- বইয়ের নামঃ খোঁড়া গোয়েন্দা
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
খোঁড়া গোয়েন্দা
১
ইস, কি বৃষ্টিরে বাবা! বলল, রেনকোট পরা মহিলা।
এক ঝলক ঝড়ো হাওয়া হয়ে গেল, উইলশায়ার বুলভারের ওপর দিয়ে। টান দিয়ে কেড়ে নিতে চাইল মহিলার ছাতা, পারল না। কিন্তু পুরোপুরি উল্টে গেল ছাতাটা, মট মট করে ভাঙল তিনচারটা শিকের জোড়া। ধেয়ে গেল বাতাস, ঝাপটা মেরে বৃষ্টি দিয়ে ভিজিয়ে দিল জানালার কাচ।
বাস স্টপ-এ দাঁড়ানো রবিনের মনে হল, ছাতাটার জন্যে চিৎকার করে কাঁদরে মহিলা। চেয়ে আছে দোমড়ানো কাপড়ের দিকে। রবিনের দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল, যেন সব দোষ তার। তারপর, হঠাৎ হাসল মহিলা। আক্কেল হয়েছে আমার। ময়লা ফেলার ড্রামে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাতিল ছাতাটা। ক্যালিফোর্নিয়ার বৃষ্টি কেমন জানি না আমি? কেন বেরোলাম? বাস স্টপ লেখা সাইনবোর্ডের পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল সে।
ভেজা ঠাণ্ডা কাঁপুনি তুলল শরীরে, কাঁধ বাঁকা করে ফেলল রবিন। এপ্রিলে এরকম বৃষ্টি আর দেখেনি কখনও। ঈস্টার মানডের দিন, সন্ধ্যা প্রায় ছটা বাজে। ঠাণ্ডা তো আছেই, ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে অসময়েই অন্ধকার হয়ে এসেছে। সান্তা মনিকায় যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল সে, মা পাঠিয়েছেন একটা ফ্যাব্রিক স্টোর থেকে পোশাকের নতুন ডিজাইন আনার জন্যে। স্কুল ছুটি। এরকম আবহাওয়া থাকলে মাঠে মারা যাবে ছুটিটা। বাসের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
ওই দেখ, আসছে মানুষটা, মহিলা বলল। আহারে, চোখে দেখে না।
পথের দিকে তাকাল রবিন। বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে কানে এল লোকটার লাঠি ঠোকার ঠক ঠক। আরেক হাতে মগু, তাতে পয়সা।
বেচারা! আফসোস করল মহিলা। অন্ধ হওয়ার যে কি জ্বালা। প্রায়ই দেখি। কদিন হল এসেছে। রোজ ভাবি, কিছু পয়সা দেব।
পার্স খুলে ভেতরে হাতড়াতে শুরু করল, মহিলা। কাছে এল লোকটা। রবিন দেখল, পাতলা শরীর তার, সামান্য বাঁকা হয়ে হাঁটে। কানের কাছে তুলে দিয়েছে কোটের কলার। ভুরুর ওপর টেনে দিয়েছে কাপড়ের টুপি। চোখে কাল চশমা। উইন্ডব্রেকারের বুকের কাছে মলাটে লেখা রয়েছেঃ অন্ধকে দয়া করুন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন। ভিজে যাতে লেখাটা নষ্ট না হয় সেজন্যে মলাটটা মুড়ে রেখেছে প্লাস্টিক দিয়ে।
ইস, কি জঘন্য আবহাওয়া, মহিলা বলল। রাতও হয়ে এল। উঠে দাঁড়িয়ে হাতের মুদ্রাটা ফেলে দিল অন্ধের মগে।
গলা থেকে বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল লোকটার। লাঠি ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করছে কোথায় কি আছে। বেঞ্চটা কোথায়, আন্দাজ করে নিয়ে বসে পড়ল।
রবিন আর মহিলা দুজনেই এক মুহূর্ত দেখল লোকটাকে। তারপর ফিরল রাস্তার ওপাশে ব্যাংকের আলোকিত জানালার দিকে।
ঝাড়ু দেয়ার পর মোছার কাজ সবে শেষ করেছে ব্যাংকের ঝাড়ুদার। চকচক করছে সব কাউন্টার। চেয়ারগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে জায়গামত। ঝাড়ুদার মোট দুজন। একজনের গায়ে ওভারঅল, লম্বা এলোমেলো ধূসর চুল। সে পুরুষ। আরেকজন মহিলা, সে বেঁটে, মোটা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ওখান থেকে লবি ধরে অফিস বিল্ডিঙে যাওয়া যায়।
হাতে চাবির গোছা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংকের পেছন দিক থেকে এল সিকিউরিটি ম্যান। ব্যাংকের দরজার কাচ লাগানো পাল্লা খুলে দিল, ঝাড়ুদারদের বেরোনোর জন্যে। দুচারটা কথা বলল ওদের সঙ্গে।
লবি পেরিয়ে গিয়ে এলিভেটরে ঢুকল দুই ঝাড়ুদার। আবার অন্ধের দিকে ফিরল রবিন। টুপির নিচ দিয়ে বেরিয়ে আছে ধূসর চুল। গালে অযত্নে বড় হওয়া দাড়ি। চওড়া কুৎসিত একটা কাটা দাগ গালের ওপর থেকে ঢুকে গেছে দাড়ির ভেতর। বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেছিল নিশ্চয়, ভাবল রবিন, আর বোধহয় তাতেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে লোকটা।
সামনে বাঁকা হয়ে উঠতে গেল লোকটা। পা বেঁধে গেল লাঠিতে। আধ-বসা অবস্থায়ই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাত হয়ে গেল একপাশে।
আরি! লাফ দিয়ে এগোল মহিলা। লোকটার হাত চেপে ধরল, যাতে পড়ে যায়। হাত থেকে মগ ছুটে গেল লোকটার। মাটিতে পড়ল। ঝনঝন করে সমস্ত পয়সা ছড়িয়ে পড়ল এদিক ওদিক।
আমার পয়সা! প্রায় কেঁদে উঠল অন্ধ।
দিচ্ছি দিচ্ছি, তুলে দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি বলল মহিলা। আপনি বসে থাকুন।
ভেজা চত্বর থেকে মুদ্রাগুলো কুড়াতে শুরু করল মহিলা। খাজ আর পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলোতে খুঁজতে গেল রবিন। ময়লা ফেলার ড্রামের কাছে মগটা গিয়ে পড়েছে, তুলে এনে তাতে মুদ্রাগুলো ফেলল মহিলা।
সব পাওয়া গেছে? ককিয়ে উঠল লোকটা, আমার সারাদিনের কামাই!
তিনটে মুদ্রা পেয়েছে রবিন, সেগুলো মগে ফেলে বলল, মনে হয় না আর আছে।
মগটা অন্ধের হাতে ধরিয়ে দিল মহিলা। হাতের তালুতে ঢেলে পয়সাগুলোয়। আঙুল বোলাতে লাগল লোকটা, সব আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। আগের মতই বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই আছে।
বাস ধরবেন? মহিলা জিজ্ঞেস করল। ওই যে, আসছে।
নাহ্। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, ম্যাডাম। আমি এই কাছেই থাকি।
রাস্তার ওপাশে তাকাল রবিন। আবার ফিরে এসেছে ঝাড়ুদার লোকটা। ব্যাংকের দরজায় খটখট করছে। হাতে চাবির গোছা নিয়ে পেছন থেকে এল গার্ড। রজা খুলে দিল। সংক্ষিপ্ত কথা হল দুজনের মাঝে। তারপর ব্যাংকে ঢুকল ঝাড়ুদার।