- বইয়ের নামঃ ক্যাট অ্যামঙ্গ দ্য পিজিওনস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
ক্যাট অ্যামঙ্গ দ্য পিজিওনস
১. পূর্বাভাস–গ্রীষ্ম পর্ব
গ্রীষ্মপর্বের প্রথমদিন মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের কাকড় বিছানো চওড়া পথটা পাক খেয়ে ঘুরে গেছে। শেষবিকেলের রোদ যেখানটায় চকচক করছে ঠিক তার ভেতরে মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে মিস ভ্যান্সিটার্ট। পরনে তার ছিল কোট আর স্কার্ট। তার মাথার চুল সুবিন্যস্ত।
প্রথমেই দেখে অজানা লোকেরা তাকে মিস বুলস্ট্রোড বলে ভুল করে। তারা যদি জানত যে মিস বুলস্ট্রোডের ঘরটি ঈশ্বরের বেদী, পুণ্যাত্মা না হলে সেখানে প্রবেশ নিষেধ তাহলে অবশ্যই তারা ভুল করত না।
স্কুলের কাজকর্মে মিস ভ্যান্সিটার্টের পাশেই মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের মিস চ্যাডাউইনের স্থান। বেশ স্বচ্ছন্দ চরিত্রের মহিলা। মেডোব্যাঙ্ক ওকে ছাড়া কখনই করা যায় না। স্কুলটির গোড়াপত্তন করেন তিনি আর বুলস্ট্রোড সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটেন। কথাবার্তা তার ভাসা ভাসা কিন্তু অংকে ভীষণ মাথা।
মিস ভ্যান্সিটার্টের স্বাগত অভ্যর্থনা ভেসে বেড়াচ্ছে, তিনি জিজ্ঞাসা করছেন মিসেস আর্নল্ডকে, তিনি ভালো আছেন কিনা। লিডিয়াকেলকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বেশ জাহাজে চড়ে গ্রীস বেরিয়ে এলেন, ভালো ফটো তুলেছেন কিনা।
তিনি বললেন লেডি গারনেটকে, নিশ্চয়ই! আটক্লার্কের ব্যাপারে তিনি বুলস্ট্রোডকে যে চিঠি দিয়েছেন, তা তিনি পেয়েছেন–সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস বার্ডকে যে তিনি কেমন আছেন। তারপর তিনি বললেন যে তার মনে হয় না আজ মিস বুলস্ট্রোড একটুও সময় পাবেন আলোচনা করার। তিনি বললেন যে একটা কাজ করা যাক তিনি মিস বোয়ানের আলোচনা করেন।
পামেলাকে বললেন যে তার ঘরটা বদলে দিয়েছেন আপেল গাছের কাছে। তারপর বললেন যে এবার বসন্তকালটা ভীষণ বাজে যাচ্ছে। তারপর তিনি বলনে যে তার এরোপ্লেনটা ভাল। তারপর বললেন মাদামকে যে, তার সৌভাগ্য যে তিনি এসেছেন।
মাদাম বললেন, ওইটা সম্ভব হবে না। তিনি ভয়ানক ব্যস্ত।
প্রফেসারকে নমস্কার করলেন, নতুন কিছু খুঁড়ে তুললেন কিনা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মিস বুলস্ট্রোডের সেক্রেটারি অ্যান শ্যাপল্যান্ড দোতলায় একটি ছোটো ঘরে টাইপ করছে। সে বেশ ভালো, চাইলে মনোরমা হয়ে উঠতে পারে কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। জীবন তাকে শিখিয়েছে কাজে মন দেওয়া। দক্ষতা দেখাতে। তাহলেই অনেক বেদনা অনেক জটিলতা এড়ানো যাবে। এই মুহূর্তে তার একমাত্র লক্ষ্য এই বিখ্যাত মেয়েস্কুলের বিখ্যাত হেড মিস্ট্রেসের নিপুণা দেখেছে জানালা দিয়ে। অস্টিন এসে ঢুকলো। গাড়ি থেকে বাপ আর মেয়ে নামে। বাপটির ভঙ্গী বিব্রত। মেয়েটি শান্ত।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে থেকে মিস ভ্যান্সিটার্ট এসে বলে, মেজর হারগ্রীভস! আর এই বুঝি অ্যালিসন! তারপর তিনি ভেতরে আসার কথা বললেন অ্যালিসনের ঘরটা দেখে যেতে বললেন।
মুচকি হেসে অ্যানি টাইপ করতে করতে মনে মনে আওড়ায় যে ভ্যান্সিটার্ট কি সুযোগ্য সহকারী সব কায়দাকানুন তার রপ্ত।
দোরঙা গাড়ি মেটে লাল ও আকাশী। মেজর অনারেবল অ্যালিস্টোয়ার হারগ্রীভসের প্রাচীন অস্টিনখানার পেছনে দাঁড়ালো।
ঘরের দরজা খুলে দিতেই এসে দাঁড়াল এক পেল্লায় মানুষ। কালো চাপাদাড়ি ঝোলা আলখাল্লা। আর তার পেছনে একটা ছিপছিপে কালো মেয়ে।
ইনিই বোধহয় প্রিন্সেস, স্কুলের পোশাকে ভাবা যাচ্ছে না।
মিস ভ্যান্সিটার্ট আর মিস চ্যাডউইক দুজনেই আসেন। তাদেরকে দেবী দর্শনে নিয়ে যাওয়া হবে। মিস বুলস্ট্রোডকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করার কথা কারোর কানেই ওঠে না। তিনি একেবারে অনন্যা।
সাধারণত অ্যানি কাজে ভুল করে না। এই তো সেইদিন সে ছিল এক বিরাট তেল কোম্পানির উচ্চতম অফিসারের একান্ত সচিব। অসহিষ্ণুতা এবং বিশ্রী হাতের লেখার কথা সবাই জানে। প্রাক্তন মনিবদের মধ্যে আছে দুজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং একজন বড় সরকারী অফিসার, তার কাজের জগত ছিল পুরুষ ঘেঁষা। এখন এই বিচিত্র নারী জগত এও এক নারী জগত। মালয়, বার্মা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে ফিরে আসছে মাঝে মাঝে, সব সময়ে ওকে বিয়ে করতে চাওয়া কিন্তু তার বউ হওয়ার মধ্যে যে কোনো বৈচিত্র্যেই নেই।
একমাত্র আশি বছরের বুড়ো মালীটি ছাড়া এখন চারপাশে শুধুই মাস্টারনী। এখানেই অ্যানের জন্য কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
বাইরে তাকালে নজরে পড়লো গাড়িবারান্দায় একটা নোক বেড়ার গাছ ছাঁটছে। গায়ের রং রোদে পোড়া। রজারগে জোয়ান। অ্যান অবাক। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বোধ হয় কাজটা দিয়েছে বা প্রাণধারণের জন্য।
এখানকার মেট্রন মিস জনসন তিনি খুব ব্যস্ত, কাকে কোন ঘরে দিলে হবে, নতুন নতুন মুখদের ডেকে ডেকে আপ্যায়ন করা, পুরানো ছাত্রীদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলা, কাজের কি আর শেষ আছে।
ছুটির দিনগুলো নিয়েই তার ভীষণ মুশকিল। দুটি বোন আছে, পালা করে কখনো এর কাছে, কখনো তার কাছে যান বটে কিন্তু বোনেরা নিজেদের সংসারের কথাই বলে, সাতকাহন মেডোব্যাঙ্ক নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। স্কুল আবার শুরু হয়েছে তাতেই তার আনন্দ।
পামালা জিজ্ঞাসা করলেন মিস জনসনকে যে, রাত্রে তার বোধ হয় কিছু ভেঙ্গে গেছে, বোধহয় তার মাথার তেল। মিস জনসন গোছাতে লাগলেন।
মাদমোয়াজেল ব্লাশ, নতুন ফরাসি শিখছে। যে লোকটা, বেড়া ছাঁটছে তাকে দেখে মনে মনে তারিফ করলেন।
ছিপছিপে শরীর তার। লোকের চোখ পড়ে না কিন্তু তার চোখ সর্বত্র।
ইংরেজি আর ভূগোলের মাস্টারনী মিস রীচ দালানের দিকে তাড়াতাড়ি চলতে চলতে মাঝে মাঝেই হোঁচট খাচ্ছেন।
ভাবতে-ভাবতে চলছেন, জমিতে মই দেবার আকশিটায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে যাবার সঙ্গেই সেই জোয়ান মালীটা ধরে ফেললো। সে বললো, সামলে চলুন।
আইলিন রীচ তার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।
মিস বোয়ান ও মিস ব্লেক নতুন স্পোর্টস প্যাভিলিয়ানটার দিকে চলেছেন। দুজনেই জুনিয়ার টিচার। মিস বোয়ান ছিপছিপে কালচে, অথচ দীপ্তিময়, মিস ব্লেক মোটা আর ফর্সা। দুজনেই ফ্লোরেন্সের গল্প করছিল। এবার সেখানে গিয়ে কী কী অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে।
মিস বোয়ান মিস ব্লেককে বললেন যে তিনি মনোবিজ্ঞান ও অর্থনীতি পড়েছেন, বেশি বাধানিষেধ তারা মানে না। তাই তো তাঁদের অমন সুন্দর দেখায়। রিপু দমন নেই। কিন্তু জিউসেপ যেই শুনেছে যে তিনি মেডোব্যাঙ্কে পড়ান অমনি সে যথেষ্ট ভদ্র হয়ে গেল।
মিস বোয়ান দারুণ খুশি, মেডোব্যাঙ্ক একটা স্কুল বটে। তার স্পোর্টস প্যাভিলিয়ন ভালো। তিনি তো ভাবতেই পারেননি এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে। তারপর তিনি একটু আফশোস করে বললেন, যে মিস বুলস্ট্রোড বলেছিলেন না…হতেই হবে। মিস বোয়ান তখন চমকে উঠল। স্পোর্টস প্যাভিলিয়নের দরজা খুলে একটি ছিপছিপে মেয়ে বেরিয়ে এসে তাদের দুজনের দিকে রুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
মিস ব্লেক বললে, এটা হয়তো নতুন গেমটিচার, কী বিশ্রী। তারপর বললেন, মিস জোনস কি সুন্দর ছিলেন। যেমন সুন্দর তেমনি মিশুকে। মিস বুলস্ট্রোড বেশ প্রভাবশালী অভিজাত চোহারা। তার চোখের তারা কটা, কিন্তু তাতে কৌতুকের দৃষ্টি। হেড মিস্ট্রেসের ব্যক্তিত্বের জন্যই এই স্কুলের এত সাফল্য, অবশ্য এখানে পড়ানো ভয়ানক ব্যয়সাধ্য। দলবদ্ধভাবে শিক্ষা দেওয়া এখানকার পদ্ধতি নয়। শিক্ষা ব্যক্তিমূলক হলেও শৃঙ্খলার ওপরেই জোর দেওয়া হয়। মিস বুলস্ট্রোডের শিক্ষানীতি হল, জোর করে দেওয়া নয়। তরুণীদের কাছে শৃঙ্খলা জিনিসটার আশ্বাস নিয়ে আসা। ওরা তাতে নিশ্চিত হয়। তার ছাত্রীরা সমাজের নানা স্তরে নানা দেশের। কিছু বিদেশী আছে, যারা উঁচু বংশের ও ধনী পরিবারের। এছাড়া আরো ছাত্রীরা আছে যারা প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে চায় ও ডিগ্রী নিতে চায়। তাছাড়া কিছু মেয়ে আছে তাদের কাছে স্কুল গণ্ডীটাই বাধা। তাছাড়া বুলস্ট্রোডের নানারকম নিয়মকানুন আছে–যেমন তিনি জড়বুদ্ধিদের নেন না, শিশু অপরাধীদেরও নয়। যে সব মেয়ের বাপ-মাকে তার পছন্দ হয় যাদের মধ্যে তিনি বিকাশের সম্ভাবনা দেখেন তাদের তিনি ভর্তি নেন।
এতক্ষণ ফায়ার প্লেসের ধারে দাঁড়িয়ে গেরাণ্ড হোপের প্যানপ্যানানি শুনছেন, তারপর তিনি বললেন, মিস বুলস্ট্রোডকে যে ডাক্তার তাদের বলে জেদী, মিস বুলস্ট্রোড মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন মনে মনে, ন্যাকা। তারপর বলেন সব মেয়েরাই ভালোবাসে তাদের নিয়ে বিদঘুঁটে কল্পনা করতে। মিস বুলস্ট্রোডের মুখে সমবেদনা, কিছু ভাবেন না তিনি। তারপর গেরা বললেন যে দু একদিনের মধ্যেই হেনরিয়েটা এমন বদলে যাবে যে অবাক হতে হবে। তারপর মিস বুলস্ট্রোড মনে মনে আওড়ালেন যে তার চেয়ে তার মেয়ে বুদ্ধিমতী। তারপর গেরা বললেন যে তারা মাস দেড়েকের মধ্যে দক্ষিণ ফ্রান্সে যাচ্ছে। তখন হেনরিয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তার একটা পরিবর্তন হবে।
তার খিটখিটে মুখটা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। মিসেস হোপের গলায় মেজাজের ঝাঁঝ ফুটে ওঠে, তিনি বলেন মেয়ে তারই। তারপর তিনি বললেন যে তার যখন খুশি মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।
তারপর হোপ বললেন যে, পারবেন না কেন। তাহলে তিনি আর তাকে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। তারপর বললেন যে তার মেয়ের জন্য তিনি কাড়িকাড়ি টাকা দিচ্ছেন।
হোপ বললেন, সেটাই তো কথা, তার স্কুল তিনিই তো বেছে নিয়েছেন। তারপর হেনরিয়েটাকে দেখে বললেন যে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আদরমাখা চোখে তাকাল, কী সুন্দর চালাক চতুর মেয়ে, ওর ভাগ্যে এমন মা জুটেছে, তারপর মিস বুলস্ট্রোড মার্গারেটকে বললেন, হেনরিয়েটাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। তারপর তিনি নিজের ঘরে ফিরে আসেন।
এরপর যারা বুলস্ট্রোডের ঘরে ঢুকলো তাদের গা দিয়ে দামী সুগন্ধ বেরুচ্ছিল। কালো বেশভূষা পরা কালো মেয়েটিকে আপ্যায়ন জানাতে মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন, রোজই বোধহয় গোটা বোতল গায়ে ঢালে তারপর মিস বুলস্ট্রোড মাদামকে আসতে বললেন, মাদাম সুন্দর । ভঙ্গীতে হেসে উঠলেন।
আরবী জোব্বা গায়ে দাড়িওলা দশাশই লোকটা মিস বুলস্ট্রোডের হাত টেনে নিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, প্রিন্সেস শাইস্তাকে নিয়ে আসার সৌভাগ্য তার হয়েছে।
নতুন ছাত্রীটি সুইজ্যারল্যান্ড স্কুল থেকে সবে এসেছেন তার কথা বুলস্ট্রোড জানেন। জানতেন না লোকটির সঙ্গে তার পরিচয় আছে। মিস বুলস্ট্রোড মেয়েটির বয়স পনেরো বলেই জানেন, বেশ বড়সড় দেখতে। প্রায় যুবতীই, প্রাচ্য দেশের মেয়েরা অমনিই হয়, পড়াশোনা নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে মিস বুলস্ট্রোড কথা বলেন, মেয়েটি ইংরেজিতে বলে, মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন যে ইংরেজ মেয়েদের দূর বিদেশে পাঠালে বেশ হয়, প্রাচ্য দেশে না হলেও মধ্যপ্রাচ্যে। মিস বুলস্ট্রোড আলোচনা শেষ করে বিদায় নিল।
মিস বুলস্ট্রোড জানালা খুলে দেন, ঘরে ঢুকলো মার্গারেট ও তাঁর মেয়ে জুলিয়া, বয়স তিরিশের শেষ কোঠায়, ঝরঝরে চুল মুখভরা দাগ। টুপিটা বেমানান তার অভ্যাস নেই, মেডোব্যাঙ্কে আসছেন মেয়েকে ভর্তি করাতে। সাদাসিধে মেয়ে, ললাটে বুদ্ধির ছাপ, হাসিখুশি মেয়ে। তাড়াতাড়ি ভূমিকা শেষ করে মার্গারেট হাত দিয়ে জুলিয়াকে চালান করে দিলেন জনসনের কাছে, মেয়েটা কিন্তু তার মাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে সে থাকবে না। গ্যাসট্যাসগুলো সাবধানে জ্বালাতে বললো। জুলিয়া একেবারেই সাধারণ মেয়ে, স্বাস্থ্য ভালো, বুদ্ধিসুদ্ধি রাখে, মিস বুলস্ট্রোড গম্ভীরভাবে বললেন জুলিয়া যে এখানে আসতে পেরেছে সেটাই বিরাট ব্যাপার।
হঠাৎ জানালা দিয়ে কী যেন দেখে মিসেস আপন অবাক হয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে বললেন, আরে কী অদ্ভুত, মিস বুলস্ট্রোডের কানেও গেল না। সামনের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন রডোডেনড্রন গুচ্ছ পেরিয়ে স্কুলবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন লেডি ভেরোনিকা কার্লটন, মদে চুর, তার পা টলছে। একটা আপদ বিশেষ লেডি ভেরোনিকা। যমজ মেয়েদুটির ওপরে খুব টান, কিন্তু মহিলা খুব ভালো কিন্তু প্রায় তিনি তা থাকেন না, তখন তিনি আরেক মানুষ হয়ে যান, কখন যে চুর হয়ে যান তিনি নিজেও জানেন না। স্বামী মেজর কার্লটন খুব চেষ্টা করেন তার স্ত্রীকে আয়ত্তে আনার জন্য। কিন্তু পারেন না। স্কুলে স্পোর্টসের দিন তারা সবাই এসেছিলেন, লেডি ভেরোনিকাকে সঙ্গে নিয়ে মেজরসাহেব ও তার বোন সেদিন প্রকৃতিস্থ অবস্থায় চমৎকার পোশাক পরে এসেছিল। তার বাৎসল্য প্রেম দেখে মনে হচ্ছিল আদর্শ এক মাতৃমূর্তি। কিন্তু যখন স্বামী ও ননদের চোখ এড়িয়ে মদে চুর হয়ে স্কুলে আসতেন যমজ মেয়ে দুটোকে স্নেহ জানাতে তখনই হত বিপদ, আজ সকালের ট্রেনে এসেছে।
মিস বুলস্ট্রোড মিসেস আপভানের কথা কিছুই শুনছেন না। তখন তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার কথা ভাবছেন, হঠাৎ মিস চ্যাডউইক জোর কদমে পা চালিয়ে লেডি ভেরোনিকার কাছে গেল। আরামে নিঃশ্বাস ফেললেন তখন বুলস্ট্রোড। চ্যাডিকে সব সময় বিশ্বাস করা যায়। কোনো মেয়ের রগ ছিঁড়ে রক্ত পড়ুক বা মাতাল বাপ-মা আসুন চ্যাডিই পরম ভরসা। লেডি ভেরোনিকা জোরেই মিস চ্যাডাইককে বলেছিলেন কি বিচ্ছিরি! বলে কিনা তাকে সরিয়ে রাখবে, আসতে দেবে না। তারপর তিনি বললেন, বুলস্ট্রোডকে গিয়ে তিনি বলবেন যে তার বাচ্চাদের নিয়ে যাবে কত আদর-টাদর করবে মায়ের স্নেহ দিয়ে। চ্যাডউইক বললেন, নিশ্চয়ই তারা খুব খুশি হয়েছে। নতুন স্পোর্টস প্যাভিলিয়নটা তাকে দেখাবেন বললেন, লেডি ভেরোনিকা কায়দা করে দালানের উল্টো দিকের পথটা ধরল, টলটলে পায়ে ভদ্রমহিলা মিস চ্যাডউইকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলবাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যান। তারপর চ্যাডউইক বলেন যে তার মেয়ে দুটোকে তিনি ওখানেই পাবেন। কি চমৎকার স্পোর্টস প্যাভিলিয়ন, ঝকঝকে নতুন নাম্বার, সাঁতারের পোশাক শুকিয়ে নেবার জন্য আলাদা ঘর আছে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, সত্যিই চ্যাডি অতুলনীয়া–ওর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। মেয়ে হিসাবে মোটেই আধুনিকা নয়। অঙ্ক ছাড়া কোনো বিষয়ে মাথা নেই। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আজ স্কুলে গ্রীষ্মপর্ব শুরু হলো, এখন অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
.
রামাতে বিপ্লব
গ্রীষ্মপর্ব আরম্ভ হবার মাস দুয়েক আগে মেডোব্যাঙ্কে কতকগুলো অসাধারণ ঘটনা ঘটেছিল। নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটি মেয়ের স্কুলটার ওপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। দুজন যুবক রাজপ্রাসাদে বসে অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল, তাদের মুখে পাইপ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল। একজনকে দেখতে তেলতেলে মসৃণ, মুখ ভাসা ভাসা, উদাস চোখ। ইনিই শাহজাদা আলি ইউসুফ, ছোটো হলেও রামাত দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের ধনবান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্য লোকটির শুকনো চুল, দাগ দাগ মুখ, মহামান্য শেখসাহেবের নিজস্ব বৈমানিক। মাইনে কয়েকটি টাকা মাত্র, এতটা সামাজিক বিভেদ সত্ত্বেও তারা দুজনে বন্ধু, কারণ দুজনে ইংল্যান্ডে একই পাবলিক স্কুলের ছাত্র।
বিশ্বাস করতে পারা যায় না রাজকুমার আলি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, বব রবিনসনের কোনো দ্বিধা নেই, নির্ঘাত আমাদের বিমানটি নিচে ফেলে দিতে চাইছিল, বব দাঁত চেপে কথাটি বললো। একটু ভেবে আলি বলেন, বোধহয় আর তারা কোনো চেষ্টা করবে না। আমি ভীষণ দেরি করে ফেলেছি নসীবের ওপর আর কতবার ভরসা করা যায়।
রামাতে রাজা বলেন, পালিয়ে যেতে কি মন করে ববের কথা সে বোঝে। রুদ্ধকণ্ঠে যুবরাজ বলে–এই দেশের লোকের জন্য তিনি কি না করেছেন। কতটাকা ঢেলে গড়া হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যবিভাগ। বব বললো দূতাবাস কিছু করতে পারে না, সে সেখানে আশ্রয় নেবে সেটা জিজ্ঞাসা করলে, ও বললো সে কখনো ও আশ্রয় নেবে না। তাহলে চরমপন্থীরা তাদের দূতাবাস গুঁড়িয়ে দেবে। আমার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগই তো যে, সে বড় ইউরোপীয় ঘেঁষা। তার মনটা যেন দূরদূরান্তে চলে যায়। তার পিতামহ ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। শয়ে শয়ে তার ক্রীতদাস ছিল। আর সে যদি পিতামহের মতো নিষ্ঠুর অত্যাচারী হন সেটা বানানোই বোধহয় তাদের কাম্য ছিল। ববের ধারণা আলির এই অনাড়ম্বর নিরুত্তাপ চেহারাটা ইংল্যান্ডে মানিয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে তেমন চলে না।
শাহজাদা আলি ইউসুফ বললেন, তারা কি বর্বর। তারা তো এখন সভ্য হয়েছে। তাছাড়া তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা বর্বর দানব লুকিয়ে থাকে। যে কোনো ছুঁতোতেই সেটা গর্জে ওঠে। বব তখন বললো, যাদের বেশ ভালো সাধারণ বুদ্ধি তেমন লোকের আজকাল চাহিদা নেই। এখন যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার নাম সাধারণ বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞান নয়। বব বললো, প্রত্যেকটা অলি-গলিতে চর আছে সবকিছু শোনে, সবকিছু জানে। বব বললো, আলিকে যদি পালাতে হয় তো এখুনি অবিলম্বে।..আলি বললো যে সে বুঝতে পারছে এখানে থাকা মানেই মৃত্যু–তাকে হত্যা করা হবে। বব বললো, মরবার সম্ভাবনাটাই বেশি, উত্তর দিকে লক্ষ্য করে বিমান চালাতে হবে। আলি ইউসুফের মুখ করুণ হয়ে উঠলো ববের যদি কিছু হয়। বব তখন বললো, যে তার আছেটা কি, না চাল না চুলো, তার কাজকর্মের ধারাই তো অদ্ভুত। কথাটা তাকে নিয়ে নয় আলিকে নিয়ে। আলি বললো যে তার পালাতে ইচ্ছে করছে না।
বব বললো যে, সেও কি চায় পালাতে কিন্তু হিংস্র জনতা যখন আলির প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে নেবে আর সে শহীদ বনে যাক।
আলি বললে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে, বেশ তবে তাই হোক।
বব বললো যে, সে সঙ্গে কিছু নিতে চায় না শুধু একটা জিনিস ছাড়া। শাহজাদা অদ্ভুতভাবে হাসলেন, পলকে যেন গোটা মানুষটা পালটে গেল। ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষা বেশভূষা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়লো প্রাচ্যদেশীয় চাতুর্য আর কৌশলের ইঙ্গিত। আলি বটুয়ার বন্ধনী খুলে সেটা টেবিলে ঢাললেন।
বব বললো, এগুলি কি আসল? আলি বললে, প্রত্যেকটা সাচ্চা পাথর। বেশিরভাগই তার বাবার সংগ্রহ, প্রতিবছর তিনি নতুন রত্ন আনতেন বিশ্বের নানা জায়গা থেকে। আলি বললো, তাদের বংশের এটা একটা রীতি, প্রয়োজনের সময় যাতে কাজে লাগে। বর্তমান বাজার দরে এর দাম প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড। বহু রক্তপাত হত্যাকাণ্ড যে তার পেছনে জড়িয়ে আছে, আর স্ত্রীলোকেরা আরো সাংঘাতিক। কারণ রত্ন তাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়, যে কোন নারীকে পাগল করে তোলে। আলি বললো যে, ববকে সে বিশ্বাস করে, আলি চায় না এই রত্নগুলো তার শত্রুর হাতে পড়ুক। হয়তো আজ বিকালে আলি বিমানযাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। কাজেই এই পাথরগুলো এখুনি নিয়ে রেখে দিতে বললো আলি।
বব বললো, এগুলি নিয়ে তিনি কি করবেন। আলি বললো, যেমন করে তোক এগুলো নিয়ে দেশের বাইরে যাবার ব্যবস্থা করবে। দরদ ভরা কণ্ঠে আলি বলেন, ববকে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে না।
.
অলিন্দে সুন্দরী
বব রবিনসনের মাথায় চিন্তা, প্যান্টের পকেটে সাড়ে সাত পাউন্ড। ভীষণ তার অস্বস্তি, প্রাসাদের প্রত্যেকেই বোধহয় খবরটা জানে, হয়তো তার চোখ মুখেও খবরটার ছায়া। মনটা তার উদ্ভ্রান্ত, কোথায় যাচ্ছে কে জানে, কী তার পরিকল্পনা তার জানা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড দামের জহরত তাকে সঁপে দেওয়া হয়েছে, এদেশ থেকে পাচার করবার জন্য সময় বিশেষ নেই। যে কোনো মুহূর্তে বিদ্রোহ হতে পারে।
বব বললো, এখন এমন একজন লোকের দরকার যে এ দেশ থেকে চলে যাচ্ছে পালিয়ে নয় হয়তো ভ্রমণ শেষে নয়তো কোনো কারণে দেশের বাইরে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী বা ভ্রমণকারী পেলেই ভালো হয় যে রাজনীতিতে নেই, রাজপরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে তার মালপত্র তল্লাশী করা হবে না। শুধু চোখ বুলিয়ে নিয়ম রক্ষা হবে।
হঠাৎ ববের মনে পড়লো অনর্থক এতক্ষণ ভেবে মরছে, তার দিদি জোয়ান তো রয়েছে মেয়ে জেনিয়াকে নিয়ে দুমাস হলো, এসেছে আবহাওয়া বদলাতে, ডাক্তার এমন দেশে যেতে বললেন যেখানে সূর্যালোক প্রচুর, আবহাওয়া শুষ্ক। চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তারা জাহাজে পাড়ি দেবে। বব বললো, যে আলি বলেছিল নারী ও রত্ন কদাপি বিশ্বাস করিবে না। জোয়ান অমন ভালো মেয়ে রত্ন দেখে কি তার মাথা ঘুরে যাবে, নিশ্চয় না। কিন্তু জোয়ানের পেটে কথা থাকে না। জোয়ান কখনও ভালো কথা চেপে রাখতে পারে না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে জোয়ান নিজেও না জানতে পারে, সঙ্গে করে কী নিয়ে যাচ্ছে, সেটা ওঁর পক্ষেও নিরাপদ। পাথরগুলো নিয়ে একটা পুটলি বাঁধতে হবে।
রামাতে সবচেয়ে নামী রিজ স্যাবয়ের সামনে বব এসে দাঁড়ালো, অতি আধুনিক হোটেলটি। সেখানকার কেরানী তাকে চেনে। হাসিখুশী মুখে ববকে সে বললো, সুপ্রভাত, দিদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বোধহয়, তিনি তার মেয়েকে নিয়ে চড়ুইভাতি করতে গেছেন। বব মনে মনে বললো, আর সময় পেল না। এখন ফিরতে তার দিদির কঘণ্টা সময় লাগবে, বরং বব তার দিদির ঘরের চাবিটা দিতে বললো। চাবি নিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢোকে বব। বেশ বড় দুটি বিছানা, ঘরময় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। তারপর বব ভাবলো কি করলে ভালো হয়, একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে ভালো হয়, জোয়ানকে কেউ সন্দেহ করবে না, তারপর কারুর হাত দিয়ে ইংল্যান্ডে জোয়ানকে খবর পাঠালেই হবে। বব লিখলে—
জোয়ানদি,
ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে গল খেলতে যেতে রাজি আছ কিনা, দেখলাম তুমি নেই, শুনলাম বাঁধ দেখতে গেছ, তাই কয়েকঘণ্টার জন্য পৃথিবীর বাইরে চলে যাওয়া। কাল আসবে কি বিকেল পাঁচটায়।
ইতি
তোমাদের বব।
এতে ববের দুটো কাজ হবে, চিঠিটায় মনে হবে দেশ ছেড়ে চলে যাবার মতলবই ছিল না ববের। একটু ভেবে ব্রিটিশ দূতাবাসকে ডাকলো, তৃতীয় সচিব জন এডমাণ্ডসনের-ববের পুরানো বন্ধু। এডমাণ্ডুসনের সুরে বড় মেজাজ, শুকনো ভদ্রতা নেই সমর্থন কি মুশকিল, বব তুমি আর তোমার মেয়েরা দুটোর সময়, কেমন, লাইন ছেড়ে দেয়, বব বুঝতে পারল লাইনে কেউ ওদের কথাবার্তা শুনেছিল সেও রিসিভার রেখে দিল। খাঁটি বন্ধু এডমাণ্ডুসন রামাতে সব টেলিফোনেই যন্ত্র লাগানো আছে, তাই বব আর জন এডমাণ্ডুসন মিলে নিজেদের একটা সঙ্কেত বানিয়ে নিয়েছিল। মেয়েটি আশ্চর্য, যেন এই জগতের নয়–এটা বললে বোঝা যাবে ভীষণ জরুরী বরং সাংঘাতিক ব্যাপার। মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে দুটোর সময় জন এডমাণ্ডুসন ববকে গাড়িতে তুলে নেবে। বব তখনই তাকে গোপন কথাটা জানাবে। জোয়ান কিছু জানে না, মাস দেড়েক লাগবে জোয়ানের ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে। তখন নিশ্চয়ই রামাতে বিপ্লব শেষ হয়ে যাবে, হয়তো আলি ইউসুফ তখন ইউরোপে থাকবেন। অথবা ওরা দুজনেই তখন মৃত। আরেকবার বব ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, সেই একই চেহারা, টেবিলে চিঠিটাকে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বব বেরিয়ে এলো।
জোয়ান সাটক্লিফের পাশের ঘরের রমণীটি অলিন্দ থেকে পা টিপে টিপে ফিরে এলে, তার হাতে একটা আয়না। মহিলাটির চিবুকে একটা চুল গজিয়েছে তাই আয়না হাতে মহিলাটি অলিন্দে এসে অনেক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, সেটা উপড়ে ফেলে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে যখন বেশ তৃপ্তি পেল ঠিক তখুনি চোখে পড়লো পাশের ঘরের আয়নায় ঝুলন্ত লোশাক, আলমারির আয়নায় স্পষ্ট প্রতিফলন ফুটে উঠেছিল, আর সেই প্রতিবিম্বে ধরা পড়লো একজন অদ্ভুত পুরুষ কিছু করছে। সেই অবাস্তব ব্যাপারটা দেখে রমণীটি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষটি তাকে দেখেনি। নারী মূর্তিটি শুধু দুই আয়নার প্রতিফলনে ব্যাপারটাকে দেখলো। পুরুষটি যদি একবারও ঝুলন্ত আয়নায় চোখ রাখতো তাহলেই দেখতে পেতে পাশের ঘরে লাগোয়া ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন সুন্দরী রমণী হাতে আয়না নিয়ে কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। লোকটি যতক্ষণ কাজ করল ততক্ষণ অলিন্দে দাঁড়িয়ে রমণীটি আয়না হাতে সব দেখলো, কাজ শেষ করে লোকটি চিঠি লিখে রেখে টেলিফোন করছে। একটু পরেই দরজা বন্ধ হল। রমণীটি নিজের ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে। বারান্দায় শেষ প্রান্তে পালকের ঝাড়ন দিয়ে একজন আরবীয় মন্থর হাতে ময়লা ঝাড়ছিল, মোড় ঘুরে সে চলে গেল। যেতেই মেয়েটি চট করে পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তালা বন্ধ ছোটো চাকুর ফলা আর চুলের কাটা দিয়ে নিপুণ হাতে তালা খুলে ফেললো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিঠিটা তুলে নেয়, চিঠি পড়তেই ভুরু কুঁচকে ওঠে। কোনো ব্যাখ্যা নেই, যথাস্থানে রেখে ঘরের এপাশে এসে দু-হাত বাড়িয়ে হঠাৎ জানলা দিয়ে একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
জোয়ান চেঁচিয়ে বলছিলো, এ যে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার মশাই, এমন পাগলামি কেউ কখনো শুনেছে? চারিদিক শান্তিপূর্ণ, হৈচৈ নেই, গণ্ডগোল নেই, আতঙ্ক নেই, প্রত্যেকের সুন্দর ব্যবহার…না-না এসব আপনাদের অহেতুক বাড়াবাড়ি।
তাই যেন হয় মিসেস সাটক্লিফ। কিন্তু মাননীয় রাজদূত মনে করেন যে বিপদের ঝুঁকি এত বেশি যে তার দায়িত্বে…তার মালপত্র প্রচুর, আমরা সমুদ্রপথে বাড়ি যাব, আগামী বুধবারে আমাদের জাহাজ ছাড়বে। সব পরিকল্পনা ছুঁড়ে ফেলে হুট বলতেই উড়ি এখন ইংল্যান্ডে, প্রতিনিধিটি বিব্রত মুখে আশার বাণী শোনালো, সাটক্লিক ও তার মেয়েকে বিমানে ইংল্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে না, পথে এডেনে নামিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে জাহাজ ধরতে হবে। রমণীটি কথাটি শোনামাত্র দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল। সবার আগে স্যুটকেসের ওপরে ঠিকানা লেখা কাগজটা ভালো করে দেখে নেয়। তার পিছনে পিছনে কেরাণীটি ছুটতে ছুটতে এসে বলে, মিসেস সাটক্লিক আপনার ভাই এসেছিলেন একটু আগেই। আপনার ঘরেও গিয়েছিল, চলে গেছেন বোধহয়। সাটক্লিক ধন্যবাদ জানালো। তারপর তিনি আফশোস করে বললেন, বব মনে হয় বিপ্লবের কথা বলতে এসেছিল। তারপর তার ঘরের দরজা খোলা কেন, কী অসাবধানতা এই লোকগুলোর।
জেনিয়া বলল, বোধহয় বব মামার কাণ্ড।
মিসেস সাটক্লিক বললেন, যে ববের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। তারপর সে চিঠিটা পেল।
চিঠিটা পড়ে যা মনে হয় বব মোটেই ব্যস্ত হয়নি, মনে হল। আমার তো মনে হয় না কোনো কূটনৈতিক ঝগড়া-টগরা বেঁধেছে।
.
মিঃ রবিনসনের পরিচয়
মাস দেড়েক পড়ে একজন যুবক ব্রুমনবেরীর কোনো একটা ঘরের দরজায় সাবধানে টোকা দিতেই ভেতর থেকে আহ্বান এলো। ছোটো ঘরটিতে বড়ো একটা টেবিলের পেছনে মোটাসোটা একজন মাঝবসয়ী ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন, তার স্যুটে ভাজ পড়ে গেছে, সামনের দিকে চুরুটের ছাই লেপটে আছে, জানলা বন্ধ থাকায় ঘরে অসহ্য গুমোট। ঢুলুঢুলু চোখে ভদ্রলোক বলেন, কি হে এবার কিসের দরকার? আজ্ঞে বিদেশ দপ্তর থেকে এডমাণ্ডুসন এসেছেন। আবার চোখ মিটমিট করে বিড়বিড় করে বললেন, রামাতে বিপ্লবের সময় তিনি আমাদের দূতাবাসে তৃতীয় সচিব ছিলেন তাই না, আজ্ঞে হ্যাঁ। কর্নেল বলেন, তাহলে তো দেখা করতেই হবে।
মিঃ এডমাণ্ডুসন বেশ লম্বা, ফর্সা, চমৎকার পরিপাটি পোশাক। কর্নেল পাইক্যাওয়ে আমি জন এডমাণ্ডুসন। ওরা বললো, আপনি নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? এডমাণ্ডুসন বললেন। বলেছেন বুঝি, তা বসুন।
পাইক্যাওয়ের চোখ বুজে আসে। তা বিপ্লবের সময় আপনি রামাতে ছিলেন? এডমাণ্ডুসন বলেন, হ্যাঁ বিশ্রী ব্যাপার। তারপর পাইক্যাওয়ের বলেন, আপনি বব রবিনসনের বন্ধু ছিলেন না, তার সঙ্গে আমার বেশ ভালোই জানাশোনা আছে।
এখানে সতর্ক হয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা সব খবর রাখি। যেদিন বিপ্লব হলো সেদিন বব শাহজাদা ইউসুফকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল। তখন থেকেই বিমানটা নিখোঁজ, হয়তো ওরা কোনো দুর্গম স্থানে নেমেছে নয়তো বিমানখানা ধ্বংস হয়েছে। আরলেজ পাহাড়ে একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে আর দুটি মৃতদেহও ছিল। সেখানে কালকের কাগজে খবরটা বেরুবে কী বলেন।
বড়ই দুঃখের! কী করুণ কাহিনী, শাহজাদা যদি বেঁচে থাকতেন তো রাজার মতো রাজা হতেন, আলোকপ্রাপ্ত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কর্নেল পাইক্যাওয়ে বলেন, হয়তো সেইজন্যই বেচারাকে মরতে হল। স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল থেকে অনুরোধ এসেছে যে কয়েকটি ব্যাপারে আমরা যেন অনুসন্ধান চালাই তাতে আমাদের সরকারের অনুমোদনও রয়েছে। এডমাসন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো, তা হ্যাঁ কিছু কিছু তিনি শুনেছেন বটে। তারপর পাইক্যাওয়ে বলেন যে মৃতদেহের কোনোটা থেকেই কোনো মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়নি, ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও না।
এডমাণ্ডুসন বলেন, যেদিন কাণ্ডটা শুরু হলো সেদিন বব আমাকে টেলিফোন করে কথাগুলো বললো, একটা ব্যাঙ্কের সামনে আমরা দেখা করতাম। কিন্তু ঠিক ওই জায়গাটায় দাঙ্গা আরম্ভ হল, পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিলো, ববের সঙ্গে আর সংযোগ করা গেল না। সেই বিকেলেই আলিকে নিয়ে আকাশে উড়লো। কর্নেল পাইক্যাওয়ে বললেন, বব কোত্থেকে ফোন করেছিল, এডমাণ্ডুসন বললেন না। আচ্ছা মিসেস সাটক্লিফকে চেনেন, এডমাসন বললেন, ববের দিদি, ওখানে দেখা হয়েছিল বটে।ইস্টার্নকুইন জাহাজে টিলবেরী বন্দরে মিসেস সাটক্লিফ ও তার মেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর দেশে ফিরছেন। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর কর্নেল একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, এখানে আসবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। জন এডমাণ্ডুসন চলে গেলে বিচক্ষণ যুবকটি ঘরে ঢুকলো। পাইক্যাওয়ে বললেন, ভেবেছিলাম ওকে টিলবেরী পাঠাবো। কিন্তু স্বভাবটি একেবারেই শুকনো বৈদেশিক দপ্তরের, শিক্ষাটাই অমনি।
যখন রনি এসে ঘরে ঢুকলো তখন কর্নেলকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। কালচে পেশীবহুল চেহারা, দীর্ঘদেহ, স্ফুর্তিবাজ মন, বেপরোয়া স্বভাব। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বলেন, মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে পারবে?
রনি তখন ভুরু নাচিয়ে বলে, মেয়েদের স্কুল, মেডোব্যাঙ্ক একেবারে অভিজাত স্কুল। শিস দিয়ে রনি বলে, মেডোব্যাঙ্ক কল্পনাই করা যায় না। রনি বললো, তাকে কি করতে হবে, নারীহরণ।
কর্নেল বললো যে, তিনি চান যে রনি চারিদিক নজর রাখবে কি হচ্ছে না হচ্ছে আমাকে জানাবে। মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটার উপর দৃষ্টি পড়বে, কে বা কারা ওখানে গিয়ে জুটবে তা এখনো বলা যায় না। তোমার কাজ হল চোখ খুলে দেখা আর কান পেতে শোনা। সেখানে তুমি মালি সেজে ঢুকবে। তারপর কর্নেল বললো, মালির কাজে যা জ্ঞানের দরকার পারবে তো?
রনি তখন বললো, ছোটোবেলায় সে এসব অনেক করেছে। রনি বললো, মেডোব্যাঙ্কে মালির কাজ খালি আছে? কর্নেল বললো, থাকতেই হবে, ইংল্যান্ডে প্রত্যেকটা বাগানে এখন লোকের অভাব। তোমাকে কতগুলো প্রশংসাপত্র যোগাড় করে দেবো তাহলেই তারা লাফিয়ে উঠবে, উনত্রিশ তারিখে স্কুল খুলবে।
রনি বলল, তখন তার নাম কি হবে?
কর্নেল বললেন, অ্যাডাম।
রবিনসনকে দেখে মনে হবে না যে তিনি কস্মিনকালের, বরঞ্চ কোনো বিদেশী নামই হওয়া উচিত। পরিপাটি পোশাক, নাদুসনুদুস চেহারা, হলুদ চুল, উদাস চোখ, চওড়া কপাল, ঝকঝকে দাঁত একটু বেরিয়ে আছে। খাঁটি ইংরেজী উচ্চারণ। কর্নেলের সঙ্গে দেখা হতেই দুজনের সম্ভাষণ আপ্যায়ন দেখে মনে হয় দুই দেশের দুই রাজা, প্রচুর সমাদর হল।
মিঃ রবিনসন মুখে একটা চুরুট দিয়ে কর্নেলকে বললো যে তিনি যে সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। রবিনসন বললো কর্নেলকে যে তিনি শুনতে পেয়েছেন যে, শাহজাদা আলি ইউসুফের বিমানটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
কর্নেল বললেন, গত বুধবার বিমানটা খুঁজে পাওয়া গেছে। উড়ানপথটা ছিল খুবই কঠিন। বিমানটাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ ঘটেছিল আহমেদ নামে এক পুরানো মিস্ত্রীর সম্পূর্ণ বিশ্বাসী লোক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মোটেই তা নয়। নতুন শাসনতন্ত্রে লোকটা বেশ ভালো পদ পেয়েছে।
তারপর রবিনসন একটু আফশোস করে বললেন, আহা বেচারী তরুণ রাজা আলি ইউসুফ, অসাধুতার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে যে লড়বে সে শক্তি কই। পাবলিক স্কুলে শিক্ষাটাই তার কাল।
পাইক্যাওয়ে জানালো, হ্যাঁ আমরা বব ও তার দিদির ওপর ব্যবস্থা করবো। রবিনসন চোখবুজে বলেন, রত্নগুলো যদি তার কাছে এখনো থাকে তো বিপদ ঘটতে পারে। গুণ্ডামি দাঙ্গা মারামারি এসব আমার সহ্য হয় না।
.
যাত্রী এলো ফিরে
মিসেস সাটক্লিফ হোটেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। কী অদ্ভুত যখন ইংল্যান্ডে আসব তখুনি বৃষ্টি হতে হবে। পাশে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠলো, মিসেস সাটক্লিফ রিসিভার তোলে। হ্যালো আমি মিসেস সাটক্লিফ বলছি, দরজায় টোকা মারল কে। ফোনটা রেখে দরজা খুলে দেখে একজন বিজলী মিস্ত্রী, বাতি ঠিক নেই, ঠিক করতে এসেছে। ছোকরা ঘরে ঢুকলো। সে বললো, গোসলখানা কোনদিকে? সাটক্লিফ বললো, শোবার ঘরের পেছনে। ফিরে টেলিফোন তুলে নেয়, দুঃখিত…কী যেন বললেন? আমি ডোরেক, আপনার সঙ্গে দেখা হবে কি? মিসেস সাটক্লিফ আমি আপনার ভাইয়ের বিষয়ে–কে বব? তার কি খবর পাওয়া গেছে। হা ফোনে অসুবিধা আছে। ও আচ্ছা আসুন, ওপরে চলে আসুন তিনশো দশ নম্বর ঘরে। আবার দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দেয়। কম বয়সী এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে করমর্দন করেন। আপনি কি বৈদেশিক দপ্তরের? আমার নাম ডোরেক ওকোনর, আমারই ওপরওয়ালারা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, আর কাউকে পাওয়া গেল না সংবাদটা দেওয়ার জন্য। মিসেস সাটক্লিফের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বলুন মারা গেছে, না?
হা মিসেস সাটক্লিফ..রাজকুমার আলি ইউসুফকে উড়োজাহাজে রামাতে বাইরে নিয়ে আসছিলেন, পথে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে তিনি মারা যান।
আমাকে জানানো হয়নি কেন? আমার জাহাজে বেতারবার্তা পাঠানো হয়নি।
ডোরেক ওকোনর বললেন মিসেস সাটক্লিফকে, তার ভাই কি কোনো জিনিস দিয়েছিল ইংল্যান্ডে নিয়ে আসবার জন্যে? মানে বব কোনো ছোটো পুঁটুলি আপনাকে দিয়েছিল। ডোরেক বললেন যে আর একটা কথা তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, একটা ভীষণ দরকারী প্যাকেট ছিল। আমাদের ধারণা দেশে নিয়ে যাবার জন্য আপনার ভাই বিপ্লবের দিন কাউকে দিয়েছিলেন। আর সেইদিনই তো তিনিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
তা জানি কিন্তু তার দুলাইন চিঠির মধ্যেও কিছু ছিল না। শুধু পরের দিন টেনিস না গলফ খেলার কয়েকটা তুচ্ছ কথা..আমার তো মনে হয়না তখন ও জানতো যে সেই বিকেলেই ওকে রাজকুমারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
শুধু ওই কটা কথাই লেখা ছিল তাতে? আপনার কাছে কি সেই চিঠিটা আসে মিসেস সাটক্লিফ?
না ও চিঠি থাকবে কেন? ওটা কি কোনো দরকারের? তক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলেছি।
রাখতে যাবই বা কেন বলুন? মিসেস সাটক্লিফ মাঝের দরজা খুলে ভেতরে যেতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ান, দেখে এক ছোকরা একটা স্যুটকেসের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, আমি বিজলী মিস্ত্রী, ওদিককার আলোগুলোর কিছু হয়েছে?
আলোর বোতাম টিপে বললো, না ঠিক আছে ভাই। তাহলে বোধহয় ঘরের নম্বর ভুল, তাড়াতাড়ি যন্ত্রপাতি নিয়ে দরজার দিকে চলে যায়। সাটক্লিফের দিকে চেয়ে, মাপ করবেন, বলেই চলে যায়।
টেলিফোনটা তুলে নিল সাটক্লিফ। আমি ৩১০ নম্বর থেকে বলছি, কোনো মিস্ত্রী পাঠিয়েছিলেন এ ঘরে, হা…আচ্ছা ধরছি, টেলিফোনটা রেখে সাটক্লিফ বলে এঘরে কোথাও কোনো আলো খারাপ হয়নি, হোটেল থেকেও কোনো মিস্ত্রী পাঠায়নি।
আঁ এ লোকটা চোর-টোর নাকি, তাড়াতাড়ি তার ব্যাগ খুলে দেখে, না, ব্যাগ থেকে কিছু নেয়নি। টাকাকড়ি সব ঠিক আছে।
রাজকুমার আলি ইউসুফ বোধহয় আপনার ভাইকে একটা জিনিস রক্ষা করতে দিয়েছিলেন। তাই তিনি হয়তো ভাবছিলেন নিজের কাছে রাখার চেয়ে আপনার মালপত্রের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা বেশি নিরাপদ।
না না, হতেই পারে না।
একবার খুঁজে দেখলে হয়।
খুঁজে দেখবেন মানে, আঁ, আমার সব জিনিসপত্র আবার সব খুলবেন, যেন কান্নার সুরে আঁতকে ওঠে।
ঝামেলা অনেক জানি। অসুবিধাও প্রচুর হবে। কিন্তু সমস্যাটা যে গুরুতর, কিছু ভাববেন না। আমার মায়ের জিনিসপত্র বেঁধে দিয়েছি। মালপত্তর গোছাতে আমি ওস্তাদ। অতএব মিসেস সাটক্লিফ প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হল, আচ্ছা যা ভালো বোঝেন করুন। অতই যদি জরুরী।
ভীষণ জরুরী বিশ্বাস করুন।
জেনিয়া এসে অবাক। মালপত্তর আবার খুলেছই বা কেন আবার গুছোচ্ছেও কেন? মিসেস সাটক্লিফ বললেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করছো? এরা ভাবেন যে তোমার বব মামা আমার মালপত্তের ভেতরে কিছু ঢুকিয়ে রেখে গেছেন।
ডোরেক ওকোনর বেশ হাসিখুশি মুখ করে বলে, সব খুলে দেখলাম কিছুই পাওয়া গেল না। সব গুছিয়ে রাখা যাক। টেলিফোনে এক কাপ চায়ের কথা বললেন মিসেস সাটক্লিফ। ওকোনর মালপত্র গোছাতে বসে নিপুণ হাতে চটপট কাজ করে। মিসেস সাটক্লিফ প্রশংসার চোখে বলে আপনার মা তো আপনাকে বেশ শিখিয়েছে।
স্থানীয় সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ : গতকাল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক ব্যক্তিকে পেশ করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, সে চুরি করার উদ্দেশ্যে মিঃ হেনরি সাটক্লিফের বাড়িতে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করেছিল। মিসেস সাটক্লিফের শয়নকক্ষে ঢুকে লোকটা সব জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করে রেখেছিল। সেই রবিবার সকালে বাড়ির বাসিন্দারা সবাই গীর্জায় গিয়েছিলেন, এবং সেই অবসরে লোকটা অতসব কাণ্ড করতে পেরেছিলো। প্রকাশ্য আদালতে লোকটা বলেছে যে তার নাম অ্যানড বল এবং তার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। সে স্বীকার করেছে। সে কোনো কাজকর্ম না থাকায় অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় ওই কাজে সে রত হয়েছিল। জেনিয়া তখন বললো, কিছুতেই বুঝতে পারছি না পুলিশ কি করে টের পেলো আমাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে। স্বামী বললো, তুমি ঠিক জানো তো জোয়ান একেবারে নিঃসন্দেহ। তারপর জোয়ান জেনিয়াকে বললো, মেডোব্যাঙ্ক কিন্তু সাধারণ স্কুল নয় আর তোমাকে যেন কেউ লোভী না বলে। জেনিয়া বললো যে তার মেডোব্যাঙ্কে যেতে ভালো লাগছে না। আমার এক বন্ধুর জ্যাঠার মেয়ে সেখানে পড়ত। সেখানে রানীর সঙ্গে যদি নেমন্তন্ন খেতে বসে তো কেমন করে বসবে, কথা বলবে খাবে, বিচ্ছিরি।
বুঝতে পারছ না তোমার কত ভাগ্য, মিস বুলস্ট্রোড কি আর সব মেয়েকে নেন। নেহাত তোমার বাবার প্রতিষ্ঠা আর তোমার মাসীর প্রতিপত্তি ছিলো তাই।
.
মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের পত্রগুচ্ছ
জুলিয়া আপনজন মাকে লিখলো মা এতদিনে আমার সব চেনা হয়ে গেছে। বেশ ভালো লাগছে। আরেকজন নতুন মেয়ে এসেছে জেনিয়া, আমরা দুজনে বন্ধু হয়েছি, দুজনে টেনিস খেলি…। ইত্যাদি।
জেনিয়া সাটক্লিফ তার মাকে লিখলো—
মামনি,
অতটা খারাপ লাগছে না। এখানে যতটুকু আশা করেছিলাম তার চেয়ে ভালো সময় কাটছে, আবহাওয়া চমৎকার…ইত্যাদি।
সবশেষে তোমাদের আদরের জেনিয়া।
.
প্রারম্ভের দিনগুলো
কতরকম গল্পগুজব হয় শিক্ষয়িত্রীদের ঘরে। কে কোন দেশে গিয়েছিল কি দেখেছিল। একসময়ে শুরু হল অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা। নতুন তৈরি ক্রীড়ামঞ্চে সবাই উৎসাহিত, দালানটা যে বেশ সুন্দর হয়েছে সেকথাও মোটামুটি সবাই স্বীকার করলেও প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বক্তব্য আছে। বড়ো গলায় মিস প্রিয়ার বললো, দুনিয়ার অকৃতজ্ঞতার কি শেষ আছে…মানুষ এত ভীরু যে সত্যি কথাটা স্বীকার করে নেবার মতো সাহস নেই–আমি কিন্তু সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কতবার যে কত লোকের কলঙ্ক ফাঁস করে দিয়েছি। ওসব আমি গন্ধে গন্ধে টের পাই।
আঃ কী আশ্চর্য সেসব কাহিনী…মাদমোয়াজেল ব্লাশ যেন অবাক, আপনার ভালো লাগে এইসব করতে?
না, তবু কর্তব্য কিন্তু সমর্থন পাইনি।
মিস বুলস্ট্রোড কর্তৃত্বের সুরে বলেন, ব্যাস ঢের হয়েছে শাইস্তা, তোমার বাড়ির লোকেরা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন ইংরেজদের আচার-ব্যবহার শেখবার জন্য। এইসব শারীরিক কসরতে তোমারই ভালো, রঙও ভালো হবে, বুকের গড়নও।
চ্যাডির একটা অসামান্য গুণ যে সবসময় ওকে হাতের কাছে পাওয়া যায়। যখনই প্রয়োজন। হয় তখনই এগিয়ে আসে। সংঘর্ষের আঘাত বহন করে নেবার জন্য পরম বিশ্বস্ততায় মাথা পেতে দেয়। যেমন দিয়েছিলো গ্রীষ্মপর্বের আরম্ভ হবার দিনটিতে লেডি ভেরোনিকার বেলায়, মিস বুলস্ট্রোড জানেন যে এই বিপুল প্রাসাদের ভিত্তি চ্যাডির অবিচল দৃঢ়তার ওপরেই।
এই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে এরা দুজনে ভালোই আয় করেন। এখন অবসর নিলেও বাকি। জীবনটা, ভালোভাবে কাটাবার একটা আয় তাদের থাকবে। সম্ভবত তিনি অবসর নিলেও চ্যাডি নেবে না, তার কাছে স্কুলটাই ঘরবাড়ি। তিনি চলে যাবার জন্য মনস্থির করে নিয়েছেন।
মিস বুলস্ট্রোড রচনাগুলো দেখে দেখে নম্বর দেওয়া শেষ করলেন। খাতা দেখতে দেখতে মনে হল আপনজন মেয়েটি বেশ মৌলিক। জেনিয়ার সাটক্লিফের কল্পনাশক্তি একেবারেই নেই কিন্তু তথ্যজ্ঞান বেশ ভালো। মেরী ভাইজের স্মরণশক্তি আশ্চর্য।
.
.
ঝড়ের মুখে কুটো
বিড়বিড় করে ওঠে বুড়ো ব্রিগস, মন্দ নয় হে মন্দ নয়। পছন্দ হয়েছে নতুন সাকরেদটির মাটি কোপানো, এটা তারই স্বীকৃতি। ভেবেছে ছোকরার বেশি তারিফ করবে না, নইলে পেয়ে বসে।
জোয়ান মানুষটা বুঝে ফেলেছে যে কাজে ব্রিগসের নিজের যে গতি তার চেয়ে তার কাজ হয়েছে অনেক দ্রুত আর অনেক ভালো।
অ্যাডাম জানে ব্রিগসের এই বক্তৃতায় মেয়ে মানুষ কথাটার অর্থ মিস বুলস্ট্রোড।
হেঁটে আসেন মিস বুলস্ট্রোড, সুপ্রভাত ব্রিগস।
সুপ্রভাত–মেমসাহেব, অ্যাডাম ওই জায়গাটা চমৎকার খুঁড়েছে..টেনিস কোর্টে তারের জালটা ঝুলে গেছে ব্রিগস, এখনই ঠিক করে দাও।
এই সামনেটায় কি ফুল লাগাচ্ছো, অ্যাস্টার লাগিও না, ডালিয়া লাগিও বলে হাঁটা দিলেন। তারপর মিস বুলস্ট্রোড হেসে মেয়েদের স্বাধীনতার সঙ্গে চাই কিছু কড়া নজর, কি বলল ইলিয়ানর?
হু
উপায় বের করে ফেলবো।
নিশ্চয়ই…মেডোব্যাঙ্কে কী কখন কোনো অপকীর্তি ঘটেছে।
মিস বুলস্ট্রোড হেসে বললেন, ঘটেনি অবশ্য। তবে স্কুল চালাতে গিয়ে কি আর ঘটনার অভাব ঘটে। জীবন কখনও একঘেয়ে হয়ে ওঠে না। ইলিয়ানর এখানকার জীবন কি তোমার একঘেয়ে ঠেকে?
মিস ভ্যান্সিটার্ট বললো, না মোটেই না। এখানকার কাজ আমার খুব ভালো লাগে।…কী যে তৃপ্তি পাই। তুমি যে রকম সাফল্য অর্জন করেছে তাতে তোমার গর্ববোধ করা উচিত অনোরিয়া।
জানি…অবশ্য সংসারে কোনো জিনিসকেই কেউ কল্পনার মাপে মাপতে পারে না…
আচ্ছা ইলিয়ানর একটা সত্যি কথা বলবে?..যদি এখন আমার জায়গায় তুমি বসো তুমি কী কী পরিবর্তন করতে চাইবে? আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
আমি কোনো পরিবর্তন করতে চাই না। তুমি যে প্রাণ সঞ্চার করে গেছ, গোটা প্রতিষ্ঠানটাই এখন সর্বাঙ্গসুন্দর।
অর্থাৎ তুমি একইভাবে স্কুলটা চালাতে চাও। |||||||||| নিশ্চয়ই। মনে হয় না আর কিছু করা যায়। মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন : আমাকে সন্তুষ্ট করবার
ওই কথাগুলো বললো। কে জানে, মানুষ চেনা বড়ো শক্ত তা যতই তুমি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হও। যত বছরের পরিচয়ই থাক। গড়ার ইচ্ছে যাদের থাকে, তারা কোনো না কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবেই। অবশ্য সে কথা মুখ ফুটে বলা শশাভন নয়…ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের মা-বাবাদের সঙ্গে স্কুলকর্মীদের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রেই শোভন আচরণ কাম্য।
আচার ব্যবহারে ইলিয়ানর বেশ পটু, তিনি বললেন, তবু সবসময়েই তো সমন্বয় সাধন করে যেতে হয়, নয় কী? মানে আদর্শের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে। মিস ভ্যান্সিটার্ট বলে, ও হা সে তো হবেই। স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠতেই ভ্যান্সিটার্ট বলেন, আমার জার্মান ক্লাস আছে চলি। বলে মিস ভ্যান্সিটার্ট চলে গেলেন। তাড়াতাড়ি পা চালালো ও তার পদক্ষেপে স্থৈর্য আছে…পেছনে মিস বুলস্ট্রোডও চললেন। আরেকটু হলেই আইলিন রীচের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগতো, সে পাশের সরু গলি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বোধহয় বেরিয়ে আসছিল।
জেনিয়া রেগে তার র্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে, নাঃ অসম্ভব, এটা দিয়ে খেলা যায় নাকি? যাচ্ছে তাই।
আঃ কি হচ্ছে জেনিয়া।
দেখো না ক্ষমতাই নেই, ভারসাম্য একেবারেই গেছে।
জুলিয়া বলে, তবুও আমার পুরানোটার চেয়ে অনেক ভালো। আমারটা তো একেবারে ন্যাতা। নতুন করে টানা দেবার কথা ছিল। কিন্তু মা ভুলেই গেছে।
অ্যাডাম টেনিস মাঠে তারের জাল টেনে টেনে সোজা করছিল। কাজ করতে করতে মনের আনন্দে শিস দেয়। হঠাৎ ক্রীড়ামঞ্চে দরজা খুলে ফরাসি শিক্ষিকা মাদমোয়াজেল উঁকি মারে।
অ্যাডাম অবাক, কী করে কী ওখানে? তার অমন চোর চোর ভঙ্গী দেখে সন্দেহ জাগে।
এখানকার মাঠগুলো সুন্দর তার ওপর সাঁতার দীঘি আছে। খেলা দেখবার আসল সিঁড়ি আছে। মাদমোয়াজেল ব্লাশ বললেন অ্যাডামকে যে ইংল্যান্ডে খেলাধূলাকে খুব বড়ো করে দেখ। অ্যাডাম বললেন, তা হবে মিস।
তুমি টেনিস খেল? চোখ দুটোকে ঈষৎ আহ্বান, মাদমোয়াজেল ব্লাশকে দেখে মনে হয় না যে, সে মেডোব্যাঙ্কের মতো স্কুলে ফরাসি শিক্ষিকা হবার যোগ্য।
না আমি টেনিস খেলি না, সময় পাই না। তবে কি ক্রিকেট খেল।
সে ছোটোবেলায় খেলতাম।–অ্যাডাম মনে মনে ভাবতে লাগল যে তিনি কোন মতলবে ক্রীড়ামঞ্চে এসেছিলেন।
২. আততায়ী
সার্জেন্ট গ্রীন হাস্ট্রীট সাইপ্রিয়ান থানায় রাতের ডিউটিতে বসে হাই তুলছিল। টেলিফোন বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে নিলো…নিমেষে তার ভঙ্গী পাল্টে গেল। তাড়াতাড়ি কাগজ টেনে লিখতে শুরু করল।
হ্যাঁ, মোডোব্যাঙ্ক, আচ্ছা কি নাম, এস.পি. আর এন-জি, জি? গ্রীনে জি? আচ্ছা ই-আর, প্রিন্সার।
মেডোব্যাঙ্কে খোলা দরজা দিয়ে আলোর রশ্মি এসে ঠিকরে পড়ছে। মিস বুলস্ট্রোড নিজে এসে গোয়েন্দা ইনসপেক্টর কেলসিকে অভ্যর্থনা করলেন। মহিলাটি ইনসপেক্টরের মুখচেনা। অবশ্য এ তল্লাটে এমন কেউ নেই যে তাঁকে চেনে না। এত গুণ্ডগোলের মধ্যেও মহিলাটি আচরণের সমতা হারাননি। সম্পূর্ণ পরিবেশ যেন তার আয়ত্তেই রয়েছে।
আমি ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর কেলসি।
প্রথমে আপনি কি করতে চান ইনসপেক্টর? ক্রীড়ামঞ্চে যাবেন, না ঘটনার বিবরণ শুনবেন।
নিশ্চয়ই। আমি সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে এসেছি তাকে আর আমার দুজন লোককে যদি দেখিয়ে দেন মৃতদেহ কোথায় আছে তাহলে আপনার সঙ্গে কটা কথা সেরে নিই।
মিস বুলস্ট্রোডের পেছনে পেছনে কেলসি বসবার ঘরে ঢুকলো।-মৃতদেহ প্রথমে কে দেখেছিল?
মিস জনসন, আমাদের মেট্রন। একটা মেয়ের কানে ব্যথা হয়েছিল, মিস জনসন তার ঘরে গিয়ে দেখাশোনা করছিলো। এমন সময় পর্দাটি ঠিকমতো খোলা নেই দেখে ঠিক করতে গিয়ে দেখে ক্রীড়ামঞ্চে আলো জ্বলছে। তখন রাত প্রায় একটা-ওখানে তো আলো জ্বলবার কথা নয়।
হু! মিস জনসন কোথায়?
এখানেই আছে ডেকে দেব কি?
এখন থাক… তারপর কি হল বলুন?
মিস জনসন তখন আমার আর এক সহকর্মী মিস চ্যাডউইককে ডেকে তুললো। দুজনে মিলে ওপাশের দরজা দিয়ে যখন নেমে যাচ্ছিল তখন বন্দুকের শব্দ শুনতে পায়। শুনেই একদৌড়ে তারা ক্রীড়ামঞ্চে হাজির হল, সেখানে…।
কিন্তু তার আগে নিহত মহিলাটি সম্বন্ধে কিছু বলুন
ওর নাম মিস গ্রেস স্প্রিঙ্গার।
আপনার এখানে কতদিন ছিলেন।
এই পরেই এসেছিলেন।…আগের ক্রীড়া শিক্ষয়িত্রীটি কাজ ছেড়ে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া।
মিস স্প্রিঙ্গার সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?
তার পরিচয় পত্রগুলো বেশ ভালোই ছিল।
ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না আগে।
না।
এমন ঘটনা কেন ঘটতে পারে বলতে পারেন। কোনো মতামত? উনি কি অসুখী ছিলেন? কোনো প্রেমঘটিত?
সেরকম আমি কিছু শুনিনি। আমার তা মনে হয় না, ওর ধারণাটাই ছিলো অন্যরকম। দুনিয়ায় যে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
মিস জনসনকে কি ডেকে দেবো?
আচ্ছা মিস বুলস্ত্রোড় তাহলে আমি মিস জনসনের সঙ্গে কথা বলি কেমন?
মিস বুলস্ট্রোড গিয়ে মিস জনসনকে নিয়ে এলেন।
মৃতদেহ আবিষ্কার করবার পর মিস জনসন ভয় কাটানোর জন্য বেশ খানিকটা ব্র্যাণ্ডি খেয়ে নিয়েছিল। ফলে কথাটথা তার বেড়ে গেছে।
এলসপেথ, ইনি গোয়েন্দা ইনসপেক্টর কেলসি। তুমি মাথা ঠিক রেখে একে সব কথা বলো, যা যা ঘটেছিলো।
মিস জনসন বলে, উঃ সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর, জন্মে কভূ দেখিনি। বিশ্বাস করতেই পারছি না, সত্যি বলছি। বিশ্বাসই হয় না, শেষ মিস স্প্রিঙ্গার
বুদ্ধিমান গোয়েন্দা কেলসি সুরের রেশ বুঝে জেরা করবার রীতি পাল্টে ফেললো। মিস ম্প্রিঙ্গারকে খুন করা হয়েছে দেখে কি আপনি অবাক হয়েছেন?
হু…তা তো হয়েছিই। উনি কেমন শক্তসমর্থ মানুষ ছিলেন, কেমন মেজাজী …দুটো চোর একসঙ্গে এলেও তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারতো না।
চোর?…ক্রীড়ামঞ্চে চুরি করবার মতো কিছু ছিল।
না…মানে…সাঁতারের পোশাক ও খেলার সরঞ্জাম আছে।
অর্থাৎ ছিঁচকে চোর।…কিন্তু তার জন্য কি কেউ দরজা ভাঙবার মতো কষ্ট স্বীকার করবে? আচ্ছা দরজার তালা কি ভেঙ্গেছিলো।
আঁ! লক্ষ্য করিনি তো, যখন আমরা ওখানে পৌঁছলাম দরজা খোলাই ছিল। কাজেই মিস বুলস্ট্রোড বলেন, না ভাঙেনি।
ও চাবির ব্যবহার করেছে। মিস স্পিঙ্গারের সঙ্গে কি সকলের সদ্ভাব ছিল?
তা–ঠিক জানি না, এখন তো তিনি মারা গেছেন। মিস জনসনের দিকে তাকিয়ে ইনসপেক্টর বলে, অর্থাৎ, তাকে আপনি পছন্দ করতেন না। তাই তো?
আমার মনে হয় কেউই তাকে পছন্দ করতো না। ভয়ানক মূর্খরা ছিলেন তিনি, তবে নিজের কাজে ভীষণ পারদর্শী ছিলেন, কী বলেন–মিস বুলস্ট্রোড?
নিশ্চয়ই
কেলসি এবার বললো, তাহলে কী কী হয়েছিলো। ঠিক করে বলুন তো মিস জনসন?
আমাদের একজন ছাত্রী জীনের কানের ব্যথা হয়েছিল। আমি একটু ওষুধ লাগিয়ে আবার তার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তক্ষুনি দেখি জানালার পর্দা আধখোলা, ভাবলাম হাওয়া লাগানো মেয়েটার পক্ষে ঠিক নয়, তাই পর্দাটি বন্ধ করে দিই। আমাদের মেয়েরা অবশ্য সবাই জানালা খুলেই শোয়। বিদেশী ছাত্রীরা যা একটু গোলমাল করে। আমি জানালা লাগাতে গিয়ে দেখলাম কী আশ্চর্য, তখন দেখি ক্রীড়ামঞ্চে আলো। স্পষ্ট দেখা গেল। আলোটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মানে আপনি বলছেন যে ওটা বিজলীর আলো ছিল না টর্চের আলো।
হা নিশ্চয়ই তাই। ভাবলাম এতরাতে ওখানে
আপনি কী ভেবেছিলেন?
মিস জনসন একবার মিস বুলস্ট্রোডের দিকে দেখে নিয়ে আমি ঠিক বুঝিনি, মানে…আমি… আমি তখন হয়তো জিনিসটা সম্বন্ধে ভাবিইনি
মিস বুলস্ট্রোড বললেন মিস জনসন বোধহয় ভেবেছিলেন যে কোনো ছাত্রী হয়তো ওখানে রাতের অভিসারে গেছে। তাই না…এলসপেথ?
মানে…হা ওরকম একটা ধারণা তখন হয়েছিলো। ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের কোনো ইতালীয় ছাত্রী। বিদেশী মেয়েরা ইংরেজ মেয়েদের তুলনায় অনেক অকালপক্ক।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, অত বিদেশীপনা করো না, বহু ইংরেজ ছাত্রী গোপনে গোপনে কত অযোগ্য পাত্রে মিলিত হয়। এসময় ওরকম ধারণা হওয়া স্বাভাবিক।
তারপর?
আমি ভাবলাম মিস চ্যাডউইকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে দেখে আসি..কী ব্যাপার?
কেলসি বললো, বিশেষ করে মিস চ্যাডউইককে কেন?
মিস বুলস্ট্রোডকে অত রাতে বিরক্ত করতে চাইনি। কাজেই মিস চ্যাডউইকের কথাই মনে পড়লো। যখনই আমরা মিস বুলস্ট্রোডকে বিরক্ত করতে চাই না। তখনই আমরা মিস চ্যাডউইককে স্মরণ করি। উনি তো কতকাল এখানে আছেন, কত তার অভিজ্ঞতা। তিনি শুনেই বলেন এখুনি সেখানে আমাদের যাওয়া উচিত। কোনোমতো একটা সোয়েটার বা কোট চাপিয়ে পাশের দরজা দিয়ে বেরুলাম। রাস্তায় যেই নেমেছি কানে এল গুলির আওয়াজ। ক্রীড়ামঞ্চের দিকে শব্দটা হতেই আমরা ওদিকে ছুটলাম, হা সঙ্গে একটা টর্চও নিইনি। অন্ধকারে দু-চারবার হোঁচট খেলাম..দরজা খোলাই ছিল, আলোর বোম টিপতেই
দাঁড়া দাঁড়া সেখানে আলো ছিল না? টর্চের বা অন্য কোনো আলো?
না জায়গাটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছিল। বোতাম টিপতেই চোখে পড়লো উনি ওখানে,
উনি–ইনসপেক্টর নরম গলায় বলে, আর কোনো বিবরণ দেবার দরকার নেই। আমি এখুনি ওখানে যাচ্ছি। নিজের চোখেই দেখবো…যেতে যেতে কাউকে দেখেছিলেন? কারো দৌড়ে পালাবার শব্দ পেয়েছিলেন?
না কোনো শব্দ শুনিনি।
স্কুল দালান থেকে আর কেউ গুলির আওয়াজ পেয়েছিল? মিস বুলস্ট্রোড মাথা নাড়লেন, না। জানি না, গুলির শব্দ শুনেছি বলে কেউ আমাকে বলেনি। ক্রীড়ামঞ্চ এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে তাই হয়তো আওয়াজটা কেউ লক্ষ্য করেনি।
.
পাখির ঝাঁকে বেড়াল
জেনিয়া সাটক্লিফ তার মাকে লিখলো—
মামনি,
আমাদের এখানে কাল রাতে একটা খুন হয়েছে। আমাদের শরীরচর্চার দিদিমনি মিস প্রিঙ্গারকে হত্যা করা হয়েছে। মাঝরাতে ঘটনাটা ঘটেছিল, পুলিশ এসেছিল। আজ সকাল থেকে সবাইকে জেরা করছে।
মিস চ্যাডউইক কাউকে এসব কথা জানাতে মানা করে দিয়েছেন কিন্তু ভাবলাম তুমি হয়তো জানতে চাইবে।
স্নেহের–
জেনিয়া।
সমাজের উপরতলায় মেডোব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানটির স্থান। কাজেই পুলিশের খোদকর্তা ব্যাপারটায় মনোযোগ দিলেন। মিস বুলস্ট্রোডও চুপচাপ বসে থাকেননি। যখন তদন্ত চলছিল তখনই তিনি দুটো টেলিফোন করেছিলেন। একজন একটি প্রভূত ক্ষমতাবান সংবাদপত্রের অধিকারীকে ও দ্বিতীয়টি স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিবকে। তারা দুজনেই মিস বুলস্ট্রোডের বন্ধু। কাজেই হত্যাকাণ্ডের সংবাদটা বিশেষ প্রচারিত হল না। ক্রীড়া শিক্ষয়িত্রীকে স্কুলের ব্যায়ামাগারে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মৃতদেহে গুলির চিহ্ন আছে কিনা এ বিষয়ে সঠিক বলা যাচ্ছে না। যে ব্যাপারটি নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়।…প্রতিটি কাগজে খবরটা প্রকাশিত হল বেশ বিনীত ভঙ্গিতে।
সেদিন সন্ধ্যায় পুলিশের বড়কর্তা মিঃ স্টোন ও ইনসপেক্টর কেলসির সঙ্গে তিনি এক গোপন বৈঠকে বসেছিলেন। কাগজওয়ালারা যদি ব্যাপারটা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্চ না করে তাতে তো পুলিশেরই সুবিধা..চুপচাপ তদন্ত চালিয়ে যাওয়া যাবে।
পুলিশের প্রধান বলেন, সত্যিই আমি ভয়ানক দুঃখিত মিস বুলস্ট্রোড, বুঝি তো এই ঘটনা আপনার জন্য কতরকম সমস্যা নিয়ে আসতে পারে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, কোনো স্কুলে যদি খুন হয় সমস্যা আসবেই। তা নিয়ে ভেবে কি লাভ, আগেও আমরা বহু সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি, এটাও কাটিয়ে উঠবো।…আমি আশা করছি যে আপনারা শীঘ্রই এর একটা কিনারা করবেন।
পুলিশ সাহেব বললেন, স্কুলবাড়ি খানাতল্লাশি করতে কি আপনার আপত্তি আছে?
মিস বলুস্ট্রোড বললেন, কিছুমাত্র নয়, আপনারা বোধহয় অস্ত্রটা খুঁজছেন?
হা বিদেশী পিস্তল। আপনি কি জানেন আপনার কোনো কর্মী বা ছাত্রীর কাছে কি পিস্তল আছে?
না, অন্তত আমার জানা নেই, ছাত্রীদের কাছে যে নেই-ই সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কারণ তারা এলে তাদের জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে রাখা হয়। পিস্তল থাকলে তো কেউ না কেউ দেখতোই। তবে ইনসপেক্টর আপনি যা ভালো বোঝেন করুন। আপনার লোকজন তো মাঠে ময়দানে তল্লাশি শুরু করেই দিয়েছে।
হ্যাঁ, এখানকার প্রত্যেক কর্মীদের আমি জেরা করতে চাই, হয়তো এমন কেউ আছেন যিনি মিস স্প্রিঙ্গারের এমন কোনো উক্তি শুনেছেন যা আমাদের অনুসন্ধানে সাহায্য করতে পারে।
আমি ভাবছি আজ সন্ধ্যায় উপাসনার পর মেয়েদের সামনে ছোট্ট একটা ভাষণ রাখবে। তাদের কেউ যদি মিস স্প্রিঙ্গারের এমন কোনো কথা জানে যেন আমার কাছ এসে সেকথা বলে।
পুলিশের কর্তাটি বললেন, বাঃ সুন্দর পরিকল্পনা।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, কিন্তু মনে রাখবেন কোনো মেয়ে অতিরঞ্জিত করবেই। হয়তো কল্পিত ঘটনাই ফেঁদে বসবে যাতে নিজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। জানেন তো মেয়েরা বড়ো অদ্ভুত চরিত্র। আপনারা নিশ্চয়ই এধরনের অনেক প্রচেষ্টাই দেখেছেন।
খেলার ঘরে দেরাজগুলো খুঁজে দেখেছি স্যার।
কিছু পেলে?
আজ্ঞে না, তেমন কিছু না। কিছু মজার জিনিস দেখেছি বটে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন নয়। কোনোটা তালা বন্ধ ছিল?
না। ওগুলোর মধ্যে চাবি ছিলো। কিন্তু তালা বন্ধ ছিল না। ভেতরের কাজ বলে মনে হচ্ছে নাকি স্যার। ওই দুজন মাস্টারনী আর জীন মেয়েটি, যার কানে ব্যথা ছিলো, এরা ছাড়া সবাই তো বিছানায় শুয়ে নাকি ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু প্রমাণ কই। সাক্ষী কই? এমনকি মিস বুলস্ট্রোড নিজেও বাইরে আসতে পারেন। এইখানে মিস স্প্রিন্সারের সঙ্গে দেখা করে থাকতে পারেন অথবা এখানে আসতে পারেন। তারপর গুলি করা হয়ে গেলে হত্যাকারী অতি সহজেই ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে চুপিসারে পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হল্লা ওঠবার আগেই নিশ্চিন্তে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারে। তবে উদ্দেশ্য কী?
কেলসি ক্রীড়ামঞ্চ থেকে স্কুলবাড়ির দিকে হাঁটে। ব্রিগস তখনো একটা ফুলের জমি তৈরি করেছিলো, সে ইনসপেক্টরকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিগস বলে, হা, আজকালকার ছেলেছোকরারা কি জানে, বাগান করা চাড্ডিখানি কথা। তাদের কাছে বাগান করাও যেন আটটা পাঁচটার কাজ। কোনোদিন হয়তো কাজ দেখতেই পারবো না। আবার হয়তো ভোর সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। মোদ্দা কথা হল বাগানে যদি পরাণ ঢেলে না দেন, এর ব্যবহার দেখে খুশী না হন তো কিছু হবে না।
কেলসি বলে, এই বাগানটা নিয়ে তুমি অহঙ্কার করতে পার হে! এত ভালো বাগান আর দেখাই যায় না।
ব্রিগস বলে, তা ঠিক। আমার কপাল ভালো একটা শক্তসমর্থ জোয়ান আমার হাতে হাতে কাজ করে দেয়। তার নাম অ্যাডাম গুডম্যান।
ইনসপেক্টর বললো, কই তাকে দেখলাম না আমি।
আজ ছুটি চেয়ে নিয়েছে কাজকর্ম ঢিলে তাই।
কিন্তু ওর কথা আমাকে জানানো উচিত ছিল। এখানে যারা কাজ করে সেই তালিকাতে ওর নাম নেই।
ওঃ তাতে কী, কাল তো আবার দেখা পাবেন। যদিও মনে হয় না আপনাকে ও কিছু বলতে পারবে। এই পর্বের শুরুতে একজন শক্তসমর্থ যুবক নিজে এসে যেচে কাজটা নিয়েছে, কেলসির মনে সন্দেহ জাগে।
যথারীতি সেই সন্ধ্যাতে মেয়েরা উপাসনার জন্য হলঘরে এল। উপাসনা শেষ হয়ে গেলে মিস বুলস্ট্রোড হাত তুলে তাদের থামতে বললেন।
তোমাদের কটি কথা বলতে চাই। জানই তো কাল রাতে মিস প্রিন্সারকে গুলি করে ক্রীড়ামঞ্চে হত্যা করা হয়েছে। তোমাদের মধ্যে কেউ গত সপ্তাহে মিস প্রিঙ্গার সম্বন্ধে এমন কিছু শুনে থাক বা দেখে থাক বা তোমাদের অস্বাভাবিক ঠেকেছে, তাহলে আমি চাই যে, সেকথা তোমরা আমাকে এখন জানাও। আজ সন্ধ্যায় যে কোনো সময়ে আমার বসার ঘরে এসে কথাগুলো বলে যেতে পার।
আইলিন রীচকে ইনসপেক্টর বললেন আপনি মেডোব্যাঙ্কে কদিন আছেন?
বছর দেড়েক হল।
আগে কখনও গণ্ডগোল হয়নি।?
আইলিন রীচ চমকে ওঠে। কোথায়, মেডোব্যাঙ্কে! না না, এই পর্বের আগে পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো।
কেন? এই পর্বে কী হয়েছে, খুন হওয়ার কথাটা নিশ্চয়ই বলছেন না। আপনি অন্য কিছু বলতে চাইছেন?
তা কেন, না না, বোধহয় তাই কিন্তু গোটা ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে-বলুন বলুন
আইলিন বলে–ইদানীং মিস বুলস্ট্রোডের মনে সুখ নেই। এই হল একটা ব্যাপার, অবশ্য আপনি সেটা বুঝতেও পারবেন না। আর শুধু তিনি একলাই যে অসুখী তা নয়। আপনি নিশ্চয়ই অন্য কোনো সংবাদের প্রত্যাশায় আছেন, তাই না? আমি যা বলছি সেটা তো মানসিকতার কথা। আইলিন বললেন যে, তার মনে হচ্ছে একটা কিছু গোঁজামিল আছে। এখানে যেন আমাদের মধ্যে এমন একজন কেউ আছেন যার স্থান এখানে নয়। অনুভূতিটা কেমন জানেন যেন মনে হচ্ছে পাখির ঝাঁকে বেড়াল এসে লুকিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু বেড়ালটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
কিন্তু রীজ কথাটা যে ভীষণ অস্পষ্ট।
.
আশ্চর্য কাহিনী
মাদমোয়াজেল অ্যাঞ্জেল ব্লাশকে দেখে পঁয়ত্রিশ বছর মনে হয়, প্রসাধন ছিল না। ঘন বাদামী চুল পরিপাটি করা, মোটা খসখসে কোর্ট আর স্কার্ট পরে আছে। বেশ ঝাঁঝালো সুরে বললেন, যে স্কুলে খুন হয় সেখানে থাকা কি পোয়! তাছাড়া বাড়িটার কোথাও কোনো গুপ্ত সংকেত ঘণ্টা নেই।
এখানে তো আর তেমন দামী জিনিসপত্র থাকে না মাদমোয়াজেল ব্লাশ, যে চোর-টোর আসবে?
কোনো মেয়ের কাছে যদি কোনো দামী জিনিস থাকেও সেটাকেও সে ব্যায়ামঘরে রাখতে যাবে কেন?
কী করে জানলেন? তাদের প্রত্যেকের জন্য একেকটা তালাবন্ধ দেরাজ আছে সেখানে জানেন না?
সে তো শুধু খেলার সরঞ্জাম রাখবার জন্য। আইনত তাই বটে, কিন্তু খেলার বুটের মধ্যে তো কেননা জিনিস রাখতে পারে। অথবা পুলোভারে বা স্কার্ফেও তোত জড়িয়ে রাখতে পারে।
কী ধরনের জিনিস মাদমোয়াজেল? খুব আদুরে বাপেরাও তো মেয়েকে জড়োয়ার হার স্কুলে নিয়ে আসতে দেবে না?
ধরুন পোকার মতো দেখতে ছোটো একটা মণি বা এমন কোনো জিনিস, তার দাম প্রচুর। এখানকার একটি মেয়ের বাবা তো পুরাতাত্ত্বিক।
আমার তো সম্ভব বলে মনে হয় না–মাদমোয়াজেল। আমি তো শুধু একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছিলাম।
ইনসপেক্টর তাকে জিজ্ঞাসা করল, মিস প্রিন্সারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল?
না ভীষণ অভদ্র ব্যবহার বলে পারতপক্ষে কথা বলতাম না। হাড়সর্বস্ব চেহারা, দাগদাগ মুখ, রুক্ষ কর্কশ সুর, যেন ইংরেজ রমণীর ব্যঙ্গ চিত্র। আমার সঙ্গে প্রায়ই বিশ্রী ব্যবহার করত।
বিশ্রী ব্যবহার করবার কারণ?
তার ক্রীড়ামঞ্চে আমাকে আসতে দিতে চাইতো না। একদিন সেখানে গিয়ে ঘুরে দেখছি, কী সুন্দর ইমারত চমৎকার সাজানো গোছানো। মিস প্রিন্সার এসে আমাকে বলে, কী করছেন এখানে, আপনার তো এখানে কোনো কাজ নেই। যে কিনা স্কুলেরই আরেকজন শিক্ষিকা–কি ভেবেছিল কি?
অ্যাঞ্জেল ব্লাশ চলে যেতেই বন্ড বললো, অভিমানী, ফরাসিরা সকলেই অভিমানী।
কেলসি বলে, যাই হোক কিছু খবর তো জানা গেল। মিস স্প্রিঙ্গার চাইতেন না যে লোকে তার ব্যায়ামঘরে আসুক মানে ক্রীড়ামঞ্চে…কিন্তু কেন?
বন্ড বললেন, তিনি হয়তো মনে মনে ভাবতেন যে ফরাসিনী তাকে চোখে চোখে রাখছে।
কিন্তু তাই বা কেন, তার ওপরে যে গোয়েন্দাগিরি করেছে এই ভয়টা তো তখুনি জাগবে যখন অ্যাঞ্জেল ব্লাশ তার কোনো গোপনীয় তথ্য জেনে নেবার সম্ভাবনা থাকবে।
আর কে কে আছে?
দুজন নবীন শিক্ষিকা মিস ব্লেক ও মিস রোয়ান, আর মিস বুলস্ট্রোডের সেক্রেটারি। মিস ব্লেকের বয়স কম, গোলগাল চেহারা, সরল মুখ। উদ্ভিদতত্ত্ব ও পদার্থবিদ্যা পড়ায়।
বিশেষ কোনো খরবই দিতে পারল না। মিস রোয়ানের মনস্তত্ত্বের ডিগ্রি। কাজেই তার নানা অভিমত। খুব সম্ভব স্প্রিঙ্গার আত্মহত্যাই করেছেন।
কেলসি তো অবাক, সে কী! তার মনে সুখ ছিল না?
ভীষণ তীব্র স্বভাব ছিলো তার।
বুঝুন তাহলে ওটা তো মানসিক প্রতিরক্ষা। তার সম্বন্ধে এতক্ষণ যতটুকু জেনেছি তাতে তো মনে হয় তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন।
একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী নয় কি, তার অনেক কথা থেকেই আমার সন্দেহ প্রমাণিত হয়।
মিস বুলস্ট্রোড এসে বললেন, ইনসপেক্টর কেলসি, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
সত্যি? কিছু জানে বুঝি?
আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপনি নিজে কথা বলে দেখুন, মেয়েটি আমাদের বিদেশী ছাত্রীদের মধ্যে একজন। আমীর ইব্রাহিমের ভাইঝি, রাজকুমারী শাইস্তা। মনে মনে নিজেকে খুব বড়ো করে ভাবে, বুঝলেন তো?
মাঝারি গড়নের একটি কাল মেয়ে ঘরে ঢুকলো, শান্ত বাদামী চোখে তাকিয়ে বলে, আপনারা পুলিশ?
হ্যাঁ আমরা পুলিশ, বসো, বলো তো তুমি কী জান মিস স্প্রিঙ্গারের সম্বন্ধে।
হ্যাঁ বলবো আপনাকে।
বসে পড়ে সামনের দিকে ঝুঁকে–এই জায়গাটার ওপর লোকে নজর রেখেছে, তাদের দেখা যায় না বটে কিন্তু তারা আছে।
এই স্কুলের ওপর কেন নজর রাখবে?
আমার জন্য, আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে।
তোমাকে তারা চুরি করতে চায় কেন?
কেন, মুক্তিপণ আদায় করবে আমার আত্মীয়দের কাছ থেকে।
আঁ…ও আচ্ছা…আচ্ছা কিন্তু তার সঙ্গে মিস স্প্রিঙ্গারের মৃত্যুর কি সম্বন্ধ?
শাইস্তা বলে, তিনি হয়তো ওদের দেখে ফেলেছিলেন, তিনি হয়তো সব জানতে পেরেছিলেন বলে তাদের ভয় দেখিয়েছিলেন। তারা হয়তো টাকার লোভ দেখিয়েছিল। তিনি টাকা নিতে ক্রীড়ামঞ্চে গেলেন, ব্যস তখন ওরা তাকে গুলি করল।
নাঃ, মিস স্প্রিঙ্গার কখনও কি ঘুষ নিতে পারেন?
কেন? স্কুলের মাস্টারনী হয়ে থাকাটা কি খুব সুখের…তাও ব্যায়াম শেখানোর মাস্টারনী? তার চেয়ে যদি টাকা থাকে সেটা ভালো না।
তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথাটা তো তোমার নিছক কল্পনাও হতে পারে? ইনসপেক্টর বললো।
শাইস্তা রেগে ওঠে, আপনি কিছু জানেন না। আমার জ্যাঠতুতো দাদা হচ্ছে রামাতের রাজা শাহাজার্দা আলি ইউসুফ। তিনি বিপ্লবে মারা গেছেন। কথা ছিল আমি বড়ো হলে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। কাজেই বুঝেছেন তো আমার গুরুত্ব কতখানি। কমিউনিস্টরা ভীষণ ভীষণ পাজি। ওরা ভাবছে যে রত্নগুলো কোথায় আছে আমি জানি।
রত্ন…কিসের রত্ন?
আমার ওই দাদার কিছু রত্ন ছিলো তার বাবারও ছিল। আমাদের পরিবারে সবসময়েই বহু হীরা জহরৎ থাকতো, বিপদের জন্য–বুঝলেন? ওরা ভাবছে যে আমি জানি রত্নগুলো কোথায়, তাই ওরা আমাকে ধরে নিয়ে খবর আদায় করবে।
জানো নাকি রত্নগুলো কোথায়?
না বিপ্লবের সময় থেকে ওগুলো উধাও। হয়তো কমিউনিস্ট হতচ্ছাড়াগুলো নিয়েছে, আবার হয়তো নিতে পারেনি।
ওগুলো কার সম্পদ?
আমার জ্যাঠতুতো দাদার মৃত্যুর পর ওগুলো আমার হয়ে গেছে, তার বংশে তো আর কেউ নেই। আমার মাও মারা গেছে।
সেই ব্যবস্থাই ছিল বুঝি, বিয়ের পর ওই রত্নগুলো তোমার হতো? তুমি পেতে?
.
আলোচনা চক্র
ইনসপেক্টর কেলসি ফিরতেই থানার সার্জেন্ট জানালো অ্যাডাম গুডম্যানকে।
অ্যাডাম গুডম্যান ও…হা মালি। অ্যাডাম বললো, শুনলাম আমাকে ডেকেছেন, কর্কশ স্বরে বললো।
কেলসি বললো–হ্যাঁ, ঘরে এসো।
খুনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আমাকে কেন? আমি তো বাসায় রাতে ঘুমোচ্ছিলাম। অ্যাডাম বললো ইনসপেক্টরকে যে, সে এইটা দেখাতে চায়।
অ্যাডামের সেই বেপরোয়া ভাবও নেই। মুখ গোমড়ানিও নেই। শান্ত ধীর সশ্রদ্ধ ভাব, কী একটা পকেট থেকে বের করে দেয়, কেলসি সেটা দেখে মাথা তুলে বলে…বারবার তোমাকে এখন দরকার হবে না।
অবাক হয়ে বিচক্ষণ তরুণ পুলিশই উঠে চলে যায়। কেলসি বললো, এই তবে আপনার পরিচয়?
কিন্তু বলুন তো কোন কাজকর্ম আপনি এখানে—
তারপর অ্যাডাম বললেন ইনসপেক্টরকে যে, তিনি কী ব্যাপারে মেডোব্যাঙ্কে।
আমাদের ঠিক জানা নেই যে মেডোব্যাঙ্কে কি হচ্ছে। আমার কাজ পাহারাদারি বা কাল রাত পর্যন্ত তাই ছিলো। খেলার মাস্টারনী হত্যা? স্কুলের পাঠ্যতালিকায় পড়ে না।
অ্যাডামের কাহিনী কেলসি মন দিয়ে শোনে…ইনসপেক্টর বললো, ওই মেয়েটার ওপর অবিচারই করেছি। কিন্তু এই কাহিনী চট করে বিশ্বাস করা অসম্ভব। পাঁচ থেকে দশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের রত্ন? কার যেন জিনিসটা বললেন? বলা ভীষণ কঠিন। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনার বাঘা বাঘা উকিলের প্রয়োজন। তিনমাস আগে রত্নগুলোর মালিক ছিল রামাতের মহামান্য শাহজা আলি ইউসুফ। রামাতে যদি রত্নগুলো পৌঁছে যায় তার মালিকানা হবে সরকারের। হয়তো আলি ইউসুফ কোনো উইল করে গেছেন। সেই উইল কোথায় করা হয়েছে সেই প্রমাণের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।
কেলসি বললো, অর্থাৎ বলতে চান যে ওগুলো যারা পাবে তাদেরই হয়ে যাবে? না না, একথা ভালো নয়।
অ্যাডম গম্ভীর গলায় বলে, ভালো কথা তো নয়ই, তাছাড়া অনেকগুলো দলও সন্ধানে ঘুরছে। তারা কেউই সাধুসন্ত নয়। গুজবও হতে পারে, সত্যিও হতে পারে।
কিন্তু মেডোব্যাঙ্কে কেন?
এই ছোট্ট রাজকুমারীর জন্য, যার মুখে এখনো দুধের গন্ধ। রাজকুমারী শাইস্তা আলি ইউসুফের খুড়তুতো বোন। ই, কেউ হয়তো ওকে জিনিসগুলো পৌঁছে দেবার চেষ্টা করবে। আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক চরিত্রের আমদানী হয়েছে।
অ্যাডাম ধীরে ধীরে বললো, প্রিঙ্গার রাত দুপুরে ক্রীড়ামঞ্চে ছিল কেন? কে তাকে হত্যা করেছে। সে প্রশ্ন অবান্তর। যতক্ষণ না আমরা জানতে পারছি কেন সে এত রাতে ক্রীড়ামঞ্চে গিয়েছিলো, বলা যেতে পারে তার অমন নির্দোষ ব্যায়ামপুষ্ট জীবনেও অনিদ্রা রোগ জন্মেছিল। বিছানা থেকে উঠে জানলা দিয়ে ক্রীড়ামঞ্চে আলো জ্বলতে দেখতে পেলো-তার জানলাটাও ওই দিকেই তো। শক্তসমর্থ সাহসী স্ত্রীলোক তাই নিজেই গেল অনুসন্ধানে, তাতে হয়তো কেউ কাজে বাধা পেলো, কাজেই লোকটা এমন মরিয়া হয়ে উঠলো যে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতেও কসুর করলো না।
কেলসি মাথা নাড়ে, আমারও ওভাবেই দেখছি। কিন্তু আপনার শেষের কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। হত্যা করবার জন্য গুলিও ছোঁড়া হয় না বা সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে লোকে আসে না, যদি না..ক্রীড়ামঞ্চে কোন রাজার ধন আছে। কিছু লুকিয়ে রাখবার মতো জায়গাই তো ওটা নয়। ওখানে কিছু পাওয়া যায়নি।
অ্যাডাম বলে, হত্যাকারী সেটা তো রেখে যাবে না, নিয়েই যাবে। অবশ্য অন্য আরেকটা সম্ভাবনা রয়েছে এতে। ক্রীড়ামঞ্চটি হয়তো গোপন আড্ডার স্থান হিসেবেই মিস স্প্রিঙ্গার বা অন্য কেউ ব্যবহার করতো। ধরা যাক মিস স্প্রিঙ্গার ওখানে গিয়েছিলেন কারো সঙ্গে দেখা করতে।… মতের অমিল হতেই গুলি খেয়ে মরলো। অথবা মিস স্প্রিঙ্গার কাউকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে তার পিছু নেয়, এবং এমন কিছু দেখে বা শোনে যা তার পক্ষে অনুচিত।
কেলসি বললো, আমি অবশ্য জীবিত অবস্থায় মিস স্প্রিঙ্গারকে দেখিনি কিন্তু শুনে স্পষ্ট বুঝলাম যে, সব ব্যাপারেই তিনি নাক গলাতেন।
অ্যাডামও একমত। মনে হয় ভদ্রমহিলার মৃত্যুও হয়েছে ওই জন্য।অধিক কৌতূহলে মরিল সিংহ..ক্রীড়ামঞ্চেই নাটকের রঙ্গমঞ্চে।
অ্যাডাম জোরে মাথা নেড়ে বললেন যে, স্কুলেই কেউ আছে, যার ওপর মনোযোগ দিতে হবে, পাখির ঝাঁকে আছে একটা বিড়াল।
কেলসি কথাটা কানে যেতেই থ। আঁ? কী বললে, পাখীর ঝাঁকে বেড়াল? আজও এই কথাটা মিস রীচ বলেছে, স্কুলের একজন শিক্ষিকা। এই পর্বে তিনজন নতুন এসেছে। সেক্রেটারি স্যাপল্যান্ড, ফরাসি শিক্ষিকা ব্লাশ, আর মিস স্প্রিঙ্গার, তিনি তো মারাই গেছেন। পাখির ঝাঁকে বেড়াল যদি থাকেই তবে দুজনের মধ্যে একজনই বেড়াল, কোনজন? তোমার কোনো ধারণা আছে?
অ্যাডাম বলে, আমি একদিন মাদমোয়াজেল ব্লাশকে ক্রীড়ামঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম কেমন যেন দোষী দোষী ভাব নিয়ে। মিস বুলস্ট্রোডও আশ্চর্য নারী। এই ব্যাপারটা আমরা যত শীঘ্র নিষ্পত্তি করতে পারি ততই মঙ্গল। মেডোব্যাঙ্ককে আমরা আবার ঝকঝকে তকতকে করে তুলতে চাই।
আপনি যে কে সে কথাটা এবার মিস বুলস্ট্রোডকে জানানো উচিত। ভয় নেই। তিনি মুখ খুলবেন না।
অ্যাডাম মাথা নেড়ে বলে, ঘটনা যেরকম দাঁড়িয়েছে, তাতে তো বলতেই হবে, আর কোনো উপায় নেই।
.
চাই পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ
আরো একটি গুণ আছে মিস বুলস্ট্রোডের, তিনি চমৎকার শ্রোতা। এই গুণের জন্যই তাকে মহিলা শ্ৰেষ্ঠা বলা যেতে পারে।
অ্যাডামের কথাগুলো শুনে কেলসি বললো, অদ্ভুত! অ্যাডাম ভাবল, আপনিই তো অদ্ভুত! মূলকথায় এসে পৌঁছলেন, ই, তাহলে আমায় কী করতে হবে বলুন?
ইনসপেক্টর কেলসি বলে, দেখুন আমারা ভেবে দেখলাম আপনাকে সব কথা খুলে বলা উচিত…স্কুলের স্বার্থেই।
মিস বুলস্ট্রোড মাথা নেড়ে বললেন, স্বভাবতই স্কুলের স্বার্থই আমি প্রথমে দেখবো। আমার ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আমিই সম্পূর্ণ দায়ী। কর্মীদের জন্যও বটে তবে কম। কাজেই মিস ম্প্রিন্সারের মৃত্যুর প্রচার যত কম হয় ততই আমার পক্ষে ভালো। অবশ্য ওটা স্বার্থপরের মতো হল। অবশ্য এই ঘটনাটার পূর্ণ প্রচার যদি আপনাদের কাজের জন্য আবশ্যক হয় তবে তো করতেই হবে। কিন্তু তার কী দরকার আছে?
কেলসি বলে, না কম প্রচার হলে আমাদের পক্ষেও ভালো। আমরাও জানিয়ে দেবো মনে হচ্ছে ঘটনাটা স্থানীয় ব্যাপার, ছোকরা গুণ্ডার দল…যাকে আজকালকার ভাষায় শিশু অপরাধী বলা হয়…মিস স্প্রিঙ্গার হঠাৎ তাদের চমকে দেওয়ায় ওরা গুলি ছোঁড়ে।…আমি চাই এই ধরনের গল্পই চলুক, তাহলেই আমরা চুপচাপ তদন্ত করতে পারবো।
কেলসি বলে, মিসেস আপজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যত শিগগির সম্ভব, আপনজনের কাছে তার ঠিকানা আছে?
নিশ্চয়।…তবে শুনেছিলাম যে তিনি এখন বিদেশে। আচ্ছা দাঁড়ান এখুনি খোঁজ করছি।
ঘন্টি বোতামটা দুবার টিপে জুলিয়া আপনজনকে একটু পাঠিয়ে দিতে বললেন।
অ্যাডাম বললো, মেয়েটি আসার আগেই আমি কেটে পড়ি। ইনসপেক্টর তদন্ত করছেন, সেখানে আমার থাকাটা ঠিক নয়। ইনসপেক্টর এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন বকাবকি দেবার জন্য, এখন দেখছেন আমি কিছুই জানি না। অতএব চলে যেতে হুকুম দিলেন।
দরজায় টোকা শুনে মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ভেতরে এসো। ছুটতে ছুটতে আসার জন্য জুলিয়া আপজন হাঁপাচ্ছে।
এসো জুলিয়া।
কেলসি গর্জে উঠলো এখন তুমি যেতে পার, গুডম্যান। নিজের কাজ করগে।
জুলিয়া বললো, যে তাকে ডাকা হয়েছে? মিসেস বুলস্ট্রোড বললো, হ্যাঁ তোমার মায়ের ঠিকানাটা দাও। একটা চিঠি লিখতে হবে। জুলিয়া বললো, মা বিদেশে গেছে, ইসাবেল মাসিকে লিখুন। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তোমার মা ইনটেলিজেন্সে কাজ করতেন, তাই না? হ্যাঁ, মায়ের খুব ভালো লাগতো।
আচ্ছা জুলিয়া ধন্যবাদ। যেতে পারো এখন।
.
বিপর্যয়
স্কুল খোলর পর তৃতীয় সপ্তাহ শেষ। এই শনি-রবিবারেই ছাত্রীরা প্রথম তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে বাইরে বেরুবার অনুমতি পাবে। ফলে সপ্তাহ শেষে প্রায় খালি মেডোব্যাঙ্ক। রোববার দুপুরে খাবার জন্য মোট কুড়িজন মেয়ে কর্মীরাও অনেকে ছুটিতে গেছে। মিস বুলস্ট্রোড নিজেও সপ্তাহের শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মেডোব্যাঙ্কের প্রতিপত্তির দরুন মিস স্প্রিঙ্গারের হত্যাকাণ্ডটি পত্রপত্রিকায় বিশেষ আলোড়ন তুললো না। স্পষ্ট করে না বললেও এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হল যেন কজন মস্তান ছোকরা দরজা ভেঙ্গে ক্রীড়ামঞ্চে ঢুকেছিলো। মিস ম্প্রিন্সারের মৃত্যু হয়তো আকস্মিক ইচ্ছাকৃত নয়। পুলিশ কজন তরুণকে থানায় ডেকেছে পুলিশকে সাহায্য করতে।
..শনিবার সকালে মিস বুলস্ট্রোড.তার সেক্রেটারি অ্যান স্যাপল্যান্ড চিঠিপত্র লেখার কাজ সবে শেষ করেছে–টেলিফোন বাজতেই অ্যান ধরলো।
আমীর ইব্রাহিমের অনুচরের সঙ্গে মিস বুলস্ট্রোড কথা বললেন…রোববার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে শাইস্তা তৈরি থাকবে। রাত আটটার মধ্যে মেয়ে যেন ফিরে আসে। টেলিফোন রেখে বললেন, এই প্রাচ্য দেশের মানুষগুলো ঠিক একটুও সময় দিতে পারে না, কালই শাইস্তা যাবে গ্রিসেলদারের সঙ্গে, সব ঠিক হয়ে গেছে, এখন আবার বদলাও। অ্যান স্যাপল্যান্ডকে বললেন যে চ্যাডউইককে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা।
চ্যাডউইক হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, চ্যাডিকাল আমীর ইব্রাহিম শাইস্তার কাকা ওকে নিতে আসবেন, যদি তিনি নিজে আসেন তো বলে দিও মেয়েটি স্কুলে ভালোই পড়াশুনা করছে।
.
রবিবার সকাল, ঝকঝকে দিন। শনিবারে মিস বুলস্ট্রোড চলে গেছেন। স্কুলে রয়েছে শুধু মিস ভ্যান্সিটার্ট, মিস চ্যাডউইক, মিস রোয়ান আর মাদমোয়াজেল ব্লাশ। মিস ভ্যান্সিটার্ট ও চ্যাডউইক সব অভিভাবকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন আর তাদের মেয়েদের দিচ্ছেন।
সভাঘরে মিস ভ্যান্সিটার্ট ও মিস চ্যাডউইক বসেছিলেন। মিস রোয়ান ঘরে ঢুকেই বললো, শাইস্তা কোথায়, তাকে কোথাও পেলাম না, আমীরের গাড়ি এসেছে তাকে নিতে। চ্যাডি বললো, কী, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। আমীরের গাড়ি তো এসেছিল সেই বলল, প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ হল। আমি নিজে দেখেছি সেই গাড়িতে উঠতে।
ভ্যান্সিটার্ট বললে, হয়তো দু-দুবার করে গাড়িকে বলে দিয়েছে অমনি কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। নিজেই বাইরে গিয়ে শোফেয়ারকে বললো, দেখো গলতি হয়েছে কোথাও। পঁয়তাল্লিশ মিনিট হল মেয়েটি লন্ডনের পথে রওনা হয়ে গেছে। কখনো অমন ভুল হতে পারে না।
হামেশাই হয় এমন।
সাড়ে চারটের সময় টেলিফোন বাজতে চ্যাডি সাড়া দিল, মেডোব্যাঙ্ক স্কুল, মিস বুলস্ট্রোড আছেন? কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল বেশ উঁচু বংশের কোনো ইংরেজ পুরুষ।
মিস বুলস্ট্রোড আজ এখানে নেই, আমি মিস চ্যাডউইক বলছি।
দেখুন আপনাদের এক ছাত্রীর সম্পর্কে আমাদের কিছু বলবার আছে…আমি ক্রারিজ থেকে বলছি আমীর ইব্রাহিমের কামরা থেকে।
হা বলুন?…শাইস্তার সম্বন্ধে তো?
হ্যাঁ, আপনাদের কাছ থেকে আমরা এখনো কোনো খবর পাইনি, আমীর বেশ বিরক্ত হয়েছেন?
খবর? তাকে আমরা কি খবর দেবো?
কেন বলতে তো পারতেন, শাইস্তা এলো না বা আসতে পারলো না।
এলো না!..মানে আপনি কি বলতে চান যে সে এখনো পৌঁছায়নি? না আসেইনি এখানে, …মেডোব্যাঙ্ক থেকে রওনা হয়ে গিয়েছে, বলছেন!
হ্যাঁ, সকালেই তো একটা গাড়ি এসেছিল। প্রায় সাড়ে এগারোটায়, সেই গাড়িতেই তো গেল।
কী আশ্চর্য এখনও পর্যন্ত কোনো পাত্তা নেই।
মিস চ্যাডউইক বললো, কী কাণ্ড! দুর্ঘটনা না হলেই বাঁচি, না না না, খারাপ কেন ভাবছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এতক্ষণ খবর পেয়ে যেতেন। নইলে আমরাও তো পেতাম।
না…ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে। আচ্ছা…মানে…আমীরকে অবশ্য এখন কোনো সম্ভাবনার কথা বলবো না…তবু আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কোনো…ইয়ে মানে পুরুষ বন্ধু নেই তো? নাঃ থাকতেই পারে না।
দেখুন ওসব কথা মনেও স্থান দেবেন না, একেবারে অসম্ভব। টেলিফোন রেখে চ্যাডি ভাবলো সত্যি কি অসম্ভব? চ্যাডি বলে, মেয়েটি কিন্তু বলেছিল যে কেউ ওকে হরণ করতে চেষ্টা করবে।
.
মিস চ্যাডউকের ঘুম আসে না
বিছানায় শুয়ে মিস চ্যাডউইক এপাশ ওপাশ করছে ঘুম আসছে না।
আটটা যখন বেজে গেলো তখনও শাইস্তা ফিরলো না। কোনো খবরও পাওয়া গেল না। তখন মিস চ্যাডউইক আর শান্ত থাকতে পারলো না। নিজের হাতেই ব্যাপারটার ভার নিলো। ইনসপেক্টর কেলসিকে টেলিফোন করলো। ইনসপেক্টর বললো যে, মিস চ্যাডউইক যেন তার ওপরেই ব্যাপারটা ছেড়ে দেয়। যা কিছু করার তিনিই করবেন।
কেলসি বললো, দেখুন সবচেয়ে বেশি করে সে জিনিসটা আপনি বা বুলস্ট্রোড এড়িয়ে যেতে চান তা হল প্রচার। মনে হয় না মেয়েটিকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। অতএব ভাবনা করবেন না। আমার উপরেই ছেড়ে দিন।
চ্যাডির ঘুম আসছে না রাতে, খাট থেকে নেমে দুটো অ্যাসপিরিন মুখে ফেলে এক গেলাস জল খায়। ফিরে যেতে যেতে জানলার পর্দা সরিয়ে একনজর দেখে মনকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল, যে সারারাতে আর কখনো ক্রীড়ামঞ্চে আলো দেখা যাবে না।
কিন্তু দেখা গেলো।…চ্যাডি সঙ্গে সঙ্গে জুতোজোড়া পড়ে মোটা কোট গায়ে চরিয়ে টর্চ লাইটটা নিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। কাউকে ডাকবার কথাও মনে হল না। ক্রীড়ামঞ্চে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দেখতে হবে সে রাতের আগন্তুক কে। পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঝোঁপের রাস্তা দিয়ে প্রায় ছুটেই চলে, দুরুদুরু বুকে দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে হাঁটে। দরজা সামান্য ভেজানো ছিলো, ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে তাকালো।
.
হত্যার পর হত্যা
ইনসপেক্টর কেলসি ভীষণ গম্ভীর গলায় ঘরে ঢুকলো, আসুন আবার একটা।
এটা আবার কী? প্রশ্ন করে অ্যাডাম। আবার একটা হত্যা, ইনসপেক্টর কেলসি বলে, তার পিছু পিছু অ্যাডামও বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইনসপেক্টরকে প্রশ্ন করে অ্যাডাম–
আরেকজন শিক্ষার্থী…মিস ভ্যান্সিটার্ট। কোথায়? ক্রীড়ামঞ্চে।
আবার অ্যাডাম বললেন, কী আছে সেখানে। আপনি এবার জায়গাটার তল্লাশি নিন, ইনসপেক্টর কেলসি বলে, বলা যায় না আপনাদের কায়দা অনুসরণ করলে যদি কোনো ফল পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই ক্রীড়ামঞ্চে কিছু আছে নইলে ওখানেই হত্যার পর হত্যা হচ্ছে কেন? ডাক্তার হাঁটু গেড়ে শব পরীক্ষায় ব্যস্ত। ঘরে ঢুকতেই ডাক্তার উঠে দাঁড়ায়।
আধঘণ্টা হল মারা গেছেন। ডাক্তার বললো, বড়োজোর চল্লিশ মিনিট হবে। প্রথম কে দেখেছিল? কেলসি জিজ্ঞাসা করল। তার লোক বলে ওঠে, মিস চ্যাডউইক। কেলসি বললো, কি দিয়ে মারা হয়েছে? আবার গুলি কি?
ডাক্তার মাথা নেড়ে বলে, না, এবারে মারা হয়েছে মাথার পেছনে বালির বস্তা বা হান্টার জাতীয় কিছু একটা দিয়ে।
দরজার কাছে গলফের ডান্ডা পড়েছিল। একমাত্র এটাই ছিল।
ডাক্তার বলে, মৃতদেহে অস্ত্রের কোনো ছাপ পড়েনি। রবার মোড়া হান্টার বা বালির বস্তা হবে। খুনি নিঃশব্দে এসে মাথার পেছনে হেনেছে প্রচণ্ড আঘাত। উনি সামনে পড়ে গিয়েছিলেন, জানতেও পারেননি কিসের আঘাত লাগলো।
কি করেছিলেন তিনি? ডাক্তার বলে এই দেরাজটার সামনে হাঁটু গেড়ে ছিলেন। ইনসপেক্টর এগিয়ে গিয়ে সেটাকে দেখে। মেয়েটির নাম লেখা আছে নিশ্চয়ই। দেখি, হ্যাঁ, এই তো শাইস্তা…ওহো সেই মিশরীয় মেয়েটা। মহামাননীয় রাজকুমারী শাইস্তা। মিস ভ্যান্সিটার্টের উপর আজ স্কুলের দায়িত্ব ছিল। মিস বুলস্ট্রোড তো বাইরে গেছে।
ইনসপেক্টর বললেন, মিস চ্যাডউইকের সঙ্গে তাহলে দেখা করা যাক।
চ্যাডউইক তার ঘরে একটা চেয়ারে বসেছিলেন। রাতটা বেশ গরম তবুও তার ঘরে বিদ্যুঞল্পী জ্বলছে, হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। ইনসপেক্টর কেলসির দিকে বিবর্ণ মুখে তাকিয়ে, মরে গেছে..মরে গেছে না?
কেলসি মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে মিস চ্যাডউইককে বলে, কী ভয়ানক! মিস বুলস্ট্রোডও নেই, স্কুলটা শেষ হয়ে যাবে যে।…বলতে বলতে কেঁদে উঠলো।
সান্ত্বনার সুরে কেলসি বলে, আমার কথা আপনার মনে খুব আঘাত লেগেছে জানি, তবু আমার অনুরোধ সাহস ফিরিয়ে আনুন। মিস চ্যাডউইক আমাকে বলুন কী ঘটেছিল। আমরা যত শিগগিরি জানতে পারি কে অপরাধী ততই মঙ্গল, ততই কম প্রচার হবে এই সব অপকাণ্ডের।
চ্যাডউইক বললো, দেখুন আমি তাড়াতাড়ি শুতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে অন্তত একটি দিনের জন্যও অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোত পারি। কিন্তু ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, ঘুম এল না।
স্কুলের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা?
হ্যাঁ, শাইস্তার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপার। মিস স্প্রিঙ্গারের কথাও মনে হচ্ছিলো। ভাবছিলাম অভিভাবকদের আতঙ্কিত করে তুলবে। তারা কি আর পরের বারে তাদের মেয়েদের পাঠাবেন? তারপর অ্যাসপিরিন খেলাম, আবার শুতে আসবার সময় কেন জানি না পর্দা তুলে বাইরে তাকালাম। বোধহয় তখনো আমার মাথার মধ্যে মিস প্রিন্সারের চিন্তাই ঘুরছিল। আমি দেখলাম –এখানে তো আলো জ্বলছে।
কী রকম আলো?
আলোটা যেন নেচে নেচে উঠলো, টর্চের লাইটই হবে বোধহয়। আগেরবার মিস জনসন ও আমি যেরকম দেখেছিলাম।
হুবহু একই আলো কী?
হুঁ, সেইরকমই মনে হচ্ছে। বোধহয় একটু তেজ কম ছিলো, কী জানি ঠিক মনে নেই।
ওঃ তারপর?
হঠাৎ চ্যাডউইকের গলার স্বর তেজালো হয়ে উঠলো। তারপর আমি এবারে সংকল্প করেছিলাম দেখতেই হবে ওখানে কে, আর কি করছে। তাই আমি কোট আর জুতো পরে নিলাম। একছুটে বাইরে চলে গেলোম। কাউকে ডেকে নেবার কথা মনে হয়নি তখনও। এত তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়েছিলাম সে সব কথা মনেও হয়নি। ভেবেছি দেরি হয়ে গেলে হয়তো তাকে পাওয়াই যাবে না। দরজা পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাই দৌড়ে গিয়েছিলাম। তারপর পা টিপে টিপে কোনো আওয়াজ না করে ওখানে গিয়ে দেখতে পাই কে আছে, ওখানে কী করছে। দরজা ভেজানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল, এদিক ওদিক চোখ বোলাতে গিয়েই দেখি…ওকী উপুড় হয়ে পড়ে আছে,…মৃত…তার গা…শিউরে শিউরে উঠলো।
একটা কথা বলতে পারেন, ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসা করল, ওখানে একটা গলফের লাঠি দেখলাম, আপনি কি সেটা নিয়ে গেছেন? না–মিস ভ্যান্সিটার্ট?
চ্যাডউইক বললেন যে, তিনি নিয়ে গেছেন, যদি কোনো প্রয়োজন হয়।
৩. ক্রীড়ামঞ্চে ধাঁধা
মনে মনে অ্যাডাম বলে, মাথা দেবো তবু মাথা নোয়াবো না।
মিস বুলস্ট্রোডকে দেখে আশ্চর্য হলেন–এর আগে কোনো নারীকে এত বিস্ময়কর মনে হয়নি। ধীর স্থির মূর্তি অথচ চোখের সামনে তার সারা জীবনের কীর্তি চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। প্রায়ই টেলিফোন বাজছে, অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন…আরো একজন মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মিস বুলস্ট্রোড অবশেষে কর্তব্য নির্ধারণ করলেন। পুলিশ অফিসারদের কাছে মাপ চেয়ে নিয়ে তিনি অ্যান স্যাপল্যান্ডকে ডেকে একটা ছোট্ট ঘোষণা লেখালেন, এই পর্বের শেষপর্যন্ত স্কুল বন্ধ রইল। যাদের পক্ষে মেয়েদের এখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা আছে তারা ইচ্ছে করলে মেয়েদের এখানে রাখতে পারেন, স্কুল থেকে তাদের দেখাশোনা করা হবে।
দরজা দিয়ে বেরুতে গিয়ে অ্যান থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ক্ষমা করবেন মিস বুলস্ট্রোড। একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন…এখুনি কি এরকম একটা কিছু করা ঠিক? মানে…আতঙ্ক একটু কমে গেলে লোকে যখন বিবেচনা করে দেখবে…তখন নিশ্চয়ই মেয়েদের নিয়ে যেতে চাইবে না। জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে তারা বুঝতে পারবে।
কেলসির দিকে তাকিয়ে, এখন সবই আপনার উপর নির্ভর করছে ইনসপেক্টর। হত্যাকাণ্ড গুলির সমাধান করুন…যারা এসবের জন্য দায়ী, তাদের ধরুন…আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
কেলসি অখুশি মনে বললো, আমরা যথাসাধ্য করছি।
টেলিফোন বাজতেই মিস বুলস্ট্রোড রিসিভার তুলে নেন, বলুন? ইনসপেক্টরকে ইশারায় ডেকে বললেন, আপনার ফোন।
টেলিফোন না রেখে একমুহূর্ত চিন্তা করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে–মহামান্য আমীর আজ সকালে একটা চিঠি পেয়েছেন, মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছে তার কাছে। পোর্টমাউথ ডাকঘরের মোহর, তবে ওটা ধোঁকা।
অ্যাডাম বলে, কোথায় কীভাবে টাকাটা দিতে হবে?
অ্যাণ্ডারটন প্রীয়র্সের দুমাইল উত্তরে চৌরাস্তা, চারিদিকে শুধু ধুধু মাঠ। কাল রাত দুটোয় ঐ চৌরাস্তায় অটোমোবাইলের অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাক্সের পাশেই টাকাটা একটা খামে পুরে রেখে দিতে হবে, পাথর চাপা দিয়ে।
কত?
কেলসি বলে, বিশ হাজার, মনে হচ্ছে আনাড়ি লোকের কাজ। মিস বুলস্ট্রোড বলেন, আপনি কী করবেন?
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, সফল হবেন আশাকরি।
অ্যাডাম বলে ওঠে, সহজ কাজ?
.
অ্যাডাম ক্রীড়ামঞ্চে একা..নিপুণ হাতে দেরাজগুলো আঁতিপাঁতি করে খোঁজে। বৃথা আশা কিছুই পাওয়া যাবে না। যেখানে পুলিশে কিছু পেলো না, সেখানে সে আর কী পাবে? তবু বলা কী যায় একেকটা বিভাগের একেক রকম পদ্ধতি। এখানেই কিছু লুকানো আছে। বারবার তারই খোঁজে হত্যাকারী আসে। গুপ্তধন নিশ্চয়ই নেই, সে সম্ভাবনা কেটেই দেওয়া আছে। কোনো চোরকুঠুরী বা ভুয়ো দেরাজ কি স্প্রিং দেওয়া হাতল-টাতলও নেই। দেরাজগুলোতেও কোনো রহস্য নেই। কিন্তু সেগুলো নেহাতই স্কুল জীবনের গোপনীয়তা, সুদর্শন নায়কদের ফটো। কদাচিৎ এক-আধটা অশ্লীল চটি বই। শাইস্তার দেরাজটা আবার খুঁজে খুঁজে দেখে। এটার ওপর ঝুঁকে পড়া অবস্থাতেই তো মিস ভ্যান্সিটার্ট মারা গেছে? কি দেখতে এসেছিলো মিস ভ্যান্সিটার্ট? পেয়েছিল সেটা? তার হত্যাকারী কি তার দেরাজ থেকে সেটা নিয়ে মিস চ্যাডউইক আসার আগেই সরে পড়েছে?
বাইরে যেন কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উঠে সিগারেট ধরিয়ে অ্যাডাম মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। দরজার সামনে জুলিয়া আপজনকে দেখা গেলো।
অ্যাডাম বলে, মিস কিছু চাই আপনার? ভাবছিলাম আমার টেনিস র্যাকেটটা যদি এখান থেকে নিয়ে যাই।
অ্যাডাম বললো, নিয়ে যেতে পারবে না কেন?…পুলিশ কনস্টেবল আমাকে এখানে বসিয়ে গেলো থানায়, যেতে হলো কিনা কী একটা কাজ, বলে গেলেন ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি যেন এখানে থাকি।
জুলিয়া বলে, দেখতে যদি আবার ফিরে আসে।
কে? পুলিশ কনস্টেবল?
না হত্যাকারী, ওরা ফিরে আসে, তাই না? যে জায়গাটায় হত্যা করে, আসতেই হবে। ওরা যে আসতে বাধ্য হয়।
অ্যাডাম বললো, বোধহয় ঠিকই বলেছেন। সবকটা র্যাকেটগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় আছে আপনারটা। জুলিয়া জানালো, এই সারিতে। ওই কোণায় শেষের দিকে, আমাদের নাম লেখা আছে। অ্যাডাম র্যাকেট যখন দিল তখন তার নাম সাঁটা ফলকটা তাকে দেখিয়ে বোঝায় জুলিয়া।
টেনিসে জুলিয়ার সামনের হাতের মারটা জেনিয়া ফিরিয়ে দিলো না, বল ওদিকেই রয়ে গেলো, কেন না, ততক্ষণে জেনিয়ার চোখে পড়েছে, চেঁচিয়ে বললো ও মা, মা আসছে যে।
ওদিকে দুজনেই চেয়ে দেখে মিসেস সাটক্লিফ বেশ উত্তেজিত, তা দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে। মিস রীচ তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে।
জেনিয়ারের হতাশ ভঙ্গী, এই রে এক্ষুনি শুরু হবে। ওই খুনের ব্যাপারটাই বোধহয়। তোমার ভাগ্য ভালো জুলিয়া তোমার মা তো নিরাপদে বাসে চড়ে ককেশাস।
কেন ইসাবেল মাসি তো আছে?
ধ্যাৎ মা আর মাসী এক হলো।
মিসেস সাটক্লিফ এসে পৌঁছতেই জেনিয়া বলে উঠলো, এই যে মামনি।
জেনিয়া শিগগিরি চলে আসো, জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাও। আমার সঙ্গে বাড়ি চলল।
বাড়িতে? হ্যাঁ।
একেবারে; আর আসব না?
বারে তা কী করে হয়।…এখানে আমার টেনিস খেলায় কত উন্নতি হয়েছে। সিঙ্গলসে আমি জিতবোই। ভীষণ সম্ভাবনা। জুলিয়া আর আমি হয়তো ডাবলসেও জিতবো, অবশ্য ততটা আশা করছি না আমি।
তুমি আজ আমার সঙ্গে বাড়ি আসছো কেন?
প্রশ্ন করো না।
মিস স্প্রিঙ্গার আর ভ্যান্সিটার্ট খুন হয়েছে বলে, কিন্তু কোনো মেয়ে তো খুন হয়নি।
আমি জানি মেয়েদের কেউ খুনটুন করবে না। তাছাড়া তিন সপ্তাহের মধ্যে খেলার প্রতিযোগিতা আসছে। লংজাম্পে আমার জেতার আশা আছে।
তর্ক করো না জেনিয়া, তুমি আজ আমার সঙ্গে ফিরে যাবে, তোমার বাবা বলে দিয়েছেন।
কিন্তু মা,
মায়ের সঙ্গে প্রবল তর্ক জুড়ে দেয়, তর্ক করতে করতে তার সঙ্গে স্কুলবাড়ির দিকে চলে গেলো। হঠাৎ জেনিয়া একদৌড়ে টেনিস মাঠে ছুটে এলো।
বিদায় জুলিয়া। মা দেখছি ভয়ে একেবারে সিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাবাও তাই।
জুলিয়া আস্তে আস্তে ক্রীড়ামঞ্চের দিকে হাঁটতে থাকে। ক্রমশ বলতে বলতে একেবারেই থেমে যায়। দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবে…গভীর চিন্তা।
মধ্যাহ্নভোজের ঘণ্টা বাজলো তবু জুলিয়ার হুঁশ নেই। হাতের র্যাকেটটাকে একদৃষ্টিতে দেখে। রাস্তা দিয়ে দু-এক পা এগোয়। তারপরে একপাক ঘুরে স্কুলবাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। এবারে পদক্ষেপ দৃঢ় সুনিশ্চিত, সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা নিষেধ তবু সে নিষেধ না মেনে সামনের দরজা দিয়ে ঢোকে। যাতে অন্য মেয়েদের এড়ানো যেতে পারে। হলঘর শূন্য সিঁড়ি দিয়ে চলে আসে নিজের ছোটো শোবার ঘরটায়। চকিতে চারিদিকে ভালো করে দেখে চট্ করে হাতের র্যাকেটটাকে বিছানার গদির নিচে শুইয়ে দেয় তারপর চুল ঠিক করে নিয়ে গম্ভীরভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে খাবার ঘরে চলে যায়।
.
আলাদীনের গুহা
সেই রাত্রে মেয়েরা শুতে চলে গেলো। হৈ-হট্টগোল অনেক কম। তিরিশ জনের মতন তো বাড়িতে চলে গেছে। যারা রয়ে গেছে তাদের উপর ঘটনার প্রভাব যথেষ্ট। যার যেমন স্বভাব, সেইরকম প্রতিক্রিয়া করে।
কেউ উত্তেজিত, কেউ ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, কেউ হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে বাইরে সেটা প্রকাশ না করে কেবল খিলখিল করে হাসছে। অনেকে আবার একেবারেই চুপ হয়ে ভাবছে। সবাই নিজের নিজের ঘরে শুতে গেলো। জুলিয়াও তাদের মধ্যে ছিলো, ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, কান পেতে শোনে দরজার বাইরে কত ফিসফিস কথা। খিলখিল হাসি, পায়ের শব্দ, রাতের শুভেচ্ছা, তারপরেই সব চুপ হয়ে গেলো, প্রায় নিস্তব্ধ। দূরেই শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে আর কখনো কখনো স্নান ঘর থেকে আসা-যাওয়ার পায়ের আওয়াজ।
দরজায় একটা হুড়কো নেই। একটা চেয়ার দিয়ে দরজার সঙ্গে এমনভাবে রাখলো যাতে চেয়ারের মাথাটা দরজার হাতলের ঠিক নিচে শক্ত হয়ে এঁটে থাকে, কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে…যাতে টের পাওয়া যায়, কিন্তু কারো আসার সম্ভাবনা খুবই কম কারণ মেয়েদের একে অন্যের ঘরে যাওয়া কড়া নিষেধ। মাস্টারনীদের মধ্যেও শুধু মিস জনসনই আসতেন–যখন কারো অসুখ হত। শরীর খারাপ হত।
তোশকের তলায় হাত বাড়িয়ে জুলিয়া টেনিস র্যাকেটটা বের করে এনে সেটা হাতে নিয়ে একমিনিট দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ঠিক করলো, এখুনি ওটাকে দেখতে হবে, সব ঘরে যখন আলো নিভে যাবে তখন তার ঘরে যদি আলো দেখা যায়। তবে সন্দেহ জাগতে পারে। ঘরে সাড়ে দশটা পর্যন্ত আলো জ্বলতে পারে। কাজেই এখুনি দেখা যাক। মেয়েরা এই সময়টাতে পোশাক-টোশাক বদলায় আবার বিছানায় শুয়ে বই পড়ে।
র্যাকেটটাকে খুঁটিয়ে দেখে ভালোভাবে। এর মধ্যে কী লুকোনো থাকতে পারে।
কিন্তু থাকতেই হবে যে। থাকতে বাধ্য। জেনিয়াদের বাড়িতে চুরি হল…ওই মেয়েছেলেটা এসে একটা আজেবাজে গল্প ছুঁড়লো নতুন র্যাকেট নিয়ে…।
…জেনিয়া ছাড়া আর কেউ অমন গল্প বিশ্বাস করে। নাঃ এ নিশ্চয়ই পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ। তার মানে আলাদীনের কাহিনীর মতো এই র্যাকেটটাতে কিছু আছে। জেনিয়া বা জুলিয়া কেউই র্যাকেট বদলাবদলি করে নেবার কথা কাউকে বলেনি। অন্তত, ও তাই বলে। তবে কি এই র্যাকেটটাকেই ক্রীড়ামঞ্চে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কেন? কারণটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সুন্দর র্যাকেট অনেক, ব্যবহারে জীর্ণ কিন্তু নতুন করে বেঁধে নেওয়ায় এখনো বেশ ব্যবহারযোগ্য। জেনিয়া কিন্তু বলতো এটার নাকি ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
টেনিস র্যাকেটে যদি কিছু লুকিয়ে রাখতে হয় তাহলে হাতলটাতে ছাড়া অন্য কোনো জায়গা নেই। হাতলের গোড়া অবশ্য জুড়ে দেওয়া থাকে। ওটা খুললে কেমন হয়।
কাজের টেবিলে বসে জুলিয়া একটা পেনসিল ছুরি নিয়ে খুলতে চেষ্টা করে, চামড়াটা কেটে একটানে খোলে। ভেতরে পাতলা কাঠের গোল মতন কী একটা বেরোয়। হাতলের ভেতরে থাকে নাকি অমন? মনে তো হয় না, তার চারপাশটায় আবার জোড়া। ছুরি বিধিয়ে দেয় জুলিয়া। ফলাটা মট করে ভেঙ্গে যায়।
নখ কাটার কাঁচি দিয়ে কিন্তু কাজ হয়। অনেক ধস্তাধস্তি করে ফল হয়। লাল-লাল নীল-নীল একটা পদার্থ দেখা গেল। জুলিয়া ওটাকে খোঁচাতেই বুঝতে পারে জিনিসটা কী, পুতুল গড়ার আঠালো মাটি। টেনিস র্যাকেটের হাতলে এমন মাটি। নখকাটার কাঁচি দিয়ে কাচিয়ে এই মাটি তুলে আনে। ওগুলো দিয়ে বোধহয় কোনো একটা জিনিস মোড়া আছে। মনে হল বোতামের মতো কিছু নুড়িও হতে পারে।
আরো জোরে জোরে পুতুল-মাটি তুলে আনে। টেবিলে গড়িয়ে পড়লো একটা জিনিস…তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে ছোট্ট একটা সুপ হয়ে গেলো।
জুলিয়া জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
তরল আগুন, লাল সবুজ, ঘন নীল, ঝকঝকে সাদা।
জুলিয়া সেই মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে গেল। ছোটো মেয়েটি আর রইলো না। নারীত্ব বিকশিত হল, রত্ন দেখছে এক নারী…মাথায় রাশি রাশি চিন্তা খেলে গেল। আলাদীনের গুহা…কালো ভেলভেটের গাউন পরে আছে সে, গলায় দুলছে চোখ ধাঁধানো হীরের হার। বসে বসে স্বপ্ন দেখে, চকচক চোখ মেলে দেখে। আঙুলে তুলে রত্নগুলো দেখে ছেড়ে দিতেই আগুনের নদী হয়ে ওগুলো পড়ে যায়..বিস্ময় ও আনন্দের উজ্জ্বল ঝর্না। তারপর সে বেসিনের কাছে যায়। তার স্পঞ্জ ব্যাগের মধ্যে সেগুলো ঠুসে তার ওপর স্পঞ্জ আর নখের ব্রাশ ভরে দেয়। বিছানার কাছে ফিরে এসে টেনিস র্যাকেটের ভেতরে পট্টিটাকে ভরে দিয়ে কাঠের মাথাটা আবার এঁটে দেয়। চামড়াটাকে তার ওপরে জোড়বার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা ওপর দিকে বেঁকে ওঠে। ওটাকে ঠিক করবার জন্য কাঠের গোল চাকতির ওপর উল্টো করে সরু সরু আঠালো টেপ রেখে তার ওপর চামড়াটাকে চেপে ধরে।
র্যাকেটটাকে এখন প্রায় আগের মতোই দেখতে লাগে। হাতে নিয়ে ওজনের তারতম্য বোঝা যায় না। র্যাকেটটাকে নেড়ে চেড়ে দেখে, একটা চেয়ারের ওপর অযত্নে ফেলে রাখে।
সুন্দর পাতা বিছানার দিকে দেখে, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। জুলিয়া কিন্তু পোশাক ছাড়লো না।
কান পেতে শোনে…বাইরে কি? হঠাৎ ভীষণ ভয় হলো, দুজন খুন হয়ে গেছে। যদি কেউ জানতে পারে তাহলে সেও খুন হয়ে যাবে…
ঘরের মধ্যে কাঠের বেশ ভারি একটা দেরাজ আলমারি আছে। জুলিয়া সেটাকে কোনমতে টানতে টানতে দরজার সামনে নিয়ে আসে। মেডোব্যাঙ্কের কী রীতি, মেয়েদের ঘরের ভেতর থেকে তালা দেবার ব্যবস্থাই নেই। জানালার কাছে গিয়ে ওপরের পাল্লা টেনে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগায়, তার জানালার কাছে অবশ্য কোনো গাছ নেই, তাই তার ঘরে ঢোকা সম্ভব নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
টেবিলের ঘড়িতে দেখলো দশটা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে দিলো, তার ঘরে যেন অস্বাভাবিক কিছু না দেখা যায়, জানালা থেকে পর্দাটা সামান্য একটু সরিয়ে দিল। চুপ করে খাটের একপাশে জুলিয়া বসে থাকে। হাতে ধরে রেখেছে খুব শক্ত একপাটি বুট।
ভাবতে থাকে যদি কেউ ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে, আমি এই দেওয়ালে এত জোরে বুটটা ঠুকে দেব যে পাশের ঘরের মেরী কিং জেগে যাবে। ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠবো। তারপর যদি অনেক লোক এসে জড়ো হয় বলবো দুঃস্বপ্ন দেখা কিছু অসম্ভব নয়, কেউই কিছুই ভাববে না।
অনেকক্ষণ বসার পর শুনলো…প্যাসেজে মৃদু পায়ের শব্দ, ঘরের সামনে এসে শব্দটা থামলো…ও শুনতে পেলো। তারপর দেখলো দরজা খোলার হাতলটা আস্তে আস্তে কে ঘোরাচ্ছে। চিৎকার করবে? না এখন নয়। দরজাটাকে ঠেললো–সামান্য একটু ঠেলা। কিন্তু দেরাজ আলমারিতে ঠেকে গেলো। এতে নিশ্চয়ই বাইরের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। আবার বিরতি, তারপর একটা ছোট্ট মৃদু টোকা পড়ল দরজার ওপরে।
জুলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। আবার টোকা–কিন্তু এবারও খুব আস্তে নরম হাতে। জুলিয়া নিজের মনে ভাবে আমি এখন ঘুমোচ্ছি, আমি কিছু শুনিনি।
জুলিয়া অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলো। আর টোকা পড়লো না বা হাতটাও ঘোরালো না। কিন্তু জুলিয়া অত্যন্ত সজাগ হয়ে বসে রইলো।
এরকম ভাবে বসে থাকতে থাকতে জানতেও পারলো না কখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে পড়েছে। স্কুলের ঘণ্টাই তাকে জানিয়ে দেয়। কোঁচকানো বিছানায় এক কোণে কোনোরকমে কষ্টেসৃষ্টে সে শুয়েছিলো।
প্রাতঃরাশের পর মেয়েরা ঘরে গিয়ে বিছানা গুছিয়ে রাখলো। তারপর বড়ো হলঘরে প্রার্থনার জন্য সমবেত হল। প্রার্থনার পরে যে যার ক্লাসে চলে গেলো।
যখন সবাই নিজের নিজের ক্লাসে যেতে ব্যস্ত জুলিয়া একটা ক্লাস ঘরের মধ্যে ঢুকে ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেয়েদের একটা দল দালানের দিকে বেশ তাড়াতাড়ি হেঁটে আসছিল তাদের সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়াও ওপাশটা দিয়ে এগুতে থাকে। একটা রডোডেনড্রন গাছের পেছনে হঠাৎ লুকিয়ে পড়ে। এদিক-ওদিক দিয়ে লাফ-টাফ মেরে অবশেষে বাইরের দেওয়ালের কাছে এসে পৌঁছায়। সেখানটায় একটা বাতাবিলেবু গাছের ঘন ঝোঁপ। যার ডালপালা প্রায় মাটি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুলিয়া গাছে চড়তে ওস্তাদ। গাছে উঠে অনেকক্ষণ ঘন পাতার আড়ালে গুটি মেরে বসে রইলো। হাতের ঘড়িটার দিকে বার বার দেখে। ঠিক জানতে কিছুক্ষণের জন্য কেউ অন্তত তার খোঁজ করবে না, আজ স্কুলের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। দুজন শিক্ষিকা নিহত, অর্ধেকের বেশি মেয়ে বাড়ি চলে গেছে।
সরসর করে গাছ থেকে দেওয়ালের মাথা পর্যন্ত নেমে আসে। অনায়াসে দেওয়াল ডিঙিয়ে ওধারে লাফ দেয়, শখানেক গজ দূরেই বাসস্টপ। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস আসবে…এলোও তাই। জুলিয়া হাত দেখিয়ে বাসে চড়লো। সুতি ফ্রকের নিচে একটা ফ্লেট-হ্যাট নিয়ে এসেছিল, অগোছালো চুলের ওপর টুপিটা পরে নিল। স্টেশনে নেমে জুলিয়া লন্ডনের ট্রেনে চড়লো।
আসবার আগে জুলিয়া ওর ঘরে বেসিনের ওপর বুলস্ট্রোডের নামে চিঠি লিখে রেখে এসেছিল।
শ্রদ্ধেয় মিস বুলস্ট্রোড,
আমি পালিয়েও যাইনি বা আমাকে কেউ চুরি করে নিয়েও যায়নি। অতএব চিন্তা করবেন না। যতশীঘ্র সম্ভব আমি ফিরে আসবো।
আপনার পরম বিশ্বস্ত ছাত্রী
জুলিয়া আপজন
আটশো নম্বর হোয়াইট হাউস ম্যানসনের দরজা খুলে দিলো। এরকুল পোয়ারোর নিজের খানসামা ও চাপরাশি জর্জ খুলেই অবাক, ময়লা মুখ নিয়ে নেহাতই একটি স্কুলের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিঃ এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে পারি? জর্জের জবাব দিতে একটু দেরিই হয়। এখন একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী–বিশ্বাসই হয় না।
মিঃ পোয়ারো আগে থাকতে খবর না দেওয়া থাকলে কারোর সঙ্গে দেখা করেন না।
অত সময় আমার নেই, এখুনি তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। ভীষণ জরুরী কয়েকটা হত্যা, একটা ডাকাতি। এইরকম আরো কিছু ব্যাপার।
জর্জ বলে, আচ্ছা জিজ্ঞাসা করে আসি, মিঃ পোয়ারো আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা। মেয়েটিকে হলঘরে রেখে ভেতরে গেলো সে মনিবকে শুধাতে।
স্যার আপনার সঙ্গে অল্পবয়সী মহিলা এখুনি দেখা করতে চান।
হু, তা তো চান। কিন্তু চাইলেই কি আর অত সহজে হয়।
সে কথা তো আমি ওকে বললাম।
কি ধরনের মহিলা?
মানে বাচ্চা মেয়ে স্যার।
কি বলতে চায়?
তিনি আপনার সঙ্গে কয়েকটি হত্যা ও একটি ডাকাতির সম্বন্ধে আলোচনা করতে চান। পোয়ায়োর ভ্রূ-গুলো এবারে উর্ধ্বে উঠে যায়।
কয়েকটা হত্যা এবং একটা ডাকাতি, বল কি হে! যাও যাও ভেতরে নিয়ে এসে বাচ্চা মেয়েটিকে।
জুলিয়া ঘরে এসে ঢুকলো, বেশ মার্জিত-স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। নমস্কার মিঃ পোয়ারো, আমার নাম জুলিয়া আপজন। শুনেছি আপনি আমার মায়ের একজন বিশেষ বন্ধুকে চেনেন। তার নাম মিসেস সামারহেইস। গতবছর গরমের ছুটিতে ওর বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম। তখন উনি আপনার কথা বলেছিলেন।
মিসেস সামারহেইস, পোয়ারো মানসচক্ষে দেখতে পেলেন, পাহাড়ের ওপরে একটা গ্রাম আর সেই পাহাড়ের চূড়ায় একটা বাড়ি…দাগভরা একটু মধুর মুখ…ভাঙাভাঙা স্প্রিংয়ের সোফা, বহু কুকুর…ভালোয়-মন্দয় মেশানো কত টুকরো টুকরো ছবি।
আমি তাকে মরিন মাসি বলি, মাসি হয় না অবশ্য। উনিই তো আমাদের গল্প করেছিলেন আপনি কি চমৎকার লোক! মিছিমিছি হত্যার অপরাধে একটি লোকের জেল হয়ে গিয়েছিলো, আপনি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, তাইতো আমি যখন বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত, কার কাছে যাওয়া উচিত, আপনার কথাই মনে এলো।
পোয়ারো গম্ভীর সুরে বললেন, আমি সম্মানিত বোধ করছি, ধন্যবাদ। মেয়েটিকে একটা চেয়ার দিলেন বসতে–আচ্ছা শুরু করে দেখি তোমার কাহিনী। আমার চাপরাশি জর্জ বললো, তুমি নাকি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাও একটা ডাকাতি আর কয়েকটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে; তাহলে কি একটার বেশি হত্যা?
জুলিয়া বলে, হ্যাঁ মিস স্প্রিঙ্গার ও মিস ভ্যান্সিটার্ট তার ওপরে বালিকা হরণও আছে–অবশ্য মনে করি না যে ওটা আমার ব্যাপার।
আশ্চর্য, তুমি যে আমাদের একেবারে হতবাক করে দিলে! তা এইসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো কোথায়।
আমার স্কুলে মেডোব্যাঙ্কে।
মেডোব্যাঙ্কে? পোয়ারো যেন এবারে বুঝতে পারলেন। সযত্নে রাখা খবরের কাগজ থেকে একটা তুলে নিলেন। ভাঁজ খুলে সামনের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে বুলাতে মাথা নাড়লেন।
পোয়ারো বললেন, এতক্ষণ বুঝতে পেরেছি, বল দেখি প্রথম থেকে, জুলিয়া।
-গতরাতে আমার শোবার ঘরে র্যাকেট পরীক্ষা করা পর্যন্ত প্রথম বলে থেমে, বুঝলেন, আমি ভেবেছিলাম যে ঠিক আলাদিনের গল্প.পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ, কাজেই টেনিস র্যাকেটেই নিশ্চয় কিছু আছে।
ছিলো? হ্যাঁ!
মিথ্যা লজ্জা করার মেয়ে নয় জুলিয়া, স্কার্ট তুলে প্রায় উরু পর্যন্ত ইজেরটাকে গুটিয়ে নিলো, দেখা গেলো আঠালো ফিতে দিয়ে হাঁটুর খানিকটা ওপরে ছাই রঙের পুলটিশ লাগানো আছে। আঠালো ফিতেগুলো টান দিয়ে খুলতে গিয়ে ব্যথায় উঃ আঃ করে ওঠে। পুলটিশটা খুলে নিতে পোয়ারো দেখলো ওটা একটা মোড়ক। ছাই রঙের প্লাস্টিকের স্পঞ্জ ব্যাগের মধ্যে ভরে রাখা মোড়কটা খুলে, কোনো কিছু না জানিয়েই, একগাদা ঝলমলে পাথর হঠাৎ টেবিলের ওপর ঢেলে দিলো।
পোয়ারো হতচকিত গলা দিয়ে স্বর ফুটলো না–আঁ একি..একি, কি না কি নাম।
তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেন। নাম বলো…নাম বলো সত্যিকারের। জুলিয়া মাথা নেড়ে-হতেই হবে, নইলে কি আর কেউ খুন করে? এগুলোর জন্য মানুষ খুন করা..বোঝা যায়? আবার হঠাৎ গতরাতের মতো শিশু চোখে ফুটে উঠলো নারীর ছবি।
তীক্ষ দৃষ্টিতে ওকে দেখে পোয়ারো ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ বুঝেছো দেখছি…যাদুর মায়া তোমাকে পেয়েছে।…শুধু রঙীন খেলনা নয়…এগুলো তোমার কাছে সেটাই তো কথা।
আবেশে জুলিয়া বলে, ওগুলো যে রত্ন।
বলছে যে তুমি এগুলো একটা টেনিস র্যাকেটের ভেতর পেয়েছো?
জুলিয়া কাহিনীর শেষপর্যন্ত শুনিয়ে দিলো। সবকিছু বলেছো, কিছু বাদ যায়নি তো? নাঃ একটু বাড়িয়ে হয়তো কোথাও একটু-আধটু বলেছি। আমার স্বভাব ওই। আমার বন্ধু জেনিয়া কিন্তু একেবারে উল্টো। তার মুখে লোমহর্ষক কাহিনীও কেমন ভেজা ভ্যাজভেজে শোনায়। আবার ঝলমলে রত্নের স্তূপটার দিকে তাকিয়ে, মঁসিয়ে পোয়ারো এগুলো কার?
বলা শক্ত। কিন্তু তোমারও না আমারও না। এক্ষুনি ঠিক করে ফেলতে হবে কি করা উচিত।
জুলিয়া তার দিকে আশার চোখে তাকায়। তুমি নিজেকে আমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছো তো, বেশ এরকুল পোয়ারো চোখ বোজেন। হঠাৎ চোখ খুলেই ভীষণ চটপট হয়ে পড়লেন।
আর চেয়ারে বসে থাকা যাচ্ছে না। প্রতিটি বিষয়েই শৃঙ্খলা থাকা চাই। তুমি যে কাহিনী বললে তাতে না আছে শৃঙ্খলা না আছে বিনাশের কারণ। কারণ এইখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক সুতো অনেক গুচ্ছ।
তোমার স্কুলে খবর দিচ্ছি। প্রধান শিক্ষিকাকে বলে দিই যে তুমি এখানে আমার কাছে নিরাপদে আছো আর আমরা দুজনেই মেডোব্যাঙ্কে যাচ্ছি।
উনি জানেন যে আমি ভালোই আছি। আমি চিঠি লিখে রেখে এসেছি। আমাকে কেউ চুরি-টুরি করেনি।
তবু খবরটা পেলে শান্তি পাবেন। টেলিফোনে মিস বুলস্ট্রোডকে পাওয়া গেল। আমার নাম এরকুল পোয়ারো, আমার কাছে আপনার ছাত্রী জুলিয়া আপজন এসেছে।…যে পুলিশ অফিসার তদন্ত করছেন তাকে জানিয়ে দেবেন যে একটা দামী মোড়ক ব্যাঙ্কে জমা করে দেওয়া হয়েছে।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আমাদের এতো তাড়াতাড়ি টেলিফোন করে আপনি যে আমাদের উদ্বেগ দূর করেছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। অত্যন্ত সুবিবেচনার কাজ করেছেন।
…জানো জুলিয়া, আজ মধ্যাহ্নভোজে তুমি যে নেই সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি।
জুলিয়া বলে, নইলে আপনি হয়তো ভাবতেন আমাকেও চুরি করে নিয়ে গেছে।
হা ভালোই করেছিলে, তবুও আমি বলবো, তোমার মতলবটা আগেই আমাকে জানানো উচিত ছিল জুলিয়া।
একমিনিট, বলে দরজার কাছে চলে এলেন এরকুল পোয়ারো, দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর খুব ঘটা করে দরজা বন্ধ করে চোখে মুখে ঝিলিক তুলে রহস্যঘন কণ্ঠে বললেন, এখন আমরা একা, এবার শুরু করা যাক।
একবার তার দিকে আরেকবার দরজার দিকে মিস বুলস্ট্রোড তাকিয়ে দেখলেন, জুলিয়া কি ব্যাপার? জুলিয়া পুরো ঘটনাটা আনুপূর্বিক বলে গেল। টেনিস র্যাকেটের বদলাবদলি রহস্যময়ী রানী…র্যাকেটের ভেতরে অবশেষে খুঁজে পেলো মিস বুলস্ট্রোড। পোয়ারোর দিকে তাকাতে তিনি বললেন, মাদমোয়াদেল জুলিয়া সবকিছু ঠিকই বলল, ও যে জিনিসগুলি নিয়ে এসেছিল তার ভার এখন আমার ওপর। সেগুলি ব্যাঙ্কে নিরাপদে রাখা হয়েছে। কাজেই মনে হয় না এখানে আর কিছু ঘটবে।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ওঃ…আচ্ছা জুলিয়ার এখানে থাকা কি ভালো হবে? বলেন তো লন্ডনে ওর মাসির বাড়িতে পৌঁছে দিই।
জুলিয়া প্রতিবাদ করে, না না, আমাকে এখানে থাকতে দিন।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, তোমার এখানে ভালো লাগে?
হ্যাঁ ভীষণ ভালো লাগে, কত অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে এখানে।
সেগুলো মেডোব্যাঙ্কের বিশেষত্ব নয়।
এরকুল পোয়ারো বলেন, এখনি আর এখানে কোনো বিপদ নেই জুলিয়ার। বলতে বলতে দরজার দিকে তাকালেন।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, বুঝেছি।
পোয়ারো সাবধান করে দিলেন, কিন্তু তা হলেও বিচক্ষণতার প্রয়োজন আছে। জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিচক্ষণতা বোঝ?
মিস বুলস্ট্রোড বুঝিয়ে দিলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো বলতে চাইছেন যে তুমি যা খুঁজে পেয়েছো সে সম্বন্ধে কোনো কথা কাউকে বলবে না। অন্য মেয়েদেরও না। পারবে চুপ করে থাকতে?
হুঁ।
পোয়ারো বলেন, বন্ধুদের কাছে গল্প করার চমৎকার বিষয়, গভীর রাতে টেনিস র্যাকেটের মধ্যে খুঁজে পেলে সাত রাজার ধন। তবু ও নিয়ে গল্প না করার অনেক যুক্তিপূর্ণ কারণ আছে।
জানি।
জুলিয়া তোমার ওপর ভরসা করতে পারি?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই…দিব্যি করছি। এই দেখুন বুকে ক্রশ আঁকলাম।
মিস বুলস্ট্রোড হেসে বললেন, তোমার মা বোধহয় শিগগিরি ফিরবেন।
মা? আশা তো করি।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ইনসপেক্টর কেলসির কাছে শুনলাম তোমার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা হচ্ছে।…কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানো?…আনাতানি বাসগুলো ভীষণ দেরি করে, সবসময় আবার সময়-টময় মানে না।
মাকে তো বলতে পারি?
হা নিশ্চয়।…আচ্ছা জুলিয়া ওই কথা রইলো, যাও তুমি এখন দৌড় লাগাও।
জুলিয়া ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মিস বুলস্ট্রোড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোকে দেখেন, আমি বোধহয় আপনার কৌশলটা বুঝতে পেরেছি।
একটু আগে দরজা বন্ধ করার ভান করলেন। আসলে কিন্তু দরজাটা আপনি ইচ্ছে করেই একটু ফাঁক করে রেখেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নাড়ে, যাতে বাইরে থেকে শোনা যায় আমরা কী বলছি? হ্যাঁ…অবশ্যই আড়িপাতার মতো যদি কেউ থাকে।…মেয়েটির নিরাপত্তার জন্যই এগুলি করতে হল।…ওর কাছে এগুলো এখন নেই, ব্যাঙ্কে রাখা আছে। সে খবরটা প্রচার করা আবশ্যক।
মিস বুলস্ট্রোড গম্ভীরভাবে ঠোঁটে চেপে বললেন, কবে যে এসব শেষ হবে।
পুলিশের বড়োসাহেব বললেন, এখন আমাদের কর্তব্য হল প্রথমেই সব খবরগুলো একত্রিত করে যত রকম ধারণা আছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা…। আপনাকে পেয়ে আমারা খুব খুশি। মিঃ পোয়ারো..ইনসপেক্টর কেলসির আপনার কথা খুব মনে আছে।
কেলসি বলে, সে অনেকদিন আগের কথা, মামলার ভার চীফ ইনসপেক্টর ওয়ারেণ্ডারের ওপর। তখন সবে ঢুকেছি। একেবারে আনকোরা সার্জেন্ট।
কাজের সুবিধার জন্য এই যে ভদ্রলোক এখানে বসে আছেন তার নাম আমরা দিয়েছি মিঃ অ্যাডাম গুডম্যান। একে হয়তো আপনি চেনেন না মিঃ পোয়ারো, কিন্তু এর বড়োকর্তাকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চ।
পোয়ারো বলেন, কর্নেল পাইক্যাওয়ে? ওঃ, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, এখনও তার সেই ঘুম ঘুম ভাব আছে নাকি?
অ্যাডাম হাসে, তাকে জানেন দেখছি মিঃ পোয়ারো। আমি কখনো তাকে পুরো জাগা অবস্থায় দেখিনি…যখন দেখবো তখন বুঝবো তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন না।
পুলিশ সাহেব বললেন, আসুন ব্যাপারটা নিয়ে এবারে আলোচনা করি। আমি অবশ্য আমার নিজের ধারণা আপনাদের ওপর চাপিয়ে দেবো না। যারা এই কেস নিয়ে কাজ করছেন তারা কী কী জানতে পেরেছেন, কী কী ভাবছেন, সেটা জানতেই আমি এখানে এসেছি।…ব্যাপারটার নানান দিক রয়েছে, তার মধ্যে একটা দিকের কথা জানিয়ে দেওয়া উচিত। ধরে নেওয়া যাক একটি ছোটো মেয়ে মানে একটি স্কুলের ছাত্রী আপনার কাছে চমৎকার একটি গল্প নিয়ে এলো। সে নাকি কোনো একটা টেনিস র্যাকেটের ফাঁকা হাতলে কীসব পেয়েছে। হয়তো সে যা পেয়েছে আসলে হচ্ছে রঙীন পাথরের একটা সংগ্রহ…বেশ সুন্দর নকল পাথর বা বড়োজোর আধদামী পাথর। যাইহোক শিশুমনে উত্তেজনা জন্মাবার পক্ষে ওই যথেষ্ট। কিন্তু ওগুলোর দাম সম্বন্ধে মেয়েটার মনে ভীষণ উঁচু ধারণা। কী বলেন এমন কাণ্ড হতে পারে না? পোয়ারোর দিকে কটমট করে তাকালেন। হওয়াই তো উচিত।
পুলিশ সাহেব বলেন, বেশ যারা এই ইয়ে মানে..রঙীন পাথরগুলো অজান্তেই এদেশে নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা চাই না যে বেআইনিভাবে ওগুলো আমদানী করার কোনো মামলা ওঠে। তার ওপর আবার আছে বৈদেশিক নীতির কথা। আমাকে বলা হয়েছে যে, কতগুলো এমন ব্যাপার আছে যা এই মুহূর্তে বেশ গোলমাল। তেল বা খনিজপদার্থ বা ওই ধরনের কোনো বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সবসময়েই প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। কোনো বোস প্রশ্ন আমার চাই না। হত্যাকাণ্ডকে কখনো চেপে রাখা যায় না। পরামর্শ চলছে
চিন্তান্বিত গলায় পোয়ারো আবার বললেন, মেডোব্যাঙ্কে দুটি হত্যা!
কেলসি বলে, আমরা আপনাকে সব তথ্যই জানালাম এখন যদি কোনো ধারণা হয়ে থাকে আপনার।
পোয়ারো বলেন ক্রীড়ামঞ্চে কেন? আপনার মনে সেই প্রশ্নই ছিলো তাই না? উত্তরটা আমরা পেয়ে গেছি, কারণ ক্রীড়ামঞ্চে ছিলো একটা টেনিস র্যাকেট, যার মধ্যে ছিল বহুমূল্য রত্ন। র্যাকেটের খবরটা নিশ্চয়ই কেউ জানতো। কে সে?…মিস শ্রিঙ্গারও হতে পারেন। আপনারাই তো বলেন ক্রীড়ামঞ্চ সম্বন্ধে তার অদ্ভুত একটা মনোভাব ছিলো। ওখানে কারো আসা তিনি পছন্দ করতেন না। মাদমোয়াজেল ব্লাশের ক্ষেত্রেই তা তো দেখা গেলো।
এরকুল পোয়ারো আবার অ্যাডামকেই বললেন, আপনিই তো বলেছিলেন ক্রীড়ামঞ্চে মাদমোয়াজেল ব্লাশের আচরণটা যেন আপনার কাছে কেমন কেমন ঠেকেছিল।
অ্যাডাম বলে, তিনি আমাকে কৈফিয়ৎ দিচ্ছিলেন। বেশ ঘটা করে কৈফিয়ৎ..অত করে যদি না বোঝাতেন তবে আমার কোনো সন্দেহই হত না।
মাথা নেড়ে পোয়ারো বলেন, বটেই তো। চিন্তার উদ্রেক করবারই কথা। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি তা হচ্ছে রাত একটায় ক্রীড়ামঞ্চে মিস স্প্রিঙ্গারকে খুন করা হয়েছিল অথচ সেই সময় ওর তো ওখানে থাকবার কথা নয়।
কেলসির দিকে ফিরে, মেডোব্যাঙ্কে আসাবার আগে মিস স্প্রিঙ্গার কোথায় ছিলেন? জানা যাচ্ছে না, তার শেষ চাকরিস্থল ছিলো বেশ নামকরা একটা স্কুলের, নাম বলেছিলো। গতবছর গ্রীষ্মকালে ওখানেই ছিলেন। কিন্তু তারপর কোথায় ছিলেন জানা নেই। মরার আগে তো প্রশ্ন করার দরকার হয়নি। তার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পোয়ারো বলেন, তবে তো রামাতে থাকাটা অসম্ভব নয়। অ্যাডাম বলে, শুনেছি যখন বিপ্লব হচ্ছিলো তখন ওখানে নাকি একদল স্কুল শিক্ষিকা ছিলো।
তাহলে ধরা যাক তিনি এখানে ছিলেন এবং কোনো উপায়ে র্যাকেটটার খবর জেনেছেন। মেডোব্যাঙ্কে কিছুদিন চুপচাপ নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ধারা লক্ষ্য করলেন তারপর একদিন রাতে ক্রীড়ামঞ্চে গিয়ে র্যাকেটটা থেকে মণিরত্নগুলো বের করে নিতে যাবেন মনস্থির করলেন। ঠিক সময়ে কেউ তাকে বাধা দিল। যে কেউ তার গতিবিধির অনুসরণ করছিলো। সে যাই হোক তার কাছে পিস্তল ছিলো। …তাকে গুলি করলো…কিন্তু রত্নগুলো সরিয়ে নেবার সময় পেলো না। কারণ ততক্ষণে গুলির শব্দে ক্রীড়ামঞ্চে লোকজন ছুটে আসছে।
পুলিস সাহেব বললেন, তাহলে আপনার ধারণা ঘটনাটা এরকমই ঘটেছিলো।…এটা শুধু একটা সম্ভাবনা। বিকল্পে এমনও হতে পারে যে পিস্তলধারীই ওখানে প্রথম গিয়েছিলো এবং মিস স্প্রিঙ্গার আসাতে সে বাধা পেলো। হয়তো এমন কোনো মানুষ যার সম্বন্ধে মিস স্প্রিঙ্গার সন্দেহ পোষণ করতেন।…আপনারাই তো বলেছেন অন্যের চরিত্রের দোষ তিনি খুঁজে বেড়াতেন।
অ্যাডাম বলে, আর দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটি আপনিও জানেন না আমিও জানি না…হয়তো বাইরের কোনো লোকও এসে থাকতে পারে।
কেলসি মাথা নেড়ে বলে, না, তা মনে হয় না। গোটা অঞ্চলটা আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, আগন্তুকদের তো আমরা খুঁটিয়ে যাচাই করেছি। কাছাকাছি থাকার মধ্যে আছেন মাদাম কোলেনস্কি অ্যাডাম চেনেন। কিন্তু তিনি দুটোর মধ্যে একটা খুনেও জড়িত থাকতে পারেন না।
তবে তো আবার মেডোব্যাঙ্কেই ফিরে আসতে হচ্ছে!..সত্য আবিষ্কারের একমাত্র পন্থার কথা বিবেচনা করে অসম্ভবগুলোকে বাদ দিয়ে সম্ভাবনা আগামীতে পৌঁছানো। কেলসি বলে, হা…তাই তো দাঁড়াচ্ছে। দেখুন প্রথমে যে খুনটা হল সেখান প্রশস্ত ক্ষেত্র :
কেউই মিস স্প্রিঙ্গারকে হত্যা করতে পারে। ব্যতিক্রম শুধু মিস জনসন, মিস চ্যাডউইক আর যে মেয়েটির কানে ব্যথা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খুনের বেলায় ক্ষেত্র অনেক সংকীর্ণ। মিস রীচ, মিস ব্লেক ও মিস স্যাপল্যান্ড এতে জড়িত নেই। কারণ সে সময়ে মিস রীচ বিশ মাইল দূরে অ্যাসিনে গ্র্যাঞ্জ হোটেলে ছিলেন।
ইনসপেক্টর বলে, মিস বুলস্ট্রোড তখন ওয়েলশ্যমের ডাচেসের বাড়িতে ছিলেন।
পোয়ারোও গম্ভীর, তবে মিস বুলস্ট্রোডও বাদ পড়লেন। এখন কে কে রইলো?
বাঁধা ঝি দুজন। তারা রাতে থাকে, মিসেস গিবসন আর আরেকটা মেয়ে উরিস হগ। তাদের আমি সন্দেহ করি না, বাকি রইলো মিস রোয়ান ও মাদমোয়োজেল ব্লাশ।
ছাত্রীরাও তো।
চমকে ওঠে কেলসি। নিশ্চয় তাদের আপনি সন্দেহ করেন না।
করি না কিন্তু সঠিক কে বলতে পারে।
কিন্তু কোনো মনোযোগই ছিলো না, কেলসি বললো। মিস রোয়ান আছেন গত একবছর ধরে। ওঁর ইতিহাস ভালো। তার ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই।
তাহলে এসে ঠেকেছি মাদমোয়াজেল ব্লাশে। ওখানেই আমাদের যাত্রা শেষ।
এবার সবাই চুপ থাকে।
কোনো প্রমাণ নেই, পরিচয়পত্রগুলো বেশ ভালো।
সে তো হবেই, পোয়ারো বললেন।
উনি আড়ি পাততেন, অ্যাডাম বলে ওঠে, কিন্তু আড়ি পাতা তো হত্যার প্রমাণ নয়। এক মিনিট, কেলসি বলে, চাবি নিয়ে কি যেন বলছিলেন…চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই স্প্রিঙ্গার তাঁকে মারেন এক ধমক।
রাতে র্যাকেট খুঁজতে যে যাবে, তার চাবি দরকার হবেই। পোয়ারো বলেন, চাবি বানাতে হলে চাবির ছাপ দরকার।
অ্যাডাম বললো, আগ বাড়িয়ে চাবির কথা বলবেন না।
কেলসি বললো, চাবির ঘটনা প্রিঙ্গার কাউকে বলেছিল। কাজেই ইনি ভাবলেন ঘটনাটা উল্লেখ করে রাখা ভালো।
মনে রাখার মতো বিষয়। পোয়ারো বলেন, এতে আমরা কদ্দূর যেতে পারি, কেলসি পোয়ারোর দিকে তাকায়।
পোয়ারো বলেন, যা বলা হয়েছে তা যদি সত্যি হয়, হয়তো একটা সম্ভাবনা আছে।
.
কথোপকথন
মিসেস সাটক্লিফ বলে, দেখুন বুঝতে পারছি না কি বলবো, সত্যি ঠিক বুঝতে পারছি না। এরকুল পোয়ারোর দিকে বিরক্তভাবে তাকিয়ে বললেন, হেনরি অবশ্য বাড়ি নেই।
পোয়ারো ঠিক বুঝতে পেরেছেন কেন তিনি এই কথা বললেন…উনি ভাবছেন হেনরি থাকলে ভালো হত ব্যাপারটা সুরাহা করে দিত। হেনরির কত বিদেশী নিয়ে কারবার। কখনো দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা কখনো জেনেভাতে। ও প্যারিসে গেছে দু-একবার।
মিসেস সাটক্লিফ বলেন, ব্যাপারটা এত বিশ্রী বুঝলেন, জেনিয়াকে যে নিরাপদে বাড়ি নিয়ে যাই সেটাই বাঁচোয়া। কিন্তু জেনিয়া ভীষণ বিরক্ত করছে। মেডোব্যাঙ্কে যাবার আগে তো সেখানে যাবে না বলেই নাকে কাঁদলো, ওটা নাকি বড়ো লোকদের ন্যাকা ন্যাকা স্কুল।
পোয়ারো বললেন, ওটা যে খুব ভালো স্কুল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ছিল, এখন আর নেই।
মিসেস সাটক্লিফ সংশয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, আপনার তাই মনে হয় বুঝি।
তখন পোয়ারো ব্যাখ্যা করলেন, মেডোব্যাঙ্কে তো এখন একটা দুঃসময় চলছে।
মিসেস সাটক্লিফও যেন ওঁত পেতেই ছিলো, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
শুধু দুঃসময় বলছেন তার চেয়েও অনেক বেশি। দুজন খুন হল। একটি মেয়ে চুরি হল। যেখানে শিক্ষয়িত্রীরা একের পর এক খুন হচ্ছেন সেই স্কুলে আপনি আপনার মেয়েকে পাঠাতে পারেন।
.
জেনিয়া থমথমে মুখে ঘরে ঢুকলো। ঘোর সন্দেহের চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। এই যে কেমন আছ?
পোয়ারো বলেন, আমি জুলিয়া আপজনের পুরানো বন্ধু, ও আমাকে খুঁজতে লন্ডনে এসেছিল।
জেনিয়া একটু আশ্চর্য হল, জুলিয়া লন্ডনে গিয়েছিল কেন?
পোয়ারো বললেন, আমার উপদেশ নিতে। জেনিয়ার কিন্তু বিশ্বাস হয় না। পোয়ারো বললেন, আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি। ও এখন আবার মেডোব্যাঙ্কে ফিরে গেছে।
জেনিয়া বলে, তাহলে ইসাবেলা মাসি ওকে নিয়ে যাননি।
পোয়ারোও মিসেস সাটক্লিফের দিকে তাকাল, কিন্তু ততক্ষণে জেনিয়ার মা ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। যখন পোয়ারো এবাড়িতে আসেন তখন তিনি ধোপার কাপড় মেলাতে ব্যস্ত ছিলেন।
পোয়ারো বললেন, ও…আচ্ছা মেডোব্যাঙ্কে এমন কাউকে দেখেছো কী যাকে রামাতে দেখেছিলে?
রামাতে, না..কই মনে হচ্ছে না। কিন্তু জেনিয়া তুমি নিঃসন্দেহ নও, তাই না? জেনিয়া কপাল চুলকোয়, মানে সবসময় তো চেনা মুখের মানুষ দেখা যায় কিন্তু কার সঙ্গে তার মুখের মিল, তা তো তার মনে থাকে না। কখনো হয়তো এমন হয় যে চেনা মানুষদের দেখলেন কিন্তু
মনে করতে পারলেন না, তারা কে? কোথায় দেখেছেন।
রাজকুমারী শাইস্তার কথাই ধরো, তাকে তুমি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছিলে। রামাতে তো তাকে দেখেছে।
রামাতে ছিলো বুঝি। খুব সম্ভব রাজ-পরিবারের মেয়ে তো, তাকে তুমি ওখানে দেখে থাকবে, কী বল।
না, মনে পড়ে না, তাছাড়া ওখানে ওরা মুখের কাপড় খুলে রাস্তায় বেরোয় না। বিদেশে এসে খুলে ফেলে বলে শুনেছি।
সে যাক। তাহলে মেডোব্যাঙ্কে কাউকে তুমি আগে দেখেছে বলে মনে হয় না।
না, দেখিনি…অবশ্য বেশির ভাগ মানুষের মুখই হয়তো যে কোনো জায়গাতেই তাদের দেশে থাকতে পারেন। যখন মিস রীচের মতো কোনো অদ্ভুত মুখ আপনার নজরে আসে, তখনই তো আপনি লক্ষ্য করেন।
মিস রীচকে আগে কোথাও দেখেছো? ঠিক দেখিনি, ওর মতোই কেউ হবে। কিন্তু অনেক বেশি মোটা।
অনেক বেশি মোটা, চিন্তায় ডুবে যান পোয়ারো। খিলখিলিয়ে হেসে জেনিয়া বলে-মিস রীচকে আপনি মোটা কল্পনা করতে পারবেন না। উনি এত রোগা পাতলা ছিপছিপে তাছাড়া মিস রীচ রামাতে যাবেন কী করে? গতবার তো তার অসুখ ছিল।
পোয়ারো বললেন, আর অন্য মেয়েরা তাদের দেখোনি আগে?
দু-একজনকে দেখেছি, তাদের আগেই জানতাম। আমি তো মোটে তিন সপ্তাহ ওখানে ছিলাম। অর্ধেক মেয়েকে তো আমি চোখেই দেখিনি।
.
সুতোর গুচ্ছ
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে আইলিন।
আইলিন রীচ তার পেছনে বসার ঘরে এসে ঢোকে। মেডোব্যাঙ্ক এখন অদ্ভুত শান্ত। মোটে জন পঁচিশ ছাত্রী আছে যাদের বাপ-মা কোন কারণে হয়তো তাদের নিয়ে যেতে পারেনি। আতঙ্ক উদ্বেগ অনেক কেটে গেছে মিস বুলস্ট্রোডের কৌশলে। তাকে দেখে মনে হয় না যে তার মনে কোনো উদ্বেগ আছে। অনায়াসে তিনি শান্ত মুখচ্ছবি বজায় রেখে চলেছেন।
অ্যানি স্যাপল্যাণ্ড মিস বুলস্ট্রোডকে বললো কিছু লোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এই স্কুল টিকবে কিনা জানিনা। জনমত কি দাঁড়াবে তা তো বলা যায় না। একেক জন মানুষ একেক রকম। শেষে দেখা যায় তার মতামত বেশি সেই নিজের মতকেই জনমতে রূপান্তরিত করে। কাজেই মনে হয় মেডোব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবে।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন–আপনার দেখছি ভীষণ দৃঢ় মনোভাব।
হা, এই বিষয়ে তাই। দুনিয়ায় কী আছে যার দাম এক কানাকড়িও নয়।
কিন্তু মেডোব্যাঙ্ক অমূল্য, আমি এসেই তা অনুভব করছি।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, আপনি যোদ্ধা। যোদ্ধাদের আমার খুব ভালো লাগে। বিশ্বাস করুন আমি সহজেই হার স্বীকার করবো না, এই যুদ্ধ আমার ভালোই লাগবে। যখন সবকিছু অত্যন্ত সহজ হয়ে ওঠে হাতের মুঠোর মধ্যে, তখন মানুষ কী বলবো-আত্মপ্রসঙ্গে চুর হয়ে থাকে?
ফলের জমি থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অ্যানি স্যাপল্যান্ড বললো, ওই যে এলোচুল দুলিয়ে আসছে, বুঝি না বাপু সামলাই কি করে।
অ্যাডাম বলে ওকে, সে কথাটা বলুন।
স্যাপল্যান্ড বলে, আমাদের মধ্যে মাখামাখি নেই। আচ্ছা আপনার কী মনে হয় স্কুল আবার চলবে? কঠিন প্রশ্ন। তাছাড়া আমি উত্তর দেবার কে?
কেন আপনার তো একটা মতামত থাকতে পারে, চলবে বোধহয় জানে।
ফরাসি সাহিত্য পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে মাদমোয়াজেল ব্লাশ বেরিয়ে এল। হাতঘড়িতে সময় দেখে…অনেক সময় আছে। আজকাল তো সময়ের কমতি নেই। ছাত্রী নেই। নিজের ঘরে গিয়ে টুপি পরে নেয়। টুপি না পরে চলাফেরা করা তার একদম ভালো লাগে না। আয়নায় চেহারা দেখে পছন্দ হয় না। চোখে লাগার মতো ব্যক্তিত্ব নেই।..মনে মনে হাসে দিদির পরিচয় পত্রগুলো কেমন সুন্দর কাজে লাগানো গেল। হাত-পা এর ফটো দেখে কেউ সন্দেহ করেনি।…অ্যাঞ্জেল তো মারাই গেছে, ওগুলো ফেলে দিয়ে কী কোনো লাভ হত। তার চেয়ে এই বেশ। অ্যাঞ্জেল পড়াতে সত্যিই ভালোবাসতো। ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বাইরে এল। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে দেখে, হাঁটু মুড়ে নতুন একজন ঝি কাজ করছে। নিশ্চয় পুলিশের চর…লোকে যেন বোঝে না।
ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি খেলে।
.
আনাতোলিয়ার ঘটনা
গভীর খাদের ওপর দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার এক পাশে মিসেস আপজন বসে আছে। বিশাল চুল এক তুর্কী রমণীর সঙ্গে গল্প জুড়েছে।
.
অনাবরণ
সবাই একটা ছোটো ক্লাসঘরে এসে জমা হল। মিস বুলস্ট্রোড দেখলেন সবাই এসেছে। মিস চ্যাডউইক, মিস জনসন, মিস রীচ ও অল্প বয়সী শিক্ষিকা দুজন। অ্যানি স্যাপল্যান্ড খাতা পেন্সিল নিয়ে বসেছে। যদি মিস বুলস্ট্রোডের কিছু লেখার দরকার হয়। মিস বুলস্ট্রোডের পাশে ইনসপেক্টর কেলসি বসেছে, আর তার পেছনে এরকুল পোয়ারো বসে আছেন।
বেশ কর্তৃত্বের সুর নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন।
আমার মনে হয় এই তদন্ত কতদূর এগিয়েছে সেটা জানতে আপনারা সকলেই উৎসাহী। কারণ আপনারা সকলেই এই স্কুলের কর্মী। এবং এই স্কুলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সুইজারল্যান্ড থেকে অমূল্য সাফল্য পেয়েছেন মিঃ পোয়ারো।
…আপনারা জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি এই বিষয়ে নিজেই আপনাদের বলবেন।
আমি দুঃখিত যে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, কিন্তু আজ একথা বলার সময় এসেছে যেগুলো খোলসা হওয়া দরকার। কাজেই আমার কতদূর এগিয়েছি সেটা যদি আপনাদের জানানো যায় তবে নিশ্চয়ই আপনারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
মিস বুলস্ট্রোড কেলসির দিকে তাকায়। ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দেখুন সরকারীভাবে আমি যা জানি সবটাই আপনাদের বলতে পারি না, তবে আমরা যথেষ্ট এগিয়েছি এবং এই স্কুলের অপরাধগুলো কে বা কারা সংঘটিত করেছিলো সে সম্বন্ধেও একটা স্পষ্ট ধারণা এসে গেছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার বন্ধু মিঃ পোয়ারো সরকারী গোপনীয়তায় আবদ্ধ নন। তিনি তার বক্তব্য আপনাদের জানাতে পারেন। আমি জানি আপনারা সবাই মেডোব্যাঙ্কের একনিষ্ঠ কর্মী।
মিস বুলস্ট্রোডের ওপরও আপনাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি ভালোবাসা রয়েছে। সুতরাং আমি আশা করবো যে, মিঃ পোয়ারো যে সব বিষয়ে আপনাদের জানাবেন সেগুলো আপনারা গোপন রাখবেন। কারণ বাজারে যত কম গুজব ছড়াবে ততই মঙ্গল। অতএব আপনাদের অনুরোধ করবো যেন খবরগুলো বাইরে প্রকাশ না হয়, এতে আপনারা সকলেই রাজী…।
পোয়ারো বললেন, আপনাদের সকলেরই এই কটাদিন বেশ অশান্তিতে কাটলো। আপনাদের অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা আমি বুঝি, বিশ্বাস করুন। মিস বুলস্ট্রোডের কষ্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আপনারাও কম কষ্ট পাননি। তিনজন সহকর্মীকে আপনারা হারিয়েছেন যাদের একজন বহুদিন ছিলেন। আমি মিস ভ্যান্সিটার্টের কথা বলছি। মিস স্প্রিঙ্গার ও মাদমোয়াজেল ব্লাশ অবশ্যই নবাগত। পোয়ারো বললো যে, আপনাদের সামনেই বসে আছে সেই নির্মম হত্যাকারী।
একটা ফটো পকেট থেকে বের করেন। প্রথমে আমি এই ফটো আপনাদের দেখাতে চাই, কেলসি ফটোটা নিয়ে মিস বুলস্ট্রোডকে দেয়। মিস বুলস্ট্রোডের হাত থেকে সবাই নিয়ে দেখে।
আপনাদের সকলকেই জিজ্ঞাসা করছি…কেউ কী আপনারা ফটোর মেয়েটাকে চিনতে পেরেছেন?
সকলেই ঘাড় নাড়িয়ে বললো, না। পোয়ারো বললো, চেনা উচিত। আমি জেনেভা থেকে ফটোটা পেয়েছি…রাজকুমারী শাইস্তার।
মিস চ্যাডউইক চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু এতো শাইস্তা নয়।
পোয়ারো বললেন, সেই তো কথা, আমাদের এই কাহিনীর যবনিকা উঠেছিল রামাতে সেখানে আপনারা সকলেই জানেন।
উত্তর দিকে পাহাড়ে রাজকুমার আলির বিমান ধ্বংস হয়ে পড়ে। বহুদিন সেটার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজকুমার আলির দেহে একটি মূল্যবান বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেটি রাজকুমার সবসময় সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। গুজব সেটি নাকি এদেশে এসেছে।..রাজকুমার আলি ইউসুফের একমাত্র ঘনিষ্ঠ জীবিত আত্মীয়ার কাছে ছিলেন। মেয়েটি তার খুড়তুতো বোন–সুইজারল্যান্ডে স্কুলে পড়তো। ধরে নেওয়া যাক সে বস্তুটি যদি নিরাপদে রামাতের বাইরে নিয়ে আসা হয়ে থাকে তো সেটি আসলে রাজকুমারী শাইস্তার কাছে বা তার কোনো আত্মীয় বা অভিভাবকদের হাতে থাকবে, তাই কিছু কিছু অনুচর লেগে রইলো। তার কাকা আমীর ইব্রাহিমের পেছনে আর রাজকুমারীর পেছনে। জানা ছিল এর পরে সে মেডোব্যাঙ্কে আসবে, কাজেই খুবই স্বাভাবিক যে, এখানে কাউকে চাকরি নিতে পাঠানো হবে। যাতে রাজকুমারীর সাক্ষাৎপ্রার্থী সব লোকের ওপরে কড়া নজর রাখা যায়। তার চিঠিপত্র টেলিফোনের সব সংবাদ জানা যায়। কিন্তু এর চেয়েও আরো সহজ কিন্তু আরো কার্যকরী একটা পথ রাজকুমারী শাইস্তাকে চুরি করে তাদেরই কাউকে একজনকে রাজকুমারী সাজিয়ে এই স্কুলে পাঠানো হল। কাজটা মোটেই কঠিন নয় কারণ আমীর ইব্রাহিম মিশরে ছিলেন। গরমকালের শেষদিকের আগে ইংল্যান্ডে আসার তার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। মেয়েটিকে মিস বুলস্ট্রোড চোখে দেখেননি। রাজকুমারীর অভ্যর্থনার সব ব্যবস্থাই তো তিনি লন্ডনের দূতাবাসের মাধ্যমে করেছিলেন।
.
পোয়ারোর বিশ্লেষণ
মিসেস আপজন মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে গেলো যে এইমাত্র তার চোখের সামনে এক রোমহর্ষক নাটকের অভিনয় হলো। এই মুহূর্তে মা শুধু তার সন্তান খুঁজছে। পরিত্যক্ত ক্লাসঘরে তার দেখা পেলো। জুলিয়া ডেস্কের ওপরে ঝুঁকে, একটু দেখি জিভ বার করে রচনা লেখবার দারুণ পরিশ্রমে ব্যস্ত।
মাকে দেখেই একছুটে মায়ের কাছে গিয়ে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাগো।
পরমুহূর্তে সচেতন হল এখন তো বড়ো হয়েছে। জুলিয়া বললো, ওঃ, ভীষণ ভালো লাগছে তুমি ফিরলে বলে। জুলিয়া বলে, মিস রীচের রচনা লিখছি। অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় কিন্তু এটা কি লিখছো দেখি? মিসেস আপজন ঝুঁকে পড়ে লেখাটা দেখে।
পৃষ্ঠার ওপরেই শিরোনাম লেখা-রচনার বিষয় তার নিচে। নয়-দশ লাইন লেখা হয়েছে, জুলিয়ার আঁকা-বাঁকা অক্ষরে। মিসেস আপজন পড়ে দেখে হত্যার প্রতি ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের মনোভাবের তুলনামূলক বৈষম্য।
.
উত্তরাধিকার
মিঃ রবিনসন নামে একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে এসেছেন স্যার।
ওঃ, পোয়ারো সামনের টেবিলে চিঠিটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বেশ চিন্তান্বিত হলেন, বললেন ভেতরে নিয়ে এসো জর্জ…।
শুধু কয়েক লাইনের চিঠি। পোয়ারো চিঠি রাখলেন..মিঃ রবিনসন ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়ান। মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে করমর্দন করলেন তারপর চেয়ারে বসতে বললেন।
মিঃ রবিনসন বসে রুমাল দিয়ে তার মস্ত বড়ো হলুদ মুখটা মুছে মন্তব্য করলেন যে দিনটা বেশ গরম…।
মিঃ রবিনসন বলেন, কত কিছুই তো শোনা যায়…সেই বেচারী মেয়ের ছোটোবেলা থেকেই নাকি স্কুলে শিক্ষিকার ওপর প্রবল ভীতি, মনের সমীক্ষকেরা বেশ ভালো বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে। তবে অন্তত লঘু দায়িত্বের অনেকবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে।
পোয়ারো বলেন, হ্যাঁ যুক্তিটা মন্দ না তবে আমার ধারণা…মাপ করবেন ওসব যুক্তি ধোপে টিকবে না।
আমিও একমত..ঠাণ্ডা মাথায় খুন একেবারে, তবু..ওর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের কথাটা ওরা বড় গলায় ঘোষণা করবে। দেখাবে কত বিখ্যাত লোকের ও সেক্রেটারি ছিলো। ওর যুদ্ধে চাকরির কথা বলবে। সেখানে তো কোনো দাগ নেই। অন্য পক্ষের চর সেজে গুপ্তচর বৃত্তি করতো। এত অল্পবয়স…কিন্তু দারুণ চালাক। কি প্রচণ্ড লোভ…একা একা কাজ চালিয়ে বিরাট লোভের ধন হস্তগত করা। বিরাট লাভ।
মিঃ রবিনসন সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, ওগুলো কোথায় মিঃ পোয়ারো?
আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন। হ্যাঁ তা তো বটেই। ব্যাঙ্কগুলো বেশ উপকারী প্রতিষ্ঠান কী বলেন। পোয়ারো হাসলেন, আমাদের কি শিবের গীত গাওয়ার প্রয়োজন আছে?
রবিনসন উঠে দাঁড়ালেন…
আমার কাজের জন্য আমি পারিশ্রমিক নেবো বুঝলেন। আমার পারিশ্রমিকও কিন্তু বেশ মোটা অঙ্কের, তবে ঠকবো না।
মেয়েটি তার চোখে চোখ রেখে তাকালো, জানি আপনি ঠকবেন না। আমার সাহায্যেরও প্রয়োজন আছে। আমি এসব কিছু বুঝি না।
মনে হচ্ছে আপনি বেশ বুদ্ধিমতী। আচ্ছা, এগুলো তাহলে নিয়ে যাই? আপনি একটাও রাখবেন না?
অ্যালিশ বলে, না আমি রাখতে চাই না। মুখ লাল করে বললে, আপনি ভাবছেন অদ্ভুত তাই না, কেন রেখে দিচ্ছি না একটা চুনী একটা পান্না অন্তত। আমার আপত্তি ছিল না, একদিন আমরা সেই অনুচ্ছেদটা পড়লাম–সেখানে আছে একজন নারীর কথা যার মূল্য চুনীর চেয়েও বেশি।…তাই আমার কোনো রত্ন চাই না। না থাকাই বোধ হয় ভালো।
মনে মনে রবিনসন বললো, বিচিত্র নারী।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রোলসের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আবার বললেন বিচিত্র নারী।