শাহজাদা আলি ইউসুফ বললেন, তারা কি বর্বর। তারা তো এখন সভ্য হয়েছে। তাছাড়া তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা বর্বর দানব লুকিয়ে থাকে। যে কোনো ছুঁতোতেই সেটা গর্জে ওঠে। বব তখন বললো, যাদের বেশ ভালো সাধারণ বুদ্ধি তেমন লোকের আজকাল চাহিদা নেই। এখন যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার নাম সাধারণ বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞান নয়। বব বললো, প্রত্যেকটা অলি-গলিতে চর আছে সবকিছু শোনে, সবকিছু জানে। বব বললো, আলিকে যদি পালাতে হয় তো এখুনি অবিলম্বে।..আলি বললো যে সে বুঝতে পারছে এখানে থাকা মানেই মৃত্যু–তাকে হত্যা করা হবে। বব বললো, মরবার সম্ভাবনাটাই বেশি, উত্তর দিকে লক্ষ্য করে বিমান চালাতে হবে। আলি ইউসুফের মুখ করুণ হয়ে উঠলো ববের যদি কিছু হয়। বব তখন বললো, যে তার আছেটা কি, না চাল না চুলো, তার কাজকর্মের ধারাই তো অদ্ভুত। কথাটা তাকে নিয়ে নয় আলিকে নিয়ে। আলি বললো যে তার পালাতে ইচ্ছে করছে না।
বব বললো যে, সেও কি চায় পালাতে কিন্তু হিংস্র জনতা যখন আলির প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে নেবে আর সে শহীদ বনে যাক।
আলি বললে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে, বেশ তবে তাই হোক।
বব বললো যে, সে সঙ্গে কিছু নিতে চায় না শুধু একটা জিনিস ছাড়া। শাহজাদা অদ্ভুতভাবে হাসলেন, পলকে যেন গোটা মানুষটা পালটে গেল। ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষা বেশভূষা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়লো প্রাচ্যদেশীয় চাতুর্য আর কৌশলের ইঙ্গিত। আলি বটুয়ার বন্ধনী খুলে সেটা টেবিলে ঢাললেন।
বব বললো, এগুলি কি আসল? আলি বললে, প্রত্যেকটা সাচ্চা পাথর। বেশিরভাগই তার বাবার সংগ্রহ, প্রতিবছর তিনি নতুন রত্ন আনতেন বিশ্বের নানা জায়গা থেকে। আলি বললো, তাদের বংশের এটা একটা রীতি, প্রয়োজনের সময় যাতে কাজে লাগে। বর্তমান বাজার দরে এর দাম প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড। বহু রক্তপাত হত্যাকাণ্ড যে তার পেছনে জড়িয়ে আছে, আর স্ত্রীলোকেরা আরো সাংঘাতিক। কারণ রত্ন তাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়, যে কোন নারীকে পাগল করে তোলে। আলি বললো যে, ববকে সে বিশ্বাস করে, আলি চায় না এই রত্নগুলো তার শত্রুর হাতে পড়ুক। হয়তো আজ বিকালে আলি বিমানযাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। কাজেই এই পাথরগুলো এখুনি নিয়ে রেখে দিতে বললো আলি।
বব বললো, এগুলি নিয়ে তিনি কি করবেন। আলি বললো, যেমন করে তোক এগুলো নিয়ে দেশের বাইরে যাবার ব্যবস্থা করবে। দরদ ভরা কণ্ঠে আলি বলেন, ববকে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে না।
.
অলিন্দে সুন্দরী
বব রবিনসনের মাথায় চিন্তা, প্যান্টের পকেটে সাড়ে সাত পাউন্ড। ভীষণ তার অস্বস্তি, প্রাসাদের প্রত্যেকেই বোধহয় খবরটা জানে, হয়তো তার চোখ মুখেও খবরটার ছায়া। মনটা তার উদ্ভ্রান্ত, কোথায় যাচ্ছে কে জানে, কী তার পরিকল্পনা তার জানা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড দামের জহরত তাকে সঁপে দেওয়া হয়েছে, এদেশ থেকে পাচার করবার জন্য সময় বিশেষ নেই। যে কোনো মুহূর্তে বিদ্রোহ হতে পারে।
বব বললো, এখন এমন একজন লোকের দরকার যে এ দেশ থেকে চলে যাচ্ছে পালিয়ে নয় হয়তো ভ্রমণ শেষে নয়তো কোনো কারণে দেশের বাইরে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী বা ভ্রমণকারী পেলেই ভালো হয় যে রাজনীতিতে নেই, রাজপরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে তার মালপত্র তল্লাশী করা হবে না। শুধু চোখ বুলিয়ে নিয়ম রক্ষা হবে।
হঠাৎ ববের মনে পড়লো অনর্থক এতক্ষণ ভেবে মরছে, তার দিদি জোয়ান তো রয়েছে মেয়ে জেনিয়াকে নিয়ে দুমাস হলো, এসেছে আবহাওয়া বদলাতে, ডাক্তার এমন দেশে যেতে বললেন যেখানে সূর্যালোক প্রচুর, আবহাওয়া শুষ্ক। চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তারা জাহাজে পাড়ি দেবে। বব বললো, যে আলি বলেছিল নারী ও রত্ন কদাপি বিশ্বাস করিবে না। জোয়ান অমন ভালো মেয়ে রত্ন দেখে কি তার মাথা ঘুরে যাবে, নিশ্চয় না। কিন্তু জোয়ানের পেটে কথা থাকে না। জোয়ান কখনও ভালো কথা চেপে রাখতে পারে না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে জোয়ান নিজেও না জানতে পারে, সঙ্গে করে কী নিয়ে যাচ্ছে, সেটা ওঁর পক্ষেও নিরাপদ। পাথরগুলো নিয়ে একটা পুটলি বাঁধতে হবে।
রামাতে সবচেয়ে নামী রিজ স্যাবয়ের সামনে বব এসে দাঁড়ালো, অতি আধুনিক হোটেলটি। সেখানকার কেরানী তাকে চেনে। হাসিখুশী মুখে ববকে সে বললো, সুপ্রভাত, দিদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বোধহয়, তিনি তার মেয়েকে নিয়ে চড়ুইভাতি করতে গেছেন। বব মনে মনে বললো, আর সময় পেল না। এখন ফিরতে তার দিদির কঘণ্টা সময় লাগবে, বরং বব তার দিদির ঘরের চাবিটা দিতে বললো। চাবি নিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢোকে বব। বেশ বড় দুটি বিছানা, ঘরময় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। তারপর বব ভাবলো কি করলে ভালো হয়, একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে ভালো হয়, জোয়ানকে কেউ সন্দেহ করবে না, তারপর কারুর হাত দিয়ে ইংল্যান্ডে জোয়ানকে খবর পাঠালেই হবে। বব লিখলে—
জোয়ানদি,
ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে গল খেলতে যেতে রাজি আছ কিনা, দেখলাম তুমি নেই, শুনলাম বাঁধ দেখতে গেছ, তাই কয়েকঘণ্টার জন্য পৃথিবীর বাইরে চলে যাওয়া। কাল আসবে কি বিকেল পাঁচটায়।
ইতি
তোমাদের বব।
এতে ববের দুটো কাজ হবে, চিঠিটায় মনে হবে দেশ ছেড়ে চলে যাবার মতলবই ছিল না ববের। একটু ভেবে ব্রিটিশ দূতাবাসকে ডাকলো, তৃতীয় সচিব জন এডমাণ্ডসনের-ববের পুরানো বন্ধু। এডমাণ্ডুসনের সুরে বড় মেজাজ, শুকনো ভদ্রতা নেই সমর্থন কি মুশকিল, বব তুমি আর তোমার মেয়েরা দুটোর সময়, কেমন, লাইন ছেড়ে দেয়, বব বুঝতে পারল লাইনে কেউ ওদের কথাবার্তা শুনেছিল সেও রিসিভার রেখে দিল। খাঁটি বন্ধু এডমাণ্ডুসন রামাতে সব টেলিফোনেই যন্ত্র লাগানো আছে, তাই বব আর জন এডমাণ্ডুসন মিলে নিজেদের একটা সঙ্কেত বানিয়ে নিয়েছিল। মেয়েটি আশ্চর্য, যেন এই জগতের নয়–এটা বললে বোঝা যাবে ভীষণ জরুরী বরং সাংঘাতিক ব্যাপার। মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে দুটোর সময় জন এডমাণ্ডুসন ববকে গাড়িতে তুলে নেবে। বব তখনই তাকে গোপন কথাটা জানাবে। জোয়ান কিছু জানে না, মাস দেড়েক লাগবে জোয়ানের ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে। তখন নিশ্চয়ই রামাতে বিপ্লব শেষ হয়ে যাবে, হয়তো আলি ইউসুফ তখন ইউরোপে থাকবেন। অথবা ওরা দুজনেই তখন মৃত। আরেকবার বব ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, সেই একই চেহারা, টেবিলে চিঠিটাকে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বব বেরিয়ে এলো।