ্বাসই করতে পারছে না। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে, আত্মরক্ষার জন্যে পিস্তল রাখে সঙ্গে, আমাকে বলেছে একথা। কিন্তু ছুরি দিয়ে করে কি? ক্যাম্পিঙে যায় না, কিছু না। অবসর সময়ে ঘুমানো আর টিভি দেখা ছাড়া আর কিছু করে না।
দেখিয়ে করে না আরকি। যা করে, গোপনে। রান্নাঘরে চিনির পাত্রে বাগ লুকায়। ফ্রিজে মূল্যবান জিনিস রাখে। আপনার ফ্রিজে কিছু লুকিয়ে রেখেছিল।
ফ্রিজে আর কি রাখবে, খাবার ছাড়া?
খাবার নয়, টাকা রেখেছিল। ব্যাংক থেকে ডাকাতি করে আনা টাকা, খাবারের প্যাকেটে মুড়ে।
অসম্ভব। খাবারই রাখে সে। একেকবারে অনেক খাবার এনে জমিয়ে রাখে। খাবার হাতের কাছে থাকলে নাকি ভরসা পায় সে। ওই ফ্রিজটা আমি ব্যবহারই করি না, সে-ই করে। খাবার রাখে বটে, কিন্তু ঘরে খায় না। অদ্ভুত স্বভাব।
হুম। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ঘরে যদি না-ই খায়, ফ্রিজের খাবারগুলো যায় কোথায়? বের করে নিতে দেখেছেন?
কি জানি, অত খেয়াল করে কে…তবে টাকার প্যাকেট এনে রাখে না ফ্রিজে। অনেকদিন ধরেই প্যাকেট রাখছে। তারমানে কি বলতে চাইছ এতদিন ধরেই ডাকাতি করছে সে! আমার বিশ্বাস হয় না। রক ওরকম লোক নয়।
টাকা না রাখলে মাদক রাখে। বিলের সঙ্গে তো সম্পর্ক আছেই। নিকারোদের বোট ব্যবহার করে মাদক চোরাচালানের কাজে, টিনাকে। গভীর সাগরে গিয়ে জাহাজ থেকে আনে মালের প্যাকেট, কিংবা চলে যায় বাজা ক্যালিফোর্নিয়ায়। কিংবা হয়ত মানুষ চোরাচালানের ব্যবসা করে ওরা। বেআইনীভাবে মানুষ পাচার করে…। থেমে গেল। না, তাহলে ফ্রিজে কি রাখে? এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিছু।
পুলিশকে জানাবে?
এখন জানিয়ে লাভ নেই। কিছু প্রমাণ করতে পারব না।
এই প্রথম রাগ দেখা দিল রোজারের চেহারায়। তাহলে, কি করবে? আমি কোন সাহায্য করতে পারব?
পারবেন। আগে একটা টেলিফোন করা দরকার। আপনার ঘরে যেটা আছে সেটা ব্যবহার করব না। প্রতিবেশীদের কারও ঘর থেকে করা যাবে?
যাবে।
তাহলে চলুন। যেতে যেতে বলছি আমার প্ল্যান।
পাশের বাড়ির দরজায় এসে বেল টিপল রোজার। বেরোল, এক মহিলা। তাকে বলল সে, নিজের টেলিফোন খারাপ, একটা ফোন করতে চায়।
হেডকোয়ার্টারে ফোন করল কিশোর। ডলফিন কোর্ট আর সেকেণ্ড স্ট্রীটটা যেখানে মিশেছে, সেখানে আসতে বলল মুসাকে।
বিশ মিনিট, মুসা বলল।
এসে আমাদেরকে না পেলে আবার হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাবে। আমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবে।
রোজারের রান্নাঘরে আবার ফিরে এল দুজনে। চিনির পাত্রে আগের মত বাগটা ঢুকিয়ে রাখল কিশোর। মিস্টার রোজার, জোরে জোরে বলল সে, চোখ টিপল রোজারের দিকে তাকিয়ে। নিশ্চয় অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তবে শীঘ্রি নতুন। খবর জানাতে পারব আশা করি। এলসি নিকারোর কাছ থেকে অবশেষে কথা আদায় করা যাবে, বুঝতে পারছি। এই একটু আগে থানায় গিয়েছিল মুসা, চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা করতে। মুসা থানায় থাকতে থাকতেই ফোন করেছিল এলসি। দেখা করতে গেছেন চীফ।
কিন্তু মিসেস নিকারোর সঙ্গে ডাকাতির সম্পর্ক কি? রোজার জিজ্ঞেস করল।
আছে, যোগাযোগ আছে, আমি শিওর। রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে আমাদেরকে যেতে বলেছে মুসা। তার ধারণা, এলসি ক্লিারোকে থানায় নিয়ে আসবেন চীফ।
বস। আমার জ্যাকেট নিয়ে আসছি।
খট করে সুইচ টিপে রান্নাঘরের লাইট নেভাল কিশোর। বেরিয়ে এসে দুজনে উঠল রোজারের হোট গাড়িতে। ড্রাইভওয়ে থেকে বেরিয়ে মস্ত একটা উইলো গাছের নিচে গাড়ি রাখল রোজার। অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
সাইকেল নিয়ে হাজির হল মুসা। হেডলাইট জ্বালল-নিভাল রোজার, সঙ্কেত দিল কোথায় আছে ওরা। একটা ঝোপের ভেতরে সাইকেল লুকিয়ে গাড়ির কাছে এল মুসা। উঠে বসল পেছনের সিটে। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
রককে সন্দেহ করে, জানাল কিশোর। চিনির পাত্রে বাগ পাওয়া গেছে, রকের ঘরে রেকর্ডারে তাদের কথাবার্তা রেকর্ড হয়েছে, এসব কথাও বলল। ভয়েসঅ্যাকটিভেটেড রেকর্ডার, কথা শুনলেই চালু হয়ে যায় রেকর্ডিং সিসটেম। শেষে জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে পড়ে?
অন্ধ! উত্তেজিত কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে বলল মুসা। খাইছে! বাগ লাগাতে গিয়েছিল স্যালভিজ ইয়ার্ডে! রক ব্যাটাই…।
হতে পারে, বলল কিশোর।
নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল দুজনে। নিকারোদের ওখানে যা যা ঘটেছে, মুসাকে জানাচ্ছে কিশোর।
অন্ধকার হয়ে গেছে। বিকেল থেকেই আসি আসি করছিল বৃষ্টি, পড়তে শুরু করল এখন। সেকেণ্ড স্ট্রীট আর ডলফিন কোর্টে যানবাহন প্রায় নেই বললেই চলে। ছটার কিছু পরে মোড়ে দেখা দিল রকের গাড়ি। ড্রাইভওয়ে ধরে গিয়ে থামল বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামল সে। একটু পরেই জ্বলে উঠল রান্নাঘরের আলো। তারপর সামনের ঘরে আলো জ্বলল।
আমাকে খুঁজছে, রোজার বলল। এসময় ঘর থেকে বেরোই না, কদিন ধরে।
দোতলায়ও আলো জ্বলল, রকের বেডরুমে।
আর বেশিক্ষণ লাগবে না, হাসি হাসি গলায় বলল রোজার।
সব কটা ঘরের আলো জ্বালিয়ে রেখেই সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল রক। দৌড়ে লন পেরিয়ে গিয়ে উঠল গাড়িতে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। কয়েক সেকেণ্ড পরেই ওদের পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
রোজারও ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। পিছু নিল। সেকেণ্ড স্ট্রীট পেরিয়ে বেরিয়ে এল ওশন অ্যাভেন্যুতে। ছুটে চলল কোস্ট হাইওয়ে ধরে।
নিকায়রোদের ওখানে যাচ্ছে, কিশোর বলল।
দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছে রোজার। মাঝখানে ঢুকে গেল আরেকটা গাড়ি। ভালই হল, রোজারের গাড়িটাকে লক্ষ্য করবে না আর রক। অঝোর বৃষ্টির মাঝে উত্তরে ছুটে চলেছে ওরা। পারলে গাড়ির গতি পুরোটাই বাড়িয়ে দিত রক, বোঝা যাচ্ছে, পুলিশের ভয়ে বাড়াচ্ছে না। অহেতুক ঝামেলায় পড়তে চায় না এখন। ম্যালিবুতে ঢুকে গতি কমাল কিছুটা, তারপর আবার বাড়াল।
মিস্টার রোজার, কিশোর জিজ্ঞেস করল। জিনো নামে কাউকে চেনেন না?
না। রকের মিডলনেমের আদ্যাক্ষর অবশ্য জি, কিন্তু তাতে কি জিনো বোঝায়? কি জানি, মানায় না। স্প্যানিশ আর ইটালিয়ানরা ওরকম নাম রাখে।
গন্তব্যস্থল দেখা যাচ্ছে। গতি কমাল রোজার। যানবাহন খুব কম রাস্তায়। ডকে দাঁড়ানো সাদা একটা ট্রাক আবছামত দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ ব্রেক কষল রক। ডানে মোড় নিয়ে মোটেলের ড্রাইভওয়ে ধরে উঠে যেতে শুরু করল।
মোটেল! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে রোজার। কিশোর, ওখানেই আছে এলসি নিকারো আর তার শাশুড়ি।
তাই তো! আমারও বোঝা উচিত ছিল। মিস্টার রোজার, আপনি এখানেই থাকুন। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা না ফিরলে পুলিশকে ফোন করবেন।
আচ্ছা। সাবধানে থাকবে।
গাড়ি থেকে নামল দুই গোয়েন্দা। ওপর দিকে তাকাল। পাহাড়ের চূড়ায় অন্ধকার একটা ছায়ামাত্র এখন মোটেলটা। নিঃশব্দে ড্রাইভ বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। তুমুল বৃষ্টি বাঁচাতে পিঠ বাঁকা করে রেখেছে। মোটেলের চওড়া চত্বরে পৌঁছে কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। ওই যে, রকের গাড়ি, ফিসফিসিয়ে বলল সে।
কিন্তু ব্যাটা গেল কই?
মোটেলের ভেতরে হয়ত।
পুলের পাশ কাটাল ওরা! সাগর এখন মোটেলের অন্যপাশে। সাগরের মাঝামাঝি রয়েছে মোটেলটা। ফলে ঝড়ো হাওয়া আর তেমন আঘাত হানতে পারছে না ওদের গায়ে। বৃষ্টির ফোঁটা চকচক করছে ম্লান আলোয়।
হাত তুলে দেখাল কিশোর। একধারে একটা জানালায় আলো, খুবই সামান্যভারি পর্দার ওপাশে নিশ্চয় ল্যাম্প জ্বলছে।
পা টিপে টিপে জানালার কাছে এসে কান পাতল ওরা, ভেতরে কথা হয় কিনা শোনার জন্যে।
হঠাৎ পেছনে শোনা গেল আরেকটা শব্দ বাতাস আর বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়াও।
পেছনে ফিরে চাইল কিশোর।
চুপ! ধমক দিল রক রেনাল্ড। হাতে পিস্তল। একদম নড়বে না।
চিৎকার করে ডাকল মোটেলের দিকে চেয়ে।
মোটেলের দরজা খুলে গেল। বাইরে এসে পড়ল ভেতরের আলো। বেরিয়ে এল বিলের আরেক রুমমেট, যাকে সারা বিকেল দেখা যায়নি। তার হাতেও পিস্তল। –
হাঁট! দুই গোয়েন্দাকে আদেশ দিল বুক।
ঘরে ঢুকল কিশোর আর মুসা। বাতাসে কড়া তামাকের ঝাঁঝাল গন্ধ। পিঠখাড়া একটা চেয়ারে বসা এলসি নিকারো, হাতলের সঙ্গে হাত বাঁধা। রাগে মুখ লাল। বিছানার কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তার শাশুড়িকে।
রক ঢুকল ভেতরে। দরদর করে পানি ঝরছে গা থেকে। দরজাটা বন্ধ করে দিল বিলের রুমমেট।
হাই! বলে উঠল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
ঘরের অন্ধকার কোণে, দরজার পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে আছে রবিন। বেঁধে রাখা হয়েছে তাকেও।
১৯
ব্যাগটা দেখে ফেলেছিলে, তাই না? রক বলল। আমাকে ফাঁকি দিতে চেয়েছ।
আপনিও ফাঁকি দিয়ে আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন, বলল কিশোর।
তাকে আর মুসাকেও চেয়ারে বসানো হয়েছে। বেঁধেছে বিলের রুমমেট, তার নাম এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে ওদের, পিনটো।
রোজার কোথায়? রক জিজ্ঞেস করল। রাস্তায়?
জবাব দিল না কিশোর।
হাসল রক। বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখব না ওকে। পিস্তলটা পকেটে রেখে স্প্যানিশে পিনটোকে কি বলল সে।
দরজায় থাবা পড়ল। পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বিল। মুসা আর কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়াল, চোখে বিস্ময়। এরা এখানে কিভাবে? এটা তো রীতিমত বিচ্ছু, কিশোরকে দেখল সে। আটকে রাখ, দেখ পালাতে না পারে। রককে বলল
সে, আমি এসেছি পিনটোকে নিতে। বোট রেডি। মাল তোল প্রায় শেষ। মাইস। চলে যাবে এখুনি।
পাশে বসা কিশোরকে ফিসফিস করে জানাল রবিন, অক্সনার্ডের একটা মুভিং কোম্পানির মালিক মাইস। বিকেলে লুকিয়ে থেকে দেখেছি, ট্রাকে মাল তুলেছে ও আর আরেকটা লোক। তোলার সময় একটা বাক্স পড়ে খুলে গিয়েছিল। ভেতরে বুলেটের বাক্স।
অ্যামুনিশন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। নিশ্চয় রাইফেলও আছে। রকের দিকে তাকাল সে। আমি ভেবেছিলাম ড্রাগস। টিনার সাহায্যে মাদকদ্রব্য চোরাচালান করে বিল আর তার দোস্তেরা।
অসম্ভব! চিৎকার করে উঠল এলসি। আমাকে না নিয়ে বোট নড়ানোরও সাহস করেনি কখনও। তুমি ভুল করছ।
বিল হাসল। এবার নেব, মিসেস নিকারো। এবার আর বোটে থাকছেন না আপনি।
অস্ত্র তুলবেন বোটে, কিশোর বলল। সেজন্যেই ডাকাতি করেছেন তিন বন্ধু মিলে, অস্ত্র কেনার টাকা চাই তো? চালান দেবেন মেসা ডিওরোতে, নিরীহ মানুষ মারার জন্যে।
গর্বের ভঙ্গিতে মাথা তুলল বিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই হবে।
নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করাকে কি লড়াই বলে নাকি?
কাদের নিরস্ত্র বলছ? রেগে উঠল বিল। মেসা ডিওরের সিভিল গার্ডদের? অন্যের জমি কেড়ে নিতে দস্যুদের সাহায্য করেছে যারা?
ওর কথা শুনছ কেন, বিল? রক বলল। যা খুশি বলুক না। আমাদের কাজ আমরা করব।
আপনিই কানা ফকির সেজেছিলেন,রককে বলল কিশোর। ছদ্মবেশে চোখ রেখেছেন ব্যাংকের ওপর। রোজার যাতে চিনতে না পারে। টাইম লকের কথা জানতেন আপনি। রোজারের ডিউটি জানতেন। তবে বেশি লোভী আপনি। ডাকাতির আগের দিন মিস্টার সাইমনের মানিব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখে লোভ সামলাতে পারেননি। তুলে পকেটে ভরে ফেলেছিলেন, আর সেটাই ভেস্তে দিল আপনাদের পরিকল্পনা। তাড়াহুড়োয় পালাতে গিয়ে কোনভাবে ফেলে দিয়েছিলেন। পকেট থেকে।
আ-আমি, তাড়াতাড়ি বলল রক। আসলে…যার ব্যাগ তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যেই তুলেছিলাম।
বিলের দিকে তাকাল পেক, তারপর রকের দিকে। স্প্যানিশ ভাষায় কি বলল। তাকে চুপ থাকতে ইশারা করল বিল। রকের দিকে ফিরে কড়া গলায় বলল, ছেলেটা যা বলছে সত্যি? সামান্য একটা ব্যাগের জন্যে…
বাধা দিয়ে বলল রক, ওর কথা বিশ্বাস কোরো না। তুলে পকেটে রেখেছিলাম। ভেবেছি, ডাকবাক্সে ফেলে দেব। পরে ভুলে গেছি, আর ফেলতে মনে ছিল না। ওসব নিয়ে তর্ক করে এখন লাভ নেই।
আমাকে বললে না কেন তুমি? চেঁচিয়ে উঠল বিল। মিস্টার সাইমনকে দিয়ে দিতাম। ওই ব্যাগ নিয়েই তো যত গোলমাল। ছেলেগুলো এসে হাজির হয়েছে!
বলছি তো, মনে ছিল না! তাছাড়া এটা কোন ব্যাপার নাকি? এদেশ থেকে চলেই তো যাচ্ছ তুমি। আর ছেলেগুলোর ব্যবস্থা আমি করব।
মিস্টার রোজারের বাড়ি ছাড়ছেন না আপনি, তাই না? বলল কিশোর। কেন, আন্দাজ করতে পারছি। এদেশেই থাকবেন, ডাকাতির টাকা ভোগ করতে হবে তো। রিপাবলিকানদের সব টাকা দেবেন না আপনি।
আবার রকের দিকে তাকাল বিল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল রকের মুখ।
কি বলছে ছেলেটা? রকের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল বিল।
সব টাকা অস্ত্র কিনতেই খরচ হয়ে গেছে, বিলের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না রক। জান তুমি, বিলানো।
আমি শুধু জানি দুলাখ ডলার খরচ হয়েছে। অর্ধেকটা আজ বিকেলে মাইসকে দিয়েছ তুমি, বাকিটা আমি দিয়েছি। আর টাকা কই? বলেছ, রডরিগেজকে পাঠিয়েছ। তোমার চেহারা দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। মিথ্যে কথা বলেছ তুমি। বিশ্বাস করে তোমার কাছে রেখেছিলাম। টাকা কি করেছ?
আমি কি করব? যা যা করতে বলেছ, করেছি…।
আজ রাতে তুমিও যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে, কঠিন গলায় বলল বিল। মেকসিকো সিটিতে গিয়ে রডরিগেজের অ্যাসিসটেন্টকে আমাদের সামনে বলবে যে তুমি তার হাতে টাকা দিয়েছ। দরকার হলে মেসা ডিওরোতে নিয়ে যাব, তোমাকে…
কি যা-তা বলছ! আজ রাতে যে যেতে পারব না, ভাল করেই জান। এখানে জরুরি কাজ রয়েছে আমার। মিশন এখনও শেষ হয়নি।
মিস্টার রোজারের বাড়িতে এখনও পঞ্চাশ হাজার ডলার রয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
এই ছেলে, চুপ কর! মিথ্যুক কোথাকার! কিশোরকে ধমক দিয়ে মিসেস নিকারোর দিকে ফিরল রক। এই বুড়ি, তুমিই এসব কথা বলেছ ছেলেটাকে। নিশ্চয় বলেছ স্বপ্নে দেখেছ তুমি, আর ছেলেটাও…।
মিসেস নিকারো কিছু বলেনি আমাকে, প্রতিবাদ করল কিশোর। টাকাটা কোথায় আছে, তা-ও বলে দিতে পারি। মিস্টার রোজারের ফ্রিজে একটা আইসক্রীমের প্যাকেটে…।
ঠাস করে কিশোরের গালে চড় মারল রক।
মাথা নাড়তে নাড়তে বিল বলল, বোকামি করে ফেলেছ তুমি, রক। তোমাকে যেতেই হচ্ছে আমাদের সঙ্গে। যা করলে না…।
ঝট করে পিস্তল বেরিয়ে এল রকের হাতে।
ছেলেটা তাহলে সত্যিই বলেছে, চকচকে নলটার দিকে তাকিয়ে বলল বিল।
পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল পিনটো, তার কথা ভুলেই গিয়েছিল রক। নড়ে উঠল সে। এত দ্রুত, গুলি করারও সময় পেল না রক। ঘাড়ে এসে লাগল কারাতের কোপ। একবার মাত্র চিৎকার করল রক, হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল, টলে উঠে মেঝেতে পড়ে গেল সে।
পিস্তলটা তুলে রকের দিকে তাক করল বিল।
গুঙিয়ে উঠল রক। ঘাড়ে হাত ডলতে ডলতে উঠে বসল। কলার চেপে ধরে তাকে টেনে তুলল পিনটো। টানতে টানতে নিয়ে গেল বাইরে। বিল গেল পেছনে।
ঝমঝম করে একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে মোটেলের ছাতে। টানাটানি করে বাঁধন খোলার চেষ্টা করল এলসি।
আটকে রাখার চেষ্টা করলাম ওদেরকে, যতক্ষণ পারলাম, কিশোর বলল। পনেরো মিনিট সময় দিয়ে এসেছিলাম মিস্টার রোজারকে। নিশ্চয় পুলিশকে খবর দিয়েছে। পালাতে পারবে না ওরা, তার আগেই পৌঁছে যাবে পুলিশ।
আমি ভাবছি অন্য কথা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল মিসেস নিকারো। পুলিশের আগেই অন্য কিছু আসবে। আমরা এঘর থেকে বেরোনোর আগেই।
কি? বলেই চমকে উঠল এলসি। একটা শব্দ! ঝড়-বৃষ্টির নয়। মনে হল, শব্দটা এসেছে মাটির নিচ থেকে। বিচিত্র এক ধরনের গোঙানি। কাছেই কোথাও ঝনঝন করে কাচ ভাঙল জানালার।
মাই গড! চেঁচিয়ে উঠল এলসি।
আমার স্বপ্ন! ফিসফিসিয়ে বলল, মিসেস নিকারো। বলেছিলাম না বিপদ! ভয়ানক বিপদ আসছে! হুঁশিয়ার করেছিলাম ছেলেটাকে, শুনল না! রবিনের উদ্দেশে বলল সে। চোখ মুদে বিড়বিড় শুরু করল ইটালিয়ান ভাষায়, প্রার্থনা করছে।
মড়মড় করে উঠল কাঠ। আবার কাচ ভাঙল। থরথর করে কাঁপছে বাড়িটা। ভূমিকম্পের মতই, কিন্তু ভূমিকম্প নয়-ভাবল রবিন। ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছলে সরে যাচ্ছে মোটেলের নিচের মাটি।
২০
দুলে উঠল ঘরটা।
মেঝেতে পড়ে ল্যাম্প ভাঙল, ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে গেল, ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি ছিটাচ্ছে।
আগুন যেন না ধরে! ঈশ্বর! প্রার্থনা করছে এলসি। আগুন ধরতে দিয়ো না!
আরও ফুলঝুরি ছিটল কয়েক সেকেণ্ড, তীব্র নীলচে সাদা আলো ঝিলিক দিল। তারপর অন্ধকার। কাঠের গোঙানি বাড়ছে। রোম-খাড়া-করা কিচকিচ আওয়াজ তুলে কাঠের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে জোড়ার পেরেকগুলো।
ভীষণ ভাবে দুলে উঠল আরেকবার ঘরটা। চেঁচিয়ে উঠল মিসেস নিকারো।
বাঁচাও! আল্লা! চিৎকার শুরু করল মুসা। এই কেউ শুনছ? বাঁচাও!
কেউ জবাব দিল না। সাহায্য করতে এল না কেউ।
আর বাঁচব না! এলসি বলল। পাহাড়টাই ধসে যাবে রে, আর বাঁচব না…!
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হড়কে আরও দুই মিটার সরে গেল বাড়িটা। অন্ধকারে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল চেয়ারগুলো। মুসা গিয়ে পড়ল বিছানার ওপর, কিশোরের চেয়ারটা গেল কাত হয়ে।
মিসেস নিকারো? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনি ঠিক আছেন?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ? এই অবস্থায় ভাল থাকা যায়? এলসি, তুমি কোথায়?
মেঝেতে।
পুলিশ আসবেই, কিশোর বলল। নিশ্চয় খবর দিয়েছে মিস্টার রোজার। রবিন, ভাল আছ? মুসা, কোথায় তুমি?
আছি, গলা কাঁপছে রবিনের।
আমি এখানে, জবাব দিল মুসা।
অপেক্ষা করছে ওরা। শুনছে। জলস্রোতের শব্দ কানে এল, ছাত থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ নয়। বেকায়দা ভঙ্গিতে কাত হয়ে আছে কিশোর। হাত ব্যথা করছে, বাধা জায়গাগুলোতে। কাদা আর রাসায়নিক পদার্থের ভেজা ভেজা একটা গন্ধ আসছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। বুঝতে পারল, ভেঙে যাচ্ছে। সুইমিং পুলের পাড়। হাজার হাজার গ্যালন পানি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ওপর, কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
খাইছে! পানি আসছে কোত্থেকে! অন্ধকারে শোনা গেল মুসার গলা।
কিশোরের মত এলসিও বুঝে গেছে কারণটা। সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে শুরু করল আবার।
এইবার জবাব মিলল।
ওখানে! চিৎকার করে বলল একটা কণ্ঠ। ওরা ওখানে!
দরজা খোলার চেষ্টা করল কেউ। কিন্তু আটকে গেছে ওটা। ভয়ঙ্কর আরেক দুলুনি। পুলের দিকে মুখ করা জানালাগুলো ভেঙে কাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আলো দেখা গেল। টর্চ হাতে ঘোরাঘুরি করছে দুজন লোক। হইচই করছে। কলকল করে পানি ঢুকতে আরম্ভ করল ঘরে। ভাঙা জানালার সামনে দেখা গেল একটা মুখ।
মিসেস নিকারোকে আগে তুলুন, চেঁচিয়ে বলল কিশোর। মিসেস নিকারো!,
জানালা দিয়ে ঢুকল একজন পুলিশ। তার পেছনেই একজন ফায়ারম্যান। টর্চের আলোয় বন্দিদের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল সে, সর্বনাশ…!
চোখের পলকে এসে মিসেস নিকারো আর এলসিকে তুলে নিল দুজনে, বাঁধা অবস্থায়। গলা ফাটিয়ে এখনও ঈশ্বরকে ডেকে চলেছে দুই মহিলা। আরও লোক ঢুকল ঘরে। তিন গোয়েন্দাকেও বের করা হল। বাঁধন কেটে দেয়া হল সকলের। একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না কেউ। নামতে শুরু করল পাহাড় থেকে। বার বার হোঁচট খেয়ে, পিছলে পড়ে, অনেক কষ্টে অবশেষে হাইওয়েতে নেমে এল ওরা।
সেখানে গাড়ির ভিড়, অনেক ইঞ্জিনের গুঞ্জন। সার্চলাইটের আলো যেন ঝাড়ু দিয়ে ফিরছে সমস্ত পাহাড়টাকে।
বলেছিলাম না, ওখানেই আছে! ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে লাগল রোজার। কাছে এসে কিশোরের হাত ধরে প্রায় নাচতে শুরু করল। আমি বলেছি ওদের, তোমরা ওখানে। যাক বাঁচা গেল। থ্যাঙ্ক গড!
আরি, আমার বোট! হঠাৎ চিৎকার করে বলল মিসেস নিকারো।
বাড়িটা অন্ধকার, অফিসটাও। জেটির ধারে সাদা ট্রাকটা এখন নেই। একশো মিটার দূরে দেখা গেল ছুটন্ত আলো, টিনার।
ডাকাত! ডাকাতেরা আমার বোট নিয়ে গেল? চেঁচিয়ে বলল এলসি। যদি মনে করে থাকে। বাক্যটা শেষ করল না সে। দৌড় দিল জেটির দিকে।
এস! বলেই রবিনের হাত ধরে টানল মুসা। ছুটল এলসির পেছনে।
মিস্টার রোজার, কিশোর বলল। পুলিশকে বলুন কোস্ট গার্ডককে জানাতে। বোটের লোকগুলো আর্মস স্মাগল করছে।
তুমি যাও, মিসেস নিকারো বলল। আমি বলছি সব।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কিশোরও দৌড় দিল।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে অফিসে ঢুকল এলসি। টান মেরে খুলল একটা ড্রয়ার। একটা চাবি তুলে নিয়ে মুসাকে বলল অফিসের পেছনের লকার থেকে দুটো দাঁড় নিয়ে আসতে।
হাইওয়েতে হট্টগোল শুরু হল। গর্জে উঠল একটা বড় ট্রাকের ইঞ্জিন। বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে ভাঙল মোটেলটা, ভাঙা টুকরো-টাকরা ছিটকে গেল এদিক ওদিক। বাড়ি-ভাঙা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে গেল রাস্তার একপাশের অর্ধেকটা। ভেঙে গেছে সুইমিং পুলের পাড়, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে এল কাদা মেশানো পানির স্রোত। বান ডাকল যেন পথের ওপর।
সেদিকে চেয়ে মাত্র একটা মুহূর্ত নষ্ট করল এলসি। তারপর ঘুরেই দৌড় দিল বৃষ্টিভেজা ডকের দিকে। পেছনে তিন গোয়েন্দা।
সাইমনের স্পীডবোটটা নেব আমরা, এলসি বলল। টিনার চেয়ে স্পীড বেশি ওটার।
জেটিতে বাঁধা রয়েছে একটা দাড়টানা নৌকা। লাফ দিয়ে তাতে উঠল এলসি। দুলে উঠল নৌকাটা। তিন গোয়েন্দাও উঠল। দড়ি কেটে দিল কিশোর। ছপাৎ করে পানিতে দাঁড় ফেলল মুসা।
আরে, টিনার আলো কই! এলসি বলল। দেখা যাচ্ছে না আর।
উপকূল ধরে যাচ্ছে। মোড় নিয়েছে বোধহয়, বলল কিশোর।
সারেঙও না সারেঙের জাতও না বিল। পাথরে ধাক্কা লাগিয়ে বোটটা ডোবাবে আজ!
স্পীডবোটের গায়ে লাগল নৌকা। টান দিয়ে ককপিটের তেরপল সরাল ওরা। এলসি উঠল, আগে। তারপর মুসা আর রবিন। ইতিমধ্যে বয়ার সঙ্গে নৌকাটা বেঁধে ফেলেছে কিশোর। খুক করে ছোট্ট কাশি দিয়েই স্টার্ট হয়ে গেল চমৎকার ইঞ্জিন। ছুটল বোট।
বৃষ্টির বিরাম নেই। বাতাসাওও পাল্লা দিয়ে চলেছে। বড় বড় ঢেউ। বোটের তলায় চাপড় মেরে যেন কামানের গর্জন তুলছে। অভিজ্ঞ দক্ষ হাতে হুইল ধরেছে এলসি। গাদাগাদি করে বসে বোটের ধার আঁকড়ে ধরে রেখেছে ছেলেরা, যাতে ঝাঁকুনির চোটে উড়ে গিয়ে না পড়ে সাগরে।
আলোটা প্রথম রবিনের চোখে পড়ল। দূরে চলে গেছে। অস্পষ্ট। হাত তুলে বলল, ওই যায়!
বোটের গতি আরও বাড়িয়ে দিল এলসি। উত্তাল এই সাগরে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে।
হঠাৎ জ্বলে ওঠা উজ্জ্বল আলো ক্ষণিকের জন্যে যেন অন্ধ করে দিল ওদের। উত্তেজনায় এতক্ষণ খেয়াল করেনি, এখন কানে আসছে হেলিকপ্টারের রোটরে ক্যাট-ক্যাট-ক্যাট-ক্যাট। গাঢ় অন্ধকারে চাদর ফুড়ে কালো পানিতে বদমাশদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সার্চলাইট।
কোস্ট গার্ড! এলসি বলল।
নিভিয়ে ফেলা হয়েছে টিনার আলো। কালো আকাশের পটভূমিতে কালচে একটা ছায়ার মত এখন চোখে পড়ছে ওটা। কাছে চলে এসেছে স্পীডবোট। আবছামত দেখা যাচ্ছে চলার পথে টিনার রেখে যাওয়া ফেনিল জলরেখা।
এহ্হে! চেঁচিয়ে উঠল এলসি। গভীর সাগরের দিকে চলে যাচ্ছে। শয়তানের দল! বেরিয়ে যাবে!
একবারে হুইলের পুরো অর্ধেকটা ঘুরিয়ে দিল সে। মোড় নিতে গিয়ে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে গেল স্পীডবোট। গোঁ গোঁ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাল ইঞ্জিন। টিনার জলরেখা ধরে ছুটল লাফিয়ে লাফিয়ে। দেখতে দেখতে চলে এল বোটটার পাশে। রাইফেলের শব্দ শোনা গেল, স্পীডবোটকে সই করে গুলি আরম্ভ করেছে।
ইতরের বাচ্চা! গাল দিল এলসি।
সামনে চলে এল স্পীডবোট। শাঁ করে বেরিয়ে গেল বোটের নাকের ডগা দিয়ে। ধাক্কা বাঁচাতে গিয়ে বোটেরও নাক ঘুরিয়ে ফেলতে হল। কাত হয়ে যাচ্ছে। উল্টে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে দেয়া হল গতি।
আবার গুলির শব্দ। এবারও ব্যর্থ হল নিশানা। বোটের কাছে পানিতে পড়ল বুলেট।
এই সময় খোলা সাগরের দিক থেকে ফিরে এল হেলিকপ্টার। ওটার শক্তিশালী নীলচে-সাদা আলো যেন বিদ্ধ করল টিনাকে।
পেয়েছে এতক্ষণে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তাকাল তীরের দিকে। ওখানকার আলোগুলো বেশি কাছে মনে হচ্ছে এখন।
কিন্তু কোস্ট গার্ডদের কাটারটা কই? জাহাজটাকে দেখার জন্যে এদিক ওদিক তাকাল এলসি।
টিনার গতি আবার বেড়েছে। একেবেঁকে ছুটছে, যেন জেঁকের মত লেগে থাক্কা হেলিকপ্টারের আলোকরশ্মি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে গা থেকে। তীরের দিকে গিয়ে বাঁচতে পারবে না, বুঝে গেছে, আবার মুখ ঘোরাল খোলা সাগরের দিকে।
হা-হা করে হেসে উঠল এলসি। আবার স্পীডবোটটাকে নিয়ে এল টিনার গলুইয়ের সামনে। ধাক্কা লাগার ভয়ে আবার গতি কমাতে বাধ্য হল বোটের সারেঙ।
বাঁয়ে দেখল কিশোর, মাথায় ফেনার মুকুট পরে তাথৈ নৃত্য জুড়েছে ঢেউ। ভীমগতিতে ধেয়ে আসছে বিশাল এক ঢেউ, যেন ছোটখাট এক পাহাড়।
হুঁশিয়ার! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাল এলসি। কাত হয়ে উল্টে যাওয়ার অবস্থা হল স্পীডবোটটার। পানির পাহাড়ের প্রায় গা ছুঁয়ে বেরিয়ে চলে এল কোনমতে।
টিনা পারল না। গা বাঁচাতে গিয়ে পাশে কাটল। চোখা পাথরে ঘষা লেগে ছিঁড়ে রয়ে গেল অর্ধেকটা তলা। কাঠ ভাঙার মড়মড় তো নয়, মুসার মনে হল বোটটার অন্তিম আর্তনাদ। লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠে গেল টিনা, ঝপাং করে পড়ল আবার। চেঁচাতে শুরু করল আরোহীরা। লকলক করে উঠল কমলা-আগুনের জিভ।
হায় হায়, আগুন লেগে গেছে! ককিয়ে উঠল এলসি।
কাত হয়ে ভাসছে এখন টিনা, ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। এলসি কাঁদছে। আগুনের আলোয় দেখা গেল, তার দুগালে অশ্রুধারা। কাঁদতে কাঁদতে বলল, নিশ্চয় ফুয়েল লাইন ফেটে গেছে!
টিনার ডেক থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ল একজন, তারপর আরেকজন। শেষে আরও দুজন।
নোঙরটা তুলে নাও একজনে, কঠিন কণ্ঠে বলল এলসি। বিন্দুমাত্র মায়া করবে না। আমাদের বোটে যেন উঠতে না পারে।
পারবে না, ম্যাডাম, কথা দিল মুসা। দুহাতে ধরে তুলে নিয়েছে ভারি নোঙরটা।
স্পীডবোটের দিকে সাঁতরে আসতে দেখা গেল একজনকে। সিটের নিচে লাইফজ্যাকেট আছে, আবার বলল এলসি। বের কর ওগুলো।
রবিন আর কিশোর মিলে বের করল। একটা জ্যাকেট ছুঁড়ে দিল কিশোর। ওটা ধরে সাঁতরে আরও কাছে চলে এল বিল, স্পীডবোটে ওঠার ইচ্ছে। বাড়ি মারার জন্যে নোঙর তুলল মুসা। থেমে গেল বিল। আর কাছে আসার চেষ্টা করল না। অন্য তিনজনও স্পীডবোট থেকে দূরে রইল। একটা করে জ্যাকেট ছুঁড়ে দিল সবাইকে কিশোর।
লম্বা একটা দড়ি খুঁজে বের করল রবিন। বোটের সঙ্গে একমাথা বেঁধে দড়িটা ছুঁড়ে দিল পানিতে। যাতে ওটা ধরে ভাসতে পারে বিল আর তার তিন সঙ্গী।
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। গ্রাস করে নিয়েছে পুরো বোটটাকেই। আলোয় আলোকিত করে ফেলেছে সাগরের একটা অংশ। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ, উড়ে চলে গেল বোটের একাংশ, বাকিটা টুপ করে ডুবে গেল পাথরের মত।
অবশেষে এল কোস্ট গার্ডদের জাহাজ। তখনও দুর্ঘটনার জায়গায়ই অপেক্ষা করছে স্পীডবোট। দড়ি ধরে ঢেউয়ের মধ্যে খাবি খাচ্ছে চার ডাকাত। টিনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
২১
এক হপ্তা পর। আবার উত্তরে চলেছে তিন গোয়েন্দা। মোড় নিয়ে সাইপ্রেস ক্যানিয়ন ড্রাইভে নামল তিনটে সাইকেল। নুমেরিজ ইন-এ পৌঁছে দেখল, ওদেরই অপেক্ষা করছেন মিস্টার ভিকটর সাইমন। সাগরের দিকে মুখ করা মস্ত ঘরটায় বসে আছেন তিনি। কাচের টেবিলে খাবার সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিম, হাসি হাসি চেহারা। ছেলেদের দেখেই ঘোষণা করল, আজ সব আমেরিকান খাবার। গুবারের পানাট-বাটার-মার্শম্যালো-ফ্লাফ স্যাণ্ডউইচ। রসাল ফ্র্যাঙ্কফর্টারস। বার্গার অন সানশাইন ব্র্যান বান, আর পিকি পিকল টেস্ট-ট্রিট রেলিশ। বলে চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বাউ করে বেরিয়ে গেল ভিয়েতনামী।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস্টার সাইমন। ব্র্যাণ্ড নেম বলে টিভিতে বিজ্ঞাপন না দিলে বাজারে গিয়ে মনে হয় খাবারই কিনতে পারত না কিম।
খাবারগুলো দেখে কিন্তু ভালই মনে হচ্ছে, রবিন বলল।
ভ্রূকুটি করলেন লেখক। পানাট-বাটার-মার্শম্যালো-ফ্লাফ স্যাণ্ডউইচ খেতে পারবে তুমি?
দ্বিধায় পড়ে গেল রবিন। জানি না। তবে ফ্র্যাঙ্কফুর্টার খেতে পারব।
বাকিগুলোও না পারার কোন কারণ নেই, মুসা বলল। অবশ্যই যদি শুয়োরের মাংস না থাকে।
শুরু করে দাও তাহলে, বললেন সাইমন।
দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল হ্যামবার্গার আর ফ্রাঙ্কফুর্টারগুলো। কিন্তু স্যাণ্ডউইচগুলো ছুঁয়েও দেখল না কেউ। সন্দেহের চোখে বার বার ওগুলোর দিকে তাকাচ্ছে মুসা। বলল, কয়েকটা খেয়ে দেখলে কেমন হয়? কিমের কথায় মনে হল, ওগুলোতেই বেশি আগ্রহ তার। না খেলে দুঃখ পাবে বেচারা।
পেলে আর কি করা? তাকে বুঝতে হবে, স্বাদ পায় বলেই খায় লোকে। বিস্বাদ হলে খেতে পারত না। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ওষুধ দরকার, কিন্তু সহজে খেতে চায় কেউ? হাত নাড়লেন সাইমন। খাবারের আলোচনা থাক। কেসের কথা বল। কয়েকবার ফোন করেছি এলসিকে, জবাবই দিতে চায় না। মেজাজ তেতে তার চুলের মতই লাল হয়ে আছে। বিলের কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
এত রাগ নিশ্চয় টিনার জন্যে? মুসা বলল।
না। পুলিশ বিলের গায়ে তাকে হাত লাগাতে দেয়নি বলে।
হাসল কিশোর। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে বিল। নাক-মুখের চামড়া আর থাকত তাহলে। যা বড় বড় নখ দেখেছি এলসির হাতে।
রাগে অন্ধ হয়ে আছে মেয়েটা। ভাগ্যিস টিনার বীমা করা আছে। নইলে আত্মহত্যাই করে বসত। তোমাদের তদন্তের কথা খুলে বলবে, প্লীজ? খবরের কাগজে যা যা জেনেছি, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। জীবনভর গোয়েন্দাগিরি করে করে স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে, খুঁটিনাটি না জানলে এখন আর ভাল লাগে না। খালি খুঁতখুঁত করে মন।
কেস রিপোর্ট পড়তে চান? রবিনের হাতে বড় একটা খাম, সেটা দেখিয়ে, জিজ্ঞেস করল। মিস্টার ক্রিস্টোফারের অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি নেই। দেশের বাইরে গেছেন। এলে তারপর দেব। ইচ্ছে করলে পড়তে পারেন।
চাই মানে? হাত বাড়ালেন সাইমন। দেখি।
নীরব হয়ে গেল ঘরটা। কোস্ট হাইওয়েতে শোনা যাচ্ছে যানবাহনের শব্দ। পাতার পর পাতা উল্টে চলেছেন সাইমন, গভীর মনোযোগে পড়ছেন। পড়া শেষ করে তাকালেন সাগরের দিকে। বললেন, অনেক সময় ছোটখাটো ব্যাপারই মানুষের সর্বনাশ করে ছাড়ে। রক ওই মানিব্যাগের লোভটা না করলেই আর ধরা পড়ত না। ধরা পড়ায় অবশ্য ভালই হয়েছে। অনেক লোকের জীবন বেঁচেছে। অস্ত্রগুলো নিয়ে যেতে পারলে কত লোক যে মারা যেত জানতেই পারতাম না কোনদিন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বিলের মত মানুষ মেসা ডিওরোতে আরও আছে। আমরা শুধু অস্ত্রের একটা চালান বন্ধ করতে পেরেছি।
রোজারের কি খবর? সন্দেহমুক্ত হয়েছে নিশ্চয়? কাগজে তো কিছু লেখেনি।
হয়েছে। পুলিশের কাছে মুখ খুলেছে বিল আর তার সঙ্গীরা। গুপ্তচরগিরি আর দূতিয়ালী করত রক। বিলের গ্রুপের মত অনেক গ্রুপ আছে রিপাবলিকানদের। নেতাদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করত রক, এনে রাখত মিস্টার রোজারের ফ্রিজে। তারপর মাসে একবার প্লেনে করে যেত মেকসিকো সিটিতে, রডরিগেজদের কারও হাতে সেই টাকা দিয়ে আসত। সব না। কিছু কিছু করে রেখে দিত নিজের জন্যে, বুঝতে পারেনি কেউ।
রকই জিনো, তাই না?
হ্যাঁ। রক জিনিমুর রেনাল্ড। মায়ের দেশ মেসা ডিওরো। বাপের নাম রেনান্ড, আমেরিকান। রকের নানার নামও ছিল জিনিসুর, রিপাবলিকানদের একজন বড়সড় নেতা ছিলেন। রকের মা-ও ছিলেন বড় নেত্রী। মায়ের মৃত্যুর পর রক যোগ দেয় রিপাবলিকানদের দলে।
হুঁ। আচ্ছা, কি করে বুঝলে, ব্যাংক ডাকাতির কিছু টাকা রেখে দিয়েছে সে?
বুঝিনি, আন্দাজেই বলে ফেলেছিলাম। কিছু একটা বলে দেরি করাতে চাইছিলাম ওদের, তাই বিলের মনে সন্দেহ ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলাম, মুসল কিশোর। কাজে লেগে গেল ফন্দিটা।
অন্ধ কে সেজেছিল? নিশ্চয় রক?
হ্যাঁ, জবাব দিল রবিন। তার গাড়ির ট্রাংকে উইগ আর মেকাপের সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। অ্যাট্রানটো সেজে ডাকাতি করতে যাওয়াটাকে বেশ একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার মনে করেছিল রক।
হাসলেন সাইমন। ওদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার মূলে ওই রক। মাইসের কথা বল। মুভিং কোম্পানিটা একটা ভাঁওতা, তাই না? আসলে ব্যবসা করত বেআইনী অস্ত্রের?
হ্যাঁ, জবাব দিল মুসা। গা ঢাকা দিয়েছে মাইস। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, এখনও ধরতে পারেনি।
এখন আসল কথাটা বল। সিনথিয়া ব্যানালিসের সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক?
কোন সম্পর্ক নেই। তার বাড়ি মেসা ডিওরোতে, বিলকে চেনে, ব্যস। রিপাবলিকানদের সাপোর্ট করে, তবে টেরোরিস্টদের নয়।
বিলের সঙ্গে ঝগড়া লাগল কি নিয়ে?
তাকে নিজের দলে ঢোকাতে চাইছিল বিল। সিনথিয়া রাজি হয়নি।
ভাল করেছে, খামটা রবিনের হাতে ফিরিয়ে দিলেন সাইমন। ভাল কাজ দেখিয়েছ তোমরা। আচ্ছা, তোমাদের এই গল্প নিয়ে যদি একটা বই লিখে ফেলি, আপত্তি আছে?
আমাদের নেই, বলল কিশোর। তবে মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমার মনে হয় রাজি হবেন তিনি। আপনি বই লিখে দিলে ছবি। বানাতে সুবিধে হবে তার।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। সে-ই ভাল। আগে তাকে জিজ্ঞেস করে নাও, গাল চুলকালেন লেখক। তা আমার সঙ্গে সাগরে বেড়াতে যাচ্ছ কবে?
ছিপ নেবেন তো, স্যার? মুসা জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুসার সারা মুখে। তাহলে যখন বলবেন তখনই।