- বইয়ের নামঃ বাক্সটা প্রয়োজন
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
বাক্সটা প্রয়োজন
১
বাবারে! বলে উঠল রবিন মিলফোর্ড। একেবারে আসল মালয়ী কিরিচ!
কিশোর পাশা আর মুসা আমানকে জিনিসটা দেখাল সে। চোখ চকচক করছে। বাড়ি থেকে মাইল কয়েক দূরের এক রোড সাইড মিউজিয়মে রয়েছে ওরা। আঙুল দিয়ে কিরিচের ধার পরখ করল মুসা।
বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। প্রাচীন আমলে ঈস্ট ইণ্ডিজ থেকে অনেক জাহাজ আসত ক্যালিফোর্নিয়ায়, বলল সে। এই মিউজিয়মের বহু জিনিস এসেছে প্রাচ্য থেকে। নীরবে তার লেকচার শুনতে লাগল দুই সহকারী।
এই, কি বকবক শুরু করেছিস ওখানে? ঘরের আরেক প্রান্ত থেকে ধমক লাগালেন মেরিচাচী। সুযোগ পেলেই বক্তৃতা..আয়, এখানে সায়। ট্রাকে মাল তুলতে হবে না?
আসছি, বলে দুই সহকারীর মুচকি হাসি উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল কিশোর।
বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে মিউজিয়মটা। জিনিসপত্র সব বিক্রি করে দিচ্ছে। সেগুলোই কিনতে এসেছেন মেরিচাচী। সাহায্য করার জন্যে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিন গোয়েন্দাকে। বড়দিনের ছুটির এই প্রথম দিনেই এরকম বিপদে পড়বে, ভাবতে পারেনি ওরা। তাহলে দূরে দূরে থাকত। অন্তত সকালবেলাটা মেরিচাচীর সামনে না পড়লেই চলত।
কি আর করবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে হাত লাগাল ওরা। এক এক করে জিনিস বয়ে নিয়ে গিয়ে দিতে লাগল ইয়ার্ডের কর্মচারী, বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান বোরিসকে। সে ওগুলো ট্রাকে তুলতে লাগল। ছেলেদের মনের অবস্থা বুঝে আপনমনেই হাসল সে, মৃদু শিস দিতে শুরু করল।
জিনিসপত্র বুঝে নিতে গেলেন মেরিচাচী, মিউজিয়মের মালিক মিস্টার ব্যানারের কাছে।
ওখানকার কাজ শেষ করে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলেন মেরিচাচী, ছেলেদের কাজ তদারক করতে। কয়েকটা বাক্স বাঁধায় হাত লাগালেন। মিস্টার ব্যানার গেলেন সামনের হলে, একজন লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্যে, এইমাত্র এসেছে লোকটা।
খানিক পরেই মেরিচাচী আর ছেলেদের কানে এল একটা উত্তেজিত কাকে কি কথা দিয়েছেন সে-পরোয়া আমি থোড়াই করি!
শান্তকণ্ঠে বললেন মিস্টার ব্যানার, দেখুন…।
তাকে কথা শেষ করতে দিল না লোকটা। দেখাদেখির কিছু নেই! ওটা এখুনি চাই আমার।
মিউজিয়মের জিনিস নিয়েই কথা কাটাকাটি হচ্ছে, বুঝতে পারলেন মেরিচাচী। তাড়াতাড়ি এগোলেন-হলের দিকে। পেছনে চলল তিন গোয়েন্দা।
ব্যানার বলছেন, সরি, মিস্টার, সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।
সেগুন কাঠের একটা বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তামার কারুকাজ করা বাক্স। ওটার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে খাটো একজন মানুষ। মুখে কালো চাপদাড়ি। রোদেপোড়া কুঁচকানো চামড়া। কোটরে বসা ঘন কালো চোখ। গালে দুটো গভীর কাটা দাগ ঢুকে গেছে দাড়ির ভেতরে। পোশাক দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, লোকটা সদাগরী জাহাজের নাবিক।
জ্বলন্ত চোখে মিস্টার ব্যানারের দিকে চেয়ে প্রায় গর্জে উঠল সে, দেখুন, এই বাক্স আমার। আমি এটা ফেরত চাই। হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি…।
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল মিউজিয়ম-মালিকের। শুনুন মিস্টার, আমি…।
মিস্টার মিস্টার করছেন কেন? আমার একটা নাম আছে। টিক বানাউ। লোকে নাম রেখেছে পানির পোকা, লোকটা জানাল গর্বের সঙ্গেই। অনেক পথ বয়ে এনেছি ওই বাক্স। ওটাতে বিপদ আছে, বুঝেছেন, বিপদ, ছেলেদের দিকে চোখ পড়তে বিড়বিড় করে কি বলল টিক, কে জানে, বোধহয় গালই দিল। ধমকে উঠল, এই, তোমাদের এখানে কি? সর, যাও, ভাগ। এই বেটি, তুমিও যাও?
চট করে মেরিচাচীর দিকে তাকাল একবার কিশোর। হাসি চাপতে কষ্ট হল।
রাগে টকটকে লাল হয়ে গেল মেরিচাচীর মুখ। কি, দাড়িওলা ছাগল! ভদ্রতা ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। আমি বেটি, না! দেখাচ্ছি মজা! এই কিশোর, বোরিসকে ডাক তো…! কথা আটকে গেল তাঁর।
মহিলা এত রেগে যাবেন, কল্পনাও করেনি নাবিক। তাছাড়া কাজের পোশাক পরে এসেছেন মেরিচাচী, টিক মনে করেছে, কাজের লোক–টোকই হবে। এখন বুঝল, ভুল করে ফেলেছে।
ভুল করেছেন আপনি, মিস্টার পানির পোকা, লোকটার ব্যবহারে ব্যানারও রেগেছেন। একজন মহিলাকে অপমান করেছেন। জানেন উনি কে? রকি বীচের সব চেয়ে বড় স্যালভিজ ইয়ার্ডের মালিক। এখানকার সমস্ত জিনিসপত্র, ওই বাক্স, সবই কিনেছেন।
চোখ মিটমিট করল নাবিক। আমি…আমি দুঃখিত, ম্যাডাম। মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। পানিতে পানিতে থাকি তো, ভদ্রতা আর কোথায় শিখব, বলুন? তাছাড়া অনেক দিন ধরে এই বাক্সটা খুঁজছি, আজ হঠাৎ পেয়ে গিয়ে মাথার ঠিক ছিল না।
লোকটা নরম হয়ে মাপ চাইতে মেরিচাচীও লজ্জিত হলেন। ছেলেরা বাক্সটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হাত বুলিয়ে দেখছে। বললেন, এটা আপনার হলে এখানে এল কিভাবে?
চুরি গিয়েছিল, ম্যাডাম। এক হারামজাদা চুরি করেছিল আমার জাহাজ থেকে। হপ্তা দুই আগে স্যান ফ্রান্সিসকোয় ভিড়েছিল, তখন। নিয়ে গিয়ে বেচে দেয় সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মাল বেচে ওরকম এক দোকানির কাছে। দোকানি সোজা পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। খোঁজ করতে করতে আমিও চলে এসেছি।
কিন্তু..।
মেরিচাচীর কথার মাঝখানে বলে উঠল রবিন, এই নামটা কার? ডালা তুলে ফেলেছে ওরা। ভেতরের দিকে লেখা লিটল মারমেইড নামটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার জাহাজের, মিস্টার বানা?
না, থোকা, টিক বলল। অনেক পুরানো বাক্স এটা। আমার হাতে পড়ার আগে কম করে হলেও পঞ্চাশ জনের হাত ঘুরে এসেছে। সিঙ্গাপুরে যখন বাক্সটা কিনলাম, তখনই ওই নাম দেখেছি।
ব্যানার জানালেন, গতকাল পেয়েছি এটা, মিসেস পাশা। মরিস ডিলম্যানকে বলে রেখেছিলাম, মিউজিয়মে রাখার মত জিনিস পেলেই যেন পাঠায়। পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা যে ছেড়ে দিচ্ছি, একথা আর জানানো হয়নি ওকে।
ন্যায্য দাম দিতে রাজি আছি আমি, টিক বানাউ বলল।
বেশ, বললেন মেরিচাচী। ধরে নিলাম, জিনিসটা আপনার। মিস্টার ব্যানার কিনেছেন, তারপর আমার কাছে।
কথা শেষ করতে পারলেন না এবারেও।
বিচিত্র খড়খড় শব্দ হল।
কী…? বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।
কট করে আরেকটা শব্দ হয়েছে।
ঝিক করে উঠল জিনিসটা। ডালার ওপর ঝুঁকে ছিল কিশোর, তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে গিয়ে দেয়ালে বিধল একটা ছুরি।
২
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পাথর হয়ে রইল যেন সবাই। দেয়ালে থিরথির করে কাঁপছে। ছুরির হাতল।
কিশোরের কাছে ছুটে গেলেন মেরিচাচী। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রায় ককিয়ে উঠলেন, এই, লাগেনি তো কোথাও! কিশোর?
মাথা নাড়ল কিশোর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না যেন, ধপ করে গিয়ে বসে পড়ল একটা পুরানো বেঞ্চে। বড় বাঁচা বেঁচেছে। অল্পের জন্যে চোখে লাগেনি ছুরিটা।
কে ছুঁড়ল? পাগলের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন ব্যানার।
আ-আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? এক পা পিছিয়ে গেল টিক।
কে-কে-কেউ ছুঁড়েনি! তোতলাতে শুরু করল রবিন। বাক্স থেকে বেরিয়েছে।
কাছে এসে ভেতরে তাকালেন ব্যানার। গড! ভেতরে গোপন খোপ খুলে গেছে! নিশ্চয় কোথাও হাত দিয়ে ফেলেছিলে, রবিনকে বলল। কোন গোপন সুইচ-টুইচে।…
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়, বলল রবিন। গোপন খোপেই ছিল ছুরিটা। খোপের ঢাকনা খুলতেই স্প্রিং ছুটে গেছে। বুবি ট্র্যাপ!
খাইছে! মুসা বলল। খোপ যে খুলবে…।
শাসানোনার ভঙ্গিতে টিক বানাউয়ের দিকে এগোলেন মেরিচাচী। যদি এটা আপনার কাজ হয়ে থাকে…।
বুবি ট্রাপ কাকে বলে তা-ই জানি না আমি! আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নাবিকের।
না, আপনি করেননি একাজ! কিশোর বলল। মুখে রঙ ফিরতে শুরু করেছে ওর। উঠে গিয়ে দেয়াল থেকে খুলে নিল ছুরিটা। প্রাচ্যের জিনিস এটা। যতদূর মনে হয়, পূর্ব ভারতীয়। বাজি রেখে বলতে পারি, শত বছর আগে ওই ফাঁদ পেতে রেখেছিল কোন জলদস্যু!
খাইছে!
জলদস্যু? রবিন বলল।
কিশোরের চোখ চকচক করছে। ছুরিটা নিয়ে বাক্সের কাছে ফিরে এল সে। গোপন খোপটা পরীক্ষা করতে লাগল। মাথা ঝাঁকাল সন্তুষ্ট হয়ে। বললাম না? স্প্রিং, হুড়কো, সব হাতে বানানো। মরচে পড়েছে। অনেক পুরানো। দামি জিনিস চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে এরকম ফাঁদ পাতা হত সেকালে। জাভা আর মালয়ের জলদস্যুরা এসব কাজে ওস্তাদ ছিল।
সবার চোখ ঘুরে গেল টিক বানাউয়ের দিকে।
না-না, তাড়াতাড়ি দুহাত নাড়ল পানির পোকা। আমি ওসব দেশের লোক নই। তবে জাভায় ছিলাম অনেকদিন। কোন জলদস্যুর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। জাভা জায়গাটা যে কোথায়, তা-ই আমি জানি না।
ইন্দোনেশিয়ার একটা বড় দ্বীপ, বলল কিশোর। কাছাকাছি আরও দ্বীপ আছে। সুমাত্রা, নিউ গিনি, বোর্নিও, সেলিবিস, এবং আরও হাজারও ছোট-বড় দ্বীপ। এখন ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন, কিন্তু আগে ওলন্দাজ কলোনি ছিল ওখানে। ছোট ছোট শত শত রাজ্য ছিল, ওগুলোকে বলা হত সালতানাত, শাসনকারীদের বলা হত সুলতান। বেশির ভাগই ডাকাত ছিল ওরা।
ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মত? জানতে চাইল মুসা। পাল তোলা জাহাজ, ভারি কামান, কালো পতাকায় মানুষের খুলি আর হাড়ের ছবি…।
না, ঠিক ওরকম নয়। এসব ছিল পশ্চিমা জলদস্যদের নিশানা। ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিল ইংরেজ। ঈস্ট ইনডিয়ান জলদস্যুদের বড় জাহাজ ছিল না, জলি রজার পতাকা ছিল না, কামানও ছিল খুব কম। ছোট দ্বীপগুলোতে থাকত ওরা। ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান জাহাজ দেখলেই তেড়ে এসে চড়াও হত।
পশ্চিমা জাহাজগুলো তখন ওসব অঞ্চলে যেত মশলা, টিন, চা আর চীন থেকে সিল্ক আনার জন্যে। নানারকম চমকপ্রদ জিনিস নিয়ে য়েত ব্যবসা করার জন্যে, আর নিত ব্যাগভর্তি সোনা-রূপা। অস্ত্রশস্ত্রও নিত। সেসব ছিনিয়ে নেয়ার জন্যেই হামলা চালাত জলদস্যুরা। তবে সব সময়ই হেরে আসত না পশ্চিমারা। পাল্টা হামলা চালাত। অনেক সময় তো ঘরে ঢুকে গিয়ে শেষ করে দিয়ে আসত জলদস্যুদের।
তারমানে এদেশীরাও কম ডাকাত ছিল না, হেসে বলল রবিন। তো, তোমার কি ধারণা? ওই অঞ্চল থেকেই এসেছে এই বুবি ট্র্যাপ?
ধারণা নয়, আমি শিওর, চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকাল কিশোর। শোনা, যায়, এখনও নাকি কিছু জলদস্যু আছে কোন কোন দ্বীপে।
কিশোর, দেখ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বাক্সের ভেতর ছোট একটা জিনিস পেয়ে তুলে দেখাল, আঙটি! খোপটাতে ছিল।
আর কিছু আছে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
ঠেলে মুসাকে সরিয়ে বাক্সের ওপর ঝুঁকল টিক। দেখি তো। ঘোড়ার ডিম আর কিছু নেই।
মুসার হাত থেকে আঙটিটা নিল কিশোর। নিখুঁত, সূক্ষ্ম খোদাই। সোনার হতে পারে, কিংবা তামার, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝখানে লাল একটা পাথর বসানো।
খাঁটি, কিশোর? মুসা জানতে চাইল।
বুঝতে পারছি না। হতে পারে। খাঁটি সোনার অলঙ্কার যেমন পরত ওখানকার লোকে মেকিও পরত। সোনার রঙ করা, কিন্তু সোনা নয়। ওসব দিয়ে ইউরোপিয়ানরাই বেশি ঠকাত দেশী লোকদের।
আঙটির জন্যে হাত বাড়াল টিক। আসলই হোক আর নকলই হোক, ওট আমার জিনিস, থোকা। বাক্সটা যেহেতু আমার, ভেতরের সব কিছুই আমার। দাম বল। আমার বাক্স আমি নিয়ে যাই।
দেখি আগে, কি কি আছে, মেরিচাচী বললেন। তারপর বলছি…
বাধা দিল কিশোর, চাচী, বাক্সটা কার, কিভাবে জানছি আমরা। নাম -তে আর লেখা নেই। ওরকম গপ্পো যে-কেউ এসে শোনাতে পারে।
আমাকে মিথ্যুক বলছ, ছেলে? খেপা ষাঁড়ের মত গোঁ গোঁ করে উঠল টিক।
বেশ, প্রমাণ করুন যে আপনি সত্যি বলছেন। কাগজ-টাগজ দেখান। কা; কাছ থেকে কিনেছেন, লিখিত আছে? নইলে এমন কাউকে গিয়ে নিয়ে আসুন, যে সাক্ষী দেবে এটা আপনার। বলবে, জাহাজে আপনার কাছে ছিল।
সবাই বলবে। আমার সঙ্গে যেসব নাবিক আছে, সব্বাই। এখন আমার জিনিস…।
ঠিক আছে, কিশোর বলল। বাক্সটা আমরা রেখে দেব। কারও কাছে বেচব। আপনি গিয়ে লোক নিয়ে আসুন। এক হপ্তা রেখে দেব আমরা। বাক্স ছাড়া ওই কটা দিন নিশ্চয় আপনার অসুবিধে হবে না?
হ্যাঁ, ভাল কথা বলেছ, মিস্টার ব্যানার বললেন। টিক বানাউয়ের চোখ জ্বলছে। যথেষ্ট হয়েছে। এত ভাল কথা লাগবে না। আমার। যা দরকার, সেটা নিয়ে তবেই যাব এখান থেকে, কেউ ঠেকাতে পারবে ন। কিশোরের দিকে এগোল। দাও দিখি আঙটিটা।
দরজার দিকে পিছাতে শুরু করল কিশোর।
এই, শুনুন, বাধা দিতে চাইলেন মেরিচাচী।
চুপ! বলে তাকে থামিয়ে দিল নাবিক।
বিশাল ছায়া পড়ল দরজায়। ঘরে ঢুকল ব্যাভারিয়ান। এই, কাকে ধমক দিলে? শান্তকণ্ঠে বলল সে। ম্যাডামকে? যাও, পায়ে ধরে মাপ চাও।
জোর করে বাক্সটা নিয়ে যেতে চাইছে! চেঁচিয়ে জানাল রবিন।
তাই নাকি?
ধরুন ওকে, বোরিস ভাই, কিশোর বলল।
ধরছি।
বোরিসকে দেখেই থমকে গিয়েছিল টিক। এগোতে দেখে মিস্টার ব্যানারের আড়ালে চলে গেল। শেষে বিপদ বুঝে এক ধাক্কায় মিউজিয়ম-মালিককে বোরিসের গায়ের ওপর ফেলে দরজার দিকে দিল দৌড়।
ধরুন, ধরুন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
চিত হয়ে পড়ে গেছে বোরিস। তার গায়ের ওপর পড়েছেন বেচারা ব্যানার। জট ছাড়িয়ে দুজনে যখন উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেছে টিক। মিউজিয়মের পেছনে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হল। ছুটে বাইরে বেরোল ছেলেরা। দেখল, ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে একটা গাড়ি। কোস্ট হাইওয়ে ধরে ছুটে হারিয়ে গেল পাহাড়ের মোড়ে।
ঝামেলা গেল, হাত ঝাড়লেন মেরিচাচী। কাজ সেরে ফেলা দরকার। দাঁড়িয়ে থেক না। মালগুলো তুলে ফেল। …
বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। বাক্সটার কী প্রয়োজন তার? এত আগ্রহ কেন?
সুন্দর দেখেছে তো, মেরিচাচী বললেন। ফাঁকি দিয়ে নিতে চেয়েছিল আরকি। যাও যাও, কাজ সেরে ফেল। একবারে শেষ হবে না মাল, আবার আসতে হবে।
ঘন্টাখানেক পর মালের ছোটখাটো একটা পাহাড় তৈরি হল ট্রাকের পেছনে। সামনে উঠে বসলেন মেরিচাচী আর বোরিস। পেছনে ছেলেদেরকে উঠতে সাহায্য করলেন ব্যানার।
মিস্টার ব্যানার, ভুরু কুঁচকে রেখেছে কিশোর। আপনি বললেন স্যান ফ্রান্সিসকোর মরিস ডিলম্যান বাক্সটা পাঠিয়েছে আপনার কাছে?
হ্যাঁ। স্থানীয় লোকের আগ্রহ রয়েছে জাহাজটার ওপর। একশো বছর আগে রকি বীচের কাছেই ডুবেছিল লিটল মারমেইড। মাঝে মাঝেই ওটার জিনিসপত্র বেরিয়ে আসে লোকের হাতে, আমার সামনে পড়লে কিনি…মানে, কিনতাম। এখন আর কিনব না।
নিশ্চয়। এখন আর কি দরকার, কিশোর বলল। হ্যাঁ, একশো নয়, কিছু কম। আঠারশো চুরানব্বই সালে ডুবেছিল জাহাজটা।
ছুটে চলেছে ট্রাক। ভাবনায় ডুবে আছে কিশোর। রবিন আর কিশোর কথা বলছে, দুপাশের দৃশ্য দেখছে।
ইয়ার্ডে পৌঁছল ট্রাক।
মুসা বলল, কিশোর, ফলো করা হয়েছে আমাদের। সবুজ একটা ফোক্সওয়াগেন। সারা পথ পিছে পিছে এসেছে।
লাফিয়ে ট্রাক থেকে নামল তিন গোয়েন্দা। ছুটে গেল গেটের কাছে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ফোক্সওয়াগেন। কিন্তু ভেতরে কে আছে, ছেলেরা সেটা দেখার আগেই স্টার্ট নিয়ে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলে পথে উঠল গাড়ি, মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
খাইছে! টিক বানাউ?
হতে পারে, কিশোর বলল। কিন্তু মিউজিয়ম থেকে তো উল্টোদিকে গিয়েছিল সে, এদিকে নয়। আমাদের পিছু নিল কিভাবে?
বাক্সটার ব্যাপারে আরও আগ্রহী লোক আছে হয়ত, রবিন বলল।
কিংবা হয়ত লিটল মারমেইডের ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে আগ্রহী। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কিশোর পাশা, উত্তেজনায় ফেটে পড়বে যেন। তিন গোয়েন্দার জন্যে আরেকটা কেস। আমরা এখন…
তোরা এখনও এখানে? পেছন থেকে ওদেরকে চমকে দিলেন মেরিচাচী। ট্রাকের মাল নামাবি কখন? জলদি কর, জলদি কর।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে মাল নামানোয় হাত লাগাল ছেলেরা। পুরানো বাক্সের রহস্য সমাধান আপাতত বাদ।
৩
মাল নামাতে নামাতে দুপুর। তদারকি রেখে যেতে পারছিলেন না মেরিচাচী, নামানো শেষ হলে রান্নাঘরে চললেন খাবার তৈরি করতে। এই সুযোগে ছেলেরা ফিরে এল পুরানো বাক্সের কাছে।
হেডকোয়ার্টারে নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, কিশোর বলল। তোমরা দুজনে আন। আমি যাই, কাজ আছে। কাউকে প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়ে ছুটে চলে গেল সে।
ভারি বাক্সটার কাছে দাঁড়িয়ে আনমনে মাথা নাড়ল মুসা। তারপর ফুসফুসে চেপে রাখা বাতাস ছেড়ে কুঁকল বাক্সটা তোলার জন্যে।
কোনমতে বাক্সটা বয়ে এনে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপের কোণে ধপ করে নামিয়ে রাখল দুজনে।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকবে না, মোটা পাইপটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।
হুঁ, মাথা দোলাল রবিন। সব আমাদের মাপের। বড় কিছু হলেই আর ঢোকানো যায় না।
সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে দুজনে, এই সময় দুই সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে বেরোল কিশোর।
হুমম! পাইপের মুখের দিকে একবার, আরেকবার বাক্সটার দিকে তাকাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। সহজ তিন দিয়ে ঢুকতে পারে, কি বল?
ট্রেলারে, অর্থাৎ হেডকোয়ার্টারে ঢোকার সব চেয়ে সহজ পথ হল সহজ তিন। ফ্রেম সহ একটা ওক কাঠের দরজা রয়েছে জঞ্জালের ভেতর। মরচে ধরা চাবি লুকানো থাকে একটা খোলে। সেটা দিয়ে দরজার পুরানো তালা খুললেই বেরিয়ে পড়ে সরু গলিপথ। পথটা চলে গেছে ট্রেলারের মূল দরজা অবধি।
চেষ্টা করার আগে, রবিন প্রস্তাব দিল। ট্রেলারের দরজার মাপ নেয়া দরকার।
হ্যাঁ, কিশোর বলল। ও, একটা কথা, সমস্তটাই টিক বানাউয়ের বানানো। গপ্পো, বুঝে ফেলেছি আমি।
বুঝে ফেলেছ! মুসা অবাক। কি করে বুঝলে?
মরিস ডিলম্যানের দোকানে ফোন করেছিলাম। কোন নাবিকের কাছ থেকে বাক্সটা কেনেনি সে। কিনেছে সান্তা বারবারার আরেক সেকেণ্ডহ্যাণ্ড দোকান
থেকে। সেই দোকানদার কিনেছে ছয় মাস আগে এক মহিলার কাছ থেকে।
খাইছে! টিক ব্যাটা তো তাহলে নাবিকও নয়, নাকি?
হলে অবাক হব না। নাবিকের ওরকম পুরানো পোশাক জোগাড় করা মোটেই কঠিন নয়। হয়ত ওসব পরে এসে আমাদের ধোকা দিতে চেয়েছে। কাঁচা কাজ। এত ভারি পোশাক পরার মত শীত নয় এখন।
টিক কল্পনাও করেনি, আমাদের সঙ্গে তার টক্কর লাগবে, রবিন বলল।
না, তা করেনি, স্বীকার করল কিশোর। যাই হোক, একটা কথা ঠিক বলেছে টিক। গতকাল ডিলম্যানের দোকানে গিয়েছিল সে। আরেকটা গল্প শুনিয়েছে। বলেছে, তার বোন বাক্সটা বিক্রি করে দিয়েছে। সে তখন বাড়ি ছিল না। ফিরে এসে জেনেছে। এখন বাক্সটা ফেরত চায়।
গল্প বদলাল কেন? মুসার প্রশ্ন।
হয়ত ভেবেছে, তার নাবিকের গল্প শুনে গলে যাব আমরা, বাক্সটা দিয়ে দেব তাড়াতাড়ি। বাক্সটা কেন চায়, সেকথা গোপন রাখতে চেয়েছে সবার কাছেই। তবে, ডিলম্যানের কাছে বলা তার গল্প একটা জিনিস বোধহয় প্রমাণ করে, যে মহিলা ছয় মাস আগে বাক্সটা বিক্রি করেছে, তাকে চেনে টিক। হয়ত বাক্স বিক্রির কথা জেনেছে ইদানীং, বেশিদিন হয়নি। আগে জানলে আগেই খোঁজ করত ওটার।
তাই তো! আচ্ছা, একটা কথা বল, এত চাইছে কেন বাক্সটা? খালি বাক্স, তেমন কিছু তো নেই।
শুধু আঙটিটা ছাড়া, মুসা বলল। তা-ও, এটাও মনে হয় তেমন দামি নয়।
আর আঙটিটার কথা টিক বানাউ জানত কিনা, সন্দেহ আছে, রবিন যোগ করল।
বাক্সে মূল্যবান কিছু আছে ভেবেছে হয়ত।
কিংবা হতে পারে, কিশোর বলল। লিটল মারমেইড থেকে এসেছে বলেই বাক্সটা দামি। হোক না ভাঙা জাহাজের বাক্স।
তোমার কি মনে হয়? জাহাজটার ব্যাপারে সে আগ্রহী? রবিন বলল। ওটাতেই কিছু আছে?
কি জানি। শোন, আঙটি আর ছুরিটা ছাড়া তো আর কিছু নেই বাক্সটায়। তার পরেও কেন ওটা চাইছে, জানতে হলে, আমার মনে হয় লিটল মারমেইডের ইতিহাস জানা দরকার।
হিসটোরিক্যাল সোসাইটির কিছু জানা থাকতে পারে, রবিন বলল।
মুসার মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমি যেতে পারব না। মার সঙ্গে বাজারে যেতে হবে। ওখান থেকে ফিরে বাড়িতে কাজ করতে হবে, বাবা বলে দিয়েছে।
আর, আমাকে আবার যেতে হবে মিউজিয়মে, বলল কিশোর। রবিন, তোমাকে একাই যেতে হচ্ছে।
যেতে হলে যাব। আমার অসুবিধে নেই, রবিন জানাল। লাইব্রেরিতে ঢুকে বই পড়া আর গবেষণামূলক কাজে আনন্দই পায় সে।
খানিক পরেই মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল। খাবারের জন্যে ডাকছেন।
সাইকেলে করে রকি বীচ হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে পৌঁছুঁতে তিনটের ওপরে বেজে গেল। ভেতরে ঢুকতে ধূসর-চুল এক মহিলা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসলেন রবিনের দিকে চেয়ে।
কি জানতে চায়, জানাল রবিন।
লিটল মারমেইড? মহিলা বললেন। নিশ্চয় শুনেছি। এক সময় বেশ আলোড়ন তুলেছিল জাহাজটা। গুজব রয়েছে, গুপ্তধন নাকি আছে ওটাতে।
গুপ্তধন?
সোনার মোহর, অলঙ্কার, এসব, হাসলেন মহিলা। লিটল মারমেইডে পাওয়া কিছু জিনিস আছে আমাদের কাছে। দেখবে?
অবশ্যই দেখবে, জানাল রবিন। উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। কজা লাগানো একটা ফাইল বক্স বের করলেন মহিলা।
বাক্সটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে এসে পড়ার ঘরে ঢুকল রবিন। সে একা, আর কেউ নেই ওখানে। লম্বা টেবিলের সামনে বসে বাক্সটা খুলল।
ভেতরের জিনিস দেখে অবাক হল সে। কাগজ, পুস্তিকা, ছোট বই, খবরের কাগজের কাটিং, ম্যাগাজিনের আর্টিক্যাল গাদাগাদি করে রাখা। অগোছাল, একটা কাগজ তুলতে যাবে, এই সময় ঘাড়ের ওপরে কথা শোনা গেল, পড়তে সারাদিন লেগে যাবে।
চমকে ফিরে তাকিয়ে রবিন দেখল, ছোটখাটো একজন মানুষ। পরনে পুরানো ফ্যাশনের কালো সুট, ওয়েস্টকোট, আর সোনার চেনওয়ালা ঘড়ি। গোলগাল লাল চেহারা, চোখে রিমলেস চশমা।
আমি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির প্রফেসর হারম্যান কেইন, জানালেন তিনি। মিসেস ডেভিড তোমার আগ্রহের কথা বলল। লোকের, বিশেষ করে তোমার মত কমবয়েসীদের কৌতূহল মেটাতে ভালবাসি আমরা। আমাকে প্রশ্ন করতে পার।
হয়ত পড়ার ঝামেলা থেকে বাচবে।
লিটল মারমেইডের কথা কিছু জানেন, স্যার? জিজ্ঞেস করল রবিন।
নিশ্চয় জানি। আমি এখানে এসেছি, বেশিদিন হয়নি। তবে আমার এক সহকর্মী ওই জাহাজটার ওপর একটা পুস্তিকা লিখেছে। সেটা পড়েই জেনেছি। কি কি জানতে চাও তুমি, বল তো?
আমি জানি, লিটল মারমেইড একটা স্কয়ার-রিগার জাতের বড়সড় জাহাজ, রবিন বলল। আঠারশো চুরানব্বইয়ে ডুবেছিল রকি বীচের কাছে। গুজব আছে, গুপ্তধন পাওয়া যাবে জাহাজটাতে। ঠিক?
হাসলেন প্রফেসর। আগের দিনে যত জাহাজ ডুবেছে, খোঁজ করলে জানবে, সবগুলোতেই গুপ্তধন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, মানে গুজব রয়েছে। তবে সময়টা ঠিকই জান। রবিনের পাশের চেয়ারে বসলেন তিনি। তিন মাস্তুলের জাহাজ লিটল মারমেইড। স্কটল্যাণ্ডের গ্লাসগো থেকে ঈস্ট ইণ্ডিজে গিয়ে মশলা আর টিনের ব্যবসা করত। ব্যবসার জন্যেই এসেছিল স্যান ফ্রান্সিসকোয়। তারপর দক্ষিণে কেপ হর্নের দিকে রওনা হয়, সেখান থেকে স্কটল্যাণ্ডে ফিরে যেত। যাওয়া আর হল না, ঝড়ের কবলে পড়ল। আঠারশো চুরানব্বইর ডিসেম্বরে রাতের বেলা তীরের কাছাকাছি প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কা খেল ওটা।
ভয়ানক ঝড় বইছিল। বেঁচেছিল হাতে গোনা কয়েকজন। নাবিকেরা জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় করে তীরে ওঠার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। বেঁচেছে তারাই, যারা জাহাজ থেকে নামেনি, কিংবা নামতে পারেনি। ধাক্কা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে যায়নি জাহাজটা, টিকেছিল ভোর পর্যন্ত। ডোবার আগে পর্যন্ত ওটাতে ছিল ক্যাপ্টেন।
গুপ্তধন ছিল না?
আমার সন্দেহ আছে। অল্প পানিতে ডুবেছে জাহাজটা। ডুবুরিরা বহুবার খুঁজেছে ওটাতে। একশো বছরের মধ্যে অনেকবার। এখনও মাঝেসাঝে কেউ কেউ গিয়ে খোঁজ করে। সে আমলের কয়েকটা মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি ওটাতে। মাথা নাড়লেন প্রফেসর। না, ইয়াং ম্যান, লিটল মারমেইডে গুপ্তধন নেই। তবে গুজবটা সম্ভবত ছড়িয়েছে তার পরের আরেকটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
আরেকটা! তাড়াতাড়ি ঘুরে বসল রবিন, প্রফেসরের দিকে মুখ করে।
রকি বীচের কাছেই বাস করছিল লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া একজন স্কটিশ নাবিক বাওরাড ডাই। আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে চারজন লোকের হাতে খুন হয় সে। পসি করে খোঁজা হয় ওই চারজনকে। তারাও মারা পড়ে পসিদের হাতে, মুখ খোলার আগেই। ফলে জানা যায়নি, ডাইকে কেন খুন করেছিল ওরা। চারজনের একজন, লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেন। সে কারণেই লোকের সন্দেহ, কোন জিনিসের পেছনে লেগেছিল ক্যাপ্টেন, যা জাহাজ থেকে সরিয়ে ফেলেছিল ডাই। তারপর থেকে কতজন যে কতবার গিয়ে জাহাজটাতে খুঁজেছে। আশপাশের তীরভূমি, ডাইয়ের বাড়ি আর চারপাশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিছুই পায়নি।
অনেক নাবিকের মত, বাওরাড ডাইও জার্নাল রাখত। পরে, তার বংশধররাই সেই জার্নালটা আমাদের সোসাইটিকে দান করেছে, পুস্তিকাটা লেখার সময় কাজে লাগবে বলে। ওই জার্নাল, আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে তৎকালীন শেরিফও পড়েছিল। বাইরের লোকে তো বটেই, ডাইয়ের বংশধরেরাও সন্দেহ করে, গুপ্তধন আছে। তারাও অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। পায়নি। জার্নালটাতে গুপ্তধনের কোন উল্লেখ নেই।
ভ্রূকুটি করল রবিন। আপনার কি মনে হয়, স্যার? ঈস্ট ইণ্ডিজ থেকে আনা কোন দামি জিনিস?
গুজব তো তাই বলে। জলদস্যুর সম্পদ। কেন? ও-ব্যাপারে তুমি কিছু জান নাকি?
ইয়ে, না, স্যার, আমতা আমতা করল রবিন। নিছক আগ্রহ। আই সী। হাসলেন প্রফেসর কেইন। কেন আগ্রহ, জানতে পারি?
আমরা….আমরা, স্যার….ওই স্কুলের ব্যাপার আরকি। বড়দিনের ছুটি তো। স্কুলের ম্যাগাজিনে গবেষণামূলক একটা লেখা লিখতে চাই।
ভাল, খুশি হলেন প্রফেসর। খুব ভাল। স্যার, জার্নাল আর পুস্তিকাটা দেখতে পারি? রিমলেস গ্লাসের ওপাশে হাসি ফুটল প্রফেসরের চোখের তারায়। স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে, না? নিশ্চয়। দেখ, কিছু আবিষ্কার করতে পার কিনা। তাহলে পুস্তিকার নতুন সংস্করণে তোমার নামও উঠে যাবে।
হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। ফিরে এলেন কয়েক মিনিট পর। সঙ্গে এসেছেন মিসেস ডেভিড। হাতে একটা পাতলা পাণ্ডুলিপি-লিটল মারমেইডের ওপর লেখা স্তিকার, আর অয়েলস্কিনে বাঁধানো একটা নোটবুক নিয়ে পড়তে আরম্ভ করল রবিন।
সন্ধ্যার একটু আগে সাইকেল চালিয়ে ফিরে এল স্যালভিজ ইয়ার্ডে। পেছন দিকে বেড়ার পঞ্চাশ ফুট দূরে সাইকেল থেকে নামল। উনিশশো ছয় সালে স্যান ফ্রান্সিসকোতে এক মহাঅগ্নিকাণ্ডের ছবি আঁকা রয়েছে বেড়ার গায়ে। দাউ দাউ করে বাড়ি জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসে আছে একটা কুকুর। এগিয়ে এসে কুকুরের একমাত্র চোখে টিপ দিল সে। বেরিয়ে পড়ল একটা ছোট ফোকর। তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লেভার চাপতেই সরে গেল বেড়ার তিনটে তক্তা। তিন গোয়েন্দার এই গোপন প্রবেশ পথের নাম লাল কুকুর চার। সাইকেল নিয়ে ভেতরে ঢুকল রবিন।
জঞ্জালের তলা দিয়ে গেছে পথ। হামাগুড়ি দিয়ে সেই পথ ধরে গেলে ট্রেলারে ঢোকা যায়। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার আগে ওয়ার্কশপটা দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে। কিছুদূর এগিয়ে দেখল মেইন গেট দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ইয়ার্ডে ঢুকছে মুসা আমান।
সারাটা বিকেল খাঁটিয়ে মেরেছে আমাকে! রবিনকে দেখে প্রায় গুঙিয়ে উঠল মুসা। ছুটি, হ্যাঁহ! এরচে স্কুলই ভাল ছিল।
আউটডোর ওয়ার্কশপে এসে ঢুকল দুজনে। ওখানে পাওয়া গেল কিশোরকে। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর একটা বাতি রেখে বাক্সটা পরীক্ষা করছে। হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে কি জেনেছে রবিন, বলার জন্যে মুখ খুলতেই হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। এক মিনিট। উত্তেজিত কণ্ঠ। আবার দেখলাম বাক্সটা। কি পেয়েছি, দেখ।
অয়েলস্কিনে মোড়া একটা নোটবুক দেখাল কিশোর। সোসাইটিতে যে-রকম দেখে এসেছে রবিন, সে-রকম, তবে আরও পাতলা। হাত বাড়াল সে।
কথা বলে উঠল একটা খসখসে কণ্ঠ, ওয়ার্কশপে ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে। ওটা আমাকে দাও!।
ছেলেদের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে পানির পোকা টিক বানাউ।
৪
লাফিয়ে উঠল কিশোর। পিছিয়ে গেল জঞ্জালের কাছে। বরফের মত জমে গেছে যেন মুসা আর রবিন।
পায়ে পায়ে কিশোরের দিকে এগোল টিক। বইটা শক্ত করে বুকের ওপর চেপে ধরেছে কিশোর। মুসা! চেঁচিয়ে উঠল সে। পরিকল্পনা এক!
পাই করে অন্য দুজনের দিকে ঘুরল টিক। খবরদার! কোন চালাকি নয়!
দাড়িওয়ালা নাবিকের কঠিন দৃষ্টি বর্শার ফলার মত বিদ্ধ করছে যেন দুই সহকারী গোয়েন্দাকে। ঢোক গিলল দুজনেই। ওদেরকে ভয় দেখাতে পেরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল টিক। দাও, বইটা। নিয়ে যাব।
আপনি এক নম্বরের মিথ্যুক! বলে, পাশে সরতে আরম্ভ করল কিশোর। এবং চোর!
হেসে উঠল টিক। ভুল বললে, থোকা। ডাকাত। ছিনিয়ে নিতে এসেছি যে। আর আমার খারাপের দেখেছ কি? দরকার পড়লে…, বাক্যটা শেষ করল না সে। দাও, বইটা।
সরেই যাচ্ছে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে টিক। জঞ্জালের একটা বিশেষ স্কুপের কাছে চলে এল লোকটা। খেয়াল করল না, তার পেছনে চলে গেছে রবিন আর মুসা।
এইবার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
নিচু হয়ে স্কুপের নিচ থেকে একটানে দুটো তক্তা বের করে ফেলল রবিন আর মুসা। ফিরে তাকাল টিক। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
লাফ দিয়ে সরে গেছে রবিন আর মুসা। টিকের গায়ের ওপর ভেঙে পড়ল জঞ্জালের স্তূপ-তত্ত্বা, খাটের স্প্রিং, ভাঙা চেয়ার, ছেড়া কার্পেট। লাথি মেরে, দুহাতে ঠেলে ওসব সরিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে সে।
দাঁত বের করে হাসছে রবিন আর মুসা।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিশোর বলল। জলদি দৌড় দাও!
ছড়িয়ে পড়া জঞ্জাল এড়িয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। ছুটল ইয়ার্ডের অফিসের দিকে। ট্রাকে মাল তুলছে বোরিস। তখনও জঞ্জাল সরিয়ে বেরোতে ব্যস্ত টিক, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বোরিস ভাই! চিল্কার করে ডাকল মুসা। ওয়ার্কশপে চোর ঢুকেছে! ধরুন ওকে!
তাই নাকি? হাতের ভাঙা চেয়ারটা মাটিতে ফেলে দিল বোরিস। চল তো দেখি।
ওয়ার্কশপে চলল আবার ওরা। আওয়াজ থেমে গেছে। ছুটে বেরোল একজন মানুষ, দৌড় দিল পেছনের বেড়ার দিকে।
ওই যে! বলেই মুসাও দৌড়াল পেছনে।
রবিন বলল, কি জানি নিয়ে যাচ্ছে! হাতে….বোধহয় নোটবুক! কিশোর, কখন ফেললে?
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
যাবে কোথায়? দৌড়াতে দৌড়াতে বলল বোরিস। ধরে ফেলব।
নাহ্, আর পারব না, থেমে গেল কিশোর। হাঁপাচ্ছে। নিশ্চয় তোমাদের কাউকে ঢুকতে দেখেছে লাল কুকুর চার দিয়ে। বেরিয়ে যাবে।
অন্য তিনজন থামল না। তাড়া করে গেল। কিন্তু লাল কুকুর চার দিয়ে বেরিয়ে দেখল পথ নির্জন। টিক বানাউয়ের ছায়াও নেই।
আরে, ওই তো! হাত নাড়ল মুসা। সবুজ ফোক্সওয়াগেন।
স্বল্প আলোকিত পথ ধরে ছুটে গেল গাড়িটা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল পথের মোড়ে।
গেল পালিয়ে ব্যাটাআ! হাত ঝাড়ল রবিন। ধরতে পারলে আজ…! কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে বোরিস।
আফসোস করতে করতে ফিরে এল ওরা। ছেলেরা ঢুকল ওয়ার্কশপে। বোরিস চলে গেল তার কাজে।
ছড়িয়ে পড়া জঞ্জালের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল ছেলেরা, তেতো হয়ে গেল মন। আবার ওগুলো তুলে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখা…দূর! কিন্তু কি আর করা? রাখতেই হবে।
কাজই বাড়ল শুধু, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। না পারলাম টিক ব্যাটাকে আটকাতে, না পারলাম বইটা রাখতে।
হাসল কিশোর। শার্টের বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে গেঞ্জির ভেতর থেকে বের করে আনল ভাজ করা একমুঠো কাগজ। অয়েলস্কিনের খাপটা নেই।
নোটবুক, জানাল সে। পাতাগুলো খুলে গেছে। পরিকল্পনা এক বলে আমি চিৎকার করতেই টিক তোমাদের দিকে ফিরেছিল। ওই সুযোগে একটানে পাতাগুলো বের করে গেঞ্জির ভেতরে ভরেছি। খাপটা ফেলে দিয়েছি মাটিতে। জিনিসটা খুব ভারি। না খুললে বুঝবে না, ভেতরে কিছু নেই। সেই ফাঁকিতেই
পড়েছে টিক। তাড়াহুড়োয় খোলারও সময় পায়নি। জাস্ট তুলে নিয়ে দৌড়।
মুসার মুখে হাসি ছড়াল। কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস! নিশ্চয়ই! একমত হল রবিন।
খোলাখুলি প্রশংসায় লজ্জা পেল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, যাক, একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিয়ে গেল টিক।
কি করে? রবিন অবাক। কিছুই তো বলল না, খালি বইটা দাও বইটা দাও ছাড়া।
আসল কথাটাই তো বলল। কেন, বুঝতে পারছ না? আঙটি চায়নি, বাক্স চায়নি, খালি বই?
খাইছে! মুসা বলল। তাই তো। শুধু বই। নোটবুকটা।
বইটা যে বাক্সে ছিল, জানত, বলল রবিন।
কিংবা অনুমান করেছিল, কিশোর বলল। আসলে বাক্স নয়, নোটবুকটা নেয়াই উদ্দেশ্য ছিল তার। বাক্সটা কিনতে চেয়েছিল এটার জন্যেই।
নোটবুক এত দামি? কি আছে ওতে? জানতে চাইল মুসা।
পাতাগুলো তুলে ধরল কিশোর। এটা একটা জার্নাল, মুসা। একধরনের ডায়েরী। প্রতিদিনের হিসেব-নিকেশ, ঘটনার কথা লেখা হয়। আমি…
জার্নাল? বাধা দিয়ে বলল রবিন। কিশোর, আমিও একটা জার্নাল পড়ে এসেছি। লিখেছিল লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া এক নাবিক, হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে জেনে আসা তথ্যগুলো জানাল রবিন। বাওরাড ডাইয়ের কথা মুখেই সব বলেছেন প্রফেসর, পুস্তিকাটাতে নতুন কিছু পাইনি। তবে জাহাজটার কথা বিস্তারিত লেখা আছে। কোন জায়গায় ঝড়ের কবলে পড়েছে, কোথায় গিয়ে প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কা খেয়েছে, ভোর পর্যন্ত কোথায় ছিল, সব। কিভাবে বেঁচে তীরে উঠেছে ডাই, পরের দুবছর কোথায় কোথায় ছিল, এসবও লিখেছে। বাড়ি তৈরির একটা সুবিধেমত জায়গার জন্যে ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছে সে।
গুপ্তধনের কথা কিছু লেখেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল রবিন। এমনকি ক্যাপ্টেনের কথা, বিপদের কথা, কিছুই না। শুধু বাড়ির ব্যাপারে। সব ভোঁতা।
কিন্তু কিশোরের কাছে ব্যাপারটা ভোতা লাগল না। বলল, দেখ, জার্নালটা বাক্সের দেয়ালে লুকানো পেয়েছি। মোটা এক পরত তক্তার ওপর পাতলা আরেক পরত লাগিয়ে তৈরি দেয়াল, মাঝখানটা ফাঁপা, তার মধ্যে ছিল। ভেতরটা শুকনো রাখার জন্যেই হয়ত ওরকম করে বানিয়েছিল, যাতে পানি ঢুকতে না পারে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। বাক্সটা ধরে যখন জোরে ঝাঁকালাম, ভেতরে শুনলাম মৃদু আওয়াজ।
তখন আরও ভালমত দেখলাম। চোখে পড়ল আলগা কাঠ। ভেতরের দেয়াল একরকম, আর বাইরেরটা আরেক। তবে রঙ, কাঠের দাগে তফাৎ খুব সামান্য। ভাল করে না দেখলে চোখেই পড়ে না। ধ্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে চলটা তুলে ফেললাম। তারপর পাতলা কাঠটা ফাঁক করে ফেলতে অসুবিধে হয়নি। কোটের একটা হ্যাঙার দিয়ে টেনে বের করেছি অয়েলস্কিনে মোড়া জার্নালটা।
নিশ্চয়ই কেউ লুকিয়েছিল? মুসা বলল।
মনে হয় না। দেয়ালের ওপরের দিকটা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল হয়ত। তখন কোনভাবে জার্নালটা পড়েছে ভেতরে। নেহাত কাকতালীয় ঘটনা। তারপর আবার দেয়ালটা মেরামত করে ফেলা হয়েছে। যে করেছে, সে খেয়ালই করেনি ভেতরে একটা জিনিস রয়েছে।
কিন্তু টিক বানাউ ঠিকই আন্দাজ করেছে, ওটা ভেতরে আছে, মুসা বলল। জার্নালটা চায় সে। কেন?
রবিন, পয়লা পৃষ্ঠাটা পড,কাগজগুলো বাড়িয়ে দিল কিশোর।
বেঞ্চে রাখা আলোর কাছাকাছি পাতাগুলো নিয়ে গেল রবিন। জোরে জোরে পড়ল, বাওরাড ডাই, ফ্যানটম লেক, ক্যালিফোর্নিয়া, অক্টোবর ২৯, ১৮৯৬!
…কিশোর, ওই জার্নালটাও এই লোকই লিখেছে- যেটা পড়ে এলাম, লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া নাবিক।
ওই জার্নালের শেষ তারিখটা মনে আছে? কোন তারিখে শেষ করেছে?
এটা ঊনত্রিশে শুরু, ওটা শেষ হয়েছে আটাশ তারিখে। তারমানে ওটার পরের অংশ এটা।
এটাতে হয়ত গুপ্তধনের কথা লেখা আছে! তুড়ি বাজাল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। না; সে-রকম কিছু দেখলাম না। রবিন যেটা পড়ে এসেছে, ও-রকমই। কোথায় কোথায় গিয়েছিল ডাই, কি কি করেছে। ব্যস, এসব।
তাহলে টিক চাইছে কেন? আবার প্রশ্ন করল মুসা। সে-ও কি গুজবের পিছেই ছুটছে?
এই জার্নালই যে চাইছে, শিওর হচ্ছি কি করে? রবিন প্রশ্ন তুলল।
জবাব দিল না কিশোর। খানিক পরে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, রবিন, তুমি বললে, ডাই পরিবার এই কিছুদিন আগে জার্নালটা হিসটোরিক্যাল সোসাইটিকে দান করেছে?
হ্যাঁ।…তারমানে…
তারমানে কাছাকাছিই কোথাও বাস করছে ওরা। বাক্যটা শেষ করে দিল কিশোর। এস।
দুই সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা।
ট্রাপচার তুলে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা। ডেস্কে বসে টেলিফোন বুক খুলল কিশোর। এই যে, পাওয়া গেছে। মিসেস বাওরাড ডাই, চার, ফ্যান্টম লেক রোড। মুসা, ম্যাপটা, জলদি।
বিশাল ম্যাপটায় চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। জার্নালটার জন্যে নতুন একটা খাপ বানাচ্ছে রবিন।
অবশেষে মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। এই যে। মাইল তিনেক পুবে, পর্বতের ভেতরে, হাসল সে। কাল সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যাব। দেখা করে আসব মিসেস ডাইয়ের সঙ্গে।
৫
সুন্দর দিন। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে পর্বতের পাশের রাস্তায় যখন পৌঁছল তিন গোয়েন্দা। তেতে উঠেছে সূর্য।
ওই যে,। কপালের ঘাম মুছল মুসা। ফ্যান্টম লেক রোড। দেখ, সোজা পর্বতের ভেতরে ঢুকে গেছে।
আর কি খাড়া, গুঙিয়ে উঠল কিশোর চালাতে তো পারবই না, ঠেলে নিতে হবে সাইকেল। চল, কি আর করা যাবে।
ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগল ছেলেরা। লম্বা গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ী পথ। পথের ধারে একটা খাড়ি,
ঝাপঝাড়ে বোঝাই, আশপাশে শুকনো, রুক্ষ মরূদ্যান।
এই নাম পেল কোথায়? ধূসর পর্বতের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। ফ্যান্টম লেক। অবাকই লাগছে। এখানকার পর্বতের মাঝে হ্রদ আছে বলে তো কখনও শুনিনি!
ভ্রূকুটি করল কিশোর। হ্যাঁ। অবাক করার মতই।
ওদিকে কয়েকটা পুকুর দেখা যাচ্ছে, মুসা বলল।
আছে। কিন্তু ওগুলোর একটার নামও ফ্যান্টম লেক নয়, বলল রবিন। আমি…।
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। সামনে, ওপর থেকে ফ্যান্টম লেক রোড ধরে নেমে আসছে গাড়িটা। মোড় নেয়ার সময় তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে টায়ার, শোনা যাচ্ছে, গাড়ি চোখে পড়ছে না এখনও। দেখা গেল অবশেষে। ছুটে আসছে ওদের দিকেই।
আরি! সবুজ ফোক্সওয়াগেন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
টিক বানাউ! বলল রবিন।
লুকাতে হবে! কিশোর বলে উঠল। কুইক!
সাইকেল তিনটে পথের পাশে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা। পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা, কয়েক গজ এগিয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। এক ঝটকায় দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে ছুটে এল চালক। এই, এই ছেলেরা, থাম!
লোকটা টিক বানাউ নয়। রোগাটে এক যুবক, পুরু গোঁফ, কালো উদাসী চুল। পরনে কালো পোশাক। এই, কি হচ্ছে? আবার চিৎকার করে বলল সে। কি করছ ওখানে…?
পিছিয়ে গেল ছেলেরা। দৌড় দাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
পথের ধার দিয়ে ছুটতে শুরু করল ওরা। পেছনে আবার চিৎকার ব পিছু নিল লোকটা।
সামনে একটা ঘন ঝোপ, পথের পাশে। আর কোন উপায় না দেখে তাতেই ঢুকে পড়ল ছেলেরা।
কে…? হাঁপাচ্ছে রবিন। কে লোকটা?
আগে পালানো দরকার, মুসা বলল। তারপর প্রশ্ন।
দাঁড়াও, বলল কিশোর। দেখি ওকে জিজ্ঞেস করে…।
এই সময় আরেকটা শব্দ শোনা গেল। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের খটাখট। পথের ডানে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন ঘোড়সওয়ার। হাতে লম্বা চকচকে কি যেন।
কে…ক্কে…! কথা জড়িয়ে গেল মুসার।
দেখ, দেখ! কিশোর বলল।
ওদের পাশ দিয়ে গাড়ির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল লোকটা। ততক্ষণে ঘুরে গাড়ির দিকে ছুট দিয়েছে যুবক। গাড়িতে উঠে, স্টার্ট দিয়ে, একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ঢালু পথ ধরে। গাড়ির পিছে পিছে কিছুদূর ছুটে গেল ঘোড়সওয়ার। ধরা যাবে না বুঝে থামল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল ছেলেদের দিকে।
রাশে হ্যাঁচকা টান খেয়ে পেছনের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল ঘোড়াটা। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা আরোহী কড়া চোখে তাকাল ছেলেদের দিকে। নীল চোখ, লাল মুখ। গায়ে টুইড জ্যাকেট, পরনে আঁটো পায়জামা। হাতের জিনিসটা তলোয়ার।
চুপ! ধমক দিল সে। একদম নড়বে না!
কিন্তু…! প্রতিবাদ জানাতে গেল কিশোর
চুইপ! গর্জে উঠল লোকটা। ওই চোরটার সঙ্গে তোমাদের কি সম্পর্ক?
গরম হয়ে বলল মুসা, ওর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পক…
মিথ্যে কথাগুলো পুলিশের কাছে বল। নাও, হাঁট।
কিন্তু, স্যার, আবার শুরু করল কিশোর। আমরা…।
হাঁটতে বললাম না!
শাই করে বাতাসে তলোয়ার চালাল লোকটা। ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ছেলেরা, না করলেও অবশ্য লাগত না, অনেক ওপর দিয়ে গেছে। আর প্রতিবাদ করল না। পা বাড়াল নীরবে।
দশ মিনিট পর। একটা শৈলশিরা পেরিয়ে হঠাৎ নিচে নেমে গেল আবার পাহাড়ী পথ, উপত্যকায়। ঘন গাছপালা জন্মেছে ওখানে। একেবারে তলায় ছোট একটা পুকুর, দুটো ফুটবল মাঠের সমান। পুকুরের মাঝে উঁচু দ্বীপ, তাতে কিছু পাইন গাছ, আর লম্বা খুঁটির মাথায় একটা লণ্ঠন-একধরনের বীকন বলা যেতে পারে, আলোক-সঙ্কেত দেয়ার জন্যেই তৈরি হয়েছে বোধহয়। দ্বীপের কিনার থেকে শুরু করে খালের মধ্য দিয়ে এসে হ্রদের প্রান্ত ছুঁয়েছে এক সারি পাথর।
থমকে গেল মুসা। এ-কি? এই সেই হ্রদ?
এই, কোন কথা না, পেছনে ধমক দিল অশ্বারোহী। এগোও।
পাহাড়ী পথ ধরে নেমে চলল ছেলেরা। কড়া রোদ। ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, হল না ছাই। ডোবাও এরচে বড়।
পথের একটা মোড় ঘুরতে নিচে একটা বাড়ি দেখা গেল। পাথরের বাড়ি, তিনতলা, উঁচু জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। চারকোণা একটা পাথরের টাওয়ারের ওপর ব্যাটলমেন্ট, তাতে বড় বড় ছিদ্র। তীর ছুঁড়তে, কিংবা ছিদ্র দিয়ে বন্দুকের নল বের করে গুলি ছোড়ার জন্যে আগের দিনে বানানো হত ওধরনের ব্যাটলমেন্ট। দুধারে দুটো বিশেষ ধরনের জানালাও আছে, ডরমার উইনডো বলে ওগুলোকে। ঘন হয়ে জন্মানো পুরানো আঙুরলতাও বাড়ির দেয়ালের রুক্ষতা ঢাকতে পারছে না।
বাপরে! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেও স্বর নামিয়ে ফেলল মুসা। বাড়ি না দুর্গ রে, বাবা! ওই টাওয়ারে উঠে বহুদূরের শত্রুকেও দেখা যাবে।
হ্যাঁ, অদ্ভুতই, একমত হল কিশোর।
বাড়ির সামনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামল লোকটা। আদেশ দিল, যাও, ঢোক।
বিরাট এক ঘরে ঢুকল ওরা, বাইরের হলরুম। দেয়ালের ওপর সুদৃশ্য কাঠের আস্তরণ। কারুকাজ করা পর্দা। পুরানো অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো। বড় একটা এল্ক হরিণের মাথাও রয়েছে। কাঠের মেঝেতে বিছানো রঙচটা কার্পেট। একসময় হয়ত দামি ছিল জিনিসগুলো, এখন পুরানো, মলিন। তলোয়ার দেখিয়ে ওদেরকে আরেকটা বড় ঘরে নিয়ে এল লোকটা, লিভিংরুম, ভারি ভারি পুরানো আসবাবপত্র আছে এটাতে। এককোণে পাথরের মস্ত ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, তাতেও ঘরের ঠাণ্ডা কাটছে না। শীত শীত একটা ভাব রয়েই গেছে।
ফায়ারপ্লেসের সামনে চেয়ারে বসে আছেন হালকাপাতলা এক মহিলা। সুন্দরী। পাশে দাঁড়ানো রবিনের বয়েসী লাল-চুল এক কিশোর। লোকটার মতই তার পরনেও আঁটো পাজামা।
ধরা পড়েছে? বলে উঠল ছেলেটা।
না, চোরটাকে ধরতে পারিনি, লালমুখো লোকটা জানাল। পালিয়েছে। এগুলোকে ধরেছি।
কাদের নিয়ে এসেছ? মহিলা বলল। কয়েকটা ছেলে…ডিনো, এরা…
ইবলিস হতে কি বয়স্ক হওয়া লাগে নাকি, ডোরিনা ডাই, ডিনো বলল। লাল-চুল ছেলেটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল, পুলিশকে ফোন কর, এড। সব
শয়তানি আজই বন্ধ করব।
সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। ফোক্সওয়াগেনের লোকটা চুরি করে ঢুকেছিল নাকি এখানে, স্যার? কি নিয়েছে?
হেসে উঠল ডিনো। এহ্, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।
সত্যি আমরা কিছু জানি না, রেগে উঠল মুসা। লোকটাকেও আগে আর দেখিনি। গাড়িটা অবশ্য দেখেছি, আমাদের পিছু নিয়েছিল।
শান্তকণ্ঠে কিশোর বলল, আমরা আপনার কাছেই আসছিলাম, মিসেস ডাই। এই সময় গাড়িটা আসতে দেখলাম। গাড়ি থামিয়ে আমাদের তাড়া করল লোকটা।… আমি কিশোর পাশা, ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড। তিনজনেই রকি বীচে থাকি। আমাদের সাইকেল রাস্তায় ফেলে এসেছি। এতেই প্রমাণ হয়, আমরা ফোক্সওয়াগেনে লোকটার সঙ্গে আসিনি।
ডোরিনা! কড়া গলায় বলল ডিনো। পুলিশকে জানানো উচিত…।
থাম, ডিনো, ছেলেদের দিকে চেয়ে বললেন মহিলা। এ আমার ছেলে, এডবার ডাই। আর ও ডিনাম্যান হ্যাঙবার, আমাদের আত্মীয়। তো, কেন আসছিলে আমার কাছে?
বাক্সটার জন্যে, ম্যাডাম, জানাল রবিন।।
একটা স্যালভিজ ইয়ার্ড আছে আমাদের, বুঝিয়ে বলল কিশোর। এক মিউজিয়মে গিয়েছিলাম পুরানো মাল কিনতে। সেখানে একটা রাক্স পেয়েছি, তাতে লিটল মারমেইড জাহাজের নাম লেখা। আমরা জেনেছি, বাক্সটা আপনাদের কোন পূর্বপুরুষের ছিল। ওটা হাতে আসার পর থেকেই রহস্যময় কতগুলো ঘটনা ঘটেছে। ফোক্সওয়াগেনের লোকটা আপনার বাড়ি থেকে কি নিয়েছে, জানলে হয়ত ঘটনাগুলোর কারণ বুঝতে পারব।
দ্বিধা করলেন মিসেস ডাই। না, সে কিছু নেয়নি। এরকমই হয়, হয়ে আসছে প্রতিটি বার। চুরি করে ঢোকে, বাওরাড ডাইয়ের জিনিসপত্র ঘাটে। কখনোই কিছু নেয়নি।
কিছুই নেয়নি? হতাশ মনে হল মুসাকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ইদানীং কবার ঢুকেছে, মিসেস ডাই?
গত ছয় মাসে পাঁচবার।
সব সময় বাওরাডের জিনিসই খালি ঘাটে। বোধহয়…,এড বলল। বাওরাড আমার দাদার দাদা।
গুপ্তধন খোঁজে! এডের কথাটা শেষ করল রবিন। : মা, দেখলে! ওরাও ভাবছে, গুপ্তধনের খোজে আসে চোর। আমার কথা তো বিশ্বাস কর না।
হাসলেন মহিলা। অনেক আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে, গুপ্তধন নেই। শুধুই গুজব।
না-ও হতে পারে, মিসেস ডাই, কিশোর বলল। টিক বানাউ আর বাক্সটার প্রতি তার আগ্রহের কথা জানাল। বাক্সে পাওয়া আঙটিটা দেখাল মহিলাকে।
হাতে নিয়ে জিনিসটা দেখলেন মিসেস ডাই। বললেন, তোমরা পেয়েছ?
দেখি তো, বোনের হাত থেকে আঙটিটা নিল ডিনো। বাহ, খুব দামি জিনিস, মুখ বাঁকাল সে। লাল কাচ আর তামা। বুড়ো ডাই এসব ফালতু জিনিস নিয়েই বাণিজ্য করতে যেত, পুবদেশের গাধাগুলোকে গিয়ে ঠকাত। তোমরাও হদা। লোকে কি আর খোঁজা বাদ রেখেছে নাকি। বুড়োর জার্নাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ছিঁড়ে ফেলেছে, পাতি পাতি করে খুঁজেছে জাহাজটা। কিছু পায়নি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস ডাই। ডিনো ঠিকই বলেছে। গুপ্তধনের সামান্যতম ইঙ্গিত থাকলেও ওই জার্নালেই থাকত। নেই বলেই পায়নি লোকে অযথাই গুজব ছড়িয়েছে।
সবাই হয়ত ভুল জার্নালটা পড়েছে, সে-জন্যেই পায়নি। জ্যাকেটের ভেতর থেকে পাতলা জার্নালটা টেনে বের করল কিশোর।
৬
আরেকটা জার্নাল? চেঁচিয়ে উঠল এড।
এসব কি? চালাকি হচ্ছে, না? ধমক দিল ডিনো। কিশোরের হাত থেকে জার্নালটা নিলেন মিসেস ডাই। ধীরে ধীরে কয়েক পাতা ওল্টালেন। না, ডিনো, চালাকি করছে না। বাওরাড ডাইয়ের হাতের লেখা, কোন সন্দেহ নেই। সইও এক। ছেলেদের দিকে তাকালেন। কোথায় পেয়েছ?
কোথায়, কিভাবে পেয়েছে, জানাল কিশোর। তারপর বলল, বাক্সটা যে-ই মেরামত করে থাকুক, ফাঁকের ভেতর জার্নালটা তার চোখে পড়েনি, বোঝা যায়। গোপন খোপটাও না। কারণ, ওটা খুললেই ছুরিটা বেরিয়ে যেত।
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ডাই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বছর দুই আগে বিক্রি করে দিয়েছিলাম, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর। অভাবে পড়ে ডাইদের আরও অনেক জিনিসই ছেড়ে দিতে হয়েছে আমাকে। এই বাড়িটা রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। ডিনোর সাহায্য না পেলে আরও আগেই ছেড়ে দিতে হত।
ছাড়তে হবে না, ডোরিনা, ডিনো বলল। আর রূপকথা শোনারও দরকার নেই।
জার্নালে রূপকথা থাকে না, মিস্টার হ্যাঙবার, কিশোর বলল।
আমাকে শুধু ডিনো বলে ডাকলেই চলবে।… ডোরিনা যখন বলছে, জার্নালটা আসল, ধরে নিলাম আসলই। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে গুপ্তধন আছে।
কিন্তু চিঠিটা! বলে উঠল এড।
চিঠি? সতর্ক হল কিশোর।
প্রশ্ন এড়িয়ে গেল ডিনো। সরু হয়ে এল চোখ। পড়ে দেখা দরকার। দেখি, জার্নালটা।
মায়ের হাত থেকে নিয়ে জার্নালটা দিল এড। ফায়ারপ্লেসের ধিকিধিকি আগুনের সামনে লম্বা একটা বেঞ্চে বসে পড়তে শুরু করল ডিনো। এডও বসল তার পাশে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মিসেস ডাই। হুঁ, দ্বিতীয় জার্নালটাও বাক্সেই থাকার কথা। আমার স্বামী বলেছে, তার দাদা নাকি প্রথম জার্নালটাও বাক্সেই পেয়েছেন। বরাবরই দাদার বিশ্বাস ছিল, গুপ্তধন আছে, আর জার্নালেই রয়েছে তার সূত্র। কিন্তু আমার শ্বশুর তা মনে করতেন না। তার ধারণা, ওটা শুধুই গুজব।
আপনার দাদা-শ্বশুর এত শিওর ছিলেন কেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।
একটা চিঠি। আমার দাদা-শ্বশুর…, থেমে গিয়ে হাসলেন মহিলা। গোড়া থেকেই বলি। বাওরাড ডাই সম্পর্কে কতখানি জান তোমরা?
কি কি জানে, জানাল রবিন।
ও, অনেক কিছুই তো জান তাহলে। সোসাইটিকে প্রায় সবই বলেছি আমি, স্বামীর মুখে যা যা শুনেছি। অনেক ঘুরে, দেখেশুনে এই উপত্যকা পছন্দ করেছিলেন বাওরাড ডাই। তাঁর বাড়ি স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডে। এখানকার সঙ্গে ওই জায়গার মিল আছে, বিশেষ করে পুকুর আর ওটার মাঝের দ্বীপটা। স্কটল্যাণ্ডে ডাইদের বাড়ি ছিল সাগরের একটা খাড়ির ধারে। খাড়িটার নাম ফ্যান্টম লক। লকের মাঝে ছিল ছোট দ্বীপ। দ্বীপ থেকে বড় বড় পাথর চলে এসেছিল তীর পর্যন্ত। এখানে পুকুরটাতে যে-রকম আছে ঠিক সে-রকম। ওগুলো দিয়ে দ্বীপে যাওয়া যেত, নাম রাখা হয়েছিল ফ্যান্টমস স্টেপস।
লক মানে কি? মুসা বলল। হ্রদ, না?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। ফ্যান্টম লক, বা ভূতের হ্রদ, আর ফ্যান্টমস স্টেপস হল গিয়ে ভূতের সিঁড়ি। ডোরিনার দিকে তাকাল সে। তাহলে এই ব্যাপার! মিস্টার বাওরাড ডাই এখানে বাড়ি বানিয়েছেন স্কটল্যাণ্ডের বাড়ির মত করে। সেজন্যেই ক্যালিফোর্নিয়ায় বেমানান।
হ্যাঁ, কিশোর। আসল ডাই লজটা তৈরি হয়েছিল তেরশো বায়ান্ন সালে। তখন ওটার নাম ছিল ডাই ক্যাসল। চোর-ডাকাত আর বাইরের শত্রুর হামলার আশঙ্কা এত বেশি ছিল সেকালে, পয়সাওয়ালা লোকেরা দুর্গ ছাড়া থাকতে সাহস পেত না। নিরাপদ মনে করত না, এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে বললেন মহিলা, প্রথমে ডাই ক্যাসল ছিল শুধু একটা টাওয়ার হাউস। আস্তে আস্তে চারপাশে ঘর তৈরি হল, ঠিক এই বাড়িটার মত। সতেরশো সালের দিকে ওই টাওয়ারে অস্ত্র ধারী দারোয়ান বসানোর দিনে শেষ হয়ে এল। সে-সময় পেশা বদল করে নাবিক হল ডাইয়েরা। তখন টাওয়ারে উঠে সাগর দেখত তাদের স্ত্রীরা, জাহাজ দেখত, স্বামীদের জাহাজের ফেরার অপেক্ষা করত।
পুরানো দিনের এসব গল্প শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠল মুসা। বলল, চিঠির কথা কি যেন বলছিলেন?
উপত্যকাটা পছন্দ করে বাড়ি তৈরি করলেন বাওরাড ডাই। বানাতে প্রায় দুবছর লেগেছিল। তারপর ছেলে আর স্ত্রীকে আনতে লোক পাঠালেন স্কটল্যাণ্ডে। কয়েক মাস পর ওরা যখন এসে পৌঁছল, বাওরাড তখননেই, খুন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নোরিয়া একটা চিঠি খুঁজে পেলেন পুরানো একটা বেড-ওয়ারমারের ভেতরে। নোরিয়ার উদ্দেশেই লেখা।
তারমানে এমন কিছু, কিশোর বলল। যা নোরিয়া ছাড়া আর কেউ বুঝতে না পারে? বেশ খুশি মনে হল তাকে।
নোরিয়ার ছেলে তা-ই ভাবতেন। গুজব ছড়ানো শুরু হয়েছে তখন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ওই চিঠি আর জার্নালেই রয়েছে গুপ্তধনের চাবিকাঠি। অনেক চেষ্টা করেছেন আমার দাদা-শ্বশুর। বোঝেননি কিছু।
চিঠিটা দেখা যায়? অনুরোধ করল মুসা।
নিশ্চয়ই। আমার শোবার ঘরেই রেখেছি, একটা খাতার ভেতরে।
কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল। খাতায় কেন? বাওরাড ডাইয়ের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে রাখেন না?
না।
উঠে বেরিয়ে গেলেন মিসেস ডাই। খাতাটা নিয়ে ফিরলেন। হলদে হয়ে গেছে চিঠির কাগজ।
তাতে লেখা :
নোরিয়া, ডিয়ার
শীঘ্রি এসে পৌঁছবে তুমি। ইদানীং আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমার ওপর চোখ রাখছে কেউ। শেষ এই জরুরি কথাগুলো বলতে হচ্ছে আমাকে, আরও অনেকেই পড়বে এই চিঠি সেকথা মনে রেখে।
তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সোনালি সুখ উপহার দেব। তা-ই দিচ্ছি। মনে করার চেষ্টা কর, বাড়িতে আমি কি ভালবাসতাম, ভাব প্লকের গোপন রহস্যের কথা। আমার শেষ নির্দেশ অনুসরণ কর। পড়, আমার দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছি তোমার জন্যে। আয়নায় দেখ সেই গোপন কথা।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ছেলেরা। আবার পড়ল চিঠিটা।
আমার দাদা-শশুর মনে করতেন, মিসেস ডাই বললেন। সোনালি সুখ বলে গুপ্তধন বোঝাতে চেয়েছেন বাওরাড ডাই। বাড়ির এমন কোন আয়না নেই যার ভেতরে তিনি দেখেননি, যেটা নিয়ে গবেষণা করেননি। কিছুই যখন পেলেন না, অনুমান করলেন, জার্নালে দেখতে বলা হয়েছে। আমার দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছি তোমার জন্যে-এটা জার্নাল দেখার ইঙ্গিত। খুঁজলেন। কিছুই বের করতে পারলেন না।
কারণ, দ্বিতীয় জার্নালটা তিনি পাননি, কিশোর বলল। চিঠিতে বলা হয়েছেঃ শেষ নির্দেশ অনুসরণ কর। তার মানে শেষ জার্নাল দেখার কথাই, বলেছেন। চিঠি লেখার আগের দুমাসের কথা লেখা রয়েছে ওতে। ওই দুমাসে কি কি করেছিলেন বাওরাড ডাই?
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে জার্নালটা রেখে দিল ডিনো। গুপ্তধনের কথা কিছু বলেনি। খালি বাজে বকবক-কোথায় কোথায় গিয়েছিল, নোরিয়াকে চমকে দেয়ার জন্যে কি কি বানিয়েছে, এসব কথা।
নাহ্, কোন সূত্র নেই, বুঝলে, তিন গোয়েন্দাকে বলল এড। কিছুই বুঝলাম।
আমিও বুঝিনি, স্বীকার করল কিশোর। মিসেস ডাই, বাওরাড ডাই বাড়িতে কি ভালবাসতেন, জানেন? লকের গোপন রহস্যটাই বা কি?
আমি কিছুই বলতে পারব না, কিশোর, কি ভালবাসতেন বাওরাড। তবে লকের ব্যাপারে পুরানো একটা কিংবদন্তী আছে স্কটল্যাণ্ডে, ডাইদের এলাকায়। ওদের কোন এক পূর্বপুরুষ নাকি অপঘাতে মারা যায়। তারপর মাঝে মাঝে দেখা গেছে তাকে, শীতের সকালে, কুয়াশার মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নাকি চেয়ে থাকত হ্রদের দিকে। শত্রু খুঁজত। নয় শতকে ভাইকিংরা মেরে ফেলেছিল তাকে। তার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল হ্রদের।
বাহ, চমৎকার, বলল এড। গুপ্তধনের সঙ্গে ভূতের গল্প। ভালই জমে।
টিক বানাউই সেই ভূত কিনা কে জানে, মুসা বলল।
সবুজ ফোক্সওয়াগেনের লোকটা কে? রবিনের প্রশ্ন।
আর আমাদের বাড়িতে চোর ঢোকারই বা কি ব্যাখ্যা? রবিনের কথার যেন প্রতিধ্বনি করল এড।
ডিনো নীরব হয়ে আছে।
চোর ঢোকার সম্ভবত একটাই ব্যাখ্যা, কিশোর বলল। টিক বানাউ কোনভাবে পেয়েছে চিঠিটা। পড়ে বুঝেছে, জার্নালে খোঁজার কথা বলা হয়েছে। প্রথম জার্নালের শেষ পাতার শেষ তারিখ, আর বাওরাড ডাইয়ের খুন হওয়ার মাঝের দুটো মাস ফাঁকা। অর্থাৎ জার্নাল যেদিন শেষ হয়েছে, তার দুমাস পরে মারা গেছেন বাওরাড। ওই দুই মাস কি তিনি জার্নাল লেখেননি? জার্নাল বা ডায়েরী লেখা যাদের অভ্যাস, তারা সাধারণত না লিখে পারে না। একথা জানা আছে টিক বানাউয়ের। সন্দেহ করেছে, নিশ্চয় দ্বিতীয় আরেকটা জার্নাল আছে। আমার ধারণা, চুরি করে ডাই লজে ঢুকে সেটাই খুঁজেছে সে।
গাধা আরকি, বিড়বিড় করল ডিনো। গুপ্তধন শিকারী। হুঁহ!
গুপ্তধন শিকারী হলেই গাধা হয় না, জোর আপত্তি জানাল কিশোর। চিঠিতে কি লিখেছেন বাওরাড? শেষ এই জরুরি কথাগুলো বলতে হচ্ছে আমাকে, আরও অনেকেই পড়বে এই চিঠি সেকথা মনে রেখে। একটা ধাধা বানিয়ে রেখে গেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, নোরিয়া সেটার সমাধান করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস আরও বাড়ছে, এখন। নিশ্চয় গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছেন বাওরাড়। ধাঁধার সমাধান করতে পারলেই বের করা যাবে। আর সমাধানের সূত্র রয়েছে দ্বিতীয় জার্নালে।
তার সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন, মুসা, এড।
কি জানি, কিশোর। মিসেস ডাই মানতে পারছেন না, কিন্তু, নোরিয়া যেটা – পারেননি, সেটা আর কে পারবে? তার জন্যেই তো লেখা হয়েছিল চিঠি।
আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি, ম্যাডাম, রবিন বলল।
অনেক জটিল ধাধার সমাধান আমরা করেছি, বলল মুসা।
রহস্যের সমাধান করাই আমাদের নেশা, ভারিক্কি চালে বলল, কিশোর। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিল।
মায়ের কাঁধের ওপর ঝুঁকে কার্ডটা পড়ল এড, বড় বড় হয়ে গেল চোখ।
এগিয়ে এসে ডিনোও দেখল। সন্দেহ ফুটল চোখে।
কিশোর খুশি, তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হল না দেখে। নতুন। ছেপেছে কার্ড। তাতে কোন চিহ্ন দেয়া হয়নি। দিলেই লোকের মনে প্রশ্ন জাগে, সন্দেহ প্রকাশ করে। প্রথমে কিছুদিন প্রশ্নবোধক দিয়ে চালিয়েছিল, তারপর দিয়েছে আশ্চর্যবোধক। তারপর আবার প্রশ্নবোধক। সেগুলোও শেষ হওয়ার পর নতুন কার্ড ছেপেছে। গম্ভীর হয়ে বড়দের মত করে বলল, আমরা আপনাদের সাহায্য করতে চাই।
নিশ্চয় চাই, মুসা যোগ করল।
মাকে অনুরোধ করল এড, চেষ্টা করতে দোষ কি, মা? করুক না। আমিও ওদের সাহায্য করব, যতটা পারি।
বেশ, হাসলেন মিসেস ডাই। কোন দোষ দেখি না। গুপ্তধন পেলে তো খুবই ভাল। বড় টানাটানিতে দিন কাটছে আমাদের।
হুররে! হুল্লোড় করে উঠল রবিন, মুসা আর এড।
মিসেস ডাইয়ের হাসি বিস্তৃত হল। লাঞ্চটা তাহলে এবার সেরে ফেলা যায়, কি বল? গুপ্তধন খুঁজতে হলে শরীরে বল চাই তো।
খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ভুলেই গিয়েছিলাম! নিশ্চয় বলা দরকার।
ডিনোর মুখে হাসি নেই, গম্ভীর হয়ে আছে। কার্ডটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, সব চালাকি। ডোরিনা, ছেলেগুলো মহা চালবাজ, বিশ্বাস করা উচিত হবে না।
আমার তা মনে হয় না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যেন মিসেস ডাই।
বেশ, যা ইচ্ছে কর! আমি এসবে নেই…! বলে রাগে দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ডিনো।
সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করল কিশোর। চিন্তিত।
৭
লাঞ্চের পর পরই বেরিয়ে গেল ডিনো। বলে গেল, পথের ধারে পাইন গাছের কিছু ডাল ছাঁটতে যাচ্ছে। ছেলেরা আর মিসেস ডাই ফিরে এলেন লিভিংরুমে। দ্বিতীয় জার্নাল থেকে সূত্র বের করায় মনোযোগ দিল।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, বক্তৃতার ঢঙে শুরু করল কিশোর। জার্নাল ঠিক ডায়েরী নয়, কিছুটা আলাদা। নিজের চিন্তা-ভাবনা পরিকল্পনার কথা এতে লেখেননি বাওরাড, কোন ঘটনারও বিশ্লেষণ করেননি। প্রতিটি ঘটনাই খুব সংক্ষিপ্ত, এক কি দুই লাইনে শেষ। এই যেমন, আজ চত্বরে কাজ করেছি, কিংবা, একটা ঈগল দেখেছি, এরকম। জাহাজের লগবুকের মত অনেকটা।
অন্য জার্নালটাও একই রকম, রবিন বলল।
তারমানে, ঘটনার উল্লেখ খুব একটা কাজে লাগছে না আমাদের। তবে চিঠিতে বলেছেন বাওরাড, তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে, আর শেষ দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছেন, সেটা মেনে চলতে। কি কি করেছেন তিনি, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেননি নোরিয়াকে। বলেছেন, কোথায় গেছেন আর কি বানিয়েছেন, সেটা লক্ষ্য করতে।
জার্নালের দিকে তাকাল এড। হ্যাঁ, প্রথমেই রয়েছে কোথায় গিয়ে কি করেছিল। লিখেছেঃ নোরয়াকে চমকে দেয়ার পালা আজ থেকেই, কাজ শুরু করেছি। প্রথমে পাউডার গালচে গেছি লোক আর টিম্বার সুস জোগাড় করার জন্যে।
নিশ্চয় কিছু বানাতে! মুসা বলল।
মনে হয়, বলল কিশোর। তারপর কি লিখেছে, এড?
কয়েকটা পাতা ওল্টাল লাল-চুল ছেলেটা। দুহপ্তা আর তেমন কিছু নেই। শুধু ছোট ছোট নোট। তারপর একটা দ্বীপে গেছে।
মিসেস ডাই? কিশোর জিজ্ঞেস করল। নোরিয়াকে চমকে দেয়ার ব্যাপারটা কি, বলতে পারেন?
নাহ।
থাক, এ-নিয়ে পরে ভাবব। লোক এবং টিম্বার স্কুস জোগাড়। কেন? এসব এলাকায় শুনেছি, একসময় খনি ছিল। খনির লোকেরা টিম্বার সুস দিয়ে আকরিক ছাকত। এড, ফ্যান্টম লেকের কাছে কোন খনি চেন?
না। সোনার খনির কথা বলছ?
হতে পারে, মুসা আন্দাজ করল। গোপনে কোন খনিতে কাজ চালিয়েছে বাওরাড! ;
তা পারে, বলল কিশোর। তবে আমার মনে হয় না, সেরকম কিছু বলতে চেয়েছেন তিনি। নির্দেশ অনুসরণ করতে বলেছেন। তারমানে, এমন কোথাও গিয়েছেন, যেখানে রয়েছে সূত্র। পাউডার গালচে যেতে হবে আমাদের, বুঝেছ।
পাউডার গালচ কি কাছাকাছিই নাকি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
এড জানাল, হাইওয়ে ধরে গেলে বড়জোর এক মাইল।
আশ্চর্য, মুসা, তুমি জান না? ভুরু কোঁচকাল কিশোর। বিখ্যাত জায়গা। লোকাল হিস্টরিতে জায়গাটার নাম রয়েছে। পড়েছি…
গোস্ট টাউন! উত্তেজনায় মোর চেড়ে উঠে পড়ল রবিন। পুরানো ভূতুড়ে শহর! তাই তো বলি, নামটা চেনা চেনা লাগে কেন?
ভূ-ভূতের শহর..! ভয় দেখা দিল মুসার চোখের তারায়। আ-আমরা যাচ্ছি নাকি?
যেতে হবে, উঠে দাঁড়াল কিশোর। এখুনি।
জীর্ণ, মলিন রোড-সাইনঃ পাউডার গালচ। তীর চিহ্ন নির্দেশ করছে সরু একটা কাঁচা সড়ক। সাইকেল চালিয়ে চলল চার কিশোর। মিনিট দশেক পরেই নিচে দেখা গেল গোস্ট টাউন।
ওপর থেকে দেখার জন্যে থামল ওরা। শুকনো খাড়ির পাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কতগুলো পুরানো, ভাঙা ছাউনি। পথের কিনার ঘেঁষে তৈরি হয়েছিল কিছু বাড়ি, বেশির ভাগই পাথরধসে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা বড় একটা বাড়ির কপালে সাইনবোের্ড রয়েছে, স্যালুন। আরেকটাতে জেনারেল স্টোর। কাত হয়ে যাওয়া একটা বাড়িতে লেখা, জেল। একটা কামারশালা আর একটা আস্তাবল আছে। পথের শেষ মাথায় পর্বতের গায়ে মস্ত এক কালো ফোকর, খনির প্রবেশ মুখ। ওই খনির জন্যেই গড়ে উঠেছিল শহরটা।
আঠারশা নব্বই সালে ফুরিয়ে আসে খনি, কিশোর বলল। চলে যেতে শুরু করে লোকে। ততদিনে খাড়িও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। একশো বছর পর এখানে কি খুঁজতে এসেছি আমরা, কিশোর?
জানি না, সেকেণ্ড। তবে আমি শিওর, নোরিয়াকে এখানে এসেই খুঁজতে বলেছেন বাওরাড। হয়ত এক-আধটা খবরের কাগজও বের হত তখন এখানে। খুঁজলে কয়েক সংখ্যা পাওয়াও যেতে পারে।
বলা যায় না, খবরের কাগজের মর্গও থাকতে পারে, রবিন আশা করল।
মর্গের নামে চমকে উঠল মুসা। খাইছে! যে শহরে এসেছি, আমরাও না শেষে মর্গের বাসিন্দা হই!
তার কথা কানে তুলল না কিশোর। বলল, এস, যাই।
পুরানো শহরের পাশে এসে সাইকেল থামাল ওরা। তালা দেয়া বড় একটা ফটকের সামনে। উঁচু বেড়ায় ঘেরা পুরো শহরটা
বেড়া দেখছ! এড বলল। দেখ, ওই বিল্ডিঙের লেখাটাও নতুন। কেউ এসে বাস করতে আরম্ভ করেছে নাকি আবার?
কি জানি, গাল চুলকাল কিশোর।
মিনিটখানেক অপেক্ষা করল ছেলেরা, কান পেতে রইল। কিন্তু নীরব হয়ে রইল পাউডার গালচ।
বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকতে হবে, অবশেষে বলল কিশোর।
সাইকেল রেখে, বেড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। ওপাশে নেমে তাকাল ধুলো-ধূসরিত পথের দিকে।
রবিন, মুসা, কিশোর বলল। তোমরা বাঁয়ের বাড়িগুলোতে খুঁজবে। আমরা যাচ্ছি জেলখানা, আস্তাবল আর অন্য কয়েকটাবাড়ি খুঁজতে। খনির কাছে গিয়ে মিলিত হব। দেখা যাক, কিছু পাই কিনা।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে জেনারেল স্টোরে গিয়ে ঢুকল রবিন আর মুসা। পা টিপে টিপে ঢুকে থামল। দুজনেই অবাক। একশো বছর আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েছে স্টোরটা। তাকে, তাকে মাল বোঝাই। ময়দা আর শুকনো আপেলের পিপা, লোহার নানারকম জিনিস-হাতুড়ি, বাটালি, করাত, শাবল, বেলচা, কুড়াল এসবই বেশি। চামড়ার জিন, আর আরও নানারকম জিনিস স্তূপ করে রাখা আছে মেঝেতে। দেয়ালে ঝোলানো পুরানো আমলের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ম্লান আলোতেও চমকাচ্ছে। লম্বা কাউন্টারটা চকচকে পালিশ করা, পরিষ্কার।
কেউ থাকে এখানে! রবিন বলল।
কি-কিন্তু, তোতলাতে লাগল মুসা। নি-নিশ্চয় এ-যুগের কেউ নয়! জিনিসপত্র সব একশো বছর আগের মত…মানে, স্টোরটা এখন ভূতের দখলে! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল সে। যেন আশঙ্কা করছে, হ্যাল্লো, কেমন আছ? বলে এখুনি বেরিয়ে আসবে ভূত।
রবিনেরও গা ছমছম করছে। ঢোক গিলল। হ্যাঁ, স্টোরটা যখন খোলা থাকত, এরকম সাজানোই থাকত বোধহয়। যেন…যেন এখনও খোলা…পোড়ো নয়! মুসা, কাউন্টারে দেখছ, পুরানো ধরনের একটা হিসেবের খাতা এখনও রয়েছে, যেন বেচা-কেনা চলছে! :
খুব সাবধানে কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। খোলা পড়ে আছে খাতাটা। খদ্দেরের নাম লেখাঃ জিনিসের অর্ডার দিয়ে গেছে। অনেক দ্বিধা করে শেষে খাতাটায় আঙুল ছোঁয়াল রবিন। কাঁপা হাতে পাতা উল্টে চলল। নব্বইয়ের পরেও আরও কয়েক বছর টিকে ছিল এই শহর। ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৬ সাল পাওয়া গেল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে জোরে জোরে পড়ল মুসা, বাওরাড ডাই, ফ্যান্টম লেক-সাপোর্ট সহ ২০০ বোর্ড-ফুট মুস টিম্বার, ২ পিপা ময়দা, ১ পিপা গরুর মাংস, ৪ বাক্স শুকনো সীমের বীচি। চোখ মিটমিট করল সে। খাইছে! কত লোকের জন্যে অর্ডার দিয়েছে?
অনেক লোক ভাড়া করেছিল নিশ্চয়। শ্রমিক। তাদের খাবার লাগবে না? আর কিছু চোখে পড়ছে, মুসা? মাথা নাড়ল মুসা। দেখছি না।
স্টোরের বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ল দুজনে। এরপর ঢুকল স্যালুনে।
আরি, এটা তো কমুনিটি সেন্টার ছিল মনে হচ্ছে, রবিন বলল। লোকে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করত এখানে, মেসেজ রেখে যেত। নিশ্চয় এখানে ঢুকেছিল বাওরাড।
ঘরটা বড়, অন্ধকার। পেছনে একটা দরজা, শোবার ঘরে ঢোকার জন্যে। বা ধারে কারুকাজ করা একটা পিয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চকচকে বারের ওপাশে সারি সারি মদের বোতল। পেছন দিকে গোল একটা টেবিলে কয়েকটা বোতল, গেলাসে ঢালা মদ, তাস ছড়িয়ে আছে, যেন এই খানিক আগে মদ খাওয়া আর তাস খেলা চলছিল।
এ-এটাও তো স্টোরের মতই, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। যেন এইমাত্র ছিল খনির শ্রমিকেরা, হঠাৎ উঠে চলে গেছে।
কথা শেষ হল না তার। অনেকগুলো, কণ্ঠের মিলিত শব্দে ভরে উঠল ঘর। সীমান্ত এলাকার পুরানো গানের সুর বাজতে শুরু করল পিয়ানোতে। কিন্তু মানুষজন কাউকে চোখে পড়ল না। বোতল আর গেলাস ঠোকাঠুকির মৃদু টুংটাং পান করার শব্দ, মানুষের হুল্লোড় চলছে। পেছনে গোল টেবিলের কাছে জোরে শব্দ, আবছা একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল বলে মনে হল। চুপ! একচুল নড়বে না! ধমক শোনা গেল।
সামান্য স্পষ্ট হল আবছা মূর্তিটা। দেখা গেল, দুহাতে দুই পিস্তল।
ভূ-ভূত! চিৎকার করে উঠল মুসা। মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল! রবিন, দৌড় দাও!
দৌড়াতে গিয়ে একজন আরেকজনের ওপর এসে পড়ল। ওদের কাণ্ড দেখেই বুঝি পেছনে হো হো করে হেসে উঠল লোকেরা। বেজেই চলেছে পিয়ানো। বাইরে গরম। পরোয়াই করল না দুই গোয়েন্দা। ধুলোয় ঢাকা পথ ধরে ছুটল খনির দিকে।
খনির ভেতরে লম্বা সুড়ঙ্গটা আলোকিত। ঢালু শ্যাফট ধরে ছুটল ওরা। সামনে দেখা গেল কিশোর আর এডকে।
কিশোর! চেঁচিয়ে ডাকল মুসা। আরেকটু হলেই ভূতে…! এবারেও শেষ হল না তার কথা। দেখল, থমকে দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর আর এড়। দৃষ্টি সামনে। কিছু একটা ওদেরকেও অবাক করেছে।
রবিন আর মুসারও কানে এল বিচিত্র শব্দ। পানি পড়ছে, মেশিন চলছে, থেকে থেকেই বন্য কণ্ঠে হেসে উহছে কোন পাগল! গুলি ফোটার বিকট আওয়াজ হল বদ্ধ সুড়ঙ্গে, কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল যেন বুলেট, গুলির শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাল সুড়ঙ্গের ভেতর।
কি হল, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বলল রবিন, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।
ঢোক গিলল কিশোর। বুঝতে পারছি না!…ঢুকলাম…গুলি করল আমাদেরকে…লোকটা…।
লোকটাকে দেখতে পেল মুসা আর রবিন।
সুড়ঙ্গের আবছা অন্ধকারে বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রাইফেলের নল ওদের দিকে ফেরানো। দাড়িওয়ালা এক খনি-শ্রমিক। গায়ে লাল উলের শার্ট। পরনে হরিণের চামড়ার প্যান্ট। পায়ে গোড়ালি ঢাকা উঁচু চামড়ার বুট।
চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা! খসখসে গলায় বলল লোকটা। হেসে উঠল খলখল করে। হাতের রাইফেল উঁচু করে আবার ট্রিগার টিপল।
৮
প্রচণ্ড শব্দ।
আবার গুলি করল লোকটা।
ছাই হয়ে গেছে মুসার চেহারা। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ককিয়ে উঠল, আমি…আমি কি..গুলি খেয়েছি?
চোখ মেলল সে। অন্যদের অবস্থাও কমবেশি তারই মত।
মিস করেছে! রবিন বলল।
আসলে…আসলে আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছে, বলল এড।
আবার বুনো হাসি হেসে উঠল লোকটা। রাইফেল তুলে হুমকি দিল, চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা!
আবার টিপে দিল ট্রিগার। পর পর দুটো গুলির শব্দ কাঁপন তুলল সুড়ঙ্গের দেয়ালে।
এবারও মিস করেছে! চিৎকার করে বলল এড। সাহস করে লোকটার দিকে এক পা এগোল সে। কি ব্যাপার? আমাদের…
দাঁড়াও, এড, ডাকল কিশোর। ভালমত দেখ সবাই। কি বলে শোন।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। খনির ভেতর থেকে এখনও ভেসে আসছে পানি পড়া আর মেশিন চলার আওয়াজ। দীর্ঘ এক মিনিট পর কট করে মৃদু একটা শব্দের পরই খড়খড় করে উঠল কিছু, সঙ্গে সঙ্গে বন্য হাসি হেসে রাইফেল তুলল লোকটা। একঘেয়ে কণ্ঠে বলল, চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা! টিপে দিল ট্রিগার। পর পর দুবার।
ওটা নকল মানুষ! বলেই হাসতে শুরু করল কিশোর। যান্ত্রিক পুতুল। ভেতরে রেকর্ড করা ক্যাসেট ভরা। নানারকম শব্দের ব্যবস্থাও করা হয়েছে ক্যাসেটের সাহায্যেই। কায়দা করে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে স্পীকারগুলো।
হঠাৎ কপালে চাপড় মারল রবিন। হায় হায়রে, গাধা বানিয়ে ছেড়েছে। আমাদের! ইস আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল। পেপারেই তো পড়েছি। পাউডার গালচের সংস্কার করে টুরিস্ট আকর্ষণের ব্যবস্থা করেছে। গড়ে তুলেছে পুরানো ওয়েস্টার্ন পরিবেশ। সেজন্যেই চারপাশে বেড়া, গেটে তালা।
হুঁ, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ধোকা খেয়েছে বলে নিজের ওপরই বিরক্ত। আমিও পড়েছি। কিছুদিন আগে।
এগিয়ে গিয়ে পুতুলটার মুখে হাত বোলাল মুসা। স্টিক। আসল না নকল বোঝাই যায় না। স্যালুনের ভূতটাও নিশ্চয় পুতুল। খোদা, কি জিনিস বানায় ওরা আজকাল!
হ্যাঁ, ভালই বানায়। খালি কথা বললে হবে না, আরও কাজ আছে। কোন সূত্র-টুত্র পাওয়া গেছে? কাজে লাগার মত?
হিসেবের খাতাটার কথা জানাল রবিন। আর কি পরিমাণ খাবার কিনেছে বাওরাড ডাই।
একজনের জন্যেও কিনতে পারেন। শুনে কিশোর বলল, অনেক দিন কোথাও থেকে কিছু বানানোর দরকার হলে। একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে, নোরিয়াকে চমকে দেয়ার জন্যে যা বানিয়েছেন, বাওরাড, সেটা বড় রকমের কিছু। কিন্তু কি বানিয়েছেন, কোথায় বানিয়েছেন এখনও জানি না আমরা। পাতলা জার্নালটা খুলল সে। ঊনত্রিশে অক্টোবর এমন কিছু লেখা নেই, যাতে কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
স্যালুনে সূত্র খোঁজার সুযোগই পাইনি,মুসা বলল।
বেশ, তাহলে আবার যাব আমরা। জার্নাল বন্ধ করল কিশোর। তারপর জেলখানায়। শেরিফের ফেলে যাওয়া রেকর্ড থাকতেও পারে। শেষে টু মারব। পত্রিকা অফিসে।
ফিরে চলল ওরা। ঢোকার সময় তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি রবিন আর মুসা। এখন দেখল ভালমত। ঠেলাগাড়ি, নানারকমের যন্ত্রপাতি, আরও একটা পুতুল কালো দাড়িওয়ালা এক খনি-শ্রমিক, হাতে গাঁইতি।
বাহ্, চমৎকার, হেসে বলল মুসা। তখন এটা দেখলেও দৌড় পেতাম…।
হাত থেকে গাইতি ফেলে দিল দাড়িওয়ালা। লাফিয়ে কিশোরের কাছে গিয়ে একটানে তার হাত থেকে জার্নালটা নিয়ে দৌড় দিল। বেরিয়ে গেল সুড়ঙ্গ থেকে।
টিক বানাউ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
এতই দ্রুত ঘটে গেছে ঘটনা, ক্ষণিকের জন্যে যেন পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ওরা। রবিন চেঁচাতেই কিশোরও চিৎকার করে উঠল, নিয়ে গেল! ধর, ধর!
ম্লান আলোকিত সুড়ঙ্গ ধরে ছুটল ওরা। বেরিয়ে এল কড়া রোদে। ভীষণ গরম।
ওই যে ব্যাটা! হাত তুলে দেখাল এড।
পথের শেষ মাথায় চলে গেছে বেঁটে নাবিক, এখনও দৌড়াচ্ছে।
থাম! এইই, থাম, চোর কোথাকার! মুসা চেঁচাল।
আরে, থামছে না তো! বলল এড। এই, এইই, থাম!
ফিরে চেয়ে হাসল টিক। তারপর ছুটে গেল স্যালুনের দিকে। এই সময় দরজায় দেখা দিল একটা আবছা মূর্তি, দুই হাতে পিস্তল।
চমকে উঠল মুসা। সেই ভূতটা…।
মূর্তিটাকে টিকও দেখেছে। সে-ও চিৎকার করে উঠল। পরক্ষণেই মোড় নিয়ে আরেকদিকে দৌড়াতে গেল। ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর একটা পুরানো গামলায় পা বেঁধে পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। হাত থেকে উড়ে চলে গেল জার্নালটা। হচড়েপাচড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়াল সে।
ধর ব্যাটাকে! মুসা বলল। ধর!
ফিরে তাকাল ভূত। তারপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল, চোরটাকে ধরার জন্যে। পিস্তলে রোদ লেগে ঝিক করে উঠল। ধরা পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকল না টিক। বাড়িটার ধার দিয়ে আবার দৌড় দিল। বেড়ার কাছে পৌঁছে দেরি করল না এক মুহূর্ত। ওপরে চড়ে লাফ দিয়ে নামল ওপাশে। খাড়ির পাড়ে ওখানে ঘন ঝোপঝাড়, হারিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না তার।
ভূতের কাছে ছুটে এল ছেলেরা। কালো ওয়েস্টার্ন পোশাক পরা একজন মানুষ। জার্নালটা তুলে নিল কিশোর।
এখানে কি করছ তোমরা? কৈফিয়ত তলব করল ভূতটা। জলদি সব খুলে বল। আর ওটা দাও, জার্নালটার কথা বলল সে। নিশ্চয় এখানকার জিনিস।
না, স্যার, মোলায়েম গলায় বলল কিশোর। জানতাম না এখানে কেউ আছে। তাহলে অনুমতি নিয়েই ঢুকতাম, পাউডার গালচে বাওরাড ডাইয়ের গতিবিধির খবর নিতে এসেছে, জানাল সে। দারুণ হয়েছে আপনার ভূত ভূত খেলা! রীতিমত ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
ভূত হাসল। প্র্যাকটিস করছিলাম। দেখতে চাইছিলাম, কি প্রতিক্রিয়া হয় তোমাদের। আমি এখানকার কেয়ারটেকার। চোয়াল ডলল সে। বাওরাড ডাই, না? বোধহয় সাহায্য করতে পারব। পুরানো রেকর্ড আছে আমার অফিসে। বাওরাড ডাই এখানে তেমন কিছু করে থাকলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।
স্যালুনের ভেতর দিয়ে এসে ছোট একটা অফিসে ঢুকল ওরা। একটা ফাইলিং ক্যাবিনেট খুলল কেয়ারটেকার এখানে আছে রেকর্ড। দেখা যাক, বুড়ো বাওরাড কি করেছে।
একটা ফাইল খুলে, পড়ে, মাথা নাড়ল কেয়ারটেকার। না, তেমন কিছু নেই। শুধু দুটো রেফারেন্স। জেনারেল স্টোরে জিনিস কিনেছে, হিসেবের খাতায় তোমরা যা দেখেছ। আর দৈনিক গালচ-এ দুই লাইনের একটা নোসিশ, আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে, কয়েকদিনের জন্যে কিছু শ্রমিক চেয়েছে। ব্যস।
এইই? নিরাশ হল মুসা। দূর! এত কষ্ট করে কোন লাভ হল না…
বাইরে ডাক শোনা গেল, এই, কোথায় গেলে তোমরা?…এড? এডবার… আই, ছেলেরা…?
ডিনো, এড বলল।
দ্রুত বেরিয়ে এল ছেলেরা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ডিনো, সঙ্গে আরেক লোক। হিসটোরিক্যাল সোসাইটির সেই প্রফেসর, হারম্যান কেইন।
ছেলেদের দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। গেটের বাইরে দেখা হল ডিনাম্যান হ্যাংবারের সঙ্গে। বললেন, তোমরা এখানে এসেছ। এসে তোমাদের সাইকেল পড়ে থাকতে দেখলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তোমাদের কিছু হয়েছে ভেবে…।
বিনা অনুমতিতে ঢুকেছ? ডিনো বলে উঠল। জানতাম, গোলমাল বাধাবে। সেজন্যেই তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছি।
না, কিছু হয়নি ওদের, কেয়ারটেকার বলল। তবে বেশ উত্তেজনার মধ্যে ছিল, আমাদের কাজ দেখে। তাই না, ছেলেরা? প্রফেসরকে জানাও সেকথা। খুশি হবেন। আমাদের হিসটোরিক্যাল অ্যাডভাইজার তিনি। নতুন করে আবার সব সাজাতে সাহায্য করেছেন সোসাইটি।
শুনব, শুনব সব, পরে, হাত তুললেন প্রফেসর। রিমলেস চশমার ওপাশে উজ্জ্বল হল তার চোখ। কেয়ারটেকারের উদ্দেশে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ছেলেদের নিয়ে রওনা হলেন ওয়েস্টার্ন শহরের পথ ধরে। বাওরাড ডাইয়ের আরেকটা জার্নাল নাকি পেয়েছ তোমরা? গুপ্তধন সত্যি আছে ভাবছ নাকি? পাওয়া গেলে কি সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। বল, জলদি খুলে বল সব।
কিভাবে জার্নালটা পাওয়া গেছে, জানাল কিশোর। টিক বানাউয়ের কথাও বলল।
লাল হয়ে গেল প্রফেসরের লাল মুখ। ওই শয়তানটা? টিক বানাউ। ডাইয়ের গুপ্তধন চুরির মতলব করেছে? নিয়ে গিয়ে নিশ্চয় গলিয়ে ফেলবে সমস্ত সোনার অলঙ্কার। নষ্ট করে ফেলবে! মানুষ নাকি ও? এত মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিসপত্র নষ্ট করে! আরিব্বাপরে, ভাবতেই রোম খাড়া হয়ে যায়—ঈস্ট ইনডিয়ান জলদস্যুদের লুটের মাল! বিখ্যাত হয়ে যাবে আমাদের সোসাইটির মিউজিয়ম। তা কোন সূত্রে পেলে?
না, বেশি কিছু না, দ্বিধা করছে কিশোর। শুধু জেনেছি, স্ত্রীর জন্যে বড় কিছু
একটা বানিয়ে গেছে বাওরাড ডাই।
হুঁ। এখানে নয় নিশ্চয়? ফ্যান্টম লেকে না তো? এই এলাকার অনেক জায়গাই চিনি আমি। তোমাদের চোখে না পড়লেও হয়ত আমার চোখে পড়বে।
একটা স্টেশন ওয়াগন দেখিয়ে বললেন প্রফেসর, যাও, সাইকেলগুলো আমার গাড়িতে তোল। ফ্যান্টম লেকে যাব আমরা। কিছুতেই টিক বানাউকে নিতে দেব না গুপ্তধন।
আরেক দিকে মুখ ফেরাল ডিনো। বিড়বিড় করল, আরেকটা বেকুব।
কী? কি বললেন? কথাটা শুনে ফেলেছেন প্রফেসর। বেকুব আমি, না আপনি? এসবের কি কচুটা জানেন আপনি? আপনি কোথাকার বুদ্ধিমান? এই, যাও তোমরা, সাইকেল তোল।
ডিনোর চেহারা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল মুসা। ছুটল সাইকেল আনার জন্যে।
৯
শেষ বিকেল। আগে আগে চলেছেন প্রফেসর, পেছনে ছেলেরা। উপত্যকার প্রতিটি ফুট পরীক্ষা করে দেখে এসেছে ওরা, ছোট পাহাড়টারও অর্ধেকটা। সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে পুকুরটাকে, ফ্যান্টম লেক। উত্তেজিত প্রফেসরের সঙ্গে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে তিনবার চক্কর দিয়েছে ওরা পুরো বাড়িটা। পরিশ্রম অনেক করেছে, কিন্তু পায়নি কিছুই।
বিশাল বাড়িটার চত্বরে এখন পড়ন্ত রোদ। সেখানে এসে জমায়েত হল সবাই। হেসে ওদের সান্ত্বনা দিলেন মিসেস ডাই। বাঁকা হাসল ডিনো, দাঁতের ফাঁকে পাইপ, ফকফক ধোঁয়া ছাড়ছে।
কিছুই পেলাম না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। বাড়িটা ছাড়া বড় কিছু বানায়নি বাওরাড ডাই। আর এখানে খোঁজা হয়েছে প্রায় একশো বছর ধরে। মাথা নাড়লেন তিনি। স্কুস টিম্বারের চিহ্নও দেখলাম না।
হেসে উঠল ডিনো, খুব মজা পাচ্ছে যেন। বলেছিলাম না, বেকুব। তখন তো রেগে গেলেন। টিম্বার দিয়ে বুড়ো কিছু বানিয়ে থাকলেও নেই এতদিন, নষ্ট হয়ে গেছে কবেই। আর গুপ্তধন? ঘোড়ার ডিম আছে।
আছে। এবং বেরও করব আমরা! রেগে গেল শান্ত রবিন। সে-ও লোকটাকে সত্ম করতে পারছে না।
নিশ্চয়ই করবে, প্রেরণা জোগালেন মিসেস ডাই। তিরস্কারের ভঙ্গিতে তাকালেন ডিনোর দিকে। সোনার মোহর কিংবা হীরের গহনা না পেলেই বা কি? এমন কিছু পাওয়া যেতে পারে, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
মা, এড বলল। মনে হচ্ছে গুপ্তধন আছে তুমিও বিশ্বাস কর না?
এসব কথায় কান নেই কিশোরের। বাওরাড ডাইয়ের চিঠিটা আবার পড়ছে। ইস, আর একটু যদি বুঝতে পারতাম। আমি শিওর, চাবি কোথাও আছেই। আসলে, সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে সূত্র। তারপর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, আচ্ছা, বাড়িতে কি ভালবাসতেন বাওরাড?
মাথা নাড়লেন মিসেস ডাই। তোমরা যখন পাউডার গালচে, আমিও বসে থাকিনি। নোরিয়ার অনেক চিঠি বের করে পড়েছি। আগেও পড়েছি, আবার পড়লাম। লেখা আছে অনেক কথাই। কিন্তু স্কটল্যান্ডে কি ভালবাসতেন বাওরাড, সে-সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। হ্রদের দৃশ্য দারুণ ভালবাসতেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধুই একথা।
ওটা এমন কোন ব্যাপার না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন প্রফেসর।
জটিল সমস্যা, আনমনে বলল কিশোর।
শঙ্কিত হল এড। খোঁজা বাদ দেবে না তো, কিশোর?
বাদ? মুচকি হাসল মুসা। কিশোর পাশাকে তুমি চেন না, এডবার ডাই। তদন্ত তো সবে শুরু করেছে ও।
বাদ দিলেও তোমাদের দোষ দেব না আমি, বললেন মিসেস ডাই।
বাদ দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, মুখ খুলল কিশোর। প্রথম ধাপে রয়েছি আমরা, বাওরাড এখনও বলেননি কোথায় খুঁজতে হবে। জার্নালটা খুলল সে। ঊনত্রিশ অক্টোবরের পরে, যেটাতে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে, সেটা নভেম্বর এগার। লিখেছেনঃ সাইপ্রেসের দ্বীপে গিয়েছিলাম আজ। নৌকা বোঝাই ছিল। আরেকটু হলেই গিয়েছিল ডুবে, দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে আসা ঝড়ে, এমনই ফুসে উঠেছিল সাগর। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে দ্বীপের মালিক। দুপুরের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি আমি। নোরিয়ার উপহারের কাজ ভালই এগোচ্ছে। মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। পরের হপ্তায় আর বিশেষ কিছু নেই।
কিশোর, মুসা বলল। লিখেছে, নৌকা বোঝাই ছিল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দ্বীপেই হয়ত রয়েছে জবাব। কিন্তু, বলল এড। কোথায় ওটা? এখানে সাইপ্রেসের দ্বীপ আছে বলে তো শুনিনি?
আমিও না, কিশোর বলল। মুসা, তুমি জান?
রকি বীচের আশপাশের সাগর সম্পর্কে ভাল জ্ঞান মুসার। সাগর, সাঁতার, নৌকা বাওয়া খুব পছন্দ করে। হাত বাড়িয়ে জার্নালটা নিল সে। আমার মনে হয় না ওটা আসল নাম। হয়ত কোন নামই নেই, সে-জনেই ওই নাম রেখেছে। চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এর বড় বড় সমস্ত দ্বীপের নাম আছে, এটার নেই যখন, নিশ্চয় খুব ছোট। উপকূলের কাছেই কোথাও হবে। নইলে সকালে গিয়ে দুপুরের আগে ফিরে আসতে পারত না বাওরাড ডাই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো বললই, আর দ্বীপটায় সাইপ্রেস গাছ আছে। খুঁজে দেখা দরকার।
আমিও যাব, বলে উঠলেন প্রফেসর। ছোট একটা সেইলিং বোট আছে আমার। রকি বীচ থেকে বেশি দূরে না হলে ওটা নিয়েই যাওয়া যায়।
উঠে দাঁড়াল ডিনো। গুজব, ভূত, নাম ছাড়া দ্বীপ, একশো বছর আগে মরে যাওয়া একজন মানুষ…পাগল..সব উন্মাদ হয়ে গেছে। গটমট করে বেরিয়ে গেল স্কটসম্যান।
সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন মিসেস ডাই, হাসলেন। প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন, ওর ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। ও একটু বদমেজাজী। অবাস্তব কথা সইতে পারে না। তবে লোক খারাপ না, ভাল। এডের বাবা মারা যাওয়ার পর কি কষ্টে যে দিন কাটছিল আমাদের, ডিনো আসাতে খানিকটা সহজ হয়েছে। ভীষণ খাটতে পারে। আগে অবশ্য মেজাজ এত খারাপ ছিল না তার। বাইরে থেকে আসার পর এমন হয়েছে।
বাইরে? কথাটা ধরল কিশোর। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। কোথায় গিয়েছিল?
সান্তা বারবারায়। অ্যাভোকাডো বেচতে গিয়েছিল। তিনদিন পর কাল রাতে ফিরেছে।
মেঘ জমল কিশোরের চেহারায়। ও আপনার কেমন আত্মীয়, মিসেস ডাই? মাত্র এক বছর হল এসেছে বললেন না?
স্কটল্যাণ্ড থেকে এসেছে। আমার স্বামীর দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই, সেই সম্পর্কে আমারও। বছরখানেক আগে আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিল। এসে দেখে এডের বাবা নেই। সাহায্য করতে চাইল। আমার তখন অবস্থা খারাপ। রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের জন্যে ওর খুব মায়া। এত যে খাটে, কাজের জন্যে একটা পয়সা নেয় না। থাকা আর খাওয়া, ব্যস।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। রবিন আর মুসাকেও ওঠার ইঙ্গিত করে বলল, দেরি হয়ে গেছে। চলি, ম্যাডাম। বাড়ি যাব।
চল, পৌঁছে দেব, বললেন প্রফেসর। শাখাপথ থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠল স্টেশন ওয়াগন।
প্রফেসর, হঠাৎ কথা বলল কিশোর। একটা ব্যাপার অবাক লাগছে। আচ্ছা বলুন তো, চিঠি আর ডাইদের সম্পর্কে এত কথা জানল কি করে টিক বানাউ?
বলতে পারব না। গুপ্তধনের জোর গুজব রয়েছে, অনেকেই জানে। কিন্তু টিক বানাউয়ের কথা যা শুনলাম, তাকে স্থানীয় লোক মনে হচ্ছে না। কে জানে, লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া অন্য কোন নাবিকের বংশধর হতে পারে। ক্যাপ্টেনের কেউ হলেও অবাক হব না।
ঠিক, রবিন বলল। এটাই ব্যাখ্যা।
হতে পারে, ধীরে ধীরে বলল কিশোর।
ডিনারের আধ ঘন্টা আগে স্যালভিজ ইয়ার্ডে ছেলেদের নামিয়ে দিয়ে গেলেন প্রফেসর।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা।
কিশোর, ভাবছি,মুসা বলল। ফ্যান্টম লেকেই কোন খনি রেখে যায়নি তো বাওরাড ডাই? গোপন খনি?
থাকতেও পারে। হাতে কোন প্রমাণ নেই, শিওর হই কি করে? আর স্কটল্যাণ্ডের ভূতের গুজবের সঙ্গে খনির যোগাযোেগ কোথায়? কিংবা আয়নার?
রবিন মনে করিয়ে দিল, মিসেস ডাই বললেন, ভাইকিংরা আসে কিনা সেদিকে নাকি চোখ রাখে ভূত। ওই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছে হয়ত বাওরাড। হ্রদের দিকে চেয়ে থাকা ভূত। মানে কি? পুকুরের নিচে লুকিয়ে রাখেনি তো গুপ্তধন?
রাখতে পারে, কিশোর বলল। তবে তার জন্যেও প্রমাণ চাই। নির্ভরযোগ্য সূত্র। কোথায় রেখেছে, জানতে হলে। সারা পুকুরের তলায় তো আর খোঁজা যাবে না। থামল এক মুহূর্ত। ডিনোর কথা মিসেস ডাই কি বললেন মনে আছে?
আছে, বলল মুসা। খুব খাটতে পারে, আর খুব মায়া। কাজের বিনিময়ে একটা পয়সা নেয় না।
তবে কিছুটা বদমেজাজী, যোগ করল রবিন। চমক্কার সব লক্ষণ।
এবং, কিশোর বলল। ফ্যান্টম লেক থেকে তিনদিনের জন্যে বাইরে চলে গিয়েছিল, ফিরেছে কাল রাতে। তারমানে, গতকাল তার রকি বীচে থাকা সম্ভব, যখন টিক আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
টিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুপ্তধন খুঁজছে ভাবছ? রবিন বলল। বাওরাডের চিঠির কথা, ফ্যান্টম লেক, মিসেস ডাই কি কি জিনিস বিক্রি করেছেন, সব জানা আছে ডিনোর।
হ্যাঁ, আছে। মুসা, আজ রাতের মধ্যে সাইপ্রেস আইল্যাণ্ডটা কোন দ্বীপ, জানার চেষ্টা করবে। কাল সকালে প্রফেসর কেইনের বোটে মিলিত হব আমরা।
ডিনারের পর চাচা-চাচীকে ঘরের কাজে সাহায্য করল কিশোর। দশটায় বাজল টেলিফোন।
মুসা করেছে। বলল, কিশোর, ওটা আসলে ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ড। আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে দ্বীপটা ক্যাবরিলো পরিবারের দখলে ছিল। সাইপ্রেস গাছের ছড়াছড়ি। তীর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে। বন্দর থেকে মাইল দুই উত্তরে।
চমৎকার কাজ দেখিয়েছ, সেকেণ্ড! দুর্লভ প্রশংসা পেল মুসা, কিশোর পাশা সহজে কারও প্রশংসা করে না।
রিসিভার রেখে দোতলায় নিজের ঘরে চলে এল কিশোর। আলো জ্বালার আগে একবার সামনের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। রকি বীচে ক্রিস্টমাস লাইট দেখার জন্যে। অনেক বাড়িতেই জ্বলছে রঙিন আলো।
সরে আসতে যাবে, এই সময় আলোর একটা ঝিলিক চোখে পড়ল তার। তাকাল সেদিকে। আবার দেখা গেল আলো। অবাক হল সে। ওখানে তো কোন বাড়িঘর নেই? হঠাৎ বুঝল, তাদের স্যালভিজ ইয়ার্ডের ভেতরেই। যেখানটায় ওদের হেডকোয়ার্টার লুকানো রয়েছে জঞ্জালের তলায়।
আলোটা আসছে ট্রেলারের স্কাইলাইটের ফোকর দিয়ে!
তাড়াতাড়ি নিচে নামল কিশোর। বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগোল। মেইন গেট বন্ধ। তালা দেয়া। মোড় নিয়ে ওয়ার্কশপের দিকে চলল সে। এখানে আরেকটা গোপন প্রবেশ পথ রয়েছে তিন গোয়েন্দার, সবুজ রঙ করা বেড়ার গায়ে দুটো আলগা বোর্ড।
সাবধানে সবুজ ফটক একের ভেতর দিয়ে ওয়ার্কশপে ঢুকল কিশোর। আলো আর চোখে পড়ছে না এখন। দুই সুড়ঙ্গের কাছেও কেউ নেই। সহজ তিন-এর সামনে থেকে খুব সতর্ক ভাবে কিছু জঞ্জাল সরাল।
পুরানো কাঠের দরজার পাল্লা ভেঙে খোলা হয়েছে। তার ওপাশে হাঁ হয়ে খুলে আছে ট্রেলারের দরজা।
হেডকোয়ার্টারে ঢুকল কিশোর। বাওরাড ডাইয়ের জার্নালটা ডেস্কের ওপরই আছে, তবে বন্ধ নয়, খোলা। তীব্র আলোর ঝিলিকের মানে বুঝে ফেলল। দরজা ভেঙে ঢুকে জার্নালটার ছবি তুলে নিয়ে গেছে কেউ। ফ্লাশগানের আলো দেখেছে সে।
সহজ তিন-এর দরজা আবার ঠিকঠাক করে লাগিয়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর। চিন্তিত। এখন আরও একজনের জানা হয়ে গেল, কি লেখা রয়েছে বাওরাডের দ্বিতীয় জার্নালে।
১০
রকি বীচ বন্দরের ওপর কুয়াশা যেন ঝুলে রয়েছে। সাইকেল চালিয়ে এসে দেখল তিন গোয়েন্দা, হাজির রয়েছে এড, ওদেরই অপেক্ষা করছে। সাইকেল তুলে নিয়েছে প্রফেসরের বোটে। আঠাল ঠাণ্ডা গায়ে কাঁপুনি তুলে দিয়েছে তার।
তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাসল এড। সারারাত ধরে ভেবেছি, বুঝেছ। আমি শিওর, নৌকা বোঝাই করে গুপ্তধনই নিয়ে গিয়েছিল বাওরাড ডাই। আমার ধারণা, আজ দ্বীপে গেলেই পেয়ে যাব।
আমি তা মনে করতে পারছি না, এড, কিশোর বলল। এত…
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। তীরের কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল স্টেশন ওয়াগন। লাফিয়ে নেমে প্রায় ছুটে এলেন প্রফেসর। সরি, বয়েজ, দেরি হয়ে গেল। আজ সকালে একটা গণ্ডগোল হয়েছে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে। লিটল মারমেইডের ফাইল চুরির চেষ্টা হয়েছিল। কালো দাড়িওয়ালা এক লোক।
টিক ব্রাউন! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল বরিন আর মুসা।
মাথা ঝাঁকালেন প্রফেসর। আমারও তাই মনে হয়।
কিন্তু কেন? এডের জিজ্ঞাসা। লিটল মারমেইডের ইতিহাস তো সবাই জানে।
হয়ত সবার চোখেই কিছু এড়িয়ে গেছে, অনুমান করল কিশোর। স্যালভিজ ইয়ার্ডেও যে চোর এসেছিল, জানাল সবাইকে।
চমকে উঠলেন প্রফেসর, জার্নালও তাহলে পেয়ে গেছে টিক! চোরটা হয়ত ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে, আমাদের আগেই গিয়ে হাজির হবে দ্বীপে। সাগরের ওপরের কুয়াশার দিকে তাকলেন তিনি। কিন্তু এই আবহাওয়ায় কি আমরা যেতে পারব?
মাথা ঝাঁকাল মুসা। তীরের কাছে ঘন বটে, তবে আমার ধারণা, যতই দূরে যাব পাতলা হয়ে যাবে কুয়াশা। এসময়ে এখানটায় কুয়াশা কিছু বেশিই থাকে, জানেনই তো। আর অসুবিধে কি? যথেষ্ট বড় আপনার বোট।
চল তাহলে। তাড়াতাড়ি করতে হবে।
পঁচিশ ফুট লম্বা সুন্দর একটা সেইলিং বোট। উঠল সবাই। অকজিলারি ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন প্রফেসর। দ্রুত তীরের কাছ থেকে সরে এল বোট। হাল ধরল মুসা, কোর্স সেট করল উত্তরে। ছেলেদের নিয়ে কেবিনে গাদাগাদি করে বসলেন প্রফেসর। প্রচণ্ড শীত। ভারি সোয়েটারেও বাগ মানছে না ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা।
দ্বীপটা ছোট, মুসা বলল। খুব সুন্দর। এখন পরিত্যক্ত। চমৎকার একটা গুহাও আছে।
বাতাস কম, পাল তুলে লাভ নেই। তাই ইঞ্জিনের ওপরই ভরসা করল মুসা। নিচে কেবিনেই রয়েছে অন্যেরা, তাদেরকে বলল সে, ওই যে, দেখা যাচ্ছে।
সামনে, প্রায় মাইলখানেক দূরে কুয়াশার ভেতর মাথা তুলেছে দ্বীপটা, যেন সাগর থেকে উঠে এসেছে কমলো কিম্ভুত এক দানব। আরও কাছে এগোলে চোখে পড়ল গাছ, রাশি রাশি সাইপ্রেস। পেছনের দুটো পাহাড় চূড়ার একটাকে ছাড়িয়ে উঠেছে লম্বা চিমনি। জনহীন, পাথুরে এলাকা। তার ওপাশে আকাশ থেকে সাগরে নেমে গেছে যেন কুয়াশার ভারি চাদর।
দক্ষ হাতে হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা খাড়ির ভেতরে বোট ঢোকাল মুসা। পুরানো কাঠের জেটিতে বাঁধল। হুড়াহুড়ি করে নামল সবাই। দেখতে লাগল জনমানবশূন্য পাথুরে দ্বীপটা। যেখানে সেখানে জন্মে রয়েছে বুড়ো সাইপ্রেস, ওগুলোর মাঝের খোলা জায়গা দখল করে নিয়েছে ঘন ঝোপঝাড়। ক্রমাগত ঝড়ো বাতাসের কারণে বিচিত্র ভঙ্গিতে বেঁকে গিয়েছে বড় বড় গাছগুলো।
সর্বনাশ! হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। বুড়ো বাওরাড এখানেই যদি গুপ্তধন লুকিয়ে থাকে, কি করে বের করব? যেখানে খুশি থাকতে পারে। শত বছর খোঁড়াখুঁড়ি করলেও খুঁজে পাব না।
না, রবিন, কিশোর বলল। কাল রাতে অনেক ভেবেছি এসব নিয়ে। আমার ধারণা, মাটির তলায় গুপ্তধন লুকাননি বাওরাড। কারণ, তিনি জানতেন, লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেন তার পিছু নিয়েছে। সদ্য খোঁড়া মাটি তার নজরে পড়ে যেতে পারে। যে কারই চোখে পড়তে পারে। তাছাড়া, তিনি চেয়েছেন, সহজেই যাতে খুঁজে বের করতে পারে নোরিয়া। মাটিতে পুঁতে রাখলে সেদিক থেকেও অসুবিধে। খুব তাড়াতাড়িই নতুন মাটি পুরানো মাটির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়, আলাদা করে চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে। মাথা নাড়ল সে। না, ওরকম জায়গায় লুকাননি। আর যেখানেই লুকিয়েছেন, স্পষ্ট চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন, দীর্ঘদিনেও যা নষ্ট হবার নয়। কারণ তিনি শিওর ছিলেন না, ধাঁধার মানে বুঝে গুপ্তধন বের করতে কতদিন লাগবে তাঁর স্ত্রীর।
এই দ্বীপে কিছু বানিয়ে যায়নি তো বাওরাড?এড বলল। নোরিয়াকে চমকে চেয়ার জন্যে হয়তো জায়গা কিনে কিছু বানিয়েছে।
সেকথাও ভেবেছি। কাঠ দিয়ে তৈরি জিনিসের দিকে চোখ রাখতে হবে। আমাদের। আর, ডাইদের চিহ্ন বহন করে এমন কিছু।
চিঠিতে বলেছেন, তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতে, রবিন বলল। তার দিনগুলো কিভাবে তৈরি হয়েছে পড়ার জন্যে। ভূত আর আয়নার কথা বলেছেন। ইঙ্গিত আর চিহ্ন বোধহয় ওগুলোই।
ঠিক, একমত হল কিশোর। জার্নালে উল্লেখ আছে, এই দ্বীপের মালিকের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন বাওরাড, হয়ত কোন জিনিস লুকানোর অনুমতি চেয়েছেন। কাজেই, ওই চিমনিওয়ালা বাড়িটা থেকে খোঁজা শুরু করব। রেকর্ড থাকতে পারে ওখানে।
পাহাড়ে চড়ল ওরা। চূড়ার কাছে একটা ছোট গুহামত রয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাতে আশ্রয় নেয়া চলে। কাছাকাছি খানিকটা সমতল জায়গা। বিশাল চিমনি মাথা তুলেছে ওখান থেকেই। পাথরের মস্ত ফায়ারপ্লেস আছে, পাথরের চুলা আছে, চারপাশে পাথরের ছড়াছড়ি, কিন্তু বাড়ি নেই। বড় বড় পাথরের চাঙড়, চাড় দিয়ে তুলে ফেলা হয়েছিল, বোঝা যায়, জায়গামত রেখে দেয়া হয়েছে আবার।
ওগুলো দেখে বলে উঠলেন প্রফেসর, কেউ এসে দেখে গেছে আমাদের আগেই। বেশিক্ষণ হয়নি।
অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করল ওরা। বার বার তাকাচ্ছে বাকাচোরা সাইপ্রেস বনের দিকে, নির্জন পাহাড়ের চূড়া আর ঢালের দিকে। কেউ নেই। শুধুই কুয়াশা, যেন ঝরে পড়ছে পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়াটে মেঘ।
দেখি তো, কি আছে ওটার তলায়, বলে একটা চাঙড়ের দিকে এগোল রবিন। সে আর মুসা মিলে সরিয়ে ফেলল ওটা। শূন্য গর্তটার দিকে তাকাল সবাই।
কিচ্ছু নেই, বলল মুসা। থাকার কথাও না অবশ্য। বিশেষ করে লোকটা এসে দেখে যাওয়ার পর।
হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। চুলার ভেতরেও খুঁজেছে। নিচেও। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চারপাশ থেকে মাটি সরিয়েছে, দেখেছ।
কিন্তু খাঁড়িতে তো আর কোন নৌকা দেখলাম না। তবে ছোট একটা সৈকত আছে ওধারে।
চল, ছড়িয়ে পড়ে খোঁজা শুরু করি ওকে, প্রস্তাব দিলেন প্রফেসর। আমি মাঝে থাকছি। তোমরা চারজন চার দিকে যাও। খুব সতর্ক থাকবে। কিছু দেখলে জোরে ডাকবে।
নতুন বা আকর্ষণীয় কোন চিহ্ন দেখলেও জানাবে, কিশোর বলল। কোন গুহা, পাথরের স্তূপ, পাথরে বা পাহাড়ে খোদাই করা কোন নকশা…কি বলছি, বুঝেছ?
নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা দোলাল অন্য তিনজন। রওনা হয়ে গেল একেকজন একেক দিকে। কুয়াশা ঘন হতে আরম্ভ করেছে। এডের চোখে আবছা হয়ে এল মুসার মূতি, দ্বীপের বা ধারে চলে এসেছে সে। অন্য তিনজন কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না এখন কুয়াশার জন্যে।
এড এসেছে পশ্চিমধারে, পাহাড়ের গোড়ায়, দ্বীপের এই ধারটা বেশি উঁচু। বায়ে সাগরের ওপর কুয়াশা খুবই ঘন কুয়াশার একটা মেঘ ভেসে এসে ঘিরে ফেলল তাকে, ফলে মুসাকেও দেখতে পেল না আর। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার, বুক কাঁপছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কান খাড়া। সামনে কিছু দেখা যায় না। অন্ধের মত পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে গেল সে। পাথরের ধস সৃষ্টি করে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঢাল বেয়ে।
ব্যথা লাগতে আঁউক করে উঠল। বাড়ি লেগেছে কোন কিছুতে, পাথরেই হবে। উঠে বসল। এই সময় চোখে পড়ল ওটা।
ভূতুড়ে একটা মূর্তি, ঢালে দাঁড়িয়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কালো মূর্তি, পিঠে কুজ, ছুঁচালো কুৎসিত মুখ, বাঁকা নাক, বড় বড় চোখ।
ভূত! ভূত! চিৎকার করে উঠল এড়। বাঁচাও!
নড়ে উঠল ভূত। লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল যেন এডকে ধরার জন্যে।
১১
দৌড়ে এল সবাই। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে এড। ইতিমধ্যে পাতলা হয়ে গেছে কুয়াশা। রবিন বলল, ভূত দেখলে কোথায়? ওটা তো গাছ।
চোখ মেলল এড। সত্যিই। কুঁজো ভূতটা একটা বাঁকা সাইপ্রেস। ডালগুলো কাণ্ডের দুপাশে এমনভাবে বেঁকে আছে, যেন হাত। তার ওপরে অনেকখানি গায়েব, ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ঝড়। কাণ্ডের ছেড়া, মোচড়ানো অংশটাকে মাথার মত দেখাচ্ছে, তাতে বড় একটা ছিদ্র-কুয়াশার কারণে মনে হয়েছিল, চোখ নড়ছে।
গাছ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এড। আমি ভেবেছি ভূত।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কিশোর, ভূতই ওটা! বুঝতে পারছ না? বাওরাড ডাইয়ের চিহ্ন।
চিহ্ন? মুসা বুঝতে পারল না।
ঠিক বলেছ! কিশোরের মতই চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
রিমলেস গ্লাসের ওপাশে সরু হল প্রফেসরের চোখ। মাই গড, কিশোর, ঠিকই বলেছ তুমি! খোঁজ, খোঁজ সবাই। গাছের চারপাশে কোন জায়গা বাদ দেবে না। গুপ্তধন এখানে থাকতে পারে।
আমি বাঁয়ে দেখছি, এড বলল।
আমি ডানে, বলল রবিন।
কিশোর, তুমি গাছে ওঠ, প্রফেসর বললেন। আমি গোড়ায় দেখছি।
অদ্ভুত গাছটার কাছে এগিয়ে গেল সবাই, একা দাঁড়িয়ে আছে মুসা। একবার ডানে তাকাচ্ছে, একবার বাঁয়ে। তারপর ঘাড় ফেরাল পেছনে। এই, শোন, আস্তে বলল সে।
তার কথা বোধহয় কারও কানে, গেল না।
এই, শুনছ, আবার বলল সে। ওখানে পাওয়া যাবে না।
থমকে গেল কিশোর। কি বললে?
মাথা নাড়ল মুসা। ওই গাছটাকে চিহ্ন বানায়নি বাওরাড।
কি বলছ? ফিরে তাকালেন প্রফেসর। কেন…
ওই যে, হাত তুলে দেখাল মুসা। কিছুটা ডানে ঢালের গায়ে আরেকটা গাছ। ওটাকে তো আরও বড় ভূত মনে হচ্ছে আমার কাছে।
আর ওই যে, পেছনে আরেকটা গাছ দেখাল সে। ওটা ভূতের দাদা।
জোরে বাতাস বইছে। দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। একটা পাথর সরানোর জন্যে ঝুঁকেছিলেন প্রফেসর, গুঙিয়ে উঠে সোজা হলেন। হায় হায়, সবগুলোকেই তো ভূতের মত দেখাচ্ছে!
হ্যাঁ, মুসা ঠিকই বলেছে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল কিশোর। এখানে কিছু পাব না। এগুলো ভূত-গাছ, কোনটাকে চিহ্ন ধরব? এরকম অনেক সাইপ্রেস আছে দ্বীপে। কুয়াশার মধ্যে বিশেষ অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে দেখলে অসংখ্য ভূত দেখা যাবে।
আমরা হেরে গেলাম, বয়েজ, নিরাশায় জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন প্রফেসর।
যদি এই দ্বীপে গুপ্তধন, লুকানো থাকে, আশা ছাড়তে পারছে না, কিশোর। পাওয়ার আশা নেই। কিন্তু…
বাধা পড়ল কথায়। হঠাৎ গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ছোট বড় অনেক পাথর। ঝট করে ওপরে তাকাল সে। কুয়াশাকে ঝেটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, অনেক দূরে দৃষ্টি চলে এখন। চূড়ার কাছে আরেকটা ভূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
আরেকটা সাইপ্রেস, হেসে উঠল এড।
কিন্তু, নিচের ঠোঁটে টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। সাইপ্রেস পাথর ফেলতে পারে না।
গাছ না, গাছ না! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর। মানুষ! এই এই, থাম! থাম!
থামল না লোকটা। হারিয়ে গেল চূড়ার ওপাশে। ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
জলদি এস, ব্যাটাকে ধরতে হবে, বলেই দৌড় দিলেন প্রফেসর।
তার পেছনে ঢাল বেয়ে ছুটল ছেলেরা। চূড়ায় উঠে দেখলেন, দূরে দৌড়ে চলে যাচ্ছে মূর্তিটা, ডানে, খড়ির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতলব।
নিশ্চয় বোট এনেছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন প্রফেসর। ধরতেই হবে।
সরাসরি গেলে পথ কিছুটা কম হয়, সোজা খাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি। তাকে পাশ কাটাল মুসা, পেছনে এড। সবার আগে ঘড়ির কাছে পৌঁছল ওরা দুজন। কিন্তু লোকটাকে দেখা গেল না।
ওই যে, মুসা আর এডের পেছনে উঁচু জায়গায় থেকে বলল কিশোর। বায়ে। বায়ে।
ঘাঁড়ির উত্তরে একটা টিলার ওপাশে হারিয়ে যাচ্ছে মূর্তিটা। ছুটল মুসা আর এড। রবিন গেল। তার পেছনে প্রফেসর। সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে চলেছে কিশোর।
টিলার কাছে আগে পৌঁছল রবিন আর প্রফেসর। তাদের পর পরই মুসা আর এড়। টিলার নিচে ছোট্ট, সরু এক টুকরো সৈকত। সেট ধরে দৌড়ে গিয়ে মোটরবোটে উঠল লোকটা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সরে যেতে শুরু করল বোট। ফিরে তাকাল একবার সে।
সেই লোকটা! রবিন বলল। সবুজ ফোক্সওয়াগেনে করে এসেছিল।
কালো চুল, কালো গোফওয়ালা হালকা-পাতলা লোকটার দিকে চেয়ে আছেন প্রফেসর। চিনি ওকে! ওর নাম নোবল। এই, এই থাম।
কে শোনে কথা। গতি আরও বাড়িয়ে দ্বীপের কাছ থেকে সরে যেতে লাগল -কোর্ট।
শয়তান! গর্জে উঠলেন প্রফেসর। চল, চল, আমার বোটে। আবার খাড়ির কাছে দৌড়ে চলল ওরা।
বোটের বাঁধন খুলে দিল মুসা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফেললেন ততক্ষণে প্রফেসর। খোলা সাগরের দিকে ছুটুল বোট। মোটরবোর্টটা কয়েক শো গৃজ সামনে।
ফুল স্পীড, মুসা! ধর ব্যাটাকে! প্রফেসর তাগাদা দিলেন। মোটরবোটের দিকে চেয়ে মুঠো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ব্যাটা চোর! আসছি, দাঁড়া!
ও কে, স্যার? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
আমার অ্যাসিসটেন্ট ছিল, খুব রেগেছেন প্রফেসর। রুক্সটন ইউনিভারসিটির গ্র্যাজুয়েট। অভাবে পড়ে এসে কাজ চাইল আমার কাছে, কাজ দিলাম। আমার ওখানেই চুরি শুরু করল। মিউজিয়মের দামি দামি জিনিস চুরি করে বিক্রি করে দিতে লাগল। অনেক বোঝালাম, শুনল না। শেষে চোরাই মালসহ ধরা পড়ে গেল জেলে।
অনেক এগিয়ে গেছে মোটরবোট, প্রায় আধ মাইল।
ধরা যাবে না, স্যার, মুসা বলল। ওটার স্পীড অনেক বেশি।
জুলন্ত চোখে ক্রমশ-দূরে-সরে-যাওয়া বোটটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রফেসর। কিশোর, টিক বানাউ কিভাবে এত কথা জানল, এবার বোঝা যাচ্ছে। এখন মনে পড়ছে আমার, লিটল মারমেইড আর বাওরাড ডাইয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল নোবল। নিশ্চয় বানাউয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। জেলে গেলে কি হবে, চোর আর শোধরায় না!
নোবলই মনে হয় কাল রাতে জার্নালের ফটো তুলে এনেছে, রবিন বলল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওটা পড়েই দ্বীপের কথা জেনেছে। তবে পায়নি কিছু। পেলে, ওভাবে পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকত না। নিয়ে চলে যেত।
আমাদের মতই ব্যর্থ।
নীরব হয়ে গেল সবাই। বাকি পথে গুপ্তধন নিয়ে আর একটা কথাও হল না। বন্দরে ভিড়ল, বোট। নোবলের মোটরবোট কিংবা সবুজ ফোক্সওয়াগেনের ছায়াও দেখা গেল না কোথাও।
পুলিশকে রিপোর্ট করব, রাগ যায়নি এখনও প্রফেসরের। কাল রাতে তোমাদের অফিসে ঢুকেছিল, একথাও জানাব।
ওকে তো তখন দেখিনি, স্যার, বলল কিশোর।
কিন্তু ওকে সন্দেহ তো করছ। পুলিশকে অন্তত জানিয়ে রাখা দরকার।
কি একখান দিন গেল! কপাল ডলল মুসা। না পেলাম গুপ্তধন, না পারলাম চোর ধরতে।
আস্তে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। হবে না, বুঝেছ, আশা করতে পারছি না আর। অনেক দেরি হয়ে গেছে…প্রায় একশো বছর, অনেক সময়।
একেবারেই এগোইনি বলা যাবে না,হাল ছাড়তে রাজি নয় কিশোর ধীর হয়ে যাচ্ছে আর কি।
ঠিক, তাড়াতাড়ি বলল এড। ভয়, পাছে না আবার গুপ্তধন খোঁজার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে সবাই। দ্বিতীয় জার্নালটা তো রয়েছেই। আরও ভালমত পড়ে দেখতে হবে।
আমি আর যেতে পারছি না তোমাদের সঙ্গে। চেহারাই বলে দিল মন খারাপ হয়ে গেছে প্রফেসরের। কাজের অনেক ক্ষতি করেছি এমনিতেই। যা করার তোমরাই কর। খবর শোনার জন্যে অধীর হয়ে থাকব আমি।
স্টেশন ওয়াগন চালিয়ে চলে গেলেন প্রফেসর।
তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল এড। সে কিছু বলার আগেই মুসা বলল, কিশোর, তদন্ত চালিয়েই যাব আমরা, না?
আপাতত লাঞ্চটা সেরে নেয়া দরকার, মুখ গোমড়া করে রেখেছে কিশোর। আরও ভাবতে হবে। ফ্যান্টম লেকে গিয়ে ঠিক করব এরপর কি করা যায়।
১২
যার যার বাড়িতে লাঞ্চ সারল ওরা। তারপর স্যালভিজ ইয়ার্ডে মিলিত হল তিন গোয়েন্দা। ট্রাক বের করে অপেক্ষা করছিল কিশোর আর বোরিস, মুসা আর রবিন এলে রওনা হল।
ডাই লজ-এর সিঁড়িতে ওদের অপেক্ষায়ই দাঁড়িয়েছিল এড, ট্রাকটা দেখে দৌড়ে এল। তার মা কোথায় জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বাড়ির পেছনে কাঠ আর পাথরে তৈরি একটা ছাউনিতে ওদেরকে নিয়ে এল এড। লাল রঙ করা কাঠের টবে তখন একটা হিবিসকাসের বড় চারা লাগাচ্ছেন মিসেস ডাই।
ম্যাডাম, কোনরকম ভূমিকা করল না কিশোর। আমরা ভেবেছি, নৌকা বোঝাই করে মাল নিয়ে গেছেন বাওরাড। বাড়িতে গিয়ে জার্নালটা আবার পড়লাম। এখন আমার বিশ্বাস, নেননি, আসলে দ্বীপ থেকে কিছু এনেছেন। ওখান থেকে আনা হয়েছে, এমন কোন জিনিসের কথা জানেন আপনি?
হাসলেন মহিলা। আমি কি করে জানব, কিশোর?
এই জবাবই আশা করেছিল কিশোর। ভাল করে ভেবে দেখুন। ইতিমধ্যে বাওরাডের মেসেজগুলো নিয়ে আরেকবার আলোচনা করে দেখি। পাতলা জার্নালটা খুলল সে। এই যে, একুশে নভেম্বর লেখা রয়েছে…ও হ্যাঁ, একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আমরা। বাওরাড বলেছেন তাঁর দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছেন, পড়ার জন্যে, একটা বা কয়েকটা দিন নয়, সমস্ত দিন পড়ে তারপর মেসেজের মানে উদ্ধার করতে বলেছেন। তাহলে দেখা যাক, আর কোথায় কি রয়েছে। জরুরি পৃষ্ঠাগুলো শুধু পড়ব। একুশে নভেম্বরঃ ড্যানিয়েল ব্রাদার্সরা খবর পাঠিয়েছে, আমার অর্ডার তৈরি। বড় ওয়াগনটা দরকার আমার।…তার পরদিন লিখেছেনঃ অর্ডার নিয়ে রকি বীচ থেকে ফিরে এলাম। চমৎকার কাজ দেখিয়েছে ওরা। প্রতিটি পিস একেবারে মাপমত। এই দেশে এরকম জিনিস বানাতে পারবে কেউ আশা করিনি। মুখ তুলল কিশোর। বাইশে নভেম্বর তেমন কিছু নেই। তেইশে নভেম্বরঃ এলাকায় দুজন নতুন মুখকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। নাবিক … একেবারে আটাশে নভেম্বর গিয়ে আবার জরুরি কথা আছেঃ ওরা চলে গেছে। ক্যাপ্টেনের কাছে রিপোর্ট করতেই গেল বোধহয়।
চোখ রাখা হয়েছে যে তখনই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, বলল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তখনকার তাঁর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পার? ছেলে নেই, বউ নেই, বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একজন মানুষ, শত্রু ঘোরাফেরা করছে…নিশ্চয় তখনই তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করার কথা ভাবেন।
আর কি লিখেছে? এড জিজ্ঞেস করল।
ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে লিখেছেনঃ নোরিয়ার চমকে শেষ ছোঁয়া দিতে সান্তা বারবারায় গেলাম। ভাল জিনিস পেয়েছি, সস্তায়, কারণ প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগেছিল। ওয়ান ম্যানস ট্র্যাজেডি ইজ অফেন অ্যানাদারম্যানস ফরচুন! জার্নাল বন্ধ করল কিশোর। কাল রাতে ড্যানিয়েল ব্রাদার্স-এর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। রকি বীচে ইট সিমেন্টের কারবার করে। নিশ্চয় অনেক ইট কিংবা পাথর কিনেছিলেন বাওরাড। ড্যানিয়েল বিল্ডিং সাপ্লাই কোম্পানি এখনও আছে, নাতিপুতিরা কোম্পানি চালাচ্ছে। গেলে পুরানো রেকর্ড পাওয়াও যেতে পারে।
তাহলে যাচ্ছি না কেন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল এড।
যাব। সান্তা বারবারায়ও যেতে হবে। নোবল জার্নালের ফটো তুলে নিয়ে গেছে, সে-ও যেতে পারে ওসব জায়গায়। জলদি করতে হবে আমাদের। রবিন আর মুসা ড্যানিয়েল কোম্পানিতে চলে যাক। আমি আর তুমি যাব সান্তা বারবারায়, বোরিস ট্রাকে করে নিয়ে যাবে আমাদের। আপনার কোন আপত্তি
আছে, মিসেস ডাই?
না, আমার আপত্তি কি? তবে একটা কাজ করে দিয়ে যাও। এই টবটা বেজায় ভারি, হিবিসকাসের টব দেখালেন মিসেস ডাই। এটা বাইরে বের করে, দিয়ে যাও। নইলে আবার ডিনোকে ডাকতে হবে, আমি একা পারব না।
সিঁড়ির একপাশে নিয়ে গিয়ে টবটা সবে বসিয়েছে ওরা, এই সময় শোনা গেল ইঞ্জিনের শব্দ। দ্রুত আসছে। প্রফেসর কেইনের স্টেশন ওয়াগন।
গাড়ি থেকে নেমে প্রায় ছুটে এলেন প্রফেসর। তোমাদের সাবধান করতে এসেছি, বয়েজ! পুলিশকে জানিয়েছিলাম। খোঁজ নিয়েছেন ইয়ান ফ্লেচার। শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়নি নোবলের, প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ডেঞ্জারাস লোক। কোন ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করবে না সে। বুঝেছ আমার কথা?
কত দিন আগে ছাড়া পেয়েছ? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
ছয় মাস।
ছয় মাস আগে থেকেই ডাই লজে চোর ঢুকতে আরম্ভ করেছে, না? মুসা বলে উঠল।
হ্যাঁ, মুসা, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ভাবছি…। হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল চোখ। নাক কুঁচকে বাতাস শুকছে। এই, গন্ধ পাচ্ছ?
তাই তো! মুসা বলল। ধোঁয়া। পুড়ছে কিছু।
বাড়ির পেছন থেকে! চেঁচিয়ে উঠল এড।
দৌড় দিল সবাই।
দেখল, ছাউনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে পকেটে খুঁজতে শুরু করল কিশোর। পেল না। প্রায় আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল, হায়, হায়! জার্নালটা! টব তোলার সময় হাত থেকে রেখেছিলাম, আর আনতে মনে নেই!
১৩
পাথরের ছাউনি, পুড়বে না, শুধু কাঠগুলো ছাড়া। ভেতরে ঘন ধোঁয়া।
ফায়ার এক্সটিংগুইশারের জন্যে দৌড় দিল এড। জ্যাকেট খুলে তৈরি রইল রবিন আর মুসা। এড ফিরতেই তার সঙ্গে সাবধানে ঢুকল ভেতরে।
আলগা কাঠ রাখা ছিল, বলল এড। ওগুলোতে লেগেছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে কিশোর, প্রফেসর আর মিসেস ডাই শুনছেন এক্সটিংগুইশারের শব্দ। জ্যাকেট দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারা হচ্ছে আগুনের ওপর। কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া পাতলা হয়ে এল। বেরিয়ে এল মুসা, মুখে বিজয়ীর হাসি। হাতে জার্নাল। জানাল, আর সামান্য দেরি হলেই যেত পুড়ে।
হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি পাতাগুলো উল্টে দেখল কিশোর, ঠিক আছে কিনা।
কাকে যেন দৌড়ে আসতে শেৰ্মিা গেল। ডিনো। চেঁচাচ্ছে, আর হাত তুলে দেখাচ্ছে ছাউনির পেছনটা। ওদিকে, ওদিকে…ব্যাটাকে দেখেছি আমি। এদিকেই তাকিয়ে ছিল…এই এক মিনিট আগে।
যাবে, ধরা যাবে! চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর।
চোরের পেছনে ছুটল ওরা। দৌড় দিল গাছপালার ভেতর দিয়ে। ডিনো আগে আগে। নিশ্চয় বড় রাস্তার দিকে গেছে।
বনের ভেতর একেকজন একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ল ওরা। প্রফেসর গেলেন ডানে, ডিনো গেল সামনের দিকে। রবিন আর কিশোর সবার পেছনে। থেমে ঝোপঝাড়ে চোখ বোলাচ্ছে। ধূসর-সবুজ ঘন ওকের আড়ালে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা দেখছে।
হঠাৎ নীরব হয়ে গেছে সব, যেন সবাই দাঁড়িয়ে কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টায় রত। সামনে বিড়বিড় করে গাল দিল একজন। আবার এগোল রবিন আর কিশোর, সতর্ক। গাছের আড়ালে আড়ালে চলে এল পঞ্চাশ গজ মত। মট করে কি যেন ভাঙল।
ঝট করে ঘুরল কিশোর। চিৎকার শোনা গেল ডানে। কে যেন এসে লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। জাপটে ধরে তাকে নিয়ে পড়ল মাটিতে। – ধরেছি! ধরেছি! ব্যাটাকে ধরেছি! চেঁচাতে লাগল মুসা।
আরে এই মুসা, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল রবিন। এই। কিশোরকে ধরেছ তো।
কী? ভাল করে তাকাল মুসা। খাইছে। আমি…. ভেবেছিলাম…শুনলাম…
সর, সর, মুসাকে ঠেলে সরিয়ে উঠল কিশোর। কাপড়ের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, কানা নাকি? দেখে লাফ দাওনি?
শব্দ শুনলাম। আর দেখে কে?
অমনি চোরের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে, হাসতে শুরু করল রবিন।
প্রফেসর, ডিনো আর এড ফিরে এসে দেখল তিনজনেই হাসছে। রিমলেস গ্লাসের ওপাশে রাগে জ্বলছে প্রফেসরের চোখ। গোল লাল মুখ আরও লাল হয়ে উঠেছে।
পালাল হারামজাদা, দাঁতে দাঁত চাপল ডিনো। টিক বানাউ ছাড়া কেউ না।
দেখলে নোবলকে দেখেছেন, প্রফেসর বললেন।
কি করে এত শিওর হচ্ছেন? নোেবলকে নয়, বানাউকেই দেখেছি আমি। দাড়ি দেখলাম মনে হল…।
দাড়ি না। বোধহয় গোঁফ দেখেছেন। কালো গোঁফকে অনেক সময়…
বলে কি? গোঁফকে দাড়ি? আপনার…
মাথা খারাপ, না? রেগে উঠতে গিয়েও উঠলেন না প্রফেসর। ছেলেদেরকে অবাক করে দিয়ে নতি স্বীকার করে নিলেন। বেশ, দেখিনি যখন, জোর করে কিছু বলল না। আপনি সত্যিই লোকটাকে দেখেছেন তো?
নিশ্চয়ই। তবে চেহারাটা দেখিনি।
তাহলে, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। দেরি করা যায় না আর। টিক বানাউ হয়ে থাকলে, বোঝা যাচ্ছে জার্নালটা আর তার দরকার নেই। যা জানার জেনে নিয়েছে। চলুন, চলুন।
বন থেকে বেরিয়ে এল ওরা। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন মিসেস ডাই। বোরিস রয়েছে তাঁর সঙ্গে। হৈ চৈ শুনে ট্রাক ফেলে দেখতে এসেছে কি হয়েছে।
পালিয়েছে শয়তানটা, ডিনো বলল। ইস, আর একটা মিনিট আগে বেরোলেই…, কথা শেষ না করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল সে।
আপনি ঘরে ছিলেন, মিস্টার হ্যাংবার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। ধোঁয়ার গন্ধ পেয়ে বেরিয়েছি।
পুলিশকে জানানো দরকার, বললেন প্রফেসর। কাজ পড়ে আছে ওদিকে। তবু, যাবার সময় থানায় ঢু মেরে যেতে পারব।
তা-ই করবেন, ডিনো বলল। ছেলেদের দিকে তাকাল। তোমাদের ধারণাই ঠিক। আমিই ভুল করেছি। গুপ্তধন হয়ত আছে। জোরে জোরে মাথা নাড়ল সে। না থাকলেও কয়েকটা শয়তান লোক অন্তত বিশ্বাস করে বসেছে যে আছে। তোমরা আর এসবে নাক গলিয়ো না। যা করার পুলিশই করবে। তোমরা করতে গিয়ে বিপদে পড়বে খামোকা।
আমিও তাই বলি, বয়েজ, ডিনোর সঙ্গে একমত হলেন প্রফেসর।
হয়ত…, শুরু করেও বাধা পেয়ে থেমে গেলেন মিসেস ডাই।
কিছুই হবে না, ম্যাডাম, কিশোর বলল। টিক ভাবছে, যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। আমাদের কিছু করতে আসবে না সে। আর দ্বীপ থেকে আমাদের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে নোবল। কিছু করার ইচ্ছে থাকলে তখনই করতে পারত। আমাদের এখন প্রধান কাজ তাড়াতাড়ি গুপ্তধন খুঁজে বের করা। নইলে নিয়ে চলে যাবে ওরা।
আত্মবিশ্বাস থাকা ভাল, খোকা, ডিনো পছন্দ করতে পারছে না কিশোরের কথা। তবে বেশি থাকা ভাল না। বিপদ বাড়ে তাতে।
আমার তা মনে হয় না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর।
আমারও, বললেন মিসেস ডাই। তাছাড়া ওরা কচি খোকা নয়। নিজেদের, ভাল-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে।
প্রফেসর হাসলেন। আমারও তাই বিশ্বাস। ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বুদ্ধি আর সাহসের পরিচয় দিয়েছে ওরা।… আমি এখন যাই। নতুন কিছু জানলে আমাকে জানিও। চলি। গুড বাই।
চলে গেলেন প্রফেসর।
যাও, গিয়ে সময় নষ্ট করে আস সবাই। আমি এসবে নেই। দেখি গিয়ে, আগুনে কি ক্ষতি করল। ছাউনিতে ঢুকল ডিনো।
ট্রাক থেকে সাইকেল নামিয়ে রওনা হয়ে গেল রবিন আর মুসা।
কিশোর আর এড ট্রাকে উঠল। চলল উত্তরে, সান্তা বারবারায়।
১৪
আরও তাড়াতাড়ি, বোরিসভাই, তাগাদা দিল কিশোর।
ভেব না, তাড়াতাড়িই পৌঁছুব। আরও বেশি তাড়াতাড়ি করতে গেলে হয়ত পৌঁছুঁতেই পারব না কোনদিন, অ্যাক্সিডেন্ট করে মরব।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার সিটে হেলান দিল কিশোর।
বাওরাড ডাইয়ের দ্বিতীয় জার্নালটা পড়তে পড়তে মুখ তুলল এড। কিশোর, বাওরাড কোথায় গিয়েছিল, লেখা নেই। কি করে জানছি? সান্তা বারবারা ছোট না।
বোরিস হাসল। হ্যাঁ, বড় শহর।
বড় হওয়াতেই তো ভাল, বলল কিশোর। পুরানো শহর, বেশি পুরানো রেকর্ড থাকবে। একটা সূত্র রেখে গেছেন বাওরাড ডাই, সেটার সাহায্যেই খুঁজে বের করব।
সূত্র? ভুরু কেঁচকাল এড।
একটা দোকান থেকে কিছু কিনেছিল, যেটা আগুনে পুড়ে গেছে। আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে এখনকার মত ছিল না সান্তা বারবারা, অনেক ছোট ছিল। অগ্নিকাণ্ডে দোকান পুড়ে যাওয়ার মত খবর না ছাপার কথা নয়।
বিকেলের মাঝামাঝি সান্তা বারবারার উপকণ্ঠে পৌঁছল ওরা। খবর সংগ্রহের জন্যে দ্য লা গুয়েরা প্রাজায় অবস্থিত সান-প্রেস পত্রিকার অফিসটা খুঁজে বের করল বোরিস, কিশোরের নির্দেশে। দোতলায় উঠে জনৈক মিস্টার বুল-এর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাল রিসিপশনিস্ট। সম্পাদকের নাম বুল বটে, কিন্তু গায়েগতরে ষাঁড়ের মত নন মোটেও। ছোটখাটো একজন মানুষ, হাসিখুশি। আঠারশো ছিয়ানব্বই? কিশোরের চাহিদা শুনে বললেন। না, আমরা তখন ছিলাম না। লোকাল একটা পত্রিকা ছিল অবশ্য। তুমি ঠিকই বলেছ, ইয়াং ম্যান, বড় রকমের একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ওই সময়।
রেকর্ডগুলো, স্যার, আছে আপনাদের মর্গে?
ছিল। যা পেয়েছিলাম সব এনে ফাইল করেছিলাম। কিন্তু নানারকম দুর্ঘটনায়—এই ভূমিকম্পে আর আগুনে-উনিশশোর আগের সব রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেছে।
গুঙিয়ে উঠল কিশোর। সব রেকর্ড, স্যার?
হ্যাঁ, সরি, বলে ভাবলেন এক মুহূর্ত। তবে, আরেক জায়গায় চেষ্টা করে দেখতে পার। একজন লেখককে চিনি, ষাট বছর আগে ওই পত্রিকায় ফিচার লিখত। তার ব্যক্তিগত একটা মর্গ আছে, পুরানো খবরের কাগজ আর কাগজের অনেক কাটিং সংগ্রহে আছে। হবি। তার কাছে গিয়ে দেখতে পার।
সান্তা বারবারায় থাকেন? হাতে যেন চাঁদ পেল কিশোর।
হ্যাঁ। ছোট একটা অ্যাড্রেস ফাইল বের করলেন সম্পাদক। নাম আলফ্রেড পেরিংটন। থাকে এগারশো অ্যানাক্যাপা স্ট্রীটে। যাও, লোক ভাল। পারলে অবশ্যই সাহায্য করবেন।
লম্বা পথের মাথায় ছোট্ট একটা অ্যাড়াব হাউস, ১১০০ নম্বর, বড় একটা বাড়ির পেছনে। ট্রাকে বসে রইল বোরিস। কিশোর আর এড নেমে এগোল বাড়িটার দিকে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর। দড়াম করে দরজা লাগার আওয়াজ, তার পর পরই ছুটন্ত পদশব্দ।
কিশোর, দেখ, দেখ!
হাঁ হয়ে খুলে আছে অ্যাড়াবের দরজা। ভেতর থেকে চিৎকার শোনা গেল। এই! কে আছ? এই!
বিপদে পড়েছে, বলেই দৌড় দিল কিশোর।
চিৎকারটা বোরিসেরও কানে গেছে। লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নেমে দৌড়ে এল।
খোলা দরজা দিয়ে ছোট একটা লিভিংরুমে ঢুকল ওরা। বই আর ফ্রেমে বাঁধাই খবরের কাগজের সামনের পাতা সুন্দর করে সাজানো।
এই, কে? বায়ের ঘর থেকে এল চিৎকার।
ঢুকে দেখা গেল, ওটা স্টাডি। গাদা গাদা পুরানো খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। ডেস্কের ওপর একটা টাইপরাইটার। পাশের বাক্সে রাখা টাইপ করা কিছু পাতা। বই লেখা চলছে বোধহয়।
মেঝেতে পড়ে আছেন এক বৃদ্ধ। মুখের কাটা থেকে রক্ত পড়ছে। ছেলেদের দিকে তাকালেন।
মাই গড! বলে তাড়াতাড়ি গিয়ে বৃদ্ধকে তুলল বোরিস। একটা ইজি-চেয়ারে শুইয়ে দিল।
এক গেলাস পানি এনে দিল এড। ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ফেললেন বৃদ্ধ। দাড়িওয়ালা এক লোক! মৃদু হাঁপাচ্ছেন তিনি। গালে কাটা দাগ, নাবিকের জ্যাকেট… তা, তোমরা কে?
টিক বানাউ! চিৎকার করে উঠল এড়।
পরিচয় দিয়ে কিশোর বলল, মিস্টার বুল পাঠিয়েছেন, স্যার। সানপ্রেসের সম্পাদক। আপনিই তো মিস্টার আলফ্রেড পেরিংটন?
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালেন বৃদ্ধ। টিক বানাউ? সে-ই হামলা করেছিল?
চেহারার বর্ণনায় তো তাই মনে হয়। কি চেয়েছিল আপনার কাছে?
লম্বা দম নিলেন পেরিংটন। তাঁর কাটা মুছে দিয়ে বোরিস জানাল, ক্ষত সামান্য।
জোর করে ঢুকে পড়ল, বৃদ্ধ বললেন। আঠারশো ছিয়ানব্বইর নভেম্বরে একটা অগ্নিকাণ্ডের কথা জানতে চাইল।
গুপ্তধন খুঁজছে ব্যাটা, রেগে গিয়ে বলল এড। লিটল মারমেইডের গুপ্তধন।
আছে নাকি?
কিছু জানেন মনে হচ্ছে?
মাথা ঝাঁকালেন পেরিংটন। অনেক গবেষণা করেছি ওটার ব্যাপারে। ওই সময়কার প্রচুর কাটিং আছে আমার মর্গে।
বানাউকে বলে দিয়েছেন, স্যার? শঙ্কিত হয়ে উঠেছে কিশোর।
কিচ্ছু বলিনি। লোকটাকে দেখেই বুঝেছি, খারাপ। বলিনি বলেই তো মারল, তারপর গিয়ে ফাইল ঘাটতে লাগল। পেয়ে গেছে মনে হয়। নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কাটিং।
কাঁধ ঝুলে পড়ল কিশোরের। নিয়ে গেছে! কি লেখা ছিল? জরুরি কিছু?
জানি না। তবে চেষ্টা করলে হয়ত বলতে পারব।
করবেন, স্যার? এড মিনতি করল, করুন না, স্যার, প্লীজ।
আমার সমস্ত ফাইল মাইক্রোফিল্ম করে রেখেছি। দেখি, ওই বাক্সটা আন তো।
ডেক্সের ওপর থেকে লম্বা, সরু একটা বাক্স এনে দিল এড। ভেতর থেকে মাইক্রোফিল্মের একটা ছোট বাক্স বের করলেন লেখক। এই যে, আঠারশো ছিয়ানব্বই। নাও, ওই রিডিং মেশিনে লাগাও।
ভিউয়ারে চোখ রেখে পড়তে আরম্ভ করল কিশোর। ছিয়ানব্বইর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু। এই যে! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল গোয়েন্দাপ্রধান। নভেম্বর, পনের। ডাইক অ্যাণ্ড সনস, শিপ শ্যাওলারস। আগুনে ওদের স্টোর হাউস পুড়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় এটাই।
শিপ শ্যাণ্ডলার কি? জিজ্ঞেস করল এড।
জাহাজের খাবার আর দরকারি জিনিসপত্র সরবরাহ করে যারা।
ডাইক অ্যাণ্ড সনস? পেরিংটন বললেন। এখনও ব্যবসা করে ওরা। বন্দরে গিয়ে খোঁজ করলেই অফিস পেয়ে যাবে।
জলদি চল তাহলে, কিশোরকে বলল এড।
আগে ডাক্তার ডাকা দরকার, বোরিস বলল।
মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। না না, লাগবে না, আমি ভালই আছি। ডাক্তার ডেকে নিতে পারব। তোমরা গিয়ে দাড়িওয়ালা লোকটাকে ধর। ওকে ধরতে পারলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব। যাও, জলদি যাও।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল কিশোর। তারপর মিস্টার পেরিংটনের দিকে চেয়ে হেসে, মাথা নেড়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।
সহজেই খুঁজে পেল ওরা, ডাইক অ্যাণ্ড সনসের অফিস। বন্দরের একটা সরু গলিতে, পানির ধারেই। স্বাগত জানালেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, এস এস, কি চাই?
আঠারশো ছিয়ানব্বই সালের রেকর্ড আছে আপনাদের? জানার জন্যে তর। সইছে না এডের। ব্যবসার খতিয়ান? জার্নাল, কিংবা ডায়েরী?
কিশোর বলল, আমার…।
ওই দাড়িওয়ালা শয়তানটার অ্যাসিসটেন্ট নাকি? নিমেষে হাসি হাসি মুখটা কঠোর হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। যেতে পার।
না, না, স্যার, হাত নাড়ল কিশোর। পরিচয় দিল। সংক্ষেপে জানাল কি জন্যে এসেছে।
বাওরাড ডাই? আফসোেস করে বললেন ভদ্রলোক, পুরানো রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেছে ভূমিকম্পে। দাড়িওলাকেও একথাই বলেছি।
দমে গেল কিশোর। রেকর্ড নেই! তাহলে বাওরাড ডাই কি কিনেছিলেন, কোনদিনই জানা যাবে না?
না… আচ্ছা, দাঁড়াও তো দেখি…।
প্রাইভেট লেখা একটা দরজা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দ্রলোক।
অস্থির ভাবে অপেক্ষা করছে ছেলেরা। হঠাৎ হাত তুলল এড, কিশোর?
তাড়াতাড়ি জানালার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর, এডের পাশে। কী?
স্টোরের ওপর চোখ রাখছে মনে হয়?
কোথায়?
ওই যে, রাস্তার শেষ মাথায়। আরি, চলে গেল, একটা বিল্ডিঙের আড়ালে। আমরা যে দেখেছি বোধহয় বুঝে ফেলেছে। টিক বানাউ না তো?
ফিরে তাকাল কিশোর। ভদ্রলোক এখনও ফেরেননি। জাহাজের একটা পুরানো ঘড়ি দেখছে মন দিয়ে বোরিস। ইশারায় এডকে আসতে বলে দরজার দিকে পা বাড়াল কিশোর।
জাহাজ ঘাটের দিকে এগিয়ে চলল দুজনে। বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে থাকছে যতটা সম্ভব। একটা বাড়ির কোণে এসে থমকে গেল এড। কিশোর। সবুজ ফোক্সওয়াগেন।
চওড়া রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ছোট গাড়িটা। তার ওপাশে, গোঁফওয়ালা এক তরুণ তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে যাচ্ছে একটা কাঠের বার্জের দিকে।
টিক বানাউ নয়, ফিসফিস করে বলল কিশোর। নোবল।
পানির কিনারে ভেজা বালি। বার্জের অর্ধেকটা বালিতে বসে গেছে, বাকি অর্ধেক পানিতে। অচল। ওটার অন্যপাশে হারিয়ে গেল তরুণ।
কারও সাথে দেখা করতে গেছে, অনুমান করল কিশোর।
টিক বানাউ?
চল, দেখি।
রাস্তা পেরিয়ে, সাবধানে বার্জের দিকে এগোল ওরা। কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কান পাতল, ওপাশে কি কথা হয় শোনার জন্যে। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না।
বেশি দূরে, এড বলল। চল ঘুরে গিয়ে দেখি।
না। দেখে ফেলবে। তারচে উপরে উঠি।
বার্জের এক পাশে একটা মই লাগানো। কাত হয়ে আছে ঝর্জটা, ফলে মই বেয়ে উঠতে অসুবিধে হয়। অনেক কায়দা কসরত করে শেষ পর্যন্ত উঠল ওরা। পা টিপে টিপে এগোল ডেকের ওপর দিয়ে। অন্য ধারে যাওয়া আর হল না, তার আগেই মড়মড় করে ভাঙল প্লচা তক্তা।
হুঁক! করে উঠল কিশোর। ভেজা, নরম কিছুর ওপর পড়েছে।
পুরানো বস্তা। বস্তার ওপর পড়েছি।
মাথার ওপরে গোল ফোকর-হ্যাচের ঢাকনা ভেঙে পড়েছে ওরা, আবছা আলো আসছে সেখান দিয়ে। বার্জের খোলে পড়েছে। ভেজা, ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। খোলের পাশেও এক জায়গায় তক্তায় ফাটল, হালকা আলো আসছে ওপথেও। মাথার ওপরের ফোকরটা বারো ফুট ওপরে।
কোন কিছুর ওপর দাঁড়াতে পারলে ধরা যেত, কিশোর বলল।
পিচ্ছিল খোলে হেঁটে বেড়াল ওরা। উঠে দাঁড়ানোর মত কিছুই চোখে পড়ল। বস্তা ছাড়া আর কিছু নেই। বাক্স, তক্তা, দড়ি, মই, কিছু না। অন্ধকার কোণে খচমচ করে নড়ছে কি যেন।
ইঁদুর, এড বলল। কিশোর, এখান থেকে বেরোনোর কোন রাস্তা নেই।
দেখি আরেকবার খুঁজে। এমাথা থেকে ওমাথা, কোথাও বাদ দেব না
পেছনের শেষ প্রান্তে এসে ছপ করে পানিতে পা দিয়ে ফেলল কিশোর। অল্প পানি জমে রয়েছে। ঢোক গিলল সে। এড, গলা কাপছে। জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে যায় এটা।
দ্রুত আবার ফোকরটার নিচে ফিরে এল ওরা।
চেঁচাই?.এড বলল।
এই সময় ফোকর দিয়ে উঁকি দিল একটা মুখ। তরুণ। কালো গোঁফ। চেঁচিয়ে লাভ হবে না, হেসে বলল সে। শীতকালে এদিকে বড় একটা আসে না কেউ। তাছাড়া রাস্তা এখান থেকে অনেক দূরে, গাড়িঘোড়ার গোলমাল। গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও কেউ শুনবে না। আবার-হাসল লোকটা। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক, এস, কথা বলি।
১৫
কিশোররা যখন সান্তা বারবারায় পৌঁছেছে, প্রায় একই সময় মুসা আর রবিনও পৌঁছুল ড্যানিয়েল ব্রাদার্সদের অফিসের সামনে। একটা ট্রাকে ইট তুলছে বাদামী চামড়ার এক লোক। ছেলেরা জানাল, কি জন্যে এসেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল সে। হাসল। বিখ্যাত ড্যানিয়েল ব্রাদার্স? একজন ছিল আমার দাদার বাবা, আরেকজন চাচা। আমি ডিলিয়ানো ড্যানিয়েল। পাথরের কাজই বেশি করি আমরা। দামি জিনিস, লাভও বেশি।
আপনার বাপ-দাদাদের কথা তো তাহলে ভালই বলতে পারবেন, হেসে বলল রবিন।
নিশ্চয়। কি জানতে চাও?
আঠারশো ছিয়ানব্বই সালের বাইশে নভেম্বর, এক ওয়াগন বোঝাই মাল কিনেছিলেন স্কটল্যাণ্ডের বাওরাড ডাই। কি কিনে ছিলেন জানতে চাই।
আঠারশা ছিয়ানব্বই? চোখ কপালে তুলল ডিলিয়ানো। মানে একশো বছর আগে?
চার বছর কম,মুসা বলল।
আপনি কোন সাহায্য করতে পারবেন না, না? বলল রবিন।
একশো বছর! আবার বলল ডিলিয়ানো। নেচে উঠল কালো চোখের তারা। হাসল। পারব না কেন? পারব। এ শহরে আমাদের চেয়ে ভাল রেকর্ড কে রাখে? এস।
ছেলেদেরকে অফিসে নিয়ে এল ডিলিয়ানো। কাঠের ক্যাবিনিট খুলে পুরানো একটা ফোল্ডার বের করল, হলদে হয়ে গেছে পাতাগুলো। ধুলো ঝেড়ে ফাইল বের করে পাতা ওল্টাল কয়েকটা। হেসে মুখ তুলে তাকাল ছেলেদের দিকে। পেয়েছি। বাইশে নভেম্বর বললে না? বাওরাড ডাই। এই যে। বাওরাড ডাই, ফ্যান্টম লেক। স্পেশাল অর্ডার দিয়েছেঃ এক টন পাথর। নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে গেছে।
এক টন? মুসা জানতে চাইল, কি পাথর?
কি পাথর, লেখা নেই। শুধু এক টন লিখেছে, আর লিখেছে, স্পেশাল অর্ডার। তবে দাম দেখে বোঝা যায় সাধারণ পাথর নয়।
স্পেশাল অর্ডার বলতে তখন কি বোঝাত? রবিন জিজ্ঞেস করল।
সাধারণ পাথর নয়, এটুক বলতে পারি, চোয়াল ডলল ডিলিয়ানো। হতে পারে স্পেশাল অর্ডারে কেটে, সাইজ করে সাপ্লাই দেয়া হত। ঘষে-মেজে পালিশ করেও পাথর সাপ্লাই দিই আমরা। আচ্ছা, নিয়ে গিয়ে সাইডওয়াক বানায়নি তো?
সাইডওয়াক?
তখনকার দিনে বড় চ্যাপ্টা পাথর দিয়েই সাইডওয়াক বানানো হত।
কি জানি, রবিন বলল। ওরকম কিছু বানিয়েছে কিনা জানি না।
পাথর দিয়ে বাড়িও বানানো হত অনেক। দেয়াল, ভিত, ফ্ল্যাগস্টোনস…কোন জায়গায় বড় পাথর, কোন জায়গায় ছোট পাথর–সাইজ জানতে চাও?
হ্যাঁ, জানলে খুব ভাল হয়।
পাহাড়ে আমাদের পুরানো আড়ত থেকে আনা হত তখন পাথর। এখন আর ওখানে তেমন নেই, ফলে লোকজনও রাখা হয় না বেশি, শুধু একজন কেয়ারটেকার আছে। একটা অফিস আছে ওখানে। পুরানো রেকর্ড থাকার কথা।
যাওয়া যাবে? আগ্রহ উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করল রবিন।
যাবে। ফ্যান্টম লেক থেকে বড়জোর দুমাইল। কিভাবে কোথায় যেতে হবে বলে দিল ডিলিয়ানো।
আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না, সাফ মানা করে দিল এড। আপনি কে খুব ভাল করেই জানি।
সতর্ক হয়ে উঠল লোকটা। কি জান?
জানি, আপনি একটা চোর। সোসাইটিতে চুরি করে জেলে গেছেন, কড়া গলায় বলল কিশোর। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে আবার শুরু করেছেন শয়তানি।
পুলিশকে জানানো হয়েছে আপনার কথা, যোগ করল এড।
ঝট করে মাথা তুলে চারপাশে তাকাল নোবল, বোধহয় পুলিশ আছে কিনা দেখল। তাকাল আবার ছেলেদের দিকে। প্রফেসরের বাচ্চা তাহলে বলে দিয়েছে তোমাদেরকে। ওটার সঙ্গে মিশলে কিভাবে?
মিশেছি, যেভাবেই হোক, কিশোর বলল। সেটা আপনাকে বলতে যাব কেন? হ্যাঁ, ভাল কথা, দ্বিতীয় জার্নালটা পোড়েনি, যেটার ছবি তুলে নিয়েছিলেন।
দ্বিধা করল নোবল। ওই স্টোরে গিয়ে কি কি জানলে?
কি করে ভাবলেন, আপনাকে বলব? ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল এড।
গিয়ে আপনার দোস্ত টিক বানাউকে জিজ্ঞেস করছেন না কেন? কিশোর, বলল।
টিক বানাউ? ওর সম্পর্কে আবার কি জান?
জানি, দুজনেই গুপ্তধনের পিছে লেগেছেন, বলল এড। কিন্তু নিতে পারবেন, মনে রাখবেন একথা। চালাকিতে আমাদের সঙ্গে…।
চালাকি? তারমানে এখনও জান না ওগুলো কোথায় আছে? প্রফেসরও না? টিক বানাউ জানে?
কেন, সব কথা বলেনি নাকি আপনার দোস্ত? হাসল কিশোর। বন্ধুকেও ঠকানোর চেষ্টা?।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল নোবল। চারজ। দেখেছি। তোমাদের অন্য দুই বন্ধু কোথায়?
জানার খুব ইচ্ছে বুঝি?ব্যঙ্গ করল এড। বলব না, কিশোর বলল।
তারমানে জরুরি কোন কাজে গেছে। নিশ্চয় ড্যানিয়েলদের স্টোন ইয়ার্ডে, তাই না?
জবাব দিল না কিশোর।
তাহলে ঠিকই বলেছি, আবার বলল নোবল। শক করে হাসল একবার। তারপর উঠে চলে গেল।
কপালই খারাপ আমাদের, দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। তক্তার এমন জায়গায় পা দিয়েছি, একেবারে ধপাস। সাবধান থাকলেই পড়তাম না।
কিশোর! আতঙ্ক চাপতে পারল না এড। জোয়ার! জোয়ার আসছে!
শেষ বিকেলে ফ্যান্টম লেকের ডাই লজে ফিরে এল মুসা আর রবিন। সাড়া পেয়ে, বেরিয়ে এলেন মিসেস ডাই। এড আর কিশোর ফেরেনি, জানালেন। ওরা জানাল, ড্যনিয়েলদের ইয়ার্ড থেকে কি জেনে এসেছে।
এক টন স্পেশাল পাথর? আনমনে বললেন মিসেস ডাই। ঈশ্বর, কেন? এই বাড়ি তৈরির জন্যে নিশ্চয়?
না, ম্যাডাম,মুসা বলল। তখন এই বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে।
পাথর দিয়ে আর কিছু বানানো হয়েছে, জানেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।
ভাবলেন মিসেস ডাই। মাথা নেড়ে বললেন, না। আর কিছু না।
কিন্তু কিছু একটা নিশ্চয় বানানো হয়েছে, মুসা বলল। এমন কিছু…
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। ওরা ভাবল ট্রাকটা, কিন্তু না। মিসেস ডাইয়ের পুরানো ফোর্ড। কাছে এসে থামল। ডিনো নামল, হাতে ছোট একটা জেনারেটর। দূর, কেউ ঠিকমত কাজ করে না এখানে, খুব বিরক্ত সে। ক মিনিটের কাজ?। অযথা এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখল, ছাউনিতে আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছিল যন্ত্রটা, মেরামত করিয়ে এনেছে, সেকথা জানাল ছেলেদের।
ডিনো, মিসেস ডাই বললেন। বাড়ি আর ছাউনি ছাড়া পাথর দিয়ে আর কি তৈরি হয়েছে এখানে, জান? এক টন পাথর।
পাথর? ভ্রূকুটি করল ডিনো। এক টন?
ড্যানিয়েলের কাছে কি কি জেনে এসেছে, আরেকবার বলল রবিন আর মুসা।
কি জানি, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আড়তে গেলে জানা যাবে বলছ?
হয়ত, রবিন বলল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সাইকেল নিয়ে যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে।
চল, আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে এমনিতেও যেতাম, কাজ আছে। পথে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে যাব। ফেরার সময় সাইকেল নিয়ে ফিরবে।
ফোর্ডের বুটে সাইকেল তুলল রবিন। মুসা ঠেলেঠুলে পেছনে, সিটের ওপর রাখল। সামনে, ডিনোর পাশে উঠে বসল দুজনে।
পুরানো আড়তের কাছে যখন পৌঁছল ওরা, তখন আলো রয়েছে। দুই গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ডিনো।
আড়ত মানে বিশাল এক গর্ত, কিংবা ছোটখাটো এক পুকুর বলা চলে—এক পাড় থেকে আরেক পাড়ের দৈর্ঘ্য দুশ ফুট। তলায় পানি জমে আছে। সর্বত্র মাথা তুলে রেখেছে পাথর, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় লাল। প্রায় পুরো পাহাড়ের গা থেকেই ওখানে পাথর কেটে নেয়া হয়েছে, কোথাও সিঁড়ির মত ধাপ ধাপ হয়ে আছে, কোথাও ছড়ানো চত্বর। ওরকম একটা চত্বরের ওপর দেখা গেল একটা জীর্ণ মলিন ছাউনি, পাহাড়ের কাঁধের ওপর। ছাউনির বাইরে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে আলো জ্বলছে।
কেয়ারটেকার আছে,মুসা বলল।
ছাউনির দিকে রওনা হল ওরা। খানিকটা যেতেই ভেতরের আলো নিভে গেল। বেরিয়ে এসে ট্রাকে উঠল একজন লোক।
চিৎকার করে ডাকল। ওরা, এই যে, স্যার…এই যে…।
বেশ দূরে ট্রাকটা, ইঞ্জিনও চালু করে দেয়া হয়েছে, ফলে ওদের ডাক লোকটার কানে পৌঁছল বলে মনে হল না। দৌড় দিল ওরা। কিন্তু ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে ট্রাক।
পাহাড়ী পথ ধরে ট্রাকটা চলে যাওয়ার পর ছাউনির সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। দরজায় তালা দেয়া।
দূর, আরেকটু আগে এলেই হত, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল মুসা।
ছাউনিটা ঘুরে দেখল রবিন। চারটে জানালা, খড়খড়ি লাগানো। বাইরে থেকে ভারি বোর্ড খাঁজে বসিয়ে, তার ওপর বার লাগিয়ে তালা দেয়ার ব্যবস্থা। ভেতরে ঢুকতে পারলে রেকর্ডগুলো দেখা যেত, বলল সে।
রবিন, মুসা ডাকল। এটা ভোলা। ঢোকা যাবে।
হুঁ। যাক, কপাল ভালই আমাদের।
জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। পুরানো কাঠের ফাইল, আসবাবপত্র। একটা কেবিনেটে লেবেল লাগানো দেখল মুসাঃ ১৮৭০-১৯০০। ওটা খুলে ভেতর থেকে ১৮৯ঙুলেখা ফাইলটা বের করল। এনে রাখল ডেস্কে।
পড়ার জন্যে ঝুঁকল রবিন।
বাইরে হালকা পায়ের শব্দ হল।
পাঁই করে ঘুরল রবিন। কে?
বন্ধ হয়ে গেল খড়খড়ি। খুঁজে বসিয়ে দেয়া হল বোর্ডটা। বার লাগানোর শব্দ শোনা গেল পরিষ্কার। তারপর দ্রুত সরে গেল পায়ের আওয়াজ।
বন্দি হল দুই গোয়েন্দা।
১৬
ফোকর দিয়ে তেরছা হয়ে রোদ এসে পড়েছে খোলে। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে চিৎকার করে ক্ষান্ত দিয়েছে কিশোর আর এড, লাভ হয়নি। ভেজা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে এখন গলুইয়ের দিকটায়। মাঝে মাঝে শঙ্কিত চোখে তাকাচ্ছে বাড়ন্ত জোয়ারেরঞ্জলের দিকে। একটু একটু করে উঠে আসছে ওদের কাছে।
আর কতক্ষণ লাগবে, কিশোর? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল এড।
ঘন্টা দুই। তবে ততক্ষণ থাকতে হবে না আমাদের। কেউ না কেউ এসে যাবেই।
কে আসবে? ডাকই তো কেউ শুনল না আমাদের।
আসবে। বোরিস। আমাদের না দেখলেই খোঁজা শুরু করবে।
কিন্তু আমরা এখানে আছি কি করে জানবে? কল্পনাই করবে না বার্জের মধ্যে ঢুকে বসে আছি।
আবার চেঁচাব। কেউ না কেউ শুনবেই।
হ্যাঁ, আর শুনেছে!
কিন্তু আর চেঁচানোর দরকার হল না। ডেকের ওপর ভারি জুতোর শব্দ।
কিশোর, ডাকব নাকি?
শ্শ্শ্! ঠোঁটে আঙুল রাখল কিশোর। শত্রু না মিত্র জানি না। আসুক আগে।
প্রায় দম বন্ধ করে কান পেতে রইল ওরা। সাবধানে ভাঙা হ্যাচের দিকে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। থেমে গেল। দীর্ঘ নীরবতার পর ডাক শোনা গেল, কিশোর? এইই কিশোর? এজ?
বোরিস!
বোরিসভাই! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল কিশোর। আমরা এখানে।
তাড়াতাড়ি ফোকরের নিচে চলে এল দুজনে।
ওখান থেকে বের করুন আমাদের, এড বলল। জলদি। পানি ভরে যাচ্ছে।
দাঁড়াও। আসছি।
ডেকের ওপর দিয়ে আবার কিনারে চলে গেল পদশব্দ। কাঠ ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল। খানিক পরেই ফিরে এল বোরিস, বার্জের কিনারে লাগানো মইটা খুলে নিয়ে এসেছে। ফোকর দিয়ে খোলে নামিয়ে দিল ওটা।
ডেকে বেরিয়ে এল দুজনে।
কত জায়গায় যে খুঁজলাম তোমাদের, বোরিস বলল। আমাকে না জানিয়ে এলে কেন?
কিশোর জিজ্ঞেস করল, আমাদের খুঁজে পেলেন কি করে?
রাস্তায় দেখলাম, আইসক্রীমের দোকানে দেখলাম, কোথাও পেলাম না। শ্যাগুলারের দোকানে ফিরে যাচ্ছি, এই সময় একটা ছেলে বলল বার্জে উঠতে দেখেছে তোমাদের। চলে এলাম।
একটা ছেলে দেখেছে আমাদের? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
সে আমাদের সাহায্য করল না কেন তাহলে? এউ বলল।
হ্যাঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ছেলেটা কোথায় এখন?
চলে গেছে। আমাকে বাৰ্জটা দেখিয়ে দিয়েই দৌড়ে চলে গেল। ওহহো, ভুলেই গেছি, মিস্টার ডাইক তাঁর বাবার সঙ্গেও কথা বলেছেন। বুড়ো থুরথুরে, এখনও বেঁচে আছেন দ্রলোক। বাওরাড ডাই কি কিনেছিল, তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। তবে একটা সূত্র দিয়েছেন।
কী? আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বললেন, তখন যত জিনিস বিক্রি করত ডাইক কোম্পানি, পিতলের প্লেটে নিজেদের নাম খোদাই করে লাগিয়ে দিত জিনিসের ওপর।
কিশোর, এড বলল। চল, বাড়ি গিয়ে খোঁজা শুরু করি।
হ্যাঁ, জলদি করা দরকার, জরুরি কণ্ঠে বলল কিশোর। ভুলেই গেছিলাম, রবিন আর মুসা কোথায় গেছে জানে নোবল! বিপদে পড়বে ওরা!
লজের ঘরে ঘরে ক্রিস্টমাস লাইট জ্বলছে। ড্রাইভওয়েতে ট্রাক রাখল বোরিস। এক লাফে নেমে বাড়ির দিকে দৌড় দিল কিশোর আর এড। পিছে পিছে এল বোরিস। অনেক দেরি হয়ে গেছে, রাশেদ পাশাকে ফোন করে জানাবে ওরা ভাল আছে।
লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ডাই। ফায়ারপ্লেসে গনগন করে জ্বলছে। আগুন।
মাআ! আমাদের বাড়িতে এমন কিছু আছে, যার ওপরে পেতলের প্লেটে লেখা ডাইক অ্যাণ্ড সনস? সান্তা বারবারায় যা যা জেনে এসেছে সব মাকে জানাল এড।
ও, বাওরাড কি কিনেছেন জানতে পারনি তাহলে? ভূরু ডললেন মিসেস ডাই। পেতলের প্লেট? পুরানো অনেক জিনিসেই তো ওরকম প্লেট লাগানো আছে। তখন ওটাই চল ছিল। কিন্তু কোনটাতে ডাইক কোম্পানির নাম আছে বলে তো মনে পড়ছে না।
ভাল করে ভেবে দেখ, মা।
রবিনরা ফেরেনি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
ফিরেছিল। আমাকে বলেছে, ড্যানিয়েলদের ওখান থেকে এক টন পাথর – কিনেছিলেন বাওরাড। কি পাথর, কি সাইজ, দেখতে কেমন, বলতে পারেনি। তাই ডিনোর সঙ্গে ড্যানিয়েলদের পুরানো আড়তে গেছে, ওখানকার অফিসে, রেকর্ড দেখতে। কিন্তু গেছে তো অনেকক্ষণ…।
এখনও ফেরেনি? এ্যাণ্ডফাদার ক্লকটার দিকে তাকাল কিশোর। প্রায় সাতটা বাজে।
না। ডিনোও তো ফিরল না…।
বিচিত্র একটা শব্দ হল। বাড়ির পেছনে দূরে কোথাও। ফোন শেষ করে সবে ঢুকছিল বোরিস, শুনে সে-ও থমকে গেল।
তখন থেকেই শুনছি, মিসেস ডাই বললেন। এক ঘন্টা ধরে, মাঝে মাঝেই। কিসের শব্দ?
দেয়াল ভাঙছে মনে হয় কেউ, বোরিস বলল। দেয়াল?
আমাদের কাছাকাছি তো কেউ থাকে না। তবে ওদিকে…
ওদিকে কি? এড বলল। ওদিকে তো কোন দেয়াল নেই।
দেখনি হয়ত। ওদিকে একটা স্মোকহাউস আছে। বহুদিন ব্যবহার হয় না, তোমার বাবা যখন ছোট, তখন থেকেই। বলতে ভুলে গেছি…।
স্মোকহাউস? কিশোর বলল। পাথরের স্মোকহাউস?
হতে পারে। আমিও ভালমত দেখিনি। দূর থেকে দেখেছিলাম, লতা, গাছগাছড়ায় ঢেকে ফেলেছে।
বোরিসভাই, ট্রাক থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে আসুন, কুইক।
বৈদ্যুতিক লণ্ঠনটা নিয়ে এল বোরিস। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মিসেস ডাই। পথ আর নেই এখন, জঙ্গল আর আগাছার রাজত্ব। কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে।
আধমাইল মত গিয়ে একটা কাঠের কুঁড়ে দেখা গেল। ওটার পাশ দিয়ে চলতে চলতে মিসেস ডাই বললেন, বাওরাডের আমলে মজুরদের ঘর ছিল এটা।
স্মোকহাউসটাও কি বাওরাডই বানিয়েছিলেন? কিশোর জানতে চাইল।
জানি না, অন্ধকারে একদিকে হাত তুলে দেখালেন মিসেস ডাই। ওখানেই কোথাও আছে।
বাড়ি মারার শব্দ থেমে গেছে। রাস্তা থেকে ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা। ভাঙা ডাল, দোমড়ানো পাতা, ছেড়া তা বুঝিয়ে দিচ্ছে এখান দিয়ে গিয়েছে কেউ। শোকহাউসটা দেখা গেল। হাউস মানে ধসে পড়া পাথরের স্তূপ।
ভেঙে ফেলেছে। বলে উঠলেন মিসেস ডাই।
গুপ্তধন খুঁজেছে! উত্তেজনায় কাঁপছে এড।
নিশ্চয় নোবলের কাজ, কিশোর বলল। টিক বানাউও হয়ত ছিল সঙ্গে। সান্তা বারবারা থেকে ফিরে এসে এই কাজ করেছে। কিন্তু স্মোকহাউসের কথা কি করে জানল…?
বড় একটা হাতুড়ি কুড়িয়ে নিল বোরিস। হাতলটা এখনও গরম।
কান পেতে রইল ওরা। কোন শব্দ শোনা গেল না। লণ্ঠনের আলোয় স্মোকহাউসের পাথরগুলো দেখছে কিশোর।
নিরেট পাথর, আনমনে বিড়বিড় করল সে। ফাপা-টাপা নেই যে ভেতরে কিছু থাকবে। সবখানে মাকড়সা :কিছু টেনে নেয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
আলগা পাথর পা দিয়ে সরিয়ে দেখছে এড। কিশোর, লেখা!
লণ্ঠনটা কাছে নিয়ে এল বোরিস। পাথরের ওপর থেকে বালি মুছতেই স্পষ্ট হল লেখাটাঃ হুঁ, ডাই। ১৯০৫।
আমার দাদা-শ্বশুর, মিসেস ডাই বললেন। তাঁর নাম ছিল এডওয়ার্ড ডাই।
তারমানে বাওরাড বানাননি এই স্মোকহাউস, হাসল কিশোর। আপনার দাদা-শ্বশুর বানিয়েছিলেন। এখানে গুপ্তধন থাকার কথা না। চলেন, যাই।
লজে ফিরে ইয়ার্ডের ট্রাকের পাশে প্রফেসরের স্টেশন ওয়াগনটা দেখা গেল। গায়ে হালকা সুট, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছেন। ইস, সাংঘাতিক শীত পড়েছে ক্যালিফোরনিয়ায়। হাসলেন। খবর কি জানতে এলাম।
গরম লিভিংরুমে আগুন আর ক্রিস্টমাস ট্রী-র সামনে বসে, সান্তা বারবারায় কি কি করে এসেছে প্রফেসরকে জানাল কিশোর।
পিতলের প্লেট? টিক আর নোবেল দুজনেই গিয়েছিল? হুমম, মাথা দোলালেন প্রফেসর। তা, পিতলের প্লেটটা পাওয়া গেছে?
না, স্যার, এড বলল। আসলে খুঁজিইনি এখনও।
মুসা আর রবিনের আসার অপেক্ষায় আছি, বলল কিশোর। কোথায়, কি জন্যে গেছে ওরা, সেকথাও জানাল প্রফেসরকে। ঘড়ির দিকে চেয়ে অস্বস্তি বাড়ল তার। ডিনো নিয়ে গেছে, না?…ওই যে, এল বোধহয়।
ফোর্ডটাই এসেছে, ইঞ্জিনের শব্দেই বোঝা গেল। হাত ডলতে ডলতে ঘরে ঢুকল ডিনো। একা।
ওরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ডাই।
ফেরেনি এখনও? তাহলে নিশ্চয় আড়তে, যেখানে নামিয়ে দিয়েছি। এডের দিকে তাকাল ডিনো। সান্তা বারবারা থেকে কি রত্ন জোগাড় করে আনলে?
সংক্ষেপে বলল এড। শেষে বলল, প্লেটটা এখনও খুঁজতে পারিনি। নানা রকম ঝামেলা…রবিন আর মুসা আসছে না। ওদিকে মোকহাউসটা ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলেছে কে জানি।
স্মোকহাউস? ও, হ্যাঁ…, ঘড়ি দেখল ডিনো। ছেলেগুলো এল না কেন এখনও? এতক্ষণ তো লাগার কথা না।
পাথরের শোকহাউস? প্রফেসর বললেন। কি করে জানল…?
প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই জবাব দিল এড, রবিন আর মুসার সঙ্গে কথা বলেছে হয়ত।
কিংবা ড্যানিয়েলদের সঙ্গে নোবেলও দেখা করেছে, বলল কিশোর। নাহ, বেশি দেরি করছে। আড়তটার কথা নোবলও জেনে গেল না তো? সহজেঁই একজন পিছু নিতে পারে ওদের।
তা-ই করেছে। লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে রওনা হয়ে গেলেন প্রফেসর। নিশ্চয় বিপদে পড়েছে ওরা। জলদি এল।
১৭
আড়তে কোথাও বাতি দেখা গেল না। শুধু তারার আলোয় আবছা মত চকচক করছে পাথরগুলো। গর্তের নিচে কালো অন্ধকার।
সাইকেল দুটো ডিনো আগে দেখল। এখানেই রেখে গিয়েছিলাম ওদের। ওরা এখানেই কোথাও আছে। নইলে সাইকেল থাকত না।
টর্চের আলোয় পাহাড়ের কাটা ধাপগুলোকে মনে হল যেন কোন দানবের সিঁড়ি। গর্তের পানিতে প্রতিফলিত হল আলো। কালো ময়লা পানির দিকে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, পিছলে পড়েনি তো? কণ্ঠ কেঁপে উঠল তার। তাহলে…।
থাক থাক, আর বলবেন না, ভয় পেয়েছে এড।
সিঁড়িগুলো ভালমত দেখছে কিশোর, চকের চিহ্ন খুঁজছে। কার্ডে চিহ্ন না থাকলেও তিন গোয়েন্দার নতুন চিহ্ন নির্ধারিত হয়েছে তারকা। পাওয়া গেল না।
টর্চ আর লণ্ঠন নিয়ে আশেপাশে অনেক জায়গায় খোঁজা হল। কোন চিহ্ন নেই, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে দুই গোয়েন্দা। শুধু পাথরের সিঁড়ি, গর্তের পুরানো দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে জন্মে থাকা প্রায় বিকলাঙ্গ উদ্ভিদ, আর অসংখ্য পাথর—ছোট-বড়-মাঝারি, নানা রকমের, নানা আকারের।
অন্ধকারে হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জীব। দুটো সাপ দেখল ওরা, এক পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আরেক পাথরের তলায় গিয়ে লুকাল। কয়োট ডাকল দূরে। নিশাচর বড় পাখি ডানায় ভারি শব্দ তুলে উড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে গাছে। খাবারের সন্ধানে ছায়ার মত নিঃশব্দে মাথার ওপর চক্কর মারছে দুর্দান্ত শিকারী হুতোয় পেঁচা।
রবিন আর মুসার কোন সাড়াশব্দ নেই।
আড়তের প্রায় পুরো সীমানাটাই ঘুরে এসেছে ওরা, এই সময় শোনা গেল আওয়াজ।
শুনছ! ফিসফিসিয়ে বলল বোরিস।
কাছেই হচ্ছে শব্দটা, ধাতব।
দেখা যায় কিছু? এড জিজ্ঞেস করল।
না, বললেন প্রফেসর।
আবার হল শব্দ, কাঠের সঙ্গে কাঠের ঘষা, তারপর কাঠের সঙ্গে ধাতব কিছুর।
ওই যে! নিচু কণ্ঠে বলল কিশোর। একটা ছাউনি না? মনে হয় ওখান থেকেই আসছে।
ছাউনিতে শব্দ হচ্ছে। খটখট ঝনঝন করে উঠল কি যেন, ছুট দিল কেউ। টর্চ জ্বালল ডিনো। পাতলা একটা মূর্তিকে ছুটে যেতে দেখা গেল ছাউনির কাছে পার্ক করা ছোট একটা গাড়ির দিকে।
নোবল! চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। ধর, ধর ব্যাটাকে!
আরে, পালিয়ে যাচ্ছে তো, ধর না, গর্জে উঠল ডিনো।
এই নোবল, দাঁড়াও। থাম! প্রফেসর বললেন।
থামল না সে। পৌঁছে গেছে সবুজ ফোক্সওয়াগেনের কাছে। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। ওটার কাছে কেউ যাওয়ার আগেই শাঁ করে বেরিয়ে গেল কাঁচা রাস্তা ধরে।
আবার পালাল! তিক্তকণ্ঠে বললেন প্রফেসর। শয়তান কোথাকার! নোবলের ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই কিশোরের। রবিন আর মুসা কোথায়? ওদের কি করল সে?
ঢোক গিলল এড। নীরব হয়ে রইল অন্যেরা। অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে কিশোর। গলা চড়িয়ে ডাকল, রবিইন! মুসাআ!
পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল তার ডাক। কেঁপে কেঁপে সেই শব্দের রেশ মিলানোর আগেই এল জবাব, কিশোওর! আমরা এখানে-এ-এ!
ক্ষণিকের জন্যে স্থির হয়ে গেল সবাই।
আবার শোনা গেল একই কথা, কিশোর। আমরা এখানে এ-এ!
আরে দেখ, প্রফেসর বললেন। ছাউনিতে আলো।
হঠাৎ জ্বলেছে আলোটা। দরজা আর একটা জানালার আবছা কাঠামো চোখে পড়ছে। দৌড় দিল কিশোর। পেছনে অন্যেরা। দরজার কাছে এসে তালা ধরে ঝাঁকি দিল। ভেতর থেকে মুসা বলল, ডানপাশে চলে যাও। একটা জানালায় তালা নেই দেখবে।
জানালার কাছে ছুটে গেল ডিনো। বার খুলে, বোর্ড সরাল। খড়খড়ি তুলে উঁকি দিল দুই গোয়েন্দা।
খাইছে! হাসিমুখে বলল মুসা। ভেবেছিলাম আজ রাতে বেরোতে পারব।
লোকের সাড়া পেয়ে আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম, রবিন বলল। ভেবেছি, শত্রু। শত্রুই। দরজার তালা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করেছে, পারেনি। শেষে এই জানালাটা খুঁজে বের করেছে। বার খোলার আগেই বোধহয় তোমরা এসে গেলে।
নোবল শয়তানটা এসেছিল, তপ্তকণ্ঠে বললেন প্রফেসর।
ও নিশ্চয় আটকায়নি তোমাদের, ডিনো বলল। কতদূর কি হয়েছে দেখতে এসেছিল বোধহয়, আমাদের দেখে পালিয়েছে।
যাকগে। বেরিয়ে এস, বোরিস বলল।
মাথা নাড়ল রবিন। আপনারা ভেতরে আসুন। একটা সূত্র পাওয়া গেছে।
উত্তেজিত হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল এড। তারপর কিশোর। একে একে অন্যেরাও ঢুকল। বিশাল শরীর নিয়ে ছোট জানালা দিয়ে ঢুকতে বেশ অসুবিধে হল বোরিসের।
ডেস্কের ওপর রাখা ফাইলটা দেখাল রবিন।
স্পেশাল অর্ডার নম্বর একশো তেতাল্লিশ, জোরে জোরে পড়ল কিশোর। বি. ডাইয়ের জন্যে লাগবে : দশটা স্কয়ার-কাট মনুমেন্ট স্টোনস। এ্যানিটের। দেখতে একই রকম হওয়া চাই সবগুলো। মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। মনুমেন্ট স্টোনস?
এত বড় পাথর দিয়ে কি করেছিল বাওরাড ডাই? মুসা বলল। স্মৃতিসৌধ বানিয়েছে?
নীরবে মাথা নাড়ল শুধু কিশোর, কি বোঝাতে চাইল বোঝা গেল না।
ফ্যান্টম লেকে কোন স্মৃতিসৌধ নেই, ডিনো বলল।
কাছাকাছি অন্য কোথাও আছে? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
কোন শহরে গিয়ে বানায়নি তো? এড বলল।
না, ধীরে ধীরে বলল কিশোর। আমি শিওর, নোরিয়ার চমক ফ্যান্টম লেকেই অপেক্ষা করছে। জার্নালের লেখার আর কোন মানে হতে পারে না।
নোরিয়ার চমক বানানোর জন্যে প্রতিবারেই বাড়ি ফিরে এসেছেন বাওরাড।
কিন্তু সেটা লুকাল কিভাবে? প্রফেসর বললেন। এমনই বুদ্ধি করে লুকিয়েছে, এত বছরেও কারও চোখে পড়ল না।
তাকালেই হয়ত দেখি, রবিন বলল। সেজন্যেই চোখে পড়ে না। চোখের সামনে যে জিনিস থাকে, সেটাই সহজে চোখে পড়ে না।
চোখে পড়ার দরকার নেই, হঠাৎ বলে উঠল মুসা। জাহান্নামে যাক গুপ্তধন। আগে খাওয়া দরকার। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
হেসে উঠল সবাই। ছিন্ন হল টান টান উত্তেজনা, হালকা হয়ে গেল পরিবেশ।
চল, আমাদের ওখানেই খাবে, আমন্ত্রণ জানাল এড। ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দিয়ো।
উত্তম প্রস্তাব, হেসে বললেন প্রফেসর। আমার মত বুড়োকে খাওয়াতেও নিশ্চয় মুখ কালো করবেন না মিসেস ডাই।
১৮
খাওয়ার পর কথা বলার জন্যে সবাই এসে বসল লিভিংরুমে।
টিক আর নোবল একসঙ্গে কাজ করছে, প্রফেসর বললেন। এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার।
প্রমাণ করতে পারব না, স্যার চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। যাক, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে, ধাধা রহস্যের সমাধান হয় কিনা দেখি। বোঝাই যাচ্ছে, নোরিয়ার জন্যে একটা ধাঁধা তৈরি করেছিলেন বাওরাড, চেয়েছিলেন, স্ত্রী সেটার সমাধান করুক।
একশো বছর আগে চেষ্টা করলে হয়ত করা যেত, ডিনো বলল। কিন্তু এখন সেটা অসম্ভব।
গরম হয়ে এড বলল, গুপ্তধন বেরোক, এটা তুমি চাও না নাকি, চাচা?
গাল ফুলিয়ে বলল ডিনো, বেশ, কর বের। আমি আর কোন কথা বলব না।
বাওরাড ডাইয়ের চিঠিটা কোলের ওপর বিছিয়ে পাতলা জার্নালটা খুলল কিশোর। কাছে সরে এল রবিন, মুসা আর এড।
পাউডার গালচ থেকেই শুরু করা যাক, কিশোর বলল। নূস টিম্বার আর শ্রমিকের জন্যে পাউডার গালচে গিয়েছিলেন বাওরাড। খাবার কিনেছিলেন অনেক। তাতে মনে হয়, বেশ বড়সড় কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন।
তারপর গিয়েছিলেন ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ডে। কোন একটা প্রস্তাব দেন দ্বীপের মালিককে, তাতে রাজি হয় সে। তারপর নৌকায় মাল বোঝাই করে ফিরে আসেন। দ্বীপ থেকে কোন জিনিস আনেন এখানে।
তার পর, ড্যানিয়েল ব্রাদার্সদের কাছ থেকে কেনেন দশটা বর্গাকৃতি মনুমেন্ট স্টোনস।
আর সব শেষে, সান্তা বারবারার ডাইক কোম্পানির কাছ থেকে এনেছিলেন কোন জিনিস। এমন কিছু, যা জাহাজে দরকার হত। কারণ, একমাত্র জাহাজের মালই সরবরাহ করে ডাইক কোম্পানি। জিনিসটা, বা জিনিসগুলোর ওপর পিতলের প্লেট লাগানো, তাতে কোম্পানির নাম খোদাই করা।
হেসে উঠল ডিনো। কথা বলবে না বলেছে বটে, কিন্তু কিশোর থামতেই প্রতিজ্ঞা ভুলে বলে উঠল, গবেষণা তো ভালই করেছ। এসব দিয়ে এখন কি ভূত ধরবে?
তার কথার জবাব দিল না কেউ। কড়া চোখে একবার ডিনোর দিকে তাকিয়ে কিশোরের দিকে ফিরলেন মিসেস ডাই। তোমরা যাওয়ার পর সারা বাড়ি খুঁজেছি আমি। পিতলের কোন প্লেটে ডাইক কোম্পানির নাম দেখলাম না। জিনিসটা কি?
আমিও জানি না, কিশোর বলল।
বড় কিছু নিশ্চয়, এড বলল।
নূস টিম্বার আর শ্রমিক দিয়ে কি করল বাওরাড? প্রফেসরের প্রশ্ন। কোথায় গেল এত কাঠ?।
আর পাথরগুলোই বা কোথায়? রবিনেরও প্রশ্ন। দশটা পাথর ছোট জিনিস না যে সহজে লুকিয়ে ফেলবে।
এইই! কি মনে হতে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। খনির শ্রমিকেরা সব চেয়ে ভাল কি পারে? কিশোর, তুমিই বল, সহজ ব্যাখ্যাগুলোর ওপর জোর দিতে। ওরা সব চেয়ে ভাল পারে মাটি খুঁড়তে। বড় গর্ত খুঁড়ে, পাথরগুলোর ভার রাখার জন্যে টিম্বার ব্যবহার করেছে হয়ত ওরা। হয়ত মাটির তলার কোন ঘরে।
পায়চারি করছিলেন প্রফেসর, মুসার কথায় থেমে গেলেন। গর্ত? মাটির তলার ঘরে?
কেন নয়? জোর দিয়ে বলল মুসা। মাটির তলার ঘরই গুপ্তধন লুকানোর আসল জায়গা। হয়ত ডাইক কোম্পানি থেকে জাহাজের লণ্ঠন কিনে এনেছিল বাওরাড ডাই। অন্ধকার ঘরে কাজ করেছে তো, বেশি আলোর প্রয়োজন ছিল।
তাহলে ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ড থেকে কি এনেছিলেন? ভুরু নাচাল কিশোর। তাছাড়া, মাটির তলার ঘরে রাখলে নোরিয়ার জন্যে চমক হবে না, নতুন কোন ব্যবস্থা নয় ওটা। আগে আরও অনেকেই মাটির তলার ঘরে গুপ্তধন লুকিয়েছে। নোরিয়ার চমকের ওপরই বেশি জোর দিয়েছেন বাওরাড, তারপর গুপ্তধন।
আবার পায়চারি শুরু করলেন প্রফেসর। চলে গেলেন জানালার কাছে, ডিনো যেখানে বসেছে। এ-বাড়িতে ওরকম কোন ঘরের কথা জানেন, মিস্টার হ্যাংবার?
না, কাটা জবাব। যত্তোসব।
জানালা দিয়ে পুকুরটার দিকে তাকালেন প্রফেসর, আর কালো গাছগুলোর দিকে। ঘুরলেন হঠাৎ, চোখ উজ্জ্বল। মুসা, ঠিক বলেছ তুমি! স্কটল্যাণ্ডে পাহাড়পর্বতও যেমন আছে, গুহারও অভাব নেই। মিসেস ডাই, চিঠিতে বলা হয়েছে, বাওরাড বাড়িতে কি ভালবাসত মনে করে দেখার জন্যে। যদি
…ছেলেবেলায় গুহার ভেতর খেলার কথা বলে থাকে? প্রফেসরের কথাটা যেন মুখ থেকে কেড়ে নিল কিশোর। সেল নোরিয়ার জানার কথা!
এখানেও হয়ত তেমন একটা গুহা বানিয়েছে, প্রফেসর বললেন। ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ড থেকে নিয়ে এসেছে পুরানো স্প্যানিশ আসবাবপত্র আর গালিচা, গুহায় সাজানোর জন্যে।
আর সেই সঙ্গে একটা আয়নাও! যোগ করল রবিন।
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল প্রফেসর। আমার মনে হয়, এইটাই জবাব,তুড়ি বাজালেন তিনি। কায়দা করে বানিয়েছে গুহা, যাতে গুহামুখটা চোখ এড়িয়ে যায়। আর এড়াতে দেব না। কাল সকালে উঠেই আগে গুহাটা খুঁজে বের করব।
এখনই নয় কেন? মুসা বলল। বাতি তো আছেই।
মাথা নাড়লেন প্রফেসর। যা অন্ধকার, বাতি দিয়ে বের করা যাবে না। তাছাড়া সবাই এখন ক্লান্ত। দিনের ভাল হবে।
হ্যাঁ, মিসেস ডাই বললেন। গুপ্তধন তো পালাচ্ছে না। তাড়াহুড়োর দরকার নেই।
কিন্তু নোবল আর টিক পেছনে লেগে রয়েছে, এড প্রতিবাদ করল। কখন কি করে ফেলে।
রাতে ওরাও কিছু পাবে না, প্রফেসর বললেন।
ছেলেরাও বুঝতে পারছে সেকথা। কিন্তু এত লম্বা একটা রাত অপেক্ষা করা খুব কঠিন, উত্তেজনায় ঘুমই হবে না ওদের।
তাহলে ওই কথাই রইল, তিনি বললেন। কাল সকালে সবাই মিলে খুঁজতে যাব আমরা।
সবারই মধ্যে আমি নেই, দুহাত নাড়ল ডিনো৷ যত্তোসব পাগলামি।
প্রফেসর চলে গেলেন।
তিন গোয়েন্দা আর বোরিস ফিরে চলল রকি বীচে।
ট্রাকের পেছনে উঠেছে ছেলেরা। কিছুক্ষণ চলল নীরব যাত্রা। তারপর কিশোর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, বল তো, গুহার নির্দেশক কি দিয়ে দিতে পারে?
বড় পাথর, মুসা বলল।
কিংবা গাছ, বলল রবিন। ডাইদের স্কটল্যাণ্ডের বাড়িতে আছে, তেমন দেখতে কোন গাছ।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। আয়না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাথরে লাগানো থাকতে পারে, গাছে ঝোলানো থাকতে পারে। কোন বিশেষ জায়গায় দাঁড়ালে হয়ত নোরিয়ার চোখে পড়ত।
বাড়ির জানালায় থেকে নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর। নাকি লজের টাওয়ারের মাথায় দাঁড়িয়ে?
জবাব মিলল না। – রকি বীচে ঢুকল ট্রাক।
একটা কথা মেলাতে পারছি না, আনমনে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। লকের গোপন রহস্যের কথা ভাবতে বলেছেন বাওরাড। গোপন রহস্য মানে সেই ভূত, যে লকে শত্রু ঢোকে কিনা নজর রাখে। এর সঙ্গে গুহার মিল পাচ্ছি না। গুহাটা পেলেই হয়ত মানে বোেঝা যাবে, আশা করল মুসা।
হয়ত।
রবিন আর মুসাকে যার যার বাড়িতে দিয়ে এল বোরিস। তারপর ঢুকল স্যালভিজ ইয়ার্ডে।
এত বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে কিশোর, ঘুম নেই চোখে। শেষে হলঘরে চাচা-চাচীর কাছে এসে বসল। গরম চকলেট খেতে খেতে জানাল, সারাদিন কি কি করেছে, কোথায় কোথায় গেছে। চাচা কোন মন্তব্য করলেন না। চাচী বললেন, হ্যাঁ, গুপ্তধনের সঙ্গে গুহার মিলই বেশি।
বিছানায় শুয়েও ঘুম এল না তার। উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল ক্রিস্টমাসের আলো।
ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে গেল কিশোর। তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। চোখ মিটমিট করল কয়েকবার। জানালায় আলো নেই, বাইরে অন্ধকার। কিন্তু ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে, সকাল আটটা। সকাল হয়েছে ঠিকই, বৃষ্টির জন্যে আলো ফুটতে পারছে না ঠিকমত। খুব জোরেসোরে নেমেছে।
কিন্তু বৃষ্টির কথা ভাবছে না কিশোর।
বিছানায় বসেই তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। ধাধার রহস্য ভেদ করে ফেলেছে সে।
১৯
কাপড় পরে মুসা আর রবিনকে ফোন করল কিশোর। পনের মিনিটের মধ্যে ইয়ার্ডে পৌঁছতে বলল। আমি একটা গাধা! বিড়বিড় করল সে। আস্ত গর্দভ! অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। এডকে ফোন করল। সে ধরতেই বলল, এড? গুপ্তধন কোথায়, জানি। গাইতি, বেলচা আর রেনকোট নিয়ে তৈরি থাক। আমরা আসছি।
নিচে নেমে তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নিল। দুধের গেলাসে সবে মুখ লাগিয়েছে, এই সময় বাজল টেলিফোন। প্রফেসর কেইন।
কিশোর? গুহাটার কথা অনেক ভাবলাম। কি করে চেনা…।
গুহা-টুহা নেই, স্যার। জবাব এখন আমার জানা।
কী? এত জোরে চিৎকার করে উঠলেন -প্রফেসর, কান থেকে রিসিভার সরাতে হল কিশোরকে। গুহা নেই? তাহলে কোথায়, কিশোর? জলদি বল।
ফ্যান্টম লেকে চলে আসুন। আমরাও যাচ্ছি। ওখানেই বলব।
দশ মিনিট পরেই এসে হাজির হল রবিন আর মুসা। আগেই ট্রাক বের করে রেখেছে বোরিস। সামনের সিটে গাদাগাদি করে বসল চারজন।
বল, কিশোর, রবিন বলল।
হ্যাঁ, বল, প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন।
মুচকি হাসল কিশোর। ঘুমিয়ে ছিলাম। রবিনের একটা কথা ভাবছিলাম ঘুমানোর আগে। সকাল বেলা হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল সব।
কি বলেছিল রবিন?
বলেছিল, কোন বিশেষ গাছ লাগিয়েছে বাওরাড। হ্যাঁ, তা-ই করছে।
গাছ? বুঝতে পারছে না মুসা।
গাছ। যেটা দেখে বাড়ির কথা নোরিয়ার মনে পড়বে ভেবেছিল বাওরাড। ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ড নিয়ে এসেছিল ওটা, বাঁকামেরা ভূতের মত দেখতে এক সাহপ্রেস। ভূতুড়ে হ্রদে ভূত এনে লাগিয়েছিল।
তারমানে, ফ্যান্টম লেকে গিয়ে এখন পুরানো ভূতটাকে খুঁজে বের করলেই হল? রবিন বলল।
কিন্তু কোথায় খুঁজব? মুসা বলল। গাছ কি একটা দুটো? ফ্যান্টম লেকে গাছের জঙ্গল।
ভাব ভালমত, মাথা খাটাও, হাসল কিশোর। খনি-শ্রমিক, সুস, টিম্বার, পাউডার গালচ। তুমিই তো বললে, ওরা সবচেয়ে ভাল পারে মাটি খুঁড়তে। গর্ত। আর মূস টিম্বারের ব্যাপারে একটা অতি জরুরি তথ্য উপেক্ষা করে গেছি আমরা। কেন ওই জিনিস আনতে গেল বাওরাড? কেন সাধারণ তক্তা নয়, বা মাইনিং টিম্বার নয়?
কেন, বল?
কারণ, স্লূস টিম্বার বিশেষ ভাবে কাটা হয়, পানি ধরে রাখার জন্যে। চতুর বাওরাড করেছে উল্টোটা। পানি ঠেকিয়ে রাখার জন্যে ব্যবহার করেছে।
কোথায়? উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছে রবিন।
বিরাট গর্তটায়, শ্রমিকরা যেটা খুঁড়েছে। খোঁড়ার সময় পানি ওঠে, সেটা ঠেকানোর জন্যেই ব্যবহার হয়েছে মূস টিম্বার। পাথরগুলোকে ধাপে ধাপে সাজিয়ে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুসা, তোমার কথাই ঠিক। ডাইক কোম্পানি থেকে লণ্ঠনই কেনা হয়েছে।
দ্বীপটা! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল রবিন আর মুসা।
হ্যাঁ। এটাই নোরিয়ার চমক। সবাই ভেবেছে, দ্বীপওয়ালা পুকুরটা দেখেই বাওরাড জায়গা পছন্দ করেছে, বাড়ি করেছে, স্কটল্যাণ্ডের বাড়ির মত দেখায় বলে। আসলে তা নয়। দ্বীপটা বানানো হয়েছে, স্কটল্যাণ্ডে যেটা আছে সেটার নকল।
নিশ্চয় ছোট একটা উপদ্বীপ মত ছিল প্রথমে, পুকুরে নেমে এসেছিল ওটা। সেটা কেটে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করার সময়ই ব্যবহার হয়েছে ক্ষুস টিম্বার, কাটা জায়গায় পাথরগুলো ফেলে আবার ছেড়ে দেয়া হয়েছে পানি। দ্বীপে একটা দণ্ডের মাথায় লণ্ঠনটা লাগিয়ে দিয়েছে বাওরাড। সাইপ্রেসটা পুঁতেছে স্কটল্যাণ্ডের ভূতের গুজব মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে, অবশ্যই নোরিয়াকে।
বাড়িতে যা ভালবাসত বাওরাড, সেটারই একটা খুদে সংস্করণ তৈরি করেছে ফ্যান্টম লেকে। ওটাই নোরিয়ার জন্যে চমক। একটানা এতগুলো কথা বলে দম নেয়ার জন্যে থামল কিশোর। তারপর, লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেন আর দোসররা যখন উদয় হল, দ্বীপটাতে গুপ্তধন লুকিয়ে ফেলল সে। সূত্র হিসেবে রেখে গেল চিঠি, আর দ্বিতীয় জার্নালটা।
বাওরাডের ধাধা, আর কিশোরের সমাধান ক্ষমতা স্তব্ধ করে দিয়েছে দুই সহকারীকে। কে বেশি চালাক? বাওরাড, না কিশোর পাশা, ভেবে ঠিক করতে পারছে না ওরা।
দ্বীপটা প্রাকৃতিক নয় কেউ বুঝতে পারেনি? অবশেষে বলল রবিন।
না। খনির শ্রমিকেরা ছিল ভাসমান, আজ এখানে কাল ওখানে। যেখানেই কাজ পেত, চলে যেত, অনেকটা যাযাবর। আমার স্থির বিশ্বাস, ওদের কাছ থেকে কেউ কোন সাহায্য পায়নি-যারা পরে গুপ্তধন খুঁজেছে। হয়ত কোন শ্রমিকেরই দেখা পায়নি তারা। বাওরাডের বংশধরেরাও ভেবেছে দ্বীপটা প্রাকৃতিক, ফলে নজর দেয়নি ওটার দিকে। শ্রমিকদের কথা ভাবতে পারেনি, কারণ, দ্বিতীয় জার্নালটাই হাতে পড়েনি কারও।
আমরা পেয়েছি! বুকে চাপড় মারল মুসা। এবার গুপ্তধনও খুঁজে বের করব।
হ্যাঁ, করব, ঘোষণা করল কিশোর।
একটা কথা এখনও বুঝতে পারছি না, কিশোর, রবিন বলল। আয়নার মধ্যে দেখ বলে কি বোঝানো হয়েছে? …
পুকুরটাকে আয়না বোঝানো হয়নি তো? বলল মুসা। পানিতেও তো প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
ওখানে গেলেই বুঝতে পারব, কিশোর বলল। পুকুর, না…।
হঠাৎ ব্রেক কষল বোরিস। পেছনে বুকে গেল ছেলেদের মাথা। আলোচনায় এতই মগ্ন ছিল, পথের দিকে চোখ ছিল না কারও। এখন দেখল। দেখেই পাশের দরজা খুলে হুড়াহুড়ি শুরু করে দিল বেরোনোর জন্যে। বোরিস ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে।
পথের আর একটা মোড় ঘুরলেই ডাই লজ। মোড়ের ওপাশে না গেলে বাড়িটা দেখা যায় না। ওখানে, পাহাড়ের পাথুরে কাধে একগুচ্ছ পাইন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রফেসরের স্টেশন ওয়াগন। ড্রাইভারের পাশের দরজা খোলা, সিটে বসে আছেন প্রফেসর। তার গায়ের ওপর প্রায় ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে এড।
কি হয়েছে, প্রফেসর? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল বোরিস।
নাহ, তেমন কিছু না, চোয়ালে হাত বোলালেন প্রফেসর। ছেলেদের দিকে তাকালেন। টিক বানাউ। কয়েক মিনিট আগে এসেছি, দেখি, রাস্তার ওর দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। কিছুই শুনল না, ঘুসি মেতে আমাকে ফেলে দিয়ে বনে ঢুকে পড়ল।
টিক বানাউ? কিশোর বলল। তাহলে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে। আর! এড, চল। কুইক।
২০
বৃষ্টির মধ্যেই ওদেরকে পুকুরটার দিকে যেতে দেখলেন মিসেস ডাই। প্রফেসরের কাঁধে গাঁইতি, বেলচা। ডেকে বললেন, এড, সাবধানে থাকিস, বেশি ভিজিস না।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ছেলেরা। দ্রুত ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এসে দাঁড়াল পুকুরের পাড়ে। পানিতে পড়ে থাকা মসৃণ পাথরগুলো মৃদু চকচক করছে, এগুলো দিয়েই সিঁড়ি বানিয়েছে বাওরাড। এক সারিতে পাথরগুলোর ওপর দিয়ে। এগিয়ে চলল দলটা, দ্বীপে উঠল। পাইন গাছে ছাওয়া খুদে দ্বীপ। চওড়ায় বড়জোর শখানেক ফুট হবে। তার মধ্যেই দুটো ছোট পাহাড়, তিরিশ ফুট, আর চল্লিশ ফুট উঁচু।
গুজব রয়েছে, কিশোর বলল। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে লেকের ওপর চোখ রাখে ভূত। কাজেই দ্বীপের ওই ওদিকটায় গাছ খুঁজতে হবে। যেহেতু পাহাড়ের ওপর দাঁড়ায় ভূত, সেহেতু ভূতের মত দেখতে গাছটাও রয়েছে কোন উঁচু জায়গায়।
ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে ওদের হ্যাট, কোর্ট থেকে, গলা বেয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে পানি। দ্বীপের একেবারে প্রান্তে যে পাহাড়টা, ওটার ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। বীকনটা রয়েছে চূড়ায়, দণ্ডের মাথায় ঝুলছে লণ্ঠন।
লণ্ঠনটা পরীক্ষা করল মুসা। চেঁচিয়ে উঠল, এই তো, আছে। পিতলের প্লেট, ডাইক কোম্পানির নাম খোদাই করা।
গাছটা খোঁজ, কিশোর বলল।
খোঁজার প্রায় দরকারই পড়ল না, তাকাতেই চোখে পড়ল। হাত তুললেন প্রফেসর। ওই তো।
বীকন থেকে পনের ফুট দূরে। বাঁকাচোরা সাইপ্রেস, ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ডে যে-রকম দেখে এসেছে ওরা, সে-রকম। বৃষ্টির মধ্যে সত্যিই যেন একটা ভূত, কিংবা বলা উচিত ভূতুড়ে মানুষ–কিত মাথা, শুকনো লম্বা একটা হাত তুলে। রেখেছে। সাগর থেকে এসে চ্যানেলে ঢুলে পড়া ভাইকিংদের দেখাচ্ছে যেন।
দেখ, দ্বীপের যে অংশটা মূল ভূখণ্ড থেকে কেটে খাল বানানো হয়েছে সেদিকে দেখাল মুসা। পাড়ে কত বড় বড় গাছ। এজন্যেই বাড়ি থেকে সাইপ্রেসটা দেখা যায় না।
এখন যায় না, কিশোর বলল। তবে বাওরাড যখন লাগিয়েছিলেন তখন পুকুর পাড়ে গাছ এত বড় ছিল না। ছিল কিনা, তাতেও সন্দেহ আছে। তখন নিশ্চয় দেখা যেত। তবে সাইপ্রেস বাড়ে খুবই কম। একেবারে বামন-গাছ বলা চলে এগুলোকে। এক ফুট লম্বা হতেই একশো বছর লাগে।
হয়েছে, হাত নাড়ল মুসা। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে আগ্রহ নেই আমার। কোন জায়গা থেকে খুঁড়ব? সাইপ্রেসটার চারপাশে ঘুরল রবিন। খোঁড়ার চিহ্ন নেই, কিশোর। টিক বানাউ আসেনি।
চল, মুসা, বোরিসের কাঁধ থেকে গাইতি নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল এড গাছের গোড়ার চারপাশে…।
বাধা দিল কিশোর, না এখানে নয়।
সবগুলো চোখ একযোগে ঘুরে গেল তার দিকে।
কিন্তু চিঠিতে বলা হয়েছেঃ ভাব লকের গোপন রহস্যের কথা, প্রফেসর বললেন। তারমানে ভূত ভূতটার কাছেই দেখতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে তো আয়নার মধ্যেও দেখতে বলা হয়েছে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। ভূতটাকে আয়নার মধ্যে দেখতেই বলা হয়েছে, আমার বিশ্বাস।
কিন্তু এখানে আয়না কই! চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা।
নেই। আয়না বলে আসলে আয়নার মত বোঝাতে চেয়েছে। আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখা যায়। ওই প্রতিবিম্বকে ব্যবহার করেই হয়ত গুপ্তধন বের করতে বলেছে। গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। ভূত নির্দেশ করছে পুকুরের দিকে। দেখা যাক, পুকুরে ভূতের প্রতিবিম্ব, বা ছায়া দেখা যায় কিনা।
সাইপ্রেসের কাছে দাঁড়িয়ে, ওটার নির্দেশিত দিকে তাকাল ছেলেরা।
যা বৃষ্টি, রবিন বলল। কিছুই তো দেখি না।
দেখি, এড, তোমার টর্চটা, হাত বাড়াল কিশোর।
সাইপ্রেসের লম্বা বাহুটায় আড়াআড়ি ভাবে টর্চটা ধরল সে, সুইচ টিপল। বৃষ্টির চদর খুঁড়ে যেন বেরিয়ে গেল উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। পড়ল গিয়ে সমতল একটা জায়গার ওপর, ঘন ঝোপ ওখানে। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সে, চল! জলদি চল।
প্রতিবিম্ব কোথায়…। মুসা কথা শেষ করতে পারল না।
চেঁচিয়ে উঠল গোয়েন্দাপ্রধান, প্রতিবিম্ব চুলোয় যাক, জলদি এস, বলেই ঢাল বেয়ে দৌড় দিল জায়গাটার দিকে। ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতরে সমতল জায়গাটা এমনই, এমনিতে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই, ওখানে মাটির নিচে কিছু লুকানো রয়েছে। এখন দেখা গেল, ডালপালা ভাঙা, মাটিতে একটা গর্ত। সদ্য খোঁড়া।
নিয়ে গেছে! কেঁদে ফেলবে যেন এড।
তোমার আগেই কেউ আন্দাজ করে ফেলেছিল, কিশোর, গুঙিয়ে উঠল মুসা।
গর্তের কিনার থেকে পিতলের একটা বোতাম কুড়িয়ে নিলেন প্রফেসর। টিক বানাউ। এজন্যেই আমাকে মেরে দৌড়ে পালিয়েছে। নিয়ে গেছে গুপ্তধন।
পুলিশকে জানানো দরকার, বলেই দৌড় দিল বোরিস।
লজে ফিরে এল ওরা। ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করতে বলল মিসেস ডাইকে কিশোর। প্রফেসরকে বলল, স্যার, চলুন। যেখানে আপনাকে মেরেছিল, সেখানে ভালমত খুঁজে দেখি। কিছু ফেলেটেলে গেল কিনা। কোথায় গেছে হয়ত আন্দাজ করা যাবে।
প্রফেসরের গাড়ির কাছে খুঁজতে লাগল ওরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছে, ভাল করে দেখার জন্যে। কিছুই পাওয়া গেল না। গাড়ি থেকে খানিক দূরে একটা জায়গা দেখালেন তিনি। কাদা হয়ে আছে, তাতে বুটের ছাপ, চলে গেছে সোজা হাইওয়ের দিকে।
জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। নিশ্চয় গাড়ি রেখে এসেছিল। গেল বোধহয়! আর ধরা যাবে না।
বুটের ছাপগুলো পরীক্ষা করল কিশোর। ছাপগুলো তেমন দাবেনি। স্যার, ওর হাতে কিছু ছিল? দেখেছেন?
না, ছিল না। হাত খালি। গুপ্তধনগুলো নিশ্চয় গাড়িতে রেখে কিছু নিতে ফিরে এসেছিল। আফসোস করলেন, গেছে, পালিয়েছে। আর ধরা যাবে না।
হ্যাঁ-না কিছু বলল না কিশোর। আবার স্টেশন ওয়াগনের কাছে ফিরে আসতে আসতে ঝট করে মাথা তুলল। ডিনো কোথায়?
ডিনো? এড বলল। সারা সকালই দেখিনি। থাকে না কোনদিনই। মর্নিং ওয়াকে যায়।
ঝিক করে উঠল কিশোরের চোখ। এড, মাত্র একবছর হল ও এসেছে। কিভাবে এল?
কিভাবে?…জাস্ট চলে এল। স্কটল্যাণ্ডে আমাদের আত্মীয়দের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে। আমাদের পুরানো বাড়ির সবাইকে চেনে ও, পরিবারের সব কথা জানে।
ওরকম যে কেউ জেনে নিতে পারে, মুসা বলল। কিশোর, টিক বানাউয়ের সঙ্গে কাজ করছে না তো ডিনো? নাকি সে-ই টিক, ছদ্মবেশে রয়েছে?
লম্বা-চওড়া তো একই রকম, থাকতে অসুবিধে নেই। তাছাড়া, গোড়া থেকেই গুপ্তধন খোঁজায়, বাধা দিয়েছে আমাদের। দুবার আমাদের কাছ থেকে জার্নাল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে টিক, দুবারই তখন লজে অনুপস্থিত ছিল ডিনো। ভূতুড়ে শহরেও টিক বানাউ পালিয়ে যাওয়ার পর পরই এসে হাজির হয়েছিল সে।
আড়তে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, রবিন বলল। কাজেই জানা ছিল আমরা কোথায় গেছি। ড্যানিয়েলদের ওখানে যা যা জেনে এসেছি, ও শুনেছে আমাদের মুখে। আমাদের ছাউনিতে আটকে রেখে ফিরে এসে স্মোকহাউসটা ভাঙা সহজ ছিল তার জন্যে। তখনও জানত না সে, কোন ধরনের পাথর কিনেছিলেন বাওরাড।
কিন্তু ছাউনিতে তো শুধু নোবলকে দেখলাম, প্রফেসর বললেন।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু নোবল দরজার তালা খোলার চেষ্টা করেছে প্রথমে। সে-ই জানালা আটকে থাকলে দরজা খুলতে যাবে কেন? তার জানাই থাকার কথা দরজা বন্ধ। আর…। কি যেন ভাবল গোয়েন্দাপ্রধান। বন্ধুদের দিকে তাকাল। লজের ছাউনিতে আগুন লাগার সময় কি কাউকে পালাতে দেখেছি আমরা?
পরস্পরের দিকে তাকাল রবিন, মুসা আর এড। কেউ দেখেনি।
আমিও দেখিনি, কিশোর বলল। আমরা ছুটে গেছি, কারণ, ডিনো আমাদের বলেছে সে চোর দেখেছে। কিন্তু সত্যি কি দেখেছে ডিনো?
তুমি কি বলতে চাইছ ডিনোই আগুন লাগিয়েছে? রবিন জিজ্ঞেস করল। টিককে দেখেছে বলে সন্দেহমুক্ত হতে চেয়েছে? কারণ সে নিজেই টিক বানাউ বলে?
এড মনে করিয়ে দিল, প্রফেসরও তো একটা লোককে দৌড়ে যেতে দেখেছেন।
এবং লোকটা নোবল, বলল কিশোর। স্যার, সত্যি কি নোবলকেই দেখেছিলেন? নাকি ভুল করে বানাউকে নোবল বলেছেন?
হতেও পারে, ধীরে ধীরে বললেন প্রফেসর। সারাক্ষণই নোবলের কথা ভাবছিলাম, তাছাড়া তাড়াহুড়া, উত্তেজনা, ভুল হতেই পারে মানুষের। ডিনো বলেছে, টিককে দেখেছে। আমার মনে হয়েছে, টিক নয়, নোবল। নী-হে, এখনও মনে হচ্ছে আমার, নোবলকেই দেখেছি।
ডিনোই চোর, বলে উঠল মুসা। ডিনোই তুলে নিয়ে গেছে…।
বৃষ্টির মধ্যে গর্জে উঠল একটা কণ্ঠ, কি নিয়ে গেছে ডিনো? রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওদের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে স্কটসম্যান।
আ-আপনি! ঢোক গিলল কিশোর। এতই চমকে গিয়েছে, স্টেশন ওয়াগনের হঙ-এ ভর দিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে হল। হাত থেকে পড়ে গেল টর্চ। তোলার জন্যে ঝুঁকল।
বোরিস, আদেশ দিলেন প্রফেসর, ধর ব্যাটাকে!
সোজা হল কিশোর। চৌখে অদ্ভুত দৃষ্টি। বিস্মিত। আবার ভর দিল প্রফেসরের গাড়িতে।
না, বোরিসভাই, বলল সে। ধরার দরকার নেই। আমার ভুল হয়েছে।
২১
কিশোরের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করছে বোরিস।
ওর কাছে থাক, বললেন প্রফেসর। খবরদার, যেন পালাতে না পারে। …কিশোর, কি ভুল করেছ? ভালই তো যুক্তি দেখাচ্ছিলে, ডিনো চোর।
আড়তে ও-ই আমাদের আটকেছিল, কিশোর, মুসা জোর দিয়ে বলল।
ছাউনিতে আগুন দিয়েছে। স্মোকহাউস গুড়িয়েছে, রবিন বলল।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ডিনো। কী? তোমরা আমাকে…।
খপ করে ডিনোর হাত চেপে ধরল বোরিস। নড়বে না।
ছাউনি পুড়িয়েছে, তোমাদেরকে আড়তের ছাউনিতে আটকেছে, স্মোকহাউসে খুঁজেছে, গুপ্তধন খুঁজতে আমাদের বাধা দিয়েছে, সবই ঠিক। মাথা নাড়ল কিশোর, কিন্তু সে টিক বানাউ নয়। গুপ্তধনও পায়নি।
তুমি না বললে সব কিছুর মূলে টিক আর নোবল? প্রফেসর বললেন।
টিক বানাউয়ের কথা বলতে পারেন, মাথা কাত করল কিশোর। কিন্তু নোবল নয়। গুপ্তধন চায়নি সে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্যই করেছে। চুরি করে হেডকোয়ার্টারে ঢুকেছিল জার্নাল নিয়ে গিয়ে আমাদের থামানোর জন্যে নয়, ওটার ছবি তুলতে। এটা ঠিক, টিক আর নোবলকে কাছাকাছি থাকতে দেখেছি আমরা। থাকবেই। কারণ টিক আর আমাদেরকে অনুসরণ করেছে নোবল। সান্তা বারবারায় আমাদের সঙ্গে জরুরি আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাকে বিশ্বাস করিনি, পাত্তা দিইনি, বরং পুলিশের ভয় দেখিয়েছি। এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই ছেলেটাকে বোরিসের কাছে সে-ই পাঠিয়েছিল, আমরা বিপদে পড়েছি একথা জানাতে। আড়তে গিয়েছিল রবিন আর মুসাকে মুক্ত করতে।
তাহলে কি টিক বানাউ একা? মুসার প্রশ্ন।
হ্যাঁ, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
তোমার কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝছি না, এড বলল।
টিক বানাউ লোকটা আজব। বোঝাতে চেয়েছে সে বাইরে থেকে এসেছে, এই এলাকায় নতুন, অথচ কাজেকর্মে বোঝা গেছে প্রায় সব কিছুই চেনে সে। রবিন হিসটোরিক্যাল সোসাইটি থেকে ফেরার পর পরই স্যালভিজ ইয়ার্ডে উদয় হয়েছে টিক। আমরা যেদিন ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ডে গেছি, সেদিন হানা দিয়েছে সোসাইটিতে। কেন? পুরানো রেকর্ড জানতে, সান-প্রেস অফিসে না গিয়ে, সরাসরি চলে গেছে আলফ্রেড পেরিংটনের বাড়িতে। লেখকের খবর জানল কিভাবে?
ঠিকই তো, রবিন বলল। টিক জানল কি করে?
আলফ্রেড পেরিংটনের নাম জানে সে, রবিন, কারণ, আমাদের এই এলাকা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ টিক। প্রফেসরের দিকে তাকাল কিশোর। ভূতুড়ে শহরে টিক গায়েব হওয়ার পর শুধু ডিনোই নয়, আপনিও হাজির হয়েছিলেন। এই এলাকার লোকাল হিস্টরিতে বিশেষজ্ঞ আপনি। আপনিই টিক বানাউ, এবং আজ সকালে গুপ্তধনগুলো তুলে নিয়ে গেছেন।
হেসে উঠলেন প্রফেসর। সত্যি, কিশোর, একেবারে চমকে দিয়েছ আমাকে। ভাল অভিনয় জান।
না, অভিনয় করছি না আমি।
তাহলে ভুল করেছ। আমার সাইজ আর টিক বানাউয়ের সাইজ এক না।
লম্বায় একই। কিছু বেশি মোটা। ওটা কিছু না। নাবিকদের ভারি জ্যাকেট, পা-জ্যাকেট পরলেই আপনাকে ওরকম মোটা দেখাবে।
আজ সকালে তাহলে চুরি করলাম কখন? বিছানা থেকে উঠেই তোমাকে ফোন করেছি।
কাল সন্ধ্যায়, কিশোর বলল। মুসা যখন রাতেই গুপ্তধন খুঁজতে যাবার কথা বলল, আপনি রাজি হননি। কারণ, আমার আগেই বুঝে ফেলেছেন, কোথায় গুপ্তধন লুকানো আছে। রাতে ফিরে এসেছেন আবার। সম্ভবত, আমার মতই টর্চের সাহায্যে জায়গা আবিষ্কার করেছেন। অন্ধকার ছিল, তার ওপর বৃষ্টি। পানিতে ছায়া দেখে, সেটা কোনখানে নির্দেশ করে বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই টর্চ ব্যবহার করেছেন। খুঁড়ে তুলতে তুলতে সকাল হয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে লজে ফোন বাজতে শুনলেন। আড়ি পাতলেন গিয়ে। এড তখন আমার সঙ্গে কথা বলছে।
বুঝে ফেললেন, আমি জেনে ফেলেছি কোথায় আছে গুপ্তধন। সকালে এখানে আপনার আসার কথা, যদি না আসেন সন্দেহ করব। তাই একটা চালাকি করলেন। কোথাও গিয়ে একটা ফোন করে আবার এসে এখানে গাড়িতে বসে রইলেন। ভাব দেখালেন, আহত। গল্প তৈরি করলেন, টিক বানাউ আপনাকে মেরে গুপ্তধন নিয়ে পালিয়েছে। পুলিশ রহস্যময় টিক বানাউকে খুঁজে সময় নষ্ট করবে, ঘুণাক্ষরেও, সন্দেহ করবে না আপনাকে, এটাই ভেবেছিলেন।
কাদার ওপর ওই বুটের ছাপও আপনার সৃষ্টি।
সবার চোখ এখন প্রফেসরের দিকে।
সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। পুলিশ আসছে।
প্রমাণ করতে পারবে এসব? হেসে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
পারব, স্যার। কারণ মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছেন। আপনি বলেছেন, আজ সকাল আটটায় আপনি বাড়িতে ছিলেন। আমরা আসার কয়েক মিনিট আগে, এখানে এসেছেন। জোর বৃষ্টি হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই।
বৃষ্টি? আবার হাসলেন প্রফেসর। তাতে কি…?।
আপনার গাড়ির নিচের মাটি অনেক জায়গায় শুকনো, প্রফেসরের হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। ইঞ্জিন ঠাণ্ডা। আটটার অনেক আগে থেকেই গাড়িটা ছিল
এখানে। বৃষ্টির আগে থেকে।
চোখের পলকে ঘুরে বড় রাস্তার দিকে দৌড় দিলেন প্রফেসর। কাছে এসে গেছে সাইরেন। গাছের ধার দিয়ে ছুটেছেন তিনি, আচমকা বনের ভেতর থেকে তাঁর ওপর লাফিয়ে পড়ল একটা মূর্তি। তাঁকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। বুকে চেপে বসল। – পৌঁছে গেল পুলিশের গাড়ি। ব্রেক কষল। লাফিয়ে নামল দুজন পুলিশ, প্রফেসর আর তাঁর হামলাকারীকে ধরে ফেলল।
বোরিস, ডিনো আর ছেলেরা দৌড়ে এল সেখানে। ভুরু কুঁচকে প্রফেসর আর নোবলের দিকে তাকিয়ে আছেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার।
ব্যাপার কি, কিশোর? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এই লোকটাই কি নোবল? চোর?
হ্যাঁ, আমিই নোবল, ভেজা এলোমেলো চুল ঝাঁকাল তরুণ। কিন্তু আমি চোর নই। চোর হল গিয়ে আপনাদের এই সম্মানিত প্রফেসর।
নোবল ঠিকই বলেছে, চীফ, কিশোর বলল। প্রফেসর হারম্যান কেইনই চোর। সংক্ষেপে কয়েক কথায় সব বুঝিয়ে দিল ফ্লেচারকে। শেষে বলল, আমার মনে হয়, নোেবল চোর ছিল না কখনই। গুপ্তধনের পেছনে লেগেছেন প্রফেসর, এটা জেনে গিয়েছিল হয়ত, আর প্রফেসরও বুঝেছিলেন সেকথা। তাই কায়দা করে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশও বোকার মত নিয়ে গিয়ে বেচারাকে জেলে ভরেছে।
তুমি ঠিকই বলেছ, নোবল বলল। তখনই কসম খেয়েছি আমি, প্রতিশোধ নেব। প্রফেসরকে ধরিয়ে দেবই।
মস্ত ঝুঁকি নিয়েছ, চীফ বললেন। ওকে ধরতে না পারলে ভয়ানক বিপদে পড়তে। এমনিতেই প্যারোলে বেরিয়েছ। আবার চুরি করে লোকের বাড়িতে ঢুকেছ জানলে বড় রকমের শাস্তি হয়ে যেত। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠল চোখ। প্রফেসর, জিনিসগুলো দিয়ে দিন ভালয় ভালয়। শাস্তি তাহলে কিছুটা রেয়াত হবে।
হাত নাড়লেন প্রফেসর, কাঁধ ঝাঁকালেন নিরাশ ভঙ্গিতে। মলিন হাসি হাসলেন। কি আর করা? কিশোর পাশা আমাকে এক মস্ত মার দিল। গাড়ির পেছনের সিটের নিচে লুকিয়ে রেখেছি।
গাড়িতে উঠল দুজন পুলিশ। সিট সরাতে বেরোল একটা পা-জ্যাকেট, একটা নাবিকের টুপি, কাদামাখা বুট, ভারি ট্রাউজার, আর একটা রবারের মুখোশ, তাতে টিক বানাউয়ের কালো দাড়ি আর কাটা দাগ।
ওগুলোর দিকে নজর নেই কারও। তাকিয়ে আছে সিটের নিচে রাখা চকচকে জিনিসগুলোর দিকে। আঙটি, হার, ব্রেসলেট, মূল্যবান পাথর বসানো সোনার বাটওয়ালা ছোরা, পাথর খচিত সোনার কৌটা, আর কয়েকশো সোনার মোহর। জলদস্যুদের লুটের মাল।
খাইছে! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে মুসার। কয়েক লাখ ডলারের মাল।
ফ্যানটাসটিক! বললেন চীফ।
বিশ্বাসই হচ্ছে না! বিড়বিড় করল ডিনো।
হাসি চলে গেছে প্রফেসরের। চিৎকার করে বললেন, ওগুলো আমার, শুনছ? সব আমার। আমি চোর নই। বাওরাড ডাইই ছিল চোর। আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছিল। আমি…আমি লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেনের বংশধর।
সেটা আদালত বিচার করবে, কঠিন কণ্ঠে বললেন চীফ। প্রায় একশো বছর পর আপনার দাবি প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, সন্দেহ। ক্যাপ্টেনও নিশ্চয় চুরি করেছিল। নাহলে সাধারণ এক সওদাগরী জাহাজের ক্যাপ্টেন এত দামি মাল পেল কোথায়? লুট করেছিল কিনা তা-ই বা কে জানে? আমার রায় বলতে পারি, এখন ওই জিনিস মিসেস ডাইয়ের প্রাপ্য। ওগুলো তুলে নেয়ার দায়ে না হলেও, লোকের বাড়িতে চুরি করে ঢোকার দায়ে, লোককে মারার দায়ে, জেলে আপনাকে যেতেই হবে।
নিরপরাধ নোবলকে ফাঁসানোর বিচার হবে না? রবিন প্রশ্ন তুলল। নিশ্চয় হবে।
নিয়ে যাও, নিজের লোককে আদেশ দিলেন চীফ।
পুলিশের গাড়িতে তোলা হল প্রফেসরকে।
গুপ্তধন নেয়ার জন্যে থলে আনতে ঘরে গেল এড। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এল। দৌড়াতে দৌড়াতে তার পেছনে এলেন মিসেস ডাই। গুপ্তধন তাহলে মিলল! হাঁপাচ্ছেন তিনি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
এগুলো আমাদের, মা! চেঁচিয়ে উঠল এড। আর গরিব থাকব না আমরা।
হাসলেন মিসেস ডাই। সেটা পরে দেখা যাবে, তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বললেন। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। তোমরা সত্যিই গোয়েন্দা, কাজের ছেলে!
হাসি ছড়িয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দার মুখে।
কিশোর, মুসা বলল। একটা কথা বুঝতে পারছি না। ডিনো ছাউনি পোড়াতে গেল কেন? আর আমাদেরকেই বা আটকে রাখল কেন আড়তে?
ডিনোর দিকে চেয়ে হাসল কিশোর। আরেক দিকে চোখ সরিয়ে নিল টসম্যান। আমার মনে হয় ডিনো আংকেল বিয়ে করতে চায়। তার ভয়, গুপ্তধন পেয়ে ধনী হয়ে গেলে, তাকে আর বিয়ে করবেন না মিসেস ডাই।
অবাক হয়ে ডিনোর দিকে তাকালেন মিসেস ডাই।
লাল হয়ে গেল স্কটসম্যানের চেহারা।
হাসি ফুটল মিসেস ডাইয়ের মুখে। ডিনো, কখনও কিন্তু বলনি আমাকে। বুঝিইনি কিছু।
তাদের দিকে চেয়ে হেসে উঠল সবাই, এমনকি এডও।
আরও লাল হল ডিনো।
২২
বিশাল ডেস্কে কনুই রেখে ঝুঁকে বসলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার। চমকপ্রদ আরেক কাহিনী নিয়ে তাঁর অফিসে আবার এসেছে তিন গোয়েন্দা।
প্রায় একশো বছর পর তাহলে পাওয়া গেল গুপ্তধন, বললেন তিনি। আরেকবার অসম্ভবকে সম্ভব করলে। ভাল একটা ছবি তৈরি করা যাবে। এখন বল তো, প্রফেসর কেইন কি সত্যি লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেনের বংশধর?
হ্যাঁ, স্যার, কিশোর জবাব দিল। ইতিহাসের প্রফেসর তিনি সত্যিই। জোয়ান বয়েসে ভাল নাবিক ছিলেন। ইতিহাস আর সাগরের নেশাই তাকে নিজের পরিবারের অতীত জানতে প্রেরণা জুগিয়েছে। জেনেছেন গুপ্তধনের কথা। সোসাইটিতে চাকরিই নিয়েছিলেন ওগুলো খুঁজতে সাহায্য হবে বলে। প্রথম জার্নালটা পড়ে বুঝেছিলেন, দ্বিতীয় আরেকটা আছে কোথাও।
ওটা খোঁজার জন্যেই বার বার চুরি করে ঢুকেছেন ডাই লজে। পাননি। শেষে খোঁজ নিতে আরম্ভ করেন, কি কি জিনিস বিক্রি করেছেন মিসেস ডাই। জেনেছেন বাক্সটার কথা। খোঁজ করতে করতে চলে আসেন মিস্টার ব্যানারের মিউজিয়মে। মিস্টার ব্যানার তাঁকে চেনেন, কাজেই ছদ্মবেশ নিতে হয়েছে। আরও একটা কারণে নিয়েছিলেন ছদ্মবেশ, যাতে কেউ বুঝতে না পারে, প্রফেসর কেইন গুপ্তধনের ব্যাপারে আগ্রহী। যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে।
আমরা গুপ্তধন খোঁজা শুরু করলে সুবিধে হল তাঁর। যোগ দিলেন আমাদের দলে। টিক বানাউ নামে সত্যি সত্যি কেউ আছে, এটা বোঝানোর জন্যে মিথ্যে গল্প বানিয়ে বললেন যে সোসাইটিতে চোর ঢুকেছিল। ভুল করেছেন। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ, সোসাইটিতে ঢোকার কোন কারণই নেই টিক বানাউয়ের।
বেশি চালাকি করতে গিয়েই ভুল করে বসে অপরাধীরা, মন্তব্য করলেন পরিচালক। ধরা পড়ে অনেক সময়।
প্রফেসরকে ঠিক অপরাধী বলা যায় না, স্যার, রবিন বলল। আই মীন, ক্রিমিন্যাল মাইণ্ডেড যাকে বলে আরকি। লোভে পড়েই করেছেন কাজটা। ভুল বুঝতে পেরে পরে অনুশোচনাও করেছেন অনেক। অর্ধেক মাল তাকে দিয়ে দিয়েছেন মিসেস ডাই। প্রফেসর সেগুলো দান করে দিয়েছেন সোসাইটিকে। সোসাইটি সেগুলো ব্যক্তিগত যাদুঘরে সাজিয়ে রেখেছে, লোকের দেখার জন্যে।
হুঁ। লোকের মন যে কখন কি হয়, বোঝা মুশকিল, বললেন পরিচালক। কিন্তু জেলে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারবে না প্রফেসর।
না, তা পারবে না, কিশোর বলল। মিসেস ডাই তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেননি, আমরাও না। ডাই লজে যে তিনি চুরি করে ঢুকেছেন, কোন প্রমাণ নেই। শুধু নোবলকে ফাঁসানোর অপরাধেই জেল হবে তার।
মাথা দোলালেন পরিচালক। নোবল তাহলে শুধু প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে নয়, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যেও প্রফেসরের পিছে লেগেছিল?
হ্যাঁ, স্যার, মুসা বলল। বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। জার্নালের কভার নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে পালাতে দেখেছে টিক বানাউ-রূপী প্রফেসরকে। তারপর দেখেছে, শূন্য কভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে। এতেই বুঝেছে, আরেকটা জানাল আছে। তখনও জানত না, ওটা আমাদের কাছে। তাই লজে গিয়েছিল খোঁজার জন্যে। ডিনো তাকে দেখে তাড়া করে।
তারপর, পরিচালক বললেন। কোনভাবে তোমাদের হাতে জার্নাল দেখে নোবল। চুরি করে হেডকোয়ার্টারে ঢুকে ছবি তুলে আনে ওটার, যাতে জানতে পারে কোথায় কি হচ্ছে। আসলে তোমাদের সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রফেসরের বিরুদ্ধে বললে যদি তখন বিশ্বাস না কর এই ভয়ে বলেনি। ঠিক বলেছি না?
হ্যাঁ, স্যার, রবিন মাথা ঝাঁকাল। তার ভয় ছিল, প্রফেসরকেই শুধু বিশ্বাস করব আমরা। তাই আমাদের অনুসরণই করেছে, সামনে এসে কিছু বলেনি। প্রফেসরের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করেছে।
অযথা হয়রানীর শিকার হয়েছে বেচারা, কিশোর বলল। ইয়ান ফ্লেচার বলেছেন, ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে তাকে। সোসাইটি আবার তাকে চাকরিতে বহাল করেছে।
ভাল। খুব ভাল, খুশি হলেন পরিচালক। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি, ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন ইন্টারভিউর সময় শেষ। আর বেশিক্ষণ আটকাব না তোমাদের। কিশোর, একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। ডিনোকে দেখে চমকে উঠে হাত থেকে টর্চ পড়ে যাবে, এত দুর্বল স্নায়ু তো তোমার নয়। অভিনয় করেছিলে, না?
ঠিকই ধরেছেন, স্যার, হাসল কিশোর। চমকে যাওয়াটা ভান। গাড়ির হুডে ভর দিয়েছি ইঞ্জিন গরম না ঠাণ্ডা বোঝার জন্যে। টর্চ ফেলেছি তোলার সময় নিচটা দেখে নিতে।
ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হওয়াটা কোন ব্যাপার নয়, পরিচালক বললেন। বৃষ্টিতে খুব অল্প সময়েই ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।
তা পারে, স্বীকার করল কিশোর। বলেছি প্রফেসরকে ভড়কে দেয়ার জন্যে। গাড়ির নিচে দেখার আগেই বুঝে ফেলেছি, মিথ্যে কথা বলছেন তিনি। উল্টোপাল্টা কথা বলে মস্ত ভুল করেছেন।
ভ্রূকুটি করলেন পরিচালক। কথাটা কি?
ডিনো তত আগুন লাগাল ছাউনিতে। এসে আমাদেরকে বলল, টিক বানাউকে দেখেছে। আর পরে প্রফেসর বললেন নোেবলকে ছুটে যেতে দেখেছেন। আসলে কাউকে দেখেননি তিনি। তর্ক শুরু করলেন ডিনোর সঙ্গে। এমন তর্ক জুড়ে দিলেন, মনে হল তিনি শিওর, টিক বানাউ হতেই পারে না…।
নিশ্চয় পারে না, প্রফেসর ভুলটা কোথায় করেছেন, বুঝে ফেললেন পরিচালক। প্রফেসর জানে, টিক বানাউকে ডিনো দেখতেই পারে না। কারণ প্রফেসর নিজেই টিক বানাউ। কিশোর, তোমাকে ফাঁকি দেয়া বড় কঠিন।
তখন বুঝতে পারিনি, স্যার। বুঝেছি পরে, বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলছিলাম যখন। সে-সময়ও জোর করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, নোবলকেই দেখেছেন।
সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি ফুটল পরিচালকের মুখে। তো, আমাদের রোমান্টিক নায়কের খবর কি? ডিনাম্যান হাংবার?
হাসল কিশোর। স্বীকার করেছে, মিসেস ডাইকে বিয়ে করতে চায়। ধনী হয়ে গেলে তাকে আর বিয়ে করতে চাইবেন না মহিলা, সে-ভয়েই আমাদের পিছে লেগেছে, ঠেকাতে চেয়েছে। গুপ্তধনের লোভ বিন্দুমাত্র ছিল না।
মহিলা নিশ্চয় খুব সুন্দরী। তার কি মত?
ঝিলিক দিয়ে উঠল মুসার ঝকঝকে সাদা দাঁত। ভেবে দেখবেন বলেছেন।